নববর্ষের অন্দরসজ্জা

 

নববর্ষ - পয়লা বৈশাখ। বাঙালির কাছে অত্যন্ত বিশিষ্ট এবং শুভ একটি দিন। গ্রামেগঞ্জে এইদিনে বাড়ির সামনে, দোরগোড়ায় কলকা দিয়ে আল্পনা আঁকা হয়ে থাকে। সমগ্র উঠোন পবিত্র করতে দেওয়া হয় গোবরের ছিটে। আরাধ্য দেবতাকে পুজো নিবেদন করার পর বাড়ি বাড়ি থেকে শঙ্খ কাঁসরঘণ্টার আওয়াজ ভেসে আসে। পয়লা বৈশাখ ব্যবসায়ীদের জন্যও এক বড় উৎসবের দিন। দোকানে দোকানে খোলা হয় হালখাতা অর্থাৎ নতুন খাতা। পুরনো বছরের বকেয়া শোধ করে দেয় খরিদ্দারেরা। সঙ্গে থাকে মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা। এসব ক্ষেত্রে আবার বড়দের থেকে ছোটদেরই আগ্রহ বেশি।

প্রত্যেক বাঙালির দৃঢ় বিশ্বাস, বছরের প্রথম দিনটি শুভ হলে গোটা বছরই ভালো যাবে। আর উৎসবপ্রিয় বাঙালির কাছে নববর্ষের গুরুত্ব থাকবে না, তা কি হয়! নতুন জামাকাপড় পরিধান করা থেকে শুরু করে বিশেষ বিশেষ পদ রান্নার মাধ্যমে মহাভোজ এবং বছরের প্রথম দিনে ঘরগুলোকে সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলা – প্রত্যেক বাড়ির দৃশ্য একই। সেই প্রসঙ্গেই আজকের বিশেষ নিবেদন নববর্ষের অন্দরসজ্জা।

পয়লা বৈশাখে ঘর সাজানো মানেই সেইসব জিনিস হতে হবে আমাদের খুবই কাছের, একেবারে নিজস্ব। তাতে থাকবে বাংলার ছোঁয়া। বিছানার চাদর, ঘরের পর্দা, টেবিলক্লথ, বাসনকোসন, দেওয়ালসজ্জা, ফুলদানি সবই পাবে বাংলার স্পর্শ। সে কারণেই গৃহসজ্জার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আপন হয়ে ধরা দেয় বেত, বাঁশ, হ্যান্ডলুম বা সুতির কাপড়, পাট, পোড়ামাটির জিনিসপত্র, এরকমই কিছু জিনিস।


 সকলেই আকাঙ্ক্ষা রাখেন বছরের প্রথম দিনটিকে রঙে রঙে ভরিয়ে তুলবেন। বিছানার চাদর, দরজা জানলার পর্দা, সোফার কভার, কুশন কভার, টেবিল ক্লথ এসবের ক্ষেত্রে অনায়াসেই ব্যবহার করা যায় বিভিন্ন রঙের খেশ অথবা খাদির ফেব্রিকের চাদর। বিছানার চাদরে কখনও মাছ, পাখি, হাতি, একতারা অথবা কলকার আদলে নানা রঙের বর্ণিল আমেজ চোখে পড়ে। বালিশের কভারে থাকে মাছ কিংবা কুলো অথবা বিছানার চাদরের সঙ্গে সেট হিসাবে একই জাতীয় নকশা। বসার ঘরের সোফার কভারের সঙ্গে মিলিয়ে মেঝেতে বিছানো যেতে পারে মানানসই শতরঞ্জি। ঘর সাজানোর ক্ষেত্রে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, কমলা এই রঙগুলোকে প্রাধান্য দিন বেশি। উজ্জ্বল রঙের ছোঁয়া মনকে করে তুলবে উৎসবমুখর।

সাধারণ সোফার পরিবর্তে বেতের সোফা রাখলে ঘরের সৌন্দর্য্যে একটি নান্দনিক মাত্রা যুক্ত হয়। এছাড়াও বাঁশ বা বেতের চেয়ার বা মোড়া সুন্দরভাবে মানানসই হয়ে যায়জায়গাও বেশি নেয় না। ঘরের কোণে ছোট একটি বেতের ওয়ার্ডরোব এনে দিতে পারে ভিন্ন আমেজ। সন্ধ্যেবেলায় বারান্দা-বাগানে বেতের চেয়ারে বসে কফি পান করতে করতে পছন্দের গান শুনলেই মনটা সতেজ হয়ে যাবে। বসার জিনিস ছাড়াও বেতের আয়না ঘরকে সৌন্দর্য্যমন্ডিত করে তোলে। এইসব আসবাবপত্রের মেরামতির ঝামেলা প্রায় নেই। বাঁধন খুলে গেলে আবার বাঁধিয়ে রং করিয়ে নিলেই নতুনের মতো হয়ে যায়। যত্নআত্তির কথা বলতে গেলে বেতের আসবাবপত্র সহজে ধোওয়া যায়, আবার রোদে শুকিয়েও নেওয়া যায়। বাঁশের আসবাব হলে শুকনো কাপড় দিয়ে অন্তত দুই দিন পরপর মুছতে হয়।

খাবারের টেবিলেও সমানভাবে বৈশাখের আমেজ বিদ্যমান। টেবিলের জন্য প্লাস্টিকের টেবিল ক্লথের পরিবর্তে ব্যবহার করা যায় সুতির কাপড়ের সুন্দর কলকা আঁকা টেবিল ক্লথ। প্রতিদিনের ব্যবহৃত খাবার প্লেটের পরিবর্তে তার স্থান নিতে পারে মাটির তৈরি প্লেট, গ্লাস অথবা খাবার পরিবশনের অন্যান্য সরঞ্জাম। রানারের ওপর রাখুন মাটির মোমদানি, বাঁশের গ্লাস স্ট্যান্ড। খাবার ঘর, বসার ঘর এবং অন্যান্য ঘরগুলোর ক্ষেত্রে জানলা দরজার পর্দা নির্বাচন করার সময় হালকা রঙকে প্রাধান্য দেওয়া উত্তম। বৈশাখের আবহাওয়ার সঙ্গে হালকা রং যেমন খুব সহজে মানিয়ে যায়, তেমনি ঘরের অন্যান্য সাজ হালকা রঙের জন্য খুব সহজেই ফুটে ওঠে।


পাট আমাদের নিজস্ব পণ্য। ঘর সাজাতে পাটের ব্যবহার বেশ ভালোরকমই পরিলক্ষিত হয়। বসার ঘরে সোফার সঙ্গে মিলিয়ে পাটের তৈরি কুশন কভার আর পর্দা বেছে নেওয়া যেতে পারে। মেঝেতে বিছানো থাকবে রঙিন কার্পেট ও ফ্লোরম্যাট। বসার ঘরের টেবিলের পাশে পাটের তৈরি ল্যাম্পশেড অথবা সেন্টার টেবিলের মাঝখানে পাট দিয়ে বানানো শোপিস রাখলে দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। সেই সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে যে ম্যাট বা রানার ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় থাকে, সেটিও পাটের হতে পারে। এই ম্যাটের মাঝখানে একটা মাটির পাত্র রাখলে তা অত্যন্ত নান্দনিক লাগে। দেওয়ালে ঝোলানো যায় পাটের তৈরি ওয়াল হ্যাঙ্গার, ছোটখাটো প্রয়োজনীয় জিনিস সেখানে রাখা যাবে। এছাড়াও ঘরে রাখা মাটির টবগুলো পাটের ব্যাগের কভার দিয়ে ঢেকে দেওয়া যেতে পারে। পাটের শিকায় ঝোলানো এক টুকরো সবুজ বসার ঘরে এনে দিতে পারে সতেজ ভাব।


নববর্ষের গৃহসজ্জায় মাটির তৈরি জিনিস থাকবে না তা কি হয়! কলকা আঁকা হ্যারিকেন বা মাটির কলসি বা কৃষ্ণনগরের পুতুল আমাদের ঘরে সহজেই জায়গা করে নেয়। অন্যান্য টুকিটাকি সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে বিষ্ণুপুরী ঘোড়া। বসার ঘরের টেবিল বা সোফার পাশে রাখা যায় মাটির তৈরি পুতুল, খেলনা, কলমদানি, মোমদানি, টেবিল ল্যাম্প অথবা ফুলদানি। এতে খুব সহজেই অতিথিদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। ঘরকে অতি সহজে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বিভিন্ন মাটির সামগ্রী যেমন পুতুল, ঢেঁকি, বাসন, সরা, পাত্র, বাহারি প্রতিকৃতি ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। মাটির তৈরী সুন্দর কোনো ওয়াল হ্যাঙ্গিং অথবা উইন্ড চাইমস ঘরের শোভা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও পোড়ামাটির তৈরি গাছের টব বা ফুলদানি বসার ঘরের শোভা বৃদ্ধি করে। টেরাকোটার পুতুল কিংবা ঘোড়া দিয়ে সাজিয়ে নেওয়া যায় টেবিল টপ। আভিজাত্য ফুটিয়ে তুলতে মূল দরজার সামনের ফ্রেমে মাটির টেরাকোটার ব্যবহার অত্যন্ত দৃষ্টিনান্দনিক। ওয়াল ডেকোরে ব্যবহার করা যায় টেরাকোটার মাটির পাত্র বা ছোট ছোট ওয়াল পিস। সিলিং সাজানোর জন্য রয়েছে পোড়ামাটির ব্লক, ঘন্টা এবং হাঁড়ি।

 

যেকোনো পুজোপার্বণে নানারকম মেলা তো লেগেই থাকে। আর সেখান থেকে ঝুড়ি কিনতে পাওয়াটাও পরিশ্রমসাধ্য নয়। এই রকমারি ঝুড়ি দিয়েই দারুণ ঘর সাজানো যায়। ঝুড়িগুলো সুন্দরভাবে সাজিয়ে ফেলুন দেওয়াল জুড়ে। ঝুড়ির বদলে ফ্রিল দেওয়া হাতপাখা দিয়েও দেওয়াল সাজাতে পারেন। এসব হাতপাখা বেশ বড় আকারের হয়, কাঠ ও কাপড়ের কম্বিনেশনে তৈরি। কখনও সখনও এর মাঝে আয়না থাকে যা দেয়ালের সৌন্দর্য্যবৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাতপাখাগুলো একটির সঙ্গে একটি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে না রেখে বড় থেকে ছোট আকারে একটি একটি করে পর্যায়ক্রমে সাজানো যায়।

 


পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে দেওয়ালসজ্জার অন্যতম উপকরণ নকশী কাঁথা যা বাঙালির বড়ো কাছের। সেই নকশী কাঁথা অথবা রঙিন সুতোয় নকশা করা কোনো কাপড় ফ্রেম করে আটকে দিন দেওয়ালে। সহজ এবং অভিনব। সনাতনী কোনো ওয়াল আর্টও টাঙিয়ে দেওয়া যায়। মধুবনী আর্ট, আদিবাসী ডিজাইনের ছবি অথবা ক্যানভাসের ছবি এনে দেয় সাবেকিয়ানার ছোঁয়া। আর আছে পটচিত্র। তালপাতা বা কাগজের ওপরে নক্সা করা এইসব পটচিত্র চিরাচরিত সেই চেনা ঘরকে অচেনা করে দেবে।

 


ঘরের সার্বিকভাবে সৌন্দর্য্যবৃদ্ধির জন্য ঘরটিকে পরিপাটি করে গুছিয়ে ছিমছাম রাখা একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটা দরজার সামনে অথবা বসার ঘরে বা ঠাকুরঘরে আঁকা যেতে পারে আলপনা। ইনডোর প্ল্যান্ট থাকলে কারুকার্য করা মাটির টব ভীষণভাবে উপযুক্ত। শুধু পয়লা বৈশাখের জন্যই নয়, সারাবছরের জন্য। ঘর সাজানোর অন্যান্য সরঞ্জামের সঙ্গে ব্যবহার করুন ছোট ছোট মাটির প্রদীপ, শোপিস হিসাবে কাঁসা বা পিতলের রিকশা বা অন্যকোন ভাস্কর্য। কলকা আঁকা মাটির ফুলদানিতে রাখুন কয়েকগুচ্ছ রজনীগন্ধা। ব্যস, আর কি! পয়লা বৈশাখের জন্য আপনার অন্দরমহল সম্পূর্ণভাবে তৈরি।


কলমে - গীতশ্রী ঘোষাল

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন