বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে এক প্রকার তাড়াহুড়ো করেই দিল্লি ছেড়ে কলকাতা চলে এসেছিলাম । বাবাকে নিয়ে ছোটাছুটি করতে গিয়ে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এল । একদিন বিকেলে বাবার সাথে বসে চা খাচ্ছি এমনসময় বাবা বলল - “ বাবু ! আমাদের হাওড়ার পুরানো বাড়িটা ভেঙ্গে দেওয়া হবে । “
আমি এক মনে
মাঠের দিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের খেলা দেখছিলাম ।ওদের অপরিণত হাতে বল ছোঁড়া , রুদ্ধশ্বাসে
এদিক ওদিক ছুটে বেড়ানো - আমার বড়ো ভালো লাগে ।
তাই প্রথমে বাবার কথাটা কানে ঢুকল
, কিন্তু মনে কোন দাগ কাটল না । বাবার আবার “ বাবু” ডাকে ঘোরটা কাটল । নেটওয়ার্ক
স্লো থাকলে যেমন কম্পিউটার
নির্দেশিত কাজ করতে সময় নেয় । আমিও তেমনি হুঁশ ফিরে পেয়ে বাবার কথাগুলো মনে
পরপর সাজিয়ে বললাম - “ কেন ভাঙ্গবে ?”
বাবা
অসুস্থ জড়ানো গলায় বলল - “ অনেক পুরানো হয়ে গেছে তো । অনেক অংশ আবার ভেঙ্গে
পড়েও যাচ্ছে । সেদিন সমীর এসে বলল , ওই বাড়ি ভেঙ্গে একটা নতুন ফ্ল্যাট বানান হবে ।
আমিও ভাবলাম - যে বাড়িতে নিজের লোক কেউ নেই । সেই বাড়ি শুধু বোঝার মত বয়ে বেড়িয়ে কি লাভ ? দাদাও সই করে দিয়েছে , তাই আমিও সইটা করেই ফেললাম । একটা কথা
রাখবি ?”
এতক্ষণ
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম ।এবার
জিজ্ঞাসা করলাম
- “ কী
কথা? ”
অসহায়
পশু যেমন সহায় খুঁজে পেয়ে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে , তেমন চোখের চাহুনি নিয়ে বাবা বলল - “ একবার শেষবার বাড়িটাকে
দেখে আয় । আমি সুস্থ থাকলে আমিই দেখে আসতাম । সেটা সম্ভব নয় ।তাই তোর চোখ দিয়েই না
হয় শেষবারের জন্য বাড়িটা দেখব । “
বাড়িটার প্রতি আমার তেমন মোহ নেই । ঠাকুমা মারা
যাবার পর বাবার কাজের সুবিধার জন্য কলকাতাতে
চলে এসেছিল
।
তারপর ছুটিছাটা পেলে , মাঝেমাঝে জেঠু , দিদি , দাদা এদের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম
। কিন্তু কলেজে ভর্তি হবার পর সেটাও কমে গিয়েছিল
। কিছু বছর আগে শুনলাম, জেঠুরাও ওই বাড়ি ছেড়ে
কলকাতাতে পাড়ি দিয়েছে । তারপর যেচে ওই বাড়ি দেখতে যাবার তাগিদ অনুভব করিনি কখনও । কিন্তু
এইবার বাবার কথা ফেলতে পারলাম না । তাই পরেরদিন
বাবার কাছ থেকে চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শিকড়ের সন্ধানে ।
আমাদের
সেই পুরানো পাড়াতে যখন গিয়ে পৌঁছলাম ,তখনও
আকাশে বিকেলের ম্লানতা স্পর্শ করেনি
। গাড়িটাকে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে , গলিপথ দিয়ে
এগিয়ে গেলাম । পিচঢালা রাস্তাটা অনাকাঙ্খিত অতিথির মত সম্ভাষণ জানাল আমাকে । চারিদিকের অপরিচিত বাড়িগুলো অচেনা লোকের আগমনে যেন একটু কুণ্ঠিত হয়ে গেছে ।
দশ বছর হয়ে গেল এই পথ আমার স্পর্শ পায়নি ।
তাই হয়ত চারিদিকের পরিবেশ এমন বেমানান ঠেকছে । আমাদের বাড়িটা খুঁজে পেতে
একটু সময় লাগল । কারণ এতদিন আমাদের বাড়ির পাশে যে লাল রঙের বাড়িটা স্থবিরের মত দাঁড়িয়ে থাকতো । আজ সে কোন বিশেষ জাদুমন্ত্রবলে ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট হয়ে
গেছে। আমাদের বাড়িটার পরিণতিও যে তাই হবে - সেটা ভেবে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে
চারিদিকের শূন্যতাটা ভরিয়ে দিল ।
মরচে
ধরা তালাটা খুলতেই , হুড়মুড় করে নাকের উপর আছড়ে পড়ল শ্যাওলার ভেজা গন্ধ । শুকনো মাটি
যেমন বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা নিমেষের মধ্যে নিজের দিকে টেনে নেয় । আমার নাকও তেমন সব গন্ধটা শোষণ
করে , একটা প্রশান্তি উপহার দিল আমাকে । বাড়ির
জরাজীর্ণ ফাঁকে গজিয়ে ওঠা অশ্বত্থ গাছের নীরব
হাতছানি উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম ।
সামনে চোখে পড়ল আমাদের সেই ছোট্ট উঠোনটা ।
মেঝের উপর এখনও খোদাই করা আছে - বাঘবন্দি খেলার ছকটা । এই উঠোনে দাঁড়িয়ে আমি কতদিন রাতের আকাশে অসংখ্য তারার ভিড়ের মধ্যে কালপুরুষকে খোঁজার চেষ্টা করেছি । আজ উঠোনের
মাঝখানে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলাম - দিদি আর আমি ক্রিকেট খেলছি । ঠাকুমা সামনের লাল রকটাতে বসে
, এক দৃষ্টিতে আমাদের খেলা দেখছে আর হয়ত তার ফেলে আসা শৈশবের কথা কল্পনা করছে । চোখের
জলে আমার চারপাশ ঝাপসা হয়ে এল । গলার কাছে কুণ্ডলীকৃত কষ্টটা জমাট বেঁধে গেল । চোখের
জল মুছে যখন চারদিকে তাকালাম , তখন বাড়িটাকে রণক্লান্ত যোদ্ধার মত পরিশ্রান্ত
দেখাল । সাপের মত এঁকেবেঁকে যে সিঁড়িটা দোতলাতে গিয়ে মিশেছে , সেই সিঁড়িটাও
আজ অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধের মতন ধুঁকছে । সিঁড়িটার
ক্ষমতা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় সেটার উপর পা দিলাম না । নীচ থেকে উপরের ভঙ্গুর ঝুল বারান্দাটার
দিকে তাকালাম । লোডশেডিং হয়ে গেলে দোতলার ওই
বারান্দাটাতে আমাদের ভূতের গল্পের মজলিশ বসত । মুড়ি চানাচুর আর হ্যারিকেনের মিঠে আলোতে
আমরা জারণ করতাম একেক রকমের অদ্ভুতুড়ে ভূতের গল্প ।
রোববার
হলেই আমাদের দুপুরের খিদেটা তাড়াতাড়ি পেয়ে যেত । কারণ সেদিন জেঠু বাজার থেকে মাংস কিনে নিয়ে আসত । সারাদিন ধরে
দস্যিপনা করার পর , একতলার বড়ো ঘরটাতে সবাই মিলে খেতে বসতাম । আজ জানলা দিয়ে একতলার সেই বড়ো ঘরটাতে উঁকিঝুঁকি মেরে
দেখলাম - মাকড়সার জাল আর কিছু লতানো গাছ আমাদের সেইসব জায়গা অধিকার করে নিয়েছে । সত্যি ! কোন স্থান কারোর জন্য কখনো ফাঁকা থাকে না । বড়ো ঘরটার পাশে
একটা দরজা আছে। এই দরজা খুললেই আমাদের বাড়ির
দ্বিতীয় সিঁড়িটির পথ উন্মোচিত হয়ে যায় । বাড়ির মধ্যে দিয়ে সুড়ঙ্গের মতন সিঁড়িটা উঠে গেছে বলে এতে কখনো
সূর্যের আলো ঢুকত না । তাই আমরা একে নাম দিয়েছিলাম
- “ অন্ধকার সিঁড়ি “। সারাদিন একটা টিমটিমে হলুদ রঙের বাল্ব জ্বালানো থাকত এখানে । সেই বাল্বের
আলোয় , “আলিবাবা চল্লিশ চোরের “ গুহার মত দেখাতো সিঁড়িটাকে । আজকে দেখলাম - একটা বিরাট
বড়ো মৌচাক ওই সিঁড়ির দরজার সামনে দ্বাররক্ষীর
মত অবস্থান করছে । ছোটবেলাতে মৌমাছি নিয়ে খুব খারাপ অভিজ্ঞতা ছিল । তাই ওদেরকে আর বিরক্ত করতে চাইলাম না ।
দোতলায় জেঠুর ঘরের ডান পাশ দিয়ে উঠে গিয়েছে ছাদে যাবার সিঁড়ি । সিঁড়িটা খুব খাড়াই হওয়ায় ছোটবেলাতে উপরে উঠতে খুব ভয় করত । তবু একদিন সাহসে ভর করে সিঁড়ি দিয়ে একা একা ছাদে উঠেছিলাম ফুল পাড়তে । টব থেকে একটা জবা ফুল ছিঁড়ে , পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম আমার সমান একটা বীর হনুমান আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে । আমি হুড়মুড় করে নামতে গিয়ে , সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম । খুব চোট লেগেছিল সেইবার । বাবা-মা , জেঠু , ঠাকুমা সবাই খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল আমাকে নিয়ে ।
আমাদের
বাড়ির পাশের লাল বাড়িটা ছিল - আমাদের কৌতূহলের
কেন্দ্রবিন্দু । একজন ধনী ডাক্তার ওই বাড়িটা
বানিয়েছিল । আমাদের বাড়ির গা ঘেঁষে এমনভাবে
, বাড়িটা উঠেছিল যে- দূর থেকে এই দুটো বাড়িকে যমজ বাড়ি বলে মনে হত ।
কাউকে কখনো এই বাড়িতে রাত্রিবাস করতে দেখিনি । ঠাকুমা বলত “বড়লোকেদের উটকো শখ “ । তাই বাড়ি বানিয়ে অমন করে
ফেলে রেখে দিয়েছে। আমাদের পাড়ার এক বুড়ো কাকু এই বাড়িটার দেখভাল করত । সে ছাড়া এই বাড়িটাতে
কারুর পদচিহ্ন পড়ত না । আমাদের সিঁড়ির পাশে
একটা উঁচু জায়গাতে কতকগুলি ফুলের টব ছিল ।
সেই উঁচু জায়গাটার অন্য পাশে সীমানা টেনে রেখেছিল
একটা বেঁটে পাঁচিল । উঁচু জায়গাটাতে পা দিয়ে পাঁচিল টপকে নেমে পড়া যেত
লাল বাড়ির সিঁড়িতে । দাদা প্রথমে আমাকে
এই রাস্তাটা দেখিয়েছিল । তারপর দুপুরবেলা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি , দাদা আর দিদি রোজ ওই
বাড়িতে খেলতে যেতাম । তখন আমরা
হতাম ওই বাড়ির রাজা আর ওই বাড়িটা হত আমাদের
সাম্রাজ্য । ঠাকুমা মামদো ভূতের ভয় দেখিয়েছিল
দু- একবার। কিন্তু মামদো ভূতের মামদোবাজি
আমাদের আটকাতে পারেনি।
আচমকা ঘুঘু পাখির সুতীব্র
আর্তনাদে আমার চিন্তার সব ঘোর কেটে গেল। বালির উপর ছবি আঁকার পর মানুষ যেমন
তার চিত্রকলাকে আগাম সমুদ্রের স্রোত থেকে বাঁচানোর
আপ্রাণ চেষ্টা করে । আমিও তেমনিভাবে বাস্তবের রুক্ষতা থেকে আমার ছেলেবেলার স্মৃতিকে রক্ষা করার চেষ্টা করলাম । কিন্তু জলের বুদবুদের মতো সেগুলো অকস্মাৎ উঠে অকস্মাৎ মিলিয়ে
গেল এই নির্জন বাড়ির মধ্যে । মনে মনে ভাবলাম - “ এর আগেও তো আমি এই বাড়িতে এসেছি জেঠুর
সাথে দেখা করতে । তখন এই সব কথা মনে পড়েনি কেন ? তবে কি এই নিঃসঙ্গ বাড়ি একজন সঙ্গীর জন্য উন্মুখ হয়ে গিয়েছিল । তাই আজকে
শেষ জীবনে এসে , আমাকে তার
সব গোপন ইতিহাস মনে করিয়ে দিল । “
আমার
মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল । মনে হল , একবার পুরো
বাড়িটাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদি আর বলি
- “ তুমি তো ইঁট , কাঠ , পাথরের তৈরি জড়বস্তু নও শুধু । তুমি আমার ছেলেবেলা । আমার
আত্মার একটা অংশ । তুমি ধ্বংস হয়ে গেলে , আমার ছেলেবেলাও যে উধাও হয়ে যাবে এই পৃথিবীর বুক থেকে । তোমাকে আমি
ভাঙতে দেব না।“
সেই
সময় পাশে নতুন গজিয়ে ওঠা ফ্ল্যাট থেকে শব্দ ভেসে এল । একটা বাচ্চার দস্যিপনার শব্দ আর
তার সাথে সেই বাচ্চাটার মায়ের স্নেহমিশ্রিত বকুনি - “ তোজো ! এত বদমায়েশি করো না ।”
আমি
থমকে গেলাম । আমার মনের সমস্ত ঝড় যেন এক নিমেষে কেউ থামিয়ে দিল । সত্যিই তো , পরিবর্তনের গতি আটকে রাখার আমি কে
? পুরানো গাছ যেমন মরে গিয়ে নতুন একটা গাছকে
জায়গা করে দেয় , আমার ছেলেবেলাকেও তেমনিভাবে মরতে হবে । এই বাড়ি গুঁড়িয়ে নতুন ফ্ল্যাট
উঠবে , সেই ফ্ল্যাটের প্রতিটা ঘরে সৃষ্টি হবে নতুন ছেলেবেলা ।
আমি
আমার মায়াকে পায়ে পিষে বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে
বেরিয়ে এলাম । গলির পথ বেয়ে কিছুটা হাঁটার পর মনে হল , একবার শেষবারের জন্য বাড়িটাকে
চেয়ে দেখি । পিছন ফিরে দেখলাম গোধূলির গোলাপি আলোতে বাড়িটাকে ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর
মত দেখাচ্ছে। কি জানি ! বাড়িটা হয়ত তার
অন্তর্জলি যাত্রার জন্য অপেক্ষা করছে ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন