অন্য উদযাপন - অহনা বসু

 


জানলার কাঠের ফাঁক দিয়ে সূর্যের এক চিলতে রোদ ঘরে ঢুকে সোজা শিউলির মুখের ওপর পড়ছিল। ঘুমের ঘোরে শিউলি এদিক ওদিক করে রোদকে তাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে একটা কাঁচা খিস্তি দিয়ে হাত বাড়িয়ে মাটিতে পড়ে থাকাটা শাড়ীটা কোনও মতে টেনে নিয়ে মুখের ওপর চাপা দিয়ে রোদকে আটকায় - আরেকটু ঘুমের জন্য।চিৎকার করে বলা খিস্তিটা দরজার বাইরে বসা পদ্মমাসির কানে পৌঁছাতে মাসি ঠোঁট বেঁকিয়ে হাঁক দিয়ে বলে উঠল - “ আর কত ঘুমাবি লা? গতর তোল এবার। রোদ তো মাথার ওপর উঠে গেল।ঘরদোর পরিষ্কার করতে হবে তো নাকি? লোক আসার সময় হয়ে এল গে যেন।“ বলার সাথে সাথে দরজার হাতলে দু’চারটে ঠক ঠক করে বাড়ি মেরে আওয়াজ করতে থাকল।

“দাঁড়াও মাসি, ও পটের বিবির ঘুমের খেয়ারি কাটতে এখনও দেরী আছে। তোমার লবাবের বেটি  উনি। সবার পরে উঠবেন আর ওনার কাজগুলোই আগেভাগে সবাইকে করে দিতে হবে।“ - পাশের দরজার চৌকাঠে ধেবড়ে বসে মাথার চুলের জট ছাড়াতে ব্যস্ত জবা টিপ্পুনি কেটে ওঠে।

“তা কি করবি বল। তোদের কপাল। লোক যদি ওকে বেশী চায়, ওকে বেশী দর দেয়, তো ওকে একটু লবাবি করতে দিতে হয় বৈকি। ও নিয়ে তোদের হিংসা করা মানায় না বাপু। যে যার কপালে খায়। তোদের দর কম সেটা তো ওর দোষ নয়।“ – মাসি মুচকি হেসে বলে।

“ তা কি করব বল? গায়ের রং তো আর অ্যাসিড ঢেলে সাদা করে দিতে পারব না।শালা লোকেদের হাঘরেপনা দেখলে মনে হয় ওর ফর্সা গায়ে গা ঘষলে যেন নিজেরাও সব সাহেব হয়ে যাবে।যত্তসব।“ক্ষেপে উঠে জবা একদলা থুতু থুঃ করে বারান্দায় ছিটিয়ে দিয়ে উঠে যায়।

কলকাতা শহরের কুখ্যাত অঞ্চলের তস্য গলির এক প্রান্তে দোতলা জীর্ণ বাড়ির বাড়িউলি মাসি পদ্মর ভরভরন্ত সংসার।স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার নয়। আটটি কন্যা,দু’টি কাজের লোক ও একটি দারোয়ান নিয়ে সংসার। দোতলা বাড়িটা যে কিকরে পদ্ম মাসির হল তা সে নিজেও ঠিক করে বলে উঠতে পারেনা। বাড়ির অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। কয়েক দশক রং হয়নি। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। ছাদের কিছু কিছু জায়গার কার্নিশ ভেঙ্গেও গেছে। এদিকে ওদিকে উঁকি দিলে বেশ কয়েকটা বট অশ্বত্থ গাছের দেখা পাওয়া যাবে।বাড়ি মেরামতির সামর্থ্য কারো নেই। সন্ধ্যা হলেই ইঁদুর, ছুঁচোর কীর্তন শুরু হয়। দিনের বেলা মুখের সামনে দিয়ে বেজি ঘুরে বেড়ায়। কেউ কাউকে বিরক্ত করেনা। বাড়ির বাসিন্দারাও ওদের তাড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেনা। দোতলা বাড়ির ওপর নীচ মিলিয়ে সাতটা ঘর। আগে পাঁচটা ছিল। বড় ঘর গুলোর মাঝ বরাবর কাঠের দেওয়াল তুলে দুটো করে নেওয়ার ফলে সাতখানা হয়ে গেছে। নীচে ওপর মিলিয়ে তিনটে স্নানঘর। একতলার এক কোণে রান্নাঘর। রাঁধুনি বলে আলাদা করে কেউ নেই। সবাই মিলে যেমন তেমন করে রোজকার দুপুরের রান্নাটা করে ফেলে।রাতের খাবার বেশিরভাগই মেয়েদের খদ্দেরদের ঘাড় ভেঙ্গে হয়ে যায়। এই বাড়ির ঘুম ভাঙ্গে দুপুর গড়িয়ে বিকালের দিক হয় যখন তখন।এই পাড়ার সব বাড়িরই এক গল্প। রাতের বেলায় আসর জমজমাট হয়।যখন স্বাভাবিক জীবন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন এই বাড়ি জেগে ওঠে। বাড়ির মেয়েরা নিজেদের যথাসম্ভব সাজিয়ে গুছিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, খদ্দেরকে আমন্ত্রন জানানোর জন্য। যে কোন লালাবাতি পাড়ার যা চিত্র, এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। প্রতিটা বাড়িতেই মেয়েরা দেহকে পসরা বানিয়ে বিক্রি করে।

পদ্মমাসির সংসার বছরের পর বছর এইভাবেই চলছে। কবে থেকে কত বছর তা হিসাব কেউ সঠিক জানে না। মেয়েরা আসে, আবার চলেও যায়। আবার নতুন মেয়ে আসে। তবে মাসির একটা বড় গুণ হল জোর করে কাউকে দিয়ে কাজ করায় না। বাচ্চা মেয়ে দিয়ে কারবার নেই। টাকা পয়সা নিয়ে ঝামেলা নেই। প্রতি গ্রাহক পিছু টাকা তার হাতে দিয়ে দিলেই হল। বরং রোগ,বালাই,বিপদে,আপদে মাসির থেকে আপনজন আর কেউ হয়না। যত্ন করে সেবা করে।মাসির কথাও তাই সবাই শুনে চলে। অন্য আর পাঁচটা বাড়ির মত তাই এখানে চিৎকার চেঁচামেচি ঝগড়াঝাটি প্রায় হয় না বললেই চলে। কয়েকজন ফড়ে আছে। যাদের মাধ্যমেও খদ্দের আসে এখানে। দিন আসে দিন যায়।ঋতু বদল হয়, জীবন বদল হয়না।

এক একজন মেয়ের এক এক গল্প।বাপ-মা মরা পদ্মমাসির কাকা বারো বছরের মাসিকে এখানে এনে বেচে দিয়ে গেছিল। এখন যে মাসির কত বয়েস মাসি নিজেও ভুলে গেছে। এই রকমই কাউকে কাজের লোভ দেখিয়ে বিক্রি করা হয়েছে, কেউ ভালোবেসে ফাঁদে পড়েছে। কেউ পেটের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে নিজে থেকেই এসে জুটেছে।

শিউলিও এইভাবেই কপালের দোষে এসে গেছিল এখানে। কলকাতা থেকে কয়েক মাইল দূরে গ্রামের ভাগ চাষির ঘরের মেয়ে শিউলির গায়ের রং কিকরে যে এত ফর্সা হল আর কিকরে যে চোখের তারা বাদামী হয়ে তাকে গ্রামের অন্যদের থেকে পৃথক করে দিল তা সবার কাছেই রহস্য। কিন্তু আমাদের দেশে গাঁয়ে এই সব রহস্য জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।চোখে পড়ার মত সৌন্দর্যই কাল হল শিউলির। একরাতে ঘরের দাওয়া থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কয়েকজন অমানুষ নিজেদের খিদে মিটিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল। ভোরবেলা আলুর ক্ষেতের মধ্যে তেরো বছরের শিউলিকে পাওয়া গেল সম্পূর্ণ সুতোহীন অবস্থায়।মরে যাওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু গরীবের ঘরের মেয়েরা সহজে মরে না বলেই হয়ত বেঁচে গেল।আইন আদালত করার ক্ষমতা কারো ছিলনা। ইচ্ছাও ছিলনা হয়ত। করেই বা কি হত। কিছু কি ফিরে আসত? কিন্তু এইভাবে সবার সামনে নগ্ন হয়ে বেঁচে থাকা যখন মরে যাওয়ার থেকেও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, উঠতে বসতে কথার জ্বালা প্রাণ অতিষ্ঠ করে তোলে, তখন যে কোনোভাবে মুক্তির পথ খোঁজে প্রাণ।সেই খোঁজে বেড়িয়ে তাই যেদিন বাবুদের বাড়ির ছেলেটা শহরে কাজ পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখালো তখন শিউলি আর দু’বার না ভেবেই রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছাড়ল। আর সারাজীবনের মত অন্ধকারকে সঙ্গী করে নিল। তারপর দু’বছর দেশের কি কি সব নাম না জানা শহরে ঘুরে শেষে এই হাড়কাটা গলিতে এসে থিতু হল। তাও নয় নয় করে দশ বছর হয়ে গেল।

ঘুম ভেঙ্গে উঠে শিউলি দরজা খুলে বেড়িয়ে আসে – “উফফফ! সেই সকাল থেকে মাইকে কিসের এত চিৎকার চলছে শুনি। একটু ঘুমাবার জো নেই মাইরি।“

মাসি শিউলির দিকে একবার তাকিয়ে বলে – “ ওই যে কাল কি যেন একটা আচে না? মহিলা দিবস না কি যেন। তাই কারা সব আসবে কাল ভাষণ টাষন দিতে।স্টেজ বানাচ্চে বিশেরা।মহিলা দিবসের উদযাপন।“ 

“ মহিলা দিবস?অ অ । বলিহারি নাটক শালা। রাতে মহিলা পেটাবে, আর সকালে দিবস করে উদ্ধার করবে। যাক গে । মরুকগে। আমাদের কি।আমরা তো আবার মহিলা নই, “মেয়েছেলে”।  ও মাসি বেশি করে লেবু দিয়ে চা দিতে বলো তো। আজ মাথাটা নাহলে ছাড়বে না। কাল শালা খুব কড়া মাল খাইয়েছে লোকটা।“

পদ্মমাসি মুখ তুলে একবার তাকিয়ে বলল – “ তুই ই বা অত হাঘরের মত গিলিস কেন? আজ বাজারে যাওয়ার আছে সেটা মনে আচে? কি কি সব কিনবি বললি যে?”

শিউলি বাসীমুখেই একটা সিগারেট ধরিয়ে, বারান্দার ওপর ধপ করে বসে পড়ে – “ এই যাহ! ভুলেই গেছিলাম গো। দাঁড়াও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচ্চি।নাহলে আজ আবার বিকালেই শঙ্করবাবুর আসার কথা। “ বলেই সিগারেটে জোর টান দিতে দিতে চেঁচিয়ে নিচের রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে চা দিতে বলে।  

“ওমা শঙ্করবাবু এই দিনে দুপুরে আসবে কিরে? বলি ওনার থানার কাজকর্ম কি শিকেয় উঠেচে নাকি?” পদ্ম গালে হাত দিয়ে অবাক হয়।

“ বুঝলে মাসি খিদে এমন জিনিস, পেলে দিনরাতের বোধ থাকে না।তা সে পেটেরই হোক আর শরীলেরই হোক না কেন।“ এক চোখ বন্ধ করে ইঙ্গিত করে শিউলি হেসে ওঠে।

শঙ্করবাবু স্থানীয় থানার কনস্টেবল। মাসের এক দু’বার থানার তরফ থেকে হপ্তা নিতে এসে নিজেও একটু আয়েশ করে যান। শিউলি ছাড়া অবশ্য অন্য কারোকে ওনার পছন্দ নয়। বদলে এদের যে কোনো ঝুট-ঝামেলা সামলান।

বাজারে গিয়ে কেনাকাটি করতে গিয়ে বেশ দেরী হয়ে গেল। ফিরতি পথে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য শিউলি গলিপথ ধরল। বেশ দ্রুত পা চালাচ্ছিল, শঙ্করবাবুর আসার আগে পৌঁছাতে হবে। না হলে বেকার ঝামেলা। এখানকার বাড়িগুলোর মধ্যে দিয়ে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে।ফাঁকা রাস্তা। তাই তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। দুটো বাড়ির মাঝে সরু সরু গলি। একটা গলি দিয়ে বেরোতে গিয়ে হঠাৎ যেন একটা কান্নার আওয়াজ পেল শিউলি। থমকে দাঁড়িয়ে গেল। এদিক ওদিক তাকিয়েও কাউকে দেখতে না পেয়ে এগোতে যাবে, আবার ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ। এবার বেশ স্পষ্ট।শিউলি একবার ‘দূর ছাই!’ বলে চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল। কেন কি জানি মনে হল কিছু একটা খারাপ হয়েছে। কিন্তু এদিক ওদিক তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেল না।প্রায় গায়ে গায়ে লেগে থাকা বাড়িগুলোর মাঝের রাস্তাগুলোতে সূর্যের রোদ পৌঁছায় না। স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাওলা ধরা দেওয়াল গুলো গলিগুলোকে অপরাধের আস্তানা বানিয়ে দেয়।শিউলি জানে এসব ব্যাপার।

চারপাশ তাকিয়েও কাউকে না দেখতে পেয়ে শিউলি একটু খুক খুক করে গলায় আওয়াজ করল। চাপা গলায় বলল – “ কেউ আছে নাকি?” কান্নার আওয়াজ থেমে গেল। শিউলি আবার বলল –“ ভয় নেই, কিছু দরকার হলে বেড়িয়ে এসো।“ কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্দতা।

“চললাম তবে” – বলে শিউলি হনহন করে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। বাড়ি গিয়েও দেখে সেখানেও ঝামেলা। মাসি পান চিবুতে চিবুতে খবর দিল – “তোর  শঙ্করবাবু আজ আসবে না রে। খপর পাঠিয়েচে।গলির মোড়ের রত্নাদের বাড়ি থেকে নাকি মেয়ে পালিয়েচে। পালানোর আগে দারোয়ান নাকি ধরতে গেচিল বলে তার হাতে বঁটির কোপ মেরে দিয়েচে। নতুন মেয়ে আনার এই এক ঝামেলা। আর রত্নারও বেশী লোভ। কোথা কোথা থেকে মেয়ে উঠিয়ে আনে। কত বারণ করেচি জোর করে ব্যাওসা করলে এইসব ঝামেলা হবেই। তা শুনলে তো। মাঝখান থেকে তোর সময়টা নষ্ট হল।“

শিউলি শুনে কিছু না বলে ঘরে ঢুকে গেল। মাথায় অন্য চিন্তা। এখুনি তো সে রত্নামাসির বাড়ির পাশ দিয়েই এল। কান্নার আওয়াজটাও তো ও বাড়ির পেছন থেকেই আসছিল। একটা কিরকম অস্বস্তি শিউলিকে ঘিরে ধরল। না জানি কোন বাড়ির মেয়ে। কাকে জোর করে তুলে এনেছে। সেই মেয়েটাই নয়ত !!

এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। মুখে মুখে খবর পাচ্ছে রত্নার পোষা গুন্ডাগুলো পাগলের মত খুঁজছে মেয়েটাকে। বার কয়েক এবাড়িতেও ঢুঁ মেরে গেছে। বেশ রাত হয়ে গেল। শিউলির ঘর থেকে এক খদ্দের বেড়িয়ে যেতেই শিউলির হঠাৎ মন বানিয়ে ফেলল। “মাসি আমি একটু আসছি গো” – বলেই মাথায় একটা চাদর ঢেকে বেড়িয়ে পড়ল রত্নাদের বাড়ির পেছনের গলিটার দিকে। ওর মন বলছে ওখানে মেয়েটা আছে। ওকে এরা পেলে কেটে ফেলতে একটুও ভাববে না, সেটা শিউলি জানে।

গলির মুখে এসে শিউলি নিস্তব্দে চারপাশ দেখে নিয়ে এগোতে লাগল। মাঝামাঝি সেই জায়গাটাতে পৌঁছে দাঁড়ালো একটু। মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করতে লাগল যদি সত্যিই কেউ থাকে। ক্ষীণ গলার কান্না শোনা যাচ্ছে যেন। কিন্তু অন্ধকারে কোথা থেকে আসছে আওয়াজটা সেটা বোঝা মুশকিল। “ দেখ আমি আবার এসেছি। কেউ কি আছো এখানে? বেড়িয়ে এস। ভয় নেই। এরপর আমি চলে গেলে আর বেউ বাঁচাতে আসবে না।এখানে অনেক সাপখোপ আছে। ভয় নেই। কে আগে দেখি তো।“ চাপা গলায় শিউলি বলে চুপ করে দাঁড়ালো একটুক্ষণ। আওয়াজ নেই কোনো।

অগত্যা আর উপায় না পেয়ে শিউলি পা বাড়িয়েছে ফিরে যাওয়ার জন্য, মনে হল কেউ পেছনে এসে দাঁড়ালো। শিউলি ঝট করে পেছন ঘুরল। পেছনের মানুষটাকে দেখে চমকে উঠে হাঁ হয়ে গেল শিউলি। একটা বারো-তেরো বছরের বাচ্চা মেয়ে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।

শিউলি আর কোনো কথা না বলে নিজের চাদরটা দিয়ে ভালো করে মেয়েটাকে মুড়ে দিয়ে অন্ধকার রাস্তা ধরে নিজেদের বাড়ির সামনের রাস্তা ছেড়ে পিছনের দিকের ঢোকার দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল।

এবার ভালো করে দেখল মেয়েটাকে। যেন সেই দশ বছর আগের নিজেকে দেখতে পেল। এতটুকু শিশুকেও এরা রেহাই দেবে না? চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল শিউলির।

মাসি ওদিকে বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে হাঁকডাক শুরু করেছে। খদ্দের এসেছে নাকি। শিউলি দরজা অল্প ফাঁক করে বলল – “ আজ আর পারব না মাসি। অসুবিধা আছে একটু। বলে দাও অন্য ঘরে বসুক। তুমি একটু গরম দুধ আর কিছু খাবার পাঠিয়ে দাও চট করে। আর সবাই দোর দিলে একবার ঘরে এসো।“

শিউলির এই জোরটা আছে। নিজের ইচ্ছা মত খদ্দের নিতে পারে। মাসি কিছু না বলে চলে গেল। শিউলি মেয়েটাকে অবাক হয়ে দেখছে। মেয়েটাও। ভয় ভাঙ্গানো দরকার। শিউলি কথা বলতে চাইল – “ কি নাম রে তোর? কোথা থেকে এসেছিস? এলি কি করে?”

কিন্তু উত্তর নেই। কাঁপছে মেয়েটা।কাঁপতে কাঁপতে মেয়েটা কোনোমতে উত্তর দেয় – “ অনিন্দিতা রায়”। বলেই শিউলির পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে – “ আমি বাড়ি যাব দিদি, বাড়ি দিয়ে এস। ওরা জোর করে নিয়ে এসেছে। ওদের ডেকো না। বাড়ি যাব, মায়ের কাছে।“ শিউলির পায়ে মুখ গুঁজে দেয়।

শিউলি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। “ অনিন্দিতা রায়”? এত আজে বাজে পাড়ার মেয়ে নয়, কথা শুনে ভদ্রবাড়ির মেয়ে মনে হচ্ছে। নিচু হয়ে টেনে দাঁড় করায় মেয়েটাকে। “অ্যাই কান্না থামা।ঠিক ঠিক বল। কারা ধরবে তোকে? কারা নিয়ে এসেছে? বাড়ি কোথায়? তোর বয়েস কত?”

“বাড়ি দুর্গাপুরে দিদি।ক্লাস এইটে পড়ি। রাতে টিউশনি করে বাড়ি ফিরছিলাম, হঠাৎ কারা যেন মুখ চেপে ধরে গাড়িতে তুলে নিল। তারপর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে দেখি একটা ঘরে শুয়ে আছি।ক’দিন ধরে ওখানের সবার কথা শুনছিলাম। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।বাড়ি যাব বললেই মারছিল। তারপর বুঝলাম আমায় কেউ বিক্রি করে দিয়ে গেছে।এরাও আমাকে বিক্রি করে দেবে।“ – হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কোনোমতে বলে থামল অনিন্দিতা।

শিউলি বুঝল কি বিপদ সে বাড়ি বয়ে এনেছে। নীল দরজার বাড়ি। মানে পাড়ার নামকরা নেতার ডানহাত মানিকদার বাড়ি। ও বাড়ি থেকে বেরোতে গেলে সোজা শ্মশানে যেতে হয়। কিন্তু এই মেয়ে পালাল কিকরে?

“তুই ওই বাড়ি থেকে পালালি কি করে?“

“একটা মেয়ে খেতে দিতে এসে দরজা খুলে রেখে ছাদের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিল। ওখানে থেকে কার্নিশ বেয়ে পেছনের রাস্তা দিয়ে পালিয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তা জানিনা তাই …..।“

কথার মাঝেই পদ্মমাসি ঘরে আসে। সব শুনেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। “ শিউলি তুই এই আপদ বিদেয় কর এখুনি। ও তো মরবেই। মানিকদা আমাদেরও মেরে ফেলবে।“

অনিন্দিতা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। হাতজোড় করে বিড়বিড় করতে লাগল – “ বাড়ি যাব। দয়া কর। মায়ের কাছে যাব।“

শিউলি বিপদ বোঝে না তা নয়। “কিন্তু মেয়েটা বাচ্চা মাসি। মাত্র বারো-তেরো বছর বয়েস। না মাসি এই বয়েসের আর কাউকে এখানে পচতে দেওয়া যাবে না।“ 

মাসি অনিন্দিতার কান্নার আওয়াজে এবার বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে ওঠে। “আঃ চুপ কর।“ শিউলিকে বলে – “ দেওয়া যাবেনা বললেই হল। করবি টা কি শুনি? একি আমার বাড়ি যে ছেড়ে দেব? এই পাড়া থেকে বের হবি কি করে? পুলিশকে জানালেও তো মানিক জানবে।“

ঠিকই তো। নাহলে শঙ্করবাবুকে বলে ব্যবস্থা নেওয়া যেত।কিন্তু ও লোকও তো মানিকের পোষা। ভাবনায় বাধা পড়ল নিচে থেকে চিৎকারের আওয়াজে। মাসি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। “এতো মানিকদার চ্যালা বিশের আওয়াজ শিউলি।“ একটু থেমে বলে – “ তুই ঘরে দরজা বন্ধ করে থাক। আমি দেখচি।“

ঘর থেকে শিউলি শুনতে পায়। শাসানির আওয়াজ। “ এই যে পদ্মবিবি।মানিকদার একটা মেয়ে পালিয়েছে।এখানে এসেছে নাকি?পাড়ার বাইরে জায়নি।তাই সব বাড়ি ঘুরছি। এলে বের করে দাও।“

মাসি গলা শোনা যায় – “ আ মোলো যা। একেনে আসবে কে্ন? আর এলে আমিই বা রাখব কেন? না রে বাপু কেউ আসে নি।“

বিশের খ্যাঁক খ্যাঁক হাসি শোনা যায় –“ না এলেই ভালো।রাতে যদি কোথাও না পাই তবে, কাল সকালে সব বাড়ির ঘর সার্চ করতে আসব।তখন ঠিক পাবোই।“

ঘরের মধ্যে শিউলির বুকের আওয়াজ যেন দরজার বাইরে বেড়িয়ে যেতে চায়। ভয়ে ঘেমে ওঠে। মেয়েটা ঘরের এক কোণে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। দেখে শিউলির নিজের তেরো বছর বয়েসের সেই ভয়ঙ্কর রাতের কথা মনে পড়ে যায়। দাঁতে দাঁত পিষে মনে মনে বলে –“ না এবার আর হারব না। শেষ দেখে ছাড়ব।“

মাসি ফিরে আসে ঘরে, “শুনলি তো কথা। এবার কি করবি? আজ রাতেই যা করার করতে হবে।“   

সময় কেটে যায়। বসে বসেই ঢুলুনি এসে যায় তিনজনের। শিউলি হঠাৎ যেন জেগে ওঠে। বলে, “মাসি আমি যাব ওকে ছাড়তে। ওর বাড়িতে। আরেকটু পড়ে ভোররাতে পেছনের গলি দিয়ে আমি ওকে নিয়ে চলে যাব।দেখি কত টাকা আছে।“

মাসি তাড়াতাড়ি উঠে নিজের ঘরে যায়। একটু পড়ে ফিরে আসে।“ চল আর দেরী করিস না। আমি তোদের পাড়ার বাইরে বের করে দিয়ে চলে আসব।তুই সব রাস্তা চিনবি না।“ 

শিউলি এবার অনিন্দিতার দিকে তাকালো –“ তোর বাড়ির ঠিকানা জানিস তো? নিয়ে যেতে পারবি তো?”

অনিন্দিতা মাথা হেলিয়ে জবাব দিল পারবে।

শিউলি ট্রাঙ্ক খুলে দুটো বোরখা বার করল। ওদের কাছে থাকে এগুলো। কখনও কখনও দরকার পড়ে। যেমন আজ। দুজনে বোরখা পড়ে নিল। 

নিকশ কালো অন্ধকারে তিনটি নারীমূর্তি অন্ধকারকে আষ্টেপিষ্টে শরীরে জড়িয়ে নিঃশব্দে রওনা হল।মাসি অন্ধকারেও অনায়াসে রাস্তা চিনে নিয়ে যেতে লাগল। গলিগুঁজি দিয়ে এঁকেবেঁকে কতক্ষন যে হেঁটেছে কেউ জানেনা। শিউলি চাপা গলায় জিজ্ঞাসা না করেই পারল না – “মাসি কতদুর যাব আর? হাওড়া যাব তো নাকি?”

মাসি ফিসফিস করে – “ আরেকটু যেতে হবে। চুপচাপ চল।“

আরও খানিকক্ষণ গিয়ে মাসি একটা দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সির কাছে দাঁড়ালো। শিউলি দেখল ভিতরে একটা লোক ঘুমাচ্ছে। মাসি আওয়াজ করে লোকটাকে তুলল। লোকটা দরজা খুলে বেড়িয়ে এসে মাসিদের দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল – “ দিদি এত রাতে কি ব্যাপার?” মাসি তাড়াতাড়ি সব কথা বুঝিয়ে দিল। “ এদের দুর্গাপুর পৌঁছে দিতে হবে। এখুনি নিয়ে যা। আর একথা পাঁচকান করা যাবে না। “

শিউলির দিকে ফিরে অল্প হেসে বলল – “ভয় নেই। আমার ভাই হয়। যা উঠে বসে পড়। ও নিয়ে যাবে। মেয়েটাকে বাড়ি পৌঁচেই তুই এই গাড়িতে করেই ফিরে আসবি। কিন্তু আধা রাস্তায় নেমে বাস ধরে ফিরবি।“ শিউলির হাত ধরে হাতে বেশ কিছু টাকা গুঁজে দেয় - “নিয়ে যা। দরকার পড়বে।সোজা চলে যাস। কোথাও থামবি না।“

শিউলি অনিন্দিতাকে নিয়ে রওনা হয়ে যায়। মাসি বাড়ির দিকে পা চালায়। ভোরের আলো ফুটেছে তখন। বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছাবে দেখতে পায় বিশে আসছে।বুক কাঁপতে থাকে।দেখে ফেলল হারামজাদাটা? মাসি দাঁড়িয়ে পড়ে। বিশে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে – “ কি পদ্মবিবি এত ভোরে কোথায় চললে?”

পদ্মমাসি বোঝে বিশে তার ঘরে ফিরে আসার ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। ভেবেছে পদ্মমাসি এখন ঘর থেকে বেরোচ্ছে।

মাসি হাঁই তোলার ভঙ্গী করে, একটু আড়মোড়া ভেঙ্গে বলে – “ এই চল্লুম একটু গঙ্গা স্নানে। ভাবলাম তোদের সাথে সাথে আমিও একটু উদযাপন করে নিই নাহয়। ওই যে তোরা করচিস না? মহিলা দিবস? আমি আমার মত করে উদযাপন করব আজ। তাই গঙ্গাস্নান করে দিনটা শুরু করি। আজ আমার বাড়ির সব মেয়েদের ছুটি।আজ দরজা বন্ধ থাকবে। ওরাও তো মহিলা নাকি বল? ‘মেয়েছেলে’ বলে কি মহিলা নয়? উদযাপন করার অধিকার তো ওদেরও আচে নাকি?”

বিশের হতবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মাসি গঙ্গার দিকে হাঁটা দেয়। আজ অনেক বছর পর বুকটা হালকা হয়ে যায়। একটা ভালো কাজ যে এত আনন্দ দিতে পারে তা এত বছর জানা ছিল না। সত্যিই আজ মহিলা দিবসের উদযাপন করল পদ্মমাসি।  

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন