যে
কোনো ঋতু পরিবর্তনের সময় রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পায়। বড়দের সাথে সাথে শিশুদেরও সর্দি-কাশি-জ্বর,গলা
ব্যথা, বিভিন্ন ধরণের অ্যালার্জি, আমাশয় প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হতে হয়। অনেক সময়েই
রোগগ্রস্ত অবস্থায় বা রোগ থেকে মুক্ত রাখার জন্য শিশুদের কি ধরণের খাবার খাওয়ানো উচিত
সেই বিষয়ে মা-বাবারা চিন্তাগ্রস্ত থাকেন। এই চিন্তা-দ্বন্দ্ব
থেকে
মুক্তির সহজ উপায় হল রোজকার খাবারের তালিকায় কিছু পরিবর্তন করা, বা তালিকায় কিছু বিশেষ
বিষয়ের উপর নজর রাখা। শিশু
বিশেষজ্ঞদের মতে যে কোনো কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য শিশুদের দেহে অতিরিক্ত
শক্তির প্রয়োজন হয়। এই
শক্তি শিশুকে ঋতু পরিবর্তনের বিভিন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা প্রদান করার
সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। তাই খাবারের তালিকায় সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর
খাবার রাখা একান্তই দরকার। ঋতু
পরিবর্তনের সময় কি ধরণের খাবার শিশুকে খাওয়ানো উচিত সেই বিষয়ে কিছু আলোচনা করা হল।
◾ছয়মাস
বয়সের পর থেকে প্রতি শিশুকে মাতৃদুগ্ধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার খাওয়ানো দরকার। প্রয়োজনে
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গরুর দুধ শিশুর খাদ্যতালিকাভুক্ত করা উচিত।
◾ঋতু পরিবর্তনের সময় অনেক শিশুর
হাঁপানি, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয়ে থাকে। তাই এ সময় ভিটামিন 'সি' জাতীয়
খাবার খাওয়াতে হবে। কমলালেবু, পালংশাক, আলু, ব্রকোলি, কিউই, বেরি খাওয়ানো যেতে পারে।
◾বিভিন্ন ধরণের সব্জি শিশুর রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এসব সবজিতে থাকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং
অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান, যা শিশুকে ঋতু পরিবর্তনের সময় হওয়া সর্দি-কাশি-জ্বর, গলা ব্যথা প্রভৃতি
উপসর্গ থেকে রক্ষা করে। শরীরকে রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
◾সব্জির
মধ্যে বিশেষ করে গাজর শিশুদের সব ঋতুতেই খাওয়ানো দরকার। এই সবজিতে থাকে বিটা ক্যারোটিন। এই উপাদান রক্তে শ্বেত রক্তকণিকার মাত্রা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। শ্বেত রক্তকণিকা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং যে কোনও প্রকারের ভাইরাল সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। এছাড়া গাজর হলো উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার। এটি শিশুর পাচনতন্ত্র নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।
◾যে কোনও বয়সের শিশুর খাদ্য তালিকায় শুকনো ফল ও
বিভিন্ন বাদাম যেমন – কাজু, আখরোট, চিনাবাদাম, আমণ্ড প্রভৃতি রাখা জরুরী। বাদামে ফেনোলিক যৌগ, উচ্চগুণসম্পন্ন প্রোটিন এবং ফাইবার
রয়েছে যা প্রদাহ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ক্যান্সার ও অন্যান্য অনেক রোগ থেকে বাঁচায়। এই খাবারগুলো একসাথে গুঁড়ো করে অল্প পরিমাণে রোজ দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়ালে শিশুর শারীরিক শক্তির যোগান হয়। এই খাবার শিশুর
প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করে শিশুর স্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
◾খেজুর শিশুদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি
খাদ্য উপাদান। সারা বছরই শিশুকে এই ফল খেতে দেওয়া
যায়। খেজুরে থাকে ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং
ম্যাগনেসিয়াম যা বাড়ন্ত বয়সে খুবই জরুরি। এইসব উপাদান শিশুর
শরীরকে উষ্ণ থাকতে সাহায্য করে। শিশু যদি শুধু খেজুর খেতে না চায়
তবে স্মুদি, মিল্কশেক, দুধ কিংবা বিভিন্ন
মিষ্টি খাবারে মিশিয়েও খাওয়ানো যেতে পারে। এই
ফলের অ্যান্টি-অক্সিডেটিভ বৈশিষ্ট্য শিশুর বিপাকক্ষমতাকে উন্নত করে।
◾ফাইবার
বা আঁশজাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে, যা
শিশুর শরীরে ক্যালোরির ভারসাম্য রক্ষা করবে। এই ধরণের
খাবারগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ঋতু পরিবর্তনের সময়ে হওয়া
বিভিন্ন রোগের হাত থেকে বাঁচায়।
তাই
বেদানা, নাশপাতি, মিষ্টি
আলু, পেঁয়াজ
ও বাজরা ইত্যাদি খাবার শিশুর খাবারের তালিকাভুক্ত হওয়া দরকার।
◾শিশুর
আহারের তালিকায় বিট, কড়াইশুঁটি, পালংশাক, বিনস, মসুর
ডাল, মুগ
ডাল ইত্যাদি উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার রাখতে হবে।
এইসমস্ত
খাবার প্রোটিনের যোগান পূরণের সাথে সাথে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
◾ভাত,
রুটির পাশাপাশি সুজিও শিশুদের জন্য অন্যতম জরুরী একটি খাবার।
তাই
প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় সুজি রাখাটা একান্তই জরুরী। দুধের সাথে সুজি মিশিয়ে পাতলা
করে রান্না করে অল্প পরিমাণে শিশুকে
এই খাবার খাওয়ানো যেতে পারে।
◾শিশুর
শীতকালীন খাবারের তালিকায় রসুন যোগ করা যায়। উপকারী এই ভেষজ
অ্যালিসিন সমৃদ্ধ। অ্যালিসিন হলো এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। তাই রসুন খেলে
শিশুর সর্দি-কাশি ও জ্বর তো দূর হয়ই, সেইসঙ্গে বিভিন্ন অসুস্থতাও
দূরে থাকে। শীতের সময়টাতে শিশুর খাবারের তালিকায় রসুন রাখা
উচিত। এছাড়া সারা বছর অল্প পরিমাণে প্রতিনিয়ত
রসুন খাবারের তালিকাভুক্ত করলে বিভিন্ন রোগ সংক্রমনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
কাঁচা
রসুন খাওয়ানো যেতে পারে অথবা বিভিন্ন ধরনের স্যুপ ও ডাল রান্নায়
রসুনের ব্যবহার করা যেতে পারে।
◾শিশুর
আহারের তালিকায় প্রতিদিন একটি করে ডিম রাখতে হবে। ডিম শিশুর শরীরের
জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের চাহিদা পূরণে কাজ করে। ডিমে আছে ভিটামিন ও খনিজ। এই দুই
উপাদান শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে কাজ করে। তাই শীতে শিশুর খাবারের তালিকায় ডিম অবশ্যই যোগ করতে হবে। গ্রীষ্মকালে একদিন অন্তর ডিম খাওয়ানো
যেতে পারে।
◾এক
বছর বয়সের পর থেকে শিশুর খাবারের তালিকায় মাছ ও মাংস রাখা দরকার। তবে মাংসের ক্ষেত্রে
প্রাথমিকভাবে মুরগীর মাংসই দেওয়া উচিত। মাছের ক্ষেত্রে জিওল মাছ, পোনা মাছ খাওয়ানো
প্রয়োজন। সামুদ্রিক মাছ শিশুদের না দেওয়াই উচিত। মাছ বা মাংস ভালো করে সেদ্ধ করে নিয়মিত
সঠিক মাত্রায় খাওয়ানো যেতে পারে।এর ফলেও শিশুর শরীরে প্রোটিনের যোগানের সাথে সাথে প্রয়োজনীয়
শক্তিরও যোগান হয়।
ঋতু পরিবর্তনের সময় শিশুদের জন্য সুস্বাদু কিছু খাবারের প্রনালী দেওয়া হল।
দুধ সুজিঃ
- দুধ – ১ কাপ
- সুজি – ২ চামচ
- মধু – ২ চামচ
পাত্রে সুজি অল্প করে ভেজে নিয়ে দুধ ও মধু মিশিয়ে
দিতে হবে। দুধ ফুটে গেলে এবং সুজি নরম হয়ে মিশে গেলে নামিয়ে নিতে হবে। একটু তরল অবস্থায়
যেন থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। এই খাবার ৬ মাস বয়সের পর থেকে শিশুকে দেওয়া যেতে পারে।
গাজরের হালুয়াঃ
- গাজর: ৩টি মাঝারি (গ্রেট করা)
- দুধ: ১ কাপ
- পাম / ব্রাউন সুগার: ৩/৪ কাপ
- ঘরে তৈরি ঘি: ৩ চামচ
- কাজু: ১০টি
- কিশমিশ: ১ চামচ
গাজর ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে মিহি করে গ্রেট করে নিতে হবে। ঘি-এ
কাঁচা গাজর যুক্ত করে, কাঁচা গন্ধ না যাওয়া পর্যন্ত ভাজতে
হবে। গাজর নরম হয়ে এলে দুধ যোগ করতে হবে এবং মাঝারি আঁচে রান্না করতে হবে। দুধ ফুটে গাজরের সাথে মিশে গেলে,
চিনি যুক্ত করতে হবে। হালুয়া ঘন হয়ে এলে ভাজা কাজু ও কিশমিশ যোগ করতে হবে। ঠাণ্ডা হলে
পরিবেশন করতে হবে। এই খাবার ২ বছরের পর থেকে শিশুদের দেওয়া যাবে।
- টমেটোর স্যুপঃ
- টমেটো: ৩ থেকে ৪টি
- পেঁয়াজ: ১ টেবিল চামচ ঘন কুচি করে নিন
- রসুন: ৪টি ছোট কোয়া, ঘন কুচি
- পাউরুটির কিউব: ঐচ্ছিক
- মাখন / ঘি: ২ টেবিল চামচ
- গোলমরিচ গুঁড়ো: ১/২ চামচ
- ফ্রেশ ক্রিম: ১ চামচ
- সব্জি ও ডালের স্যুপঃ
- মুগ/মুসুর ডাল: ৪ চামচ।
- গোটা জিরে: ১/৪ চামচ।
- গাজর, শিম, মটর, আলু: অল্প পরিমাণে ( পছন্দ অনুযায়ী অন্য সব্জিও দেওয়া যাবে)
- রসুন: ১ বা ২টি
- মাখন / ঘি: ১/৪ চামচ
- গোলমরিচ গুঁড়ো: এক চিমটি
ডাল
ভালো করে ধুয়ে আধা ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। ভেজানো নরম ডালের
সাথে কাটা সবজিগুলি ধুয়ে প্রেসার কুকারে ভালো করে সিদ্ধ করতে
হবে। সেদ্ধ সবজি শীতল হওয়ার পর বেটে একটি মসৃণ পেস্ট তৈরি করতে হবে। মিশ্রিত স্যুপটি
মাখন বা ঘি মিশিয়ে অল্প গরম করে নুন ও গোলমরিচ গুঁড়ো দিয়ে
গরম গরম পরিবেশন করতে হবে। এই স্যুপ ১ বছর বয়সী শিশুদের খাওয়ানো যাবে।
এই সমস্ত খাবারই শিশুদের ঋতুকালীন বিভিন্ন পরিবর্তনের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করবে। পুষ্টির যোগান দেওয়ার সাথে সাথে এই সমস্ত খাবার শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে শিশুকে সুস্থ ও সুন্দর স্বাস্থ্য প্রদান করবে।
কলমে - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন