"অ্যাই,
অ্যাই, আবার এসেছিস তোরা? তোদের কতোবার বলেছি না আমার গাছ থেকে ফুল
তুলবি না! যা এক্ষুনি!"
হইহই করে ওঠেন নীলিমাদেবী।
অনেক শখ করে ফুলগাছগুলো লাগিয়েছিলেন। টগরগাছ, জবাগাছ, গোলাপগাছ, গাঁদাফুলগাছ, বাহারি পাতা, আরো বেশ কিছু। তবে সে অনেকদিন আগের কথা, এখন আর তেমন যত্ন করা হয়ে ওঠে না। গাছ গাছের মতো বেড়ে উঠছে। ঘাস বেড়ে গেলে আর আগাছা জন্মালে লোক ডাকিয়ে পরিষ্কার করিয়ে নেন।
বাড়িতে একাই থাকেন নীলিমাদেবী। ছেলে তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে দিল্লীনিবাসী, কর্মক্ষেত্র ওখানে। তাঁকে অনেকবার করে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছিল, কিন্তু তিনিই এখানকার মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেননি। যতোদিন চালিয়ে নিতে পারছেন কোনো সমস্যা নেই, শরীর বিগড়োলে নাহয় তখন দেখা যাবে।
আর সপ্তাহখানেক ধরে এই হয়েছে মুশকিল, ভোর হতে না হতেই সাত-আট বছরের দু'টো মেয়ে এসে তাঁর গাছের টগরফুলগুলো তুলে নিয়ে চলে যায়। যদিও গেটের ভেতরে ঢুকতে পারে না, বাইরে থেকেই যতটা যা পারা যায় নিয়ে নেয়। কিন্তু এমনটা নীলিমাদেবীর একান্তই অপছন্দ।
চাঁদের আলোয় মাঝেমধ্যেই বারান্দা থেকে বাইরেটা দেখেন, আলো হয়ে আছে তাঁর বাগানখানা। খুব ভালো লাগে দেখতে। আগের মতো আর পরিচর্যা করতে না পারলেও বেশ ক'দিন আগে একটা হলদে গোলাপের চারা পুঁতেছেন, ফুল ফুটবে কিনা কেজানে! অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন তিনি।
ক'দিন পরেই তাঁর নাতনির সাতবছরের জন্মদিন পালন হবে, নিজেদের মতো ঘরোয়াভাবে। ওরই বয়সি বেশ কয়েকজন বাচ্চাকে নিমন্ত্রণ করা হবে এমনটাই স্থির হয়ে আছে। সন্ধ্যাবেলায় ভিডিও কলে নীলিমাদেবী কথা বলায় মশগুল তাঁর নাতনির সঙ্গে।
"আচ্ছা ঠাম্মি, তুমি আমায় কি দেবে বার্থডেতে?"
"তুমি আগে এখানে এসো তো দিদিভাই, তারপর দেখবে কতকিছু দিই তোমায়।"
"বলো না কি দেবে?"
"আচ্ছা, আমি তোমায় দেবো হলুদরঙের গোলাপ।"
"হলুদ? কিন্তু গোলাপ তো রেড হয়!"
"ওটাই তো ম্যাজিক! আমার কাছে রেড ছাড়াও অন্য রঙের গোলাপ আছে।"
"আচ্ছা ঠাম্মি, তোমার কাছে আর কি কি ফ্লাওয়ার আছে?"
"সে অনেক আছে। গোলাপ, গাঁদা, টগর, নয়নতারা.."
"আমি যখন যাবো, তোমার সঙ্গে সকালবেলায় ফুল তুলবো।"
"হ্যাঁ, তুলবো তো। আমি আর তুমি একসঙ্গে।"
মুখে হাসি ফুটে ওঠে নীলিমাদেবীর।
সেদিন সন্ধ্যেবেলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানটা দেখতে দেখতে নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। তিনি আর তাঁর বান্ধবী ফুলি আর কুসুম একসঙ্গে ফুল তুলতে যেতেন ভোরবেলায়, শরৎকাল এলেই ছুটতেন শিউলিফুল কুড়োতে। বড়ো সুন্দর ছিল ছোটবেলাটা। তাঁর নাতনির কাছে এসবের আনন্দ অধরাই রয়ে গেলো!
পরদিন পয়লা বৈশাখ। ঠাকুরের সিংহাসন আর সেই সংলগ্ন জায়গাটা পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখলেন নীলিমাদেবী। কাল ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজাবেন। ঠাকুরের জন্য নৈবেদ্য ছাড়াও একটু পায়েস বানাবেন। তক্কে তক্কে থাকতে হবে, নয়তো সেই মেয়েদু'টো এসে গাছের সব ফুল তুলে নিয়ে চলে যাবে। তাঁর জন্য কিচ্ছুটি আর রাখবে না।
ভোরবেলায় যথারীতি মেয়েদু'টোর আগমন ঘটলো ফুল তুলতে। বারান্দায় গিয়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখতেই পেলেন নীলিমাদেবী। ধমকে উঠতে গিয়েও থেমে গেলেন। মেয়েদু'টোর হাসিমুখ দেখে হঠাৎই নাতনির মুখখানা তাঁর মনে পড়ে গেলো, সঙ্গে নিজের ছোটবেলাটাও। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের ফুল তোলা দেখতে লাগলেন তিনি।
এরই মধ্যে মেয়েদু'টোও ওনাকে দেখতে পেয়ে গেছে। যারপরনাই অবাক হলো। নীলিমাদেবী বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন, অথচ তাদের বকছেন না। বরং স্মিত হাসছেন। সব ফুল তুললো না ওরা, নীলিমাদেবীর জন্যও কিছু রেখে দিয়ে গেলো। নতুন বছরের প্রথম দিনে এভাবেই সূচনা হলো নতুন বন্ধুত্বের।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন