প্রাণঘাতী এক্টোপিক গর্ভাবস্থা

 


একবছর আগে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে শ্রীতমা আর তমোঘ্ন। এখন তাদের চোখে অনেক রঙিন স্বপ্ন কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে শ্রীতমার তলপেটটা হালকা মোচড় দিচ্ছে শরীরটাও কেমন দূর্বল হয়ে গেছে ‌‌। ঋতুস্রাবও শুরু হয়েছে ঋতুস্রাবের সময় এমনটা হতেই পারে ভেবে এই আকস্মিক শারীরিক পরিবর্তনকে বিশেষ গুরুত্ব দিল না শ্রীতমা। হঠাৎ একদিন মাঝরাতে এই ব্যথা মারাত্মক আকার ধারণ করল। শ্রীতমার মনে হচ্ছে তার দেহ থেকে নাড়িভুঁড়ি সব যেন ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে একটু একটু করে রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানাশ্রীতমা বেশ বুঝতে পারছে এটা কোন সাধারণ ঋতুস্রাবের ঘটনা নয়। কোনরকমে হাত নেড়ে তমোঘ্নকে জাগাল সে এরপর তার সামনের সবকিছু ঝাপসা হয়ে এল। অবশেষে যখন চোখ মেলে চাইল তখন ফিনাইল, ডেটল আর ওষুধের মিশ্রিত গন্ধ তার নাকে ঝাপটা মারছে। হতচকিত হয়ে উঠে পড়তে চাইল শ্রীতমা, কিন্তু তার হাতে জড়ানো সিরিঞ্জগুলো তার গতি অবরুদ্ধ করে দিল একজন নার্স ছুটে এসে বলল – “উঠবেন না। উঠবেন না আপনার অনেক রক্ত চলে গেছে তাই রক্ত দিতে হচ্ছেকোনরকমে স্বরযন্ত্রকে সচল করে শ্রীতমা জিজ্ঞাসা করল – “ কী হয়েছে আমার?”

নার্স জবাব দেয় – “আপনি গর্ভবতী ছিলেন

শ্রীতমা আর্তনাদ করে ওঠে – “ছিলেন মানে ? এখন নই !”

নার্স বললেন – “আপনার এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি ছিল। তাই আপনার বাচ্চাকে বাঁচানো সম্ভব ছিল না তবে আপনাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আনা হয়েছিল বলে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে

শ্রীতমার মতো অনেক মহিলার ক্ষেত্রে এক্টোপিক গর্ভাবস্থা দেখা যায় উন্নত দেশে এই এক্টোপিক গর্ভাবস্থার হার প্রায় ১-২% মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর কারণগুলির মধ্যে একটি কারণ হল এই এক্টোপিক গর্ভাবস্থা

 

এক্টোপিক গর্ভাবস্থা (Ectopic pregnancy) কাকে বলে  ?

ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর মিলনের ফলে ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়।এই ডিম্বাণুর নিষেক ঘটে জরায়ুর সংলগ্ন ডিম্বনালীতে। নিষেকের চার-ছয় দিন পর এই নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর গাত্রদেশের অন্তঃস্তরে (এন্ড্রোমেট্রিয়াম) প্রোথিত হয় এবং বৃদ্ধি পায়


কিন্তু এই নিষিক্ত ডিম্বাণু যদি জরায়ুর পরিবর্তে অন্য কোন স্থানে যেমন ফ্যালোপিয়ান টিউব(ডিম্বনালী), ডিম্বাশয়, জরায়ুর নিম্নদেশে বা উদর গহ্বরে প্রোথিত হয় তবে তাকে এক্টোপিক গর্ভাবস্থা বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর পরিবর্তে ডিম্বনালীতে প্রোথিত হয় এই প্রকার এক্টোপিক গর্ভাবস্থাকে টিউবাল গর্ভাবস্থা বলে


জরায়ুর বাইরে নিষিক্ত ডিম্বাণু প্রোথিত হওয়ায় সঠিক পুষ্টি ও রক্ত সরবরাহের অভাবে ভ্রুণটি বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না উপরন্তু এই প্রকার গর্ভাবস্থায় ভ্রুণ ডিম্বনালীতে বা অন্য কোন অঙ্গে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ায় ডিম্বনালীর উপর চাপ সৃষ্টি হয় এবং এটি বিদীর্ণ হয়ে গিয়ে প্রাণঘাতী আকার ধারণ করতে পারে  

প্রাথমিক লক্ষণ :

এক্টোপিক গর্ভাবস্থার প্রাথমিক স্তরে কোন বিশেষ লক্ষণ প্রকাশ পায় না তবে কিছুমাস পর বিশেষ কিছু লক্ষণ দেখে এটিকে শনাক্তকরণ করা সম্ভব যেমন

  • যোনি থেকে হালকা থেকে মাঝারি রক্তক্ষরণ‌ (অনেকসময় এটিকে ঋতুস্রাবের রক্ত ভেবে ভুল করেন মহিলারা). 
  •  শ্রোণী সংলগ্ন অংশে ও পিঠের নিচের দিকে হালকা ব্যথা। 
  • গলা ও কাঁধে ব্যথা। দূর্বলতা ও তন্দ্রাচ্ছন্নতা।
  • পেটের সমস্যা ও কিছু ক্ষেত্রে ডায়রিয়াও হতে পারে
  •  মল ও মূত্র ত্যাগের সময় ব্যথা।

এই প্রকার গর্ভাবস্থার সবথেকে ভয়ানক লক্ষণগুলি হল- পেটের যন্ত্রণা, প্রভূত পরিমাণে রক্তক্ষরণ এবং শরীরের একটি অংশে প্রচন্ড ব্যথা হওয়া। এই লক্ষণগুলো প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া দরকার

 

এক্টোপিক গর্ভাবস্থার কারণ :

ডিম্বনালী ক্ষতিগ্রস্ত থাকলে, নিষিক্ত ডিম্বাণু সহজে জরায়ুর অন্তঃস্তরে প্রবেশ করতে পারে না। এর ফলে এক্টোপিক গর্ভাবস্থা দেখা যায় তবে এছাড়াও বিভিন্ন রকম কারণের জন্য এক্টোপিক গর্ভাবস্থা দেখা যায়

  •  নিয়মিত ধূমপান করার প্রভাবে এক্টোপিক গর্ভাবস্থার সম্ভাবনা চার থেকে কুড়ি গুণ বেড়ে যায়। 
  • ৩৫ বছরের বেশি বয়স হলে এর সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়
  • অস্বাভাবিক হারে জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ সেবন করার ফলে জরায়ুর অন্তঃস্তর ভ্রুণ প্রতিস্থাপনের অনুপযুক্ত হয়ে যায়। এরফলে জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধের সাথে এক্টোপিক গর্ভাবস্থার সংযোগ রয়েছে বলে মনে করা হয়।
  • যৌনসম্পর্কের মাধ্যমে সঞ্চারিত রোগ যেমন গনোরিয়া এবং ক্ল্যামাইডিয়া অনেক সময় এক্টোপিক গর্ভাবস্থার কারণ হতে পারে।
  • শ্রোণীর প্রদাহ রোগের(Pelvic inflammatory disease)প্রভাবে ডিম্বনালী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এক্টোপিক গর্ভাবস্থার সম্ভাবনা দুই থেকে দশ গুণ বেড়ে যায়
  • পূর্বে এক্টোপিক গর্ভাবস্থার ইতিহাস থাকলে বিশেষভাবে সচেতন হওয়া দরকার।
  • অনেকের ক্ষেত্রে টিউবাল লাইগেশন বা টিউবাল লাইগেশন রিভার্সালের পর এই এক্টোপিক গর্ভাবস্থা দেখা যায়(টিউবাল লাইগেশন (tubal ligation)-এর মাধ্যমে ডিম্বনালীকে কেটে সিল, ক্লিপ বা ব্যান্ডের সাহায্যে বন্ধ করে দেওয়া হয় এর ফলে গর্ভসঞ্চারের কোন সম্ভাবনা থাকে না কিন্তু কেউ যদি টিউবাল লাইগেশনের পর পুনরায় গর্ভবতী হতে চান তখন টিউবাল লাইগেশন রিভার্সালের ( Tubal ligation reversal) মাধ্যমে ডিম্বনালীকে পুনরায় সংযুক্ত করে দেওয়া হয়।
  • এন্ডোমেট্রিওসিসের ফলে নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর অন্তঃস্তরে প্রোথিত হতে পারে না এবং এক্টোপিক গর্ভাবস্থার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। 


এক্টোপিক গর্ভাবস্থা নির্ধারণের উপায় :

এই প্রকার গর্ভাবস্থা নির্ধারণের জন্য ডাক্তার প্রথমে গর্ভধারণ পরীক্ষা এবং শ্রোণীর পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন তাছাড়া আল্ট্রাসোনোগ্রাফির দ্বারা জরায়ু ও ডিম্বনালীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এটি নির্ধারণ করা সম্ভব‌।

এক্টোপিক গর্ভাবস্থার চিকিৎসা :

পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে নিষিক্ত ডিম্বাণু কখনো জরায়ুর বাইরে বেঁচে থাকতে পারে না এমনকি এই গর্ভাবস্থা গর্ভধারিনীর জীবনকে সংকটে ফেলে দিতে পারে তাই দু'টি পদ্ধতির মাধ্যমে এর চিকিৎসা করা হয়

ওষুধের মাধ্যমেযদি ডিম্বনালী ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং এটির শনাক্তকরণ প্রাথমিক স্তরে করা সম্ভব হয়, তখন ডাক্তার ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে নিষিক্ত ডিম্বাণুর  বৃদ্ধি রোধ করে দেয় এবং অবশেষে শরীরের দ্বারা এটি শোষিত হয়ে যায়।

অপারেশনের মাধ্যমে ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে তলপেটে ছোট একটি অংশ কেটে তার মধ্যে একটি নমনীয় নল প্রবেশ করিয়ে ভ্রুণটিকে সরিয়ে ফেলা হয় তবে ডিম্বনালী যদি এই প্রকার গর্ভাবস্থার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন ডিম্বনালীটিকেও অপসারণ করতে হয়।

 

এক্টোপিক গর্ভাবস্থা শুধু শরীরের উপর নয়, মনের উপরেও সমানভাবে ছাপ ফেলে যায়। সন্তান হারানোর কষ্ট কখনোই সামান্য হতে পারে না তাই এক্টোপিক গর্ভাবস্থার পর প্রিয়জন এবং বিশেষ ক্ষেত্রে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়

এক্টোপিক গর্ভাবস্থা মানে ভবিষ্যতে স্বাভাবিকভাবে গর্ভবতী হওয়ার পথ বন্ধ এটি একেবারেই ভুল ধারণা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে পুনরায় স্বাভাবিকভাবে গর্ভবতী হওয়া সম্ভব। একটি ডিম্বনালী ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা কেটে বাদ দিয়ে দিলেও ভবিষ্যতে গর্ভসঞ্চারে কোন সমস্যা হয় না ‌।

এক্টোপিক গর্ভাবস্থার পর দু'টো ডিম্বনালী বাদ চলে গেলে বা ডিম্বনালীর কোন বিশেষ সমস্যা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের মাধ্যমে গর্ভসঞ্চার করা সম্ভব।

তবে এক্টোপিক গর্ভাবস্থাকে এড়ানোর সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল সন্তান নেওয়ার পূর্বে একবার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করে নেওয়া এবং গর্ভবতী হওয়ার পর চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা।

 

কলমে - সু কৃ তি  দা স 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন