গোটা বাড়ি লোকে লোকারণ্য, তার সাথেই নাকিকান্না। অসহ্য লাগে সুমিতের। কিন্তু কিছু বলাও যাবে না। বলা তো দূরের কথা, মুখখানা এমন বিষণ্ণ করে রাখতে হবে যাতে প্রতিটা লোক তার জন্য সহানুভূতি পোষণ করে। বিয়ের পর তো খুব বেশিদিন হয়ও নি, তার মধ্যেই এমন ধাক্কা। কোন স্বামীই বা মন থেকে মেনে নিতে পারে!
আদৃতার বাবা মা আর বোনটা একঘেয়ে রেকর্ডের মতো সেই থেকে কান্নাকাটি করেই চলেছে। মনে মনে যারপরনাই বিরক্ত হয় সুমিত। এদের নাকিকান্নায় মাথাটা বেজায় ধরে গেছে, একটু চা পেলে ভালো হতো। এদিকে সকলের সামনে এখন চা খেতে বসলে আবার লোকজন ট্যারা নজরে তাকাবে। এককাপ চায়ের জন্য লোকের মনে সন্দেহ জাগানোর দরকার নেই। এসব ভেবে বাড়ির পাশের চায়ের দোকানটার দিকে পা বাড়ালো সে। চা খেতে খেতে পুরোনো কথা ভাবতে থাকে, নিজের উপরেই বিরক্ত হয়। সত্যি, একটা কাজও সে ঠিক করে করতে পারে না!
আদৃতাকে তার বরাবরই অপছন্দ। একটু মোটাসোটা, গোলগাল। দেখতে শুনতেও তেমন স্মার্ট নয়। বিশেষ করে রুক্মিণীর ধারেকাছে আসতে পারবে না সে। সুমিত আর রুক্মিণীর সম্পর্কটা বহুদিনের, সেই কলেজ লাইফ থেকে। তবে সম্পর্ক বলতে সেই অর্থে প্রেমিকযুগল ছিল না তারা, একটা ওপেন রিলেশনশিপ ছিল। দু'জনেরই মত ছিল তাতে। বন্ধুবান্ধব, হইহুল্লোড়, এদিক সেদিক ট্যুর এভাবেই জীবনটাকে উপভোগ করতে করতে আনন্দে খুশিতে ভেসে যাচ্ছিল তারা।
এরই মধ্যে হঠাৎ বাদ সাধে সুমিতের বাবার একটা সিদ্ধান্ত। সুমিতের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন তিনি, বন্ধুকন্যা আদৃতার সঙ্গে। বিয়ের জন্য সুমিত তো এমনিতেই রাজি ছিল না। তার উপর বাবার নিমন্ত্রণে আদৃতারা তাদের বাড়িতে এলে হবু স্ত্রীকে দেখার পর একেবারেই ভালো লাগেনি সুমিতের। বাবাকে সে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় সে আদৃতাকে বিয়ে করতে চায় না। আদৃতা কেন, এখন বিয়ে করারই কোনো ইচ্ছা বা পরিকল্পনা তার নেই। সুমিতের কথা শুনে তার বাবা গম্ভীরমুখে জানিয়ে দেন এই বিয়ে না হলে সুমিত তাঁর বিজনেসের অংশ পাবে না। নিজের ছোট ছেলের সঙ্গে বন্ধুর মেয়ের বিয়ে দেবেন বলে আগে থাকতেই কথা দিয়ে রেখেছিলেন তিনি। মনে মনে ভাবেন, সময়ের সাথে সাথে আদৃতার গুণগুলো সুমিতকে ঠিকই আপন করে নেবে। কিন্তু সবক্ষেত্রে যা ভাবা হয় সেটা ঘটে না।
মহা আড়ম্বরের সঙ্গে সুমিত আর আদৃতার বিয়ে হয়ে যায়, বলা ভালো বিয়ে করতে বাধ্য হয় সুমিত। আর বিয়ের পর থেকে তারই খেসারত দিতে হয় আদৃতাকে। ছোটো ছোটো ব্যাপারে তার দোষত্রুটি খুঁজে বের করা, শারীরিক গঠন নিয়ে তাকে হেয় করা, কারণে অকারণে অপমান আদৃতার নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে ওঠে। প্রথম প্রথম আদৃতা কিছু বলে না, সবকিছু সহ্য করতে থাকে। মনে একটা ক্ষীণ আশা রাখে, দেরি হলেও সুমিত তাকে ঠিক ভালোবাসবে। সে তো হয়ই না, বরং দিনে দিনে অসম্মানের মাত্রা আরো বাড়তে থাকে।
যদিও আদৃতা অনেক চেষ্টা করেছিল সুমিতের মন জয় করার, কিন্তু সুমিতের তাকে দু'চক্ষে সহ্য হতো না। তার কথা বলার ধরণ, আদবকায়দা সবই সুমিতের বেমানান লাগতো নিজের সঙ্গে। মাঝেমধ্যেই তর্কাতর্কি লেগে যেতো। অবশেষে আদৃতা সুমিতের কাছ থেকে ডিভোর্স চায়।
ঘাবড়ে যায় সুমিত। বিয়ের এতো তাড়াতাড়ির মধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেলে বাবা তো আবার সবটা বুঝে যাবে যে সুমিত ইচ্ছা করেই ঝামেলা বাঁধিয়েছে যার কারণে এই ডিভোর্স।
"আমি তোমাকে ডিভোর্স দেবো না।" সুমিত জানিয়ে দেয়।
আদৃতা অবাক হয়, "ডিভোর্স দেবে না কেন? আমায় নিয়ে যে তুমি সুখী নও সেটা তো প্রতি মুহূর্তে আমাকে বুঝিয়ে চলেছো। তাহলে আপত্তি কীসের?"
"সে কথা তোমাকে জানাতে আমি বাধ্য নই।"
"একশ'বার বাধ্য!" বলে আদৃতা। "তুমি আমাকে সবসময় যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করো, সেই অধিকার তোমার নেই। তাও যখন করছো তাহলে তোমার সঙ্গে আমি আর থাকতে চাই না। ডিভোর্স তোমাকে দিতেই হবে।"
তারপর সুমিতের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, "তুমি কি এই বাসনা রাখো যে গাছেরও খাবে তলারও কুড়োবে?"
"মানে?" জিজ্ঞাসা করে সুমিত।
"তোমার আর রুক্মিণীর ব্যাপারে আমি জানি। তুমি যখন ওর সাথে ফোন কথা বলো, অনেককিছুই আমার কানে এসেছে। তোমাকে পাঠানো ওর ম্যাসেজও আমি দেখেছি। সেসবের স্ক্রিনশট তুলে তোমার ফোন থেকে আমার ফোনে পাঠিয়ে সেভ করে রেখেছি। তুমি যদি মনে করো আমাকে এখানে আটকে রেখে এভাবে কষ্ট দিয়ে মজা পাবে সে আমি হতে দেবো না। সংসার যখন করতে পারলে না, ডিভোর্স তোমাকে দিতেই হবে।"
সুমিত রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যায়, "তোমার এত বড় সাহস আমার ফোনে হাত দাও!"
"সাহস আমার অনেককিছুতেই আছে। তোমার বাবা মা দাদা বৌদি তো বিয়েবাড়িতে গেছে, তুমি আমার সাথে ঝামেলা করে নিজে গেলে না, আমাকেও যেতে দিলে না। ওরা ফিরুক, আমি আজকেই সবটা ওদের জানিয়ে দেবো।"
সুমিত আদৃতার দিকে তাকিয়ে থাকার পর ছুটে গিয়ে বিছানার ওপর থেকে তার ফোনটা নিয়ে নিতে যায়। তার আগেই আদৃতা ফোনটা নিয়ে ঘরের বাইরে দৌড় লাগায়। সুমিত তার পিছু ধাওয়া করে ধরে ফেলে। ফোন নিয়ে দু'জনের মধ্যে ধ্বস্তাধ্বস্তি হতে হতে হঠাৎই সুমিতের মাথায় জম্পেশ একটা বুদ্ধি খেলে যায়। আদৃতাকে আচম্বিতে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি থেকে ঠেলে ফেলে দেয় সে।
উপর থেকে সুমিত দেখে সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে মেঝের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে আদৃতা। মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে চলে যাচ্ছে। গোটা বাড়ি ফাঁকা, কেউ দেখতে পায়নি তার এই কীর্তি। সবাইকে বলে দেবে আদৃতা অসাবধানতাবশত সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে, সোজা হিসেব। তারপরেই ভয় পেয়ে যায়। আদৃতার পাকাপাকিভাবে কিছু না হলে সুস্থ হওয়ার পর সে তো সুমিতের এই কীর্তি সকলের সামনে ফাঁস করে দেবে! মনে মনে ভাবে এবার তার বউ পরপারের টিকিট কাটলেই রক্ষা পায় সে।
কিন্তু সুমিতের ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়ে আদৃতা মরলো না, কোমায় পড়ে রইলো। আর এখন শ্বশুরবাড়ির গুষ্টি তাদের বাড়িতে উঠে কান্নার রোল জুড়েছে!
ওইদিন রাতে হঠাৎই একটা দুঃস্বপ্ন দেখে সুমিত। আদৃতা তার দিকে পা ঘষটে ঘষটে এগিয়ে আসছে। বাঁ হাতটা পিছনদিকে মোচড়ানো, ডান হাতটা তার দিকে বাড়িয়ে রেখেছে। পরনের পোশাক রক্তে মাখামাখি, মাথার একপাশটা থেঁতলে গেছে, মুখের অর্ধেক রক্তাক্ত। অমন দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙে যায় তার, গলাটা শুকিয়ে গেছে। একগ্লাস জল খেয়ে আবার ঘুমোনোর চেষ্টা করে।
তারপর থেকে পরপর তিন-চারদিন সুমিত এরকমই স্বপ্ন দেখে যায়। সেদিন অফিস থেকে ফিরে বেশ কিছুক্ষণ পর টিভিটা চালিয়ে দেখতে বসে। সিনেমা চলছে একটা। স্বামী তার স্ত্রীকে খুন করে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল, স্ত্রীর আত্মা সেই স্বামীটির পিছু নিয়েছে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।
একটা প্রবল অস্বস্তিতে সুমিত টিভিটা বন্ধ করে দেয়, কেমন যেন একটা ভয় চেপে বসছে। আচ্ছা, আদৃতাও এমনটা করবে না তো! কিন্তু আদৃতা তো এখনও বেঁচে আছে। এদিকে বেঁচে গেলেও তো তার বিপদ, সবাইকে বলে দেবে সুমিতই ওকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু মরে গেলে যদি এরকমভাবে পিছু নেয়! ধুর, এসব কী ভাবছে সে!
পরেরদিন আদৃতার বাবা আর বোনের সঙ্গে সুমিত হাসপাতালে যায়। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই আদৃতার রুম থেকে সিস্টাররা ছুটে এসে ডেকে নিয়ে যান ডাক্তারকে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আদৃতা, সকলে মিলে চেষ্টা করছে বাঁচানোর। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে কিছুক্ষণ পরেই নিথর হয়ে গেল তার শরীরটা।
আদৃতার বাবা আর বোনকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো সুমিত। আদৃতার বাবা আর দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় নেই, অঝোরে কেঁদে চলেছেন। তাঁর ছোটো মেয়ে তাঁকে ধরে ধরে রুমের বাইরে নিয়ে গেলো। ডাক্তার আর সিস্টাররাও চলে গেলেন পরবর্তী ব্যবস্থার জন্য। পায়ে পায়ে সুমিত আদৃতার মৃতদেহের কাছে এসে দাঁড়ালো, দেখতে লাগলো আদৃতার মৃতদেহটাকে। চোখদু'টো স্থির, যেন তার দিকেই তাকিয়ে। কেমন যেন একটা করে উঠলো সুমিতের শরীরটা। যাক গে, আপদ গেছে!
হঠাৎই আদৃতার দেহটা কেমন যেন নড়ে উঠলো, সাথেই কেমন একটা আওয়াজ। তার অমন বিস্ফোরিত চোখের দিকে তাকিয়ে অসম্ভব আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সুমিত। আদৃতার আত্মা কি তাহলে সুমিতের প্রাণটাও নিয়ে যেতে এসেছে! সেই স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেলো। উফ্! দম আটকে আসছে যেন, ঘাম দিচ্ছে খুব। বুকটা টনটন করে উঠলো যন্ত্রণায়, মুহূর্তের মধ্যে সুমিত মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো।
গোটা হাসপাতালে খবর ছড়িয়ে পড়লো, স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ সহ্য করতে না পেরে স্বামীর হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু। ঘটনাটি দুঃখজনক হলেও লোকে ধন্য ধন্য করতে লাগলো এমন ভালোবাসা। খবরটা রুক্মিণীর কাছে পৌঁছতেও দেরি লাগলো না। দুঃখ তো দূরের কথা, রুক্মিণী সুমিতের উপর রাগে জ্বলতে লাগলো এই ভেবে যে তার কাছে এসে এতোদিন ধরে সুমিত আদৃতার যে অতো নিন্দে করতো সেসব তাহলে মিথ্যে! বউয়ের প্রতি এতো ভালোবাসা যে নিজেই মরে গেলো!
এদিকে সুমিতের আর জানা হলো না, তখন কোনোমতেই আদৃতার আত্মার আবির্ভাব হয়নি। ঘটনাটি ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ল্যাজারাস ফেনমেনন, যেটি কোনো সদ্য মৃত মানুষের দেহের মধ্যেকার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যার ফলে মৃতদেহের সামান্য নড়াচড়ার এবং শব্দের সম্ভাবনা থেকে যায়। সুমিতের কৃতকর্ম আর সেই সংক্রান্ত ভয়ই শেষ করে দিল তাকে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন