সেলুলয়েডের সাতকাহন - Mayanagri - City of Dreams

 সিরিজ রিভিউ

 


 মহারাষ্ট্রের ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলের মুখ্য নেতা আমেয়া রাও গায়েকোয়াড়। তাঁর স্বপ্ন কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীত্বপদ, সেই বিষয়ে চেষ্টাও করছেন। এমনসময় হঠাৎই একদিন গুলি চলে তাঁর উপর। ভয়ানকভাবে জখম অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রাণে তো বেঁচে যান, কিন্তু চলে যান কোমায়। তাহলে তাঁর দলের কান্ডারী কে হবে এবার!

 

এগিয়ে আসে তাঁর ছেলে আশীষ। বাবার দলের রাশ সে হাতে নিতে চায়। কিন্তু মদ্যপানে ও ড্রাগে আসক্ত এবং নারীসঙ্গে সর্বদা ব্যস্ত আশীষ যে এই পদে কোনোভাবেই যোগ্য মানুষ নয় তা বারবার প্রমাণ হয়ে যায়। বাবার এতদিনের পরিশ্রমে দাঁড় করানো দল নষ্ট হয়ে যাবে! — এসব ভেবে শক্ত হাতে রাশ ধরে আমেয়ার কন্যা পূর্ণিমা। যতো দিন যায় সে উপলব্ধি করে দলের মুখ্য হওয়ার যোগ্য একমাত্র সে, তার ভাই নয়। গৃহবধূর ভূমিকা ছেড়ে সে অবতীর্ণ হয় রাজনৈতিক ময়দানে।

ইতিমধ্যে এক পুলিশ অফিসার ওয়াসিম খানের তৎপরতায় সামনে চলে আসে যে আমেয়াকে খুন করার পরিকল্পনা কার ছিল। আমেয়ার ছেলে আশীষও জানতে পেরে যায় এবং সেই ব্যক্তির সঙ্গে সে বোঝাপড়া করে নেয় যাতে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর পদ সে পেতে পারে।

হঠাৎই একদিন কোমা থেকে জেগে ওঠেন আমেয়া রাও গায়েকোয়াড়। জানতে পারেন তাঁর ছেলে সবটা জেনেও তাঁর খুনির সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিয়েছে। মনে মনে আঘাত পেলেও দলে তাঁর উত্তরসূরি হিসাবে বেছে নেন ছেলে আশীষকেই। পূর্ণিমা সবদিক থেকে অধিক যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তাকে ব্রাত্য রাখেন। কারণ পূর্ণিমা তাঁর ছেলে নয়, মেয়ে। তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, সে আর গায়েকোয়াড় নেই। আরেকখানি কারণ দর্শান, পূর্ণিমার মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্যের অভাব রয়েছে যার কারণে সে এই পদের জন্য কখনোই যোগ্য হয়ে উঠতে পারবে না।

বাবার এই অন্যায় ও অসম ব্যবহার মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না পূর্ণিমা। সে তার বাবার সামনে প্রমাণ করে দেয়, তিনি যে বৈশিষ্ট্যের অভাবের কথা বলেছিলেন সেটি তার মধ্যেও বিদ্যমান। মেয়ের এহেন রূপ দেখে স্তব্ধ হয়ে যান আমেয়া রাও গায়েকোয়াড়। প্রথম সিজনের পরিসমাপ্তি ঘটে এখানেই।

দ্বিতীয় সিজন শুরু হয় পূর্ণিমার মুখ্যমন্ত্রীত্বের পদে অবতারণা দিয়ে। তার ভাবনাচিন্তা, আদবকায়দা, কথাবার্তা সবকিছুই তার বাবার থেকে আলাদা, একমাত্র আত্মবিশ্বাস এবং চ্যালেঞ্জ নেওয়ার বৈশিষ্ট্যদ্বয় ছাড়া। পিতা-পুত্রীর মধ্যে সংঘাত লাগে। চারিদিকে মেয়ের এমন জয়জয়কার কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না আমেয়া রাও গায়েকোয়াড়। মেয়ের ব্যক্তিগত জীবনের অপ্রিয় কিছু ঘটনাবলী সকলের সামনে তুলে ধরে তাকে হেনস্তা করার প্রতিটি সুযোগ তিনি কাজে লাগান। হাত মেলান বিরোধী দলের সঙ্গে। মেয়েকে পরাজিত করতেই হবে, তাতে অন্যকেউ জিতলেও তিনি রাজি।

সামনে ভোট আর এই ভোটে জয়লাভ করলে পূর্ণিমা পাকাপাকিভাবে মুখ্যমন্ত্রীর পদে আসীন হয়ে যাবে — অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান স্বয়ং তার বাবা আমেয়া রাও গায়েকোয়াড়। সবদিক থেকে মেয়ের পথে বাধা সৃষ্টি করতে থাকেন। প্রাক্তন পুলিশ অফিসার ওয়াসিম খানের সাহায্যে পূর্ণিমা সেসব বাধা পেরিয়েও যেতে থাকে। অবশেষে তার বাবা আশ্রয় নেন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার। এই দাঙ্গার ফলাফল কারুর জন্যই সুখকর হয় না। না পূর্ণিমার জন্য, না আমেয়া রাও গায়েকোয়াড়ের জন্য।

কিন্তু ভোটে কে জয়লাভ করলো তাহলে? কে বসলো মুখ্যমন্ত্রীর পদে? সিরিজটি দেখে নিজেরাই জেনে নিন নাহয়। কথা দিচ্ছি, কারুর কাছ থেকে শোনার তুলনায় নিজে দেখতে অনেক বেশি ভালো লাগবে।

নাগেশ কুকুনুর পরিচালিত পলিটিক্যাল থ্রিলার সিরিজ Mayanagri - City of Dreamsদু'খানি সিজনে সর্বমোট কুড়িটি পর্ব আছে এতে। কাহিনীর ঘনঘটার কারণে চরিত্রের আধিক্যও রয়েছে। কিন্তু কোনো চরিত্রকেই অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত বলা যাবে না।

অভিনয় নিয়ে যে কী বলবো সত্যিই ভেবে পাচ্ছি না। সিরিজটির এতগুলি পর্বে একজনের অভিনয়কেও অতি-অভিনয় বলে মনে হয়নি। সাবলীল সংলাপ এবং সেই অনুযায়ী ভাবপ্রকাশ স্বল্প সময়ের অভিনেতা থেকে শুরু করে দীর্ঘ সময়ের অভিনেতা পর্যন্ত সকলের মধ্যে বিদ্যমান। অধিকাংশকে তো সেভাবে চিনিই না, আগে কখনো দেখিনি। কিন্তু তাঁদের অভিনয় মনে দাগ কেটে যেতে বাধ্য।

তবুও সকলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ লেগেছে পূর্ণিমা গায়েকোয়াড়ের ভূমিকায় প্রিয়া বাপাতের অভিনয়। কী অদ্ভুত সাবলীলতা! সাধারণ গৃহবধূ, স্নেহময়ী মা, যত্নশীল স্ত্রী, বাধ্য মেয়ে, প্রাণচঞ্চল প্রেমিকা এবং সর্বশেষে একজন দায়িত্বজ্ঞান যুক্ত ও সংবেদনশীল রাজনৈতিক মুখ — প্রত্যেকটি চরিত্রের অভিব্যক্তি তিনি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এছাড়াও তাঁর পিতা আমেয়া রাও গায়েকোয়াড়ের ভূমিকায় অতুল কুলকার্নি, পুলিশ অফিসার ওয়াসিম খানের ভূমিকায় এজাজ খান, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগদীশ গুরাভের ভূমিকায় শচীন পিলগাঁওকার প্রত্যেকে অতুলনীয়।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিরিজটির পরতে পরতে রয়েছে চমক। একই ঘটনা জোর করে টেনে বাড়িয়ে কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি। তবে সিরিজটি দেখাকালীন উপলব্ধি করলাম যা অপ্রিয় হলেও কিছু ক্ষেত্রে সত্য — একটি মেয়ে তার বাবা, ভাই, দাদা, স্বামী, পুত্র সকলকে জীবনের এগিয়ে যাওয়ার পথে নিজের সমর্থন দেয়, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগায়। কিন্তু মেয়েটির ক্ষেত্রে এদের কাউকে আর পাশে পাওয়া যায় না। সকলে যে যার নিজের স্বার্থ দেখে। আর ঠিক এটাই ঘটেছে পূর্ণিমার সঙ্গে। সে যখন নিজের পরিশ্রমে নিজের একটা পরিচয় বানাতে চেয়েছে তার পাশে কেউ থাকেনি — না তার বাবা, ভাই, স্বামী, ছেলে। নিজের লড়াইটা সে একাই লড়ে গেছে, বরং তাকে সাহায্যে করতে এগিয়ে এসেছে অচেনা কিছু মানুষ।

এই লড়াইটা পূর্ণিমার একার নয়। আমাদের সমাজে লক্ষ লক্ষ মেয়ে নিজের লড়াই লড়ছে। তাদের জন্য রইলো একরাশ শুভেচ্ছা। সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে জয়ের মুখ দেখুক তারা, এই আশাই রাখি।


কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন