শিশুর নিরাপদ ঘুম

 


একটি ঘুমন্ত শিশুর তুলনায় নিষ্পাপ এই পৃথিবীতে আর কিছু হয় না। তাদের ঘুমের ধরণও আবার ভিন্ন। কেউ ঘুমের মধ্যে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, কেউ আবার ঠোঁট ফুলিয়ে একটু ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, কেউ আবার দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোয়। কিন্তু শিশুর বিছানা এবং ঘুমের ভঙ্গিমা সঠিক না হলে তা ডেকে আনতে পারে সমূহ বিপদ।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতিবছর প্রায় ৩৫০০ শিশু ঘুমের মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে মারা যায় যার কারণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে এর জন্য দায়ী শ্বাসরুদ্ধ হওয়া এবং শিশুমৃত্যু সিনড্রোম অর্থাৎ সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম (SIDS)সাধারণত ২ মাস থেকে ৪ মাস বয়সী শিশুরাই বেশি এই পরিস্থিতির শিকার হয়। শিশু একটু বড়ো হলে কোনো সমস্যা থাকে না, কোনো অস্বস্তিতে পড়লে সে নিজেই জানান দিয়ে দেয়। কিন্তু নবজাতকদের ক্ষেত্রে ঘুমের সঠিক ভঙ্গিমার দিকে লক্ষ্য দেওয়া অত্যন্ত জরুরী।

 বিপদের সম্ভাব্য কারণসমূহ :

  • উপুড় হয়ে ঘুমানো শিশুদের জন্য ক্ষতিকর। এই ভঙ্গিতে শিশুর চোয়ালের উপর চাপ পড়ে এবং বায়ুচলাচল অবরুদ্ধ হয় যার ফলে শিশুর পক্ষে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বাচ্চার শরীরের ওজন তার পেটের উপর পড়ায় স্পাইনেও এর দুষ্প্রভাব দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার এই ভঙ্গিমায় ঘুম পাড়ালে SIDS এর ঝুঁকিও থাকে সবচেয়ে বেশি। শুধু তাই নয়, অপরিষ্কার বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমালে বিছানায় উপস্থিত অতিক্ষুদ্র জীবাণু শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে শিশুর শরীরে প্রবেশ করে অ্যালার্জির সম্মুখীন করতে পারে।
  • পাশ ফিরে ঘুমালে শিশুর সমস্ত ওজন শরীরের একটি অংশে পড়ে যায় এবং ত্বক হাল্কা লাল বা গোলাপী হয়ে পড়ে। একটানা কয়েকঘণ্টা একদিকে পাশ ফিরে ঘুমালে শিশুর মস্তিষ্কের বৃদ্ধির গতি কমে যায়। শ্বাস নিতেও সমস্যা হতে পারে। এছাড়াও পাশ ফিরে ঘুমালে ঘুমের মধ্যে শিশুটির ঘুরে গিয়ে উপুড় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে যা SIDS এর ঝুঁকি বাড়ায়।
  • অত্যধিক নরম গদি ও বিছানা শিশুর জন্য নিরাপদ নয়। খুব নরম গদির উপর উপুড় হয়ে ঘুমালে শিশুর মুখ গদির নরম ফ্যাব্রিকের গভীরে ঢুকে পড়ে। ফলে শ্বাসরোধের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
  • নবজাতকের ঠান্ডা লাগতে পারে ভেবে বেশি লেপ কম্বল কাঁথা তার গায়ে চাপা দিয়ে রাখা একেবারেই অনুচিত। সেগুলি অসাবধানতাবশত তার মুখের উপর উঠে গেলে সেটা সরিয়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। শ্বাসরোধ হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
  • পাহাড়ি অঞ্চলে শৈত্যের কারণে শিশুর ঘরে রুম হিটার বা কাঠকয়লা জ্বালিয়ে ঘর গরম রাখার চেষ্টা করলে শিশুটির শ্বাসকষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • মনের বিশ্বাসে শিশুর মঙ্গল কামনায় অনেকেই শিশুর গলায় কালো সুতোতে মাদুলি বা হার পরিয়ে রাখেন। এগুলি গলায় জড়িয়ে গিয়ে শিশুর শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • শিশুর ঘরে ধূমপান করলে শ্বাস প্রশ্বাসে তার সমস্যা হয়।

 শিশুর নিরাপদ ঘুমের জন্য করণীয় :

  • সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নবজাতককে শোয়ানোর ভঙ্গিমা। নানান গবেষণা ও সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, পিঠের ওপর ভর করে শোয়ানো নবজাতকের জন্য সবচাইতে ভালো। এর ফলে তাদের মধ্যে SIDS এর ঝুঁকি অনেকখানি কমে যায়। ১৯৯২ সালে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স নবজাতকের বাবা মায়েদের পরামর্শ দেয় শিশুকে চিৎ করে শোয়ানোর জন্য এবং এর ফলে SIDS এর হার প্রায় ৫০% কমে গিয়েছিল। আমেরিকার স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ কেন্দ্রের জাতীয় শিশু ইনস্টিটিউট এটিকে শিশুর ঘুমের জন্য সেরা ভঙ্গিমা হিসাবে চিহ্নিতকরণ করেছে।
  • নরম গদির পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত শক্ত ম্যাট্রেসে শিশুকে শোওয়াতে হবে। তার শোওয়ার জায়গায় বালিশ, কম্বল, কাঁথা, লেপ, খেলনা এসব রাখা চলবে না। এর ফলে ঘুমোনোর সময় শিশুর নাক, মুখ বা মাথা ঢেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
  • শিশুকে শোওয়ানোর জন্য বিছানাই আদর্শ। সোফা, কাউচ, গদিযুক্ত চেয়ার, কার সিট ইত্যাদি জায়গা তার ঘুমোনোর জন্য মোটেও নিরাপদ নয়। শিশুকে ক্যারিয়ার বা কার সিটে রাখলে ঘুমোনোর সময় তার মাথা সামনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়লে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
  • প্রবল শৈত্যের কারণে শিশুকে অতিরিক্ত লেপ কম্বলে না মুড়ে তাকে আরামদায়ক ফুলহাতা জামা ও ফুলপ্যান্ট পড়িয়ে তার গায়ে যথাযথভাবে বেবি ব্ল্যাঙ্কেট চাপা দেওয়া উচিত যাতে সে স্বচ্ছন্দে নড়াচড়া করতে পারে।
  • শিশুর গায়ে কাঁথা বা কম্বল চাপা দিলে খেয়াল রাখতে হবে সেটি যেন তার বুক পর্যন্ত ঢাকা থাকে। নয়তো হাত পা নাড়ার কারণে সেই কাঁথা বা কম্বল তার মুখের উপর চাপা পড়ে যেতে পারে।
  • শিশুকে আলাদা ক্রিবে শোওয়ানো সর্বোত্তম। নেহাতই সম্ভব না হলে তাকে বাবা মায়ের বিছানার এক পাশে শোওয়ানো যেতে পারে, কিন্তু বাবা মায়ের মাঝখানে কখনোই নয়। এতে ঘুমের মধ্যে অসাবধানতাবশত বাবা মায়ের গায়ে লেগে শিশুটির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়াও শীতকালে বাবা মায়ের নেওয়া লেপ কম্বলের তলায় ঘুমন্ত অবস্থায় চলে গিয়ে শ্বাসরোধ হয়ে যেতে পারে।
 মনে রাখা প্রয়োজন :
  • চিৎ হয়ে শোয়ানোর ফলে শিশুর মাথার পিছনের দিকটা চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এতে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। শিশু একটু বড়ো হলে সঠিক বালিশ দিতে হবে, একবছর বয়স হতে হতে আবার ঠিক হয়ে যাবে।
  • ক্রমাগত এক পাশ ফিরে ঘুমোনোর ফলে শিশুর মাথার একদিকটা চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে মনে হলে তার ঘুমোনোর সময় তাকে অন্য পাশে ফিরিয়ে দিন। তবে সে পাশ ফিরে ঘুমোলে পরিবারের কোনো না কোনো বড়ো সদস্যকে সামনে থাকতে হবে।
  • শিশুকে ক্যারিয়ার সিটে বা কার সিটে যতো কম রাখা যায় ততো ভালো।
  • শিশুর ঘর ও বিছানা সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা বাঞ্ছনীয়।
  • শিশু জেগে থাকাকালীন তাকে পেটের উপর উল্টো করে রেখে tummy time দেওয়া যেতে পারে। তবে এসময় বড়ো কারুর সঙ্গে থাকা অপরিহার্য।
  • শিশুরা ঘুমের প্রথম দিকটায় দ্রুত ও ঘন ঘন শ্বাস নেয়। ঘুম যতই গভীর হয় তাদের শ্বাস নেওয়ার মাত্রা কমে যায় এবং ধীরে ও থেমে থেমে শ্বাস নেয়। এতে চিন্তার কিছু নেই। চিকিৎসকরা একে ‘পিরিওডিক ব্রিদিং’ বলে থাকেন। ছয়মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে এটি খুবই স্বাভাবিক। তবে শিশুর যদি শ্বাস নেওয়া খানিকক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, তার নাক ঠোঁট জিভ নখ কপাল নীল হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়, খুব কাশতে থাকে, তাহলে তার অক্সিজেনের ঘাটতির সমস্যা হতে পারে। এই অবস্থায় তাকে আলতোভাবে জাগিয়ে তুলতে হবে এবং পরবর্তীর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।


কলমে - শুভ্রা ব্যানার্জী


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন