শিশুদের স্থুলতার সমস্যা

 



বর্তমান কালে ওজন বৃদ্ধি বা স্থুলতার সমস্যায় সারা বিশ্ব চিন্তান্বিত। স্থুলতার সমস্যা শুধুমাত্র যে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই দেখা যায় তা নয়।শিশুদের মধ্যেও এই সমস্যা বহুল পরিমানে বিস্তৃতি লাভ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(হু)-র একটি গবেষণা অনুসারে, ২০২০ সালে ৫ বছরের কমবয়সি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন স্থুলতার সমস্যায় আক্রান্ত বর্তমানে গৃহবন্দী জীবনে খেলাধুলার অভাব, বাজারজাত জাঙ্ক তথা তেল – চর্বিযুক্ত খাবারের প্রতি আসক্তি এই সমস্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।  

একজন শিশুর বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী যতটুকু ওজন থাকা দরকার, তার থেকে কোন শিশুর ওজন বেশি হলে সেই শিশুটি তখন স্থুলকায় বা obesity র শিকার বলে ধরা হয়। শিশুর স্থুলতা একটি গুরুতর শারীরিক সমস্যা যা শিশু এবং কিশোরদের প্রভাবিত করে।

শৈশবকালে শিশুর স্থুলত্ব বিভিন্ন সমস্যাসৃষ্টি করে এবং একটা সময় যখন তার বয়স বাড়তে থাকে তখন তারা স্থুলতাজনিত নানান ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে থাকে। শিশু ও কিশোরদের মধ্যে এই স্থুলতা দিনদিন বেড়েই চলছে। শিশুর স্থূলতার কারনে বিভিন্ন সময়ে তারা বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সন্মুখীন হয়ে থাকে।

ওবেসিটি বা স্থূলতার সমস্যা আছে কি না, তা বোঝার একমাত্র পদ্ধতি হল ‘বডি মাস ইনডেক্স’ বা বিএমআই নির্ধারণ করাসহজে বলতে গেলে স্থুলতা হল ক্যালোরি গ্রহন ও ক্যালোরি ব্যায় করার মধ্যে ভারসাম্যতাহীনতা।গৃহীত ক্যালোরির যদি প্রয়োজনীয় হারে ব্যয় না হয় তাহলেই একজন মানুষ স্থুলতার শিকার হয়ে থাকেন। বিএমআই হল মানুষের উচ্চতা ও ওজনের অনুপাত যার থেকে একজন মানুষের ওজন তাঁর উচ্চতা অনুযায়ী স্বাভাবিক হারে বর্তমান কিনা তা নির্দেশ করে।


কোনও শিশুর বিএমআই যদি ৩০-এর উপর থাকে,সেক্ষেত্রে ধরা যেতে পারে যে, সেই শিশু স্থূলতার সমস্যায় ভুগছে। ছোটবেলা থেকে ওবেসিটি গ্রাস করলে শরীরে বিপাক হার কমতে থাকে। ফলে ইনসুলিন সঠিক ভাবে কাজ করতে পারে না। টাইপ টু ডায়াবিটিস, পিসিওডি(পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম), হরমোনের ভারসাম্যহীনতার মতো নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে মেদবহুল চেহারা অনেক সময়েই একজন শিশুকে হাসির পাত্রে পরিণত করে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। ফলে আত্মবিশ্বাসের অভাব, অবসাদ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা প্রভৃতি থেকে শিশুকে আত্মহননের পথেও ঠেলে দেয়।

স্থুলতার কারণঃ

বংশানুক্রমিক ধারাঃ মা,বাবা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে মোটা হওয়ার প্রবণতা থাকলে শিশুরা মোটা হতে পারে।শৈশবে শিশুদের ওজন বেশি থাকলে পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ কিশোর অবস্থাতেও তারা মোটা হতে থাকে।

হরমোনজনিত কারণঃ শরীরে কোনো কোনো হরমোনের তারতম্য হলে শিশুরা স্থূল হতে পারে।সাধারণত থাইরয়েড প্রভৃতি বৃদ্ধিবর্ধক হরমোনের তারতম্যে শিশুদের ওজন বৃদ্ধি ঘটে থাকে। হাইপোথায়রয়েডিসম শিশুদের মধ্যে স্থুলতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে অন্যতম পরিচিত রোগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

পরিবেশগত কারণঃশিশুর জীবনযাত্রা যেমন: দৈনন্দিন কাজ, খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক শ্রম প্রভৃতিও একজন শিশুর ওজন বাড়ার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে।অধিকাংশ শিশুরা এখন মাঠে খেলাধুলার সুযোগ পায় না। টেলিভিশন, ভিডিও গেম আর কম্পিউটারে সময় কাটায়।পড়াশোনা বা খেলার জায়গার ও সাথীর অভাবের ফলেও তারা শারীরিক কসরত থেকে বিরত থাকে। স্বভাবতই গৃহীত ক্যালোরি ব্যয় হওয়ার রাস্তা থাকেনা।

অনেক শিশু বিশেষ করে আঁশযুক্ত খাবার, যেমন: শাকসবজি, ফলমূল খেতে চায় না বা তাদের মধ্যে সেই খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা হয়না ফলে ফাস্টফুড, চকলেট, কোমলপানীয়, ভাজাভুজি প্রভৃতির প্রতি তাদের আকর্ষণ তৈরি হয়। এই খাদ্যাভ্যাসের ফলে শিশুর শরীরে মেদ জমতে থাকে ও ওজন বৃদ্ধি করে। 

 

শিশুর স্থুলতার ফলে সৃষ্ট জটিলতাঃ

  • শৈশবে স্থুলত্ব বাচ্চাদের শারীরিক,সামাজিক, মানসিক দিক দিয়ে বিভিন্ন জটিলতার কারণ হয়ে দেখা দেয়। যেমন –
  • ডায়াবেটিস: এই দীর্ঘস্থায়ী অবস্থাটি একজন শিশুর রক্তে শর্করার (গ্লুকোজ) মাত্রাকে প্রভাবিত করে।
  • রক্তে কোলেস্টেলের মাত্রা বেড়ে যায়
  • উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা তৈরি করে।
  • অতিরিক্ত ওজন বা স্থুলকায় শিশুদের হাঁপানির সমস্যা দেখা দেয়।
  • ঘুমের সমস্যা :অতিরিক্ত ওজনের ফলে বাচ্চার শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যহত হয়, যা ঘুমের সমস্যা তৈরি করে
  • চর্বি জমে লিভারের স্থায়ী সমস্যা দেখা দেয়।অর্থাৎ ফ্যাটি লিভার অসুখে আক্রান্ত হয়।
  • অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি শিশুর হাড়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে হাড়ের বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করে।
  • শারীরিক সমস্যা ছাড়াও একজন স্থুল শিশুকে মানসিক ও সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
  • অতিরিক্ত ওজনের ফলে তাদের বন্ধুদের কাছে লাঞ্ছিত হতে হয়। ফলে আত্মবিশ্বাসের অভাবের সাথে সাথে অবসাদ, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ প্রভৃতি জটিল মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে।

 শিশুর স্থুলতা প্রতিরোধে করনীয়ঃ


  • তাই শিশু যাতে স্থূলতার শিকার না হয় তা দেখার দায়িত্ব বাবা-মায়ের। তা শিশুর স্থুলতা রোধের জন্য শারীরিক পরিশ্রমের সাথে সাথে দরকার শিশুর সঠিকমাত্রার স্বাস্থ্যকর  খাদ্যাভ্যাস
  • সদ্যজাত শিশুকে ছয় মাস পর্যন্ত স্তনদুগ্ধ দেওয়া বাধ্যতামুলকবাজারজাত কৌটার দুধ বা কৃত্রিম খাবার খেলে শিশু দ্রুত মোটা হয়ে যায়।
  • ছয়মাস পর থেকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় জল খাওয়ানো আবশ্যিক।একবছর বয়েস অবধি দিনে অন্তত এক থেকে দেড় লিটার জল খাওয়াতেই হবে।
  • ছয় মাস বয়স থেকে পরিবারের সাথে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে,যার মধ্যে অবশ্যই শাকসবজি, ফলমূল, ফাইবারযুক্ত খাবার,দানাশস্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
  • যদি শিশুর ওজন বাড়তে থাকে তাহলে ভাত,আলু,মিষ্টি কম পরিমাণে খেতে দিতে হবে
  • ফাস্টফুড, কোমলপানীয়,চকলেট, আইসক্রিম, চিপস প্রভৃতি কম খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।
  • শিশুর বিএমআই(BMI - Body mass index) খেয়াল রাখতে হবে। এতে বোঝা যাবে শিশুর ওজন কোন পর্যায়ে আছে। বা শিশুটি স্থূলতার শিকার কি না।
  • শিশুকে বাইরে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে। হাঁটাচলা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যয়াম করার সুযোগ করে দিতে হবে।
  • বাবা-মাকে সন্তানের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। তাদের ভালোকাজে উৎসাহ দিতে হবে।
  • শিশুরা টিভি দেখতে এবং ভিডিও গেমস খেলতে পছন্দ করে।কিন্তু চেষ্টা করতে হবে যেন শিশু খুব অল্প সময়ের জন্য এইসব খেলে।
  • নির্দিষ্ট সময় মেনে খেতে হবে এবং ঘুমোতে যেতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুমের ব্যবস্থা যেন অতি অবশ্যই থাকে।
  • অতিরিক্ত ওজন বেড়ে গেলে শিশুকে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী সারাদিনের প্রয়োজনীয় ক্যালোরির হিসাব করে খাবার খাওয়াতে হবে।

এছাড়া-
  • অনেক শিশুরাই আছে,যারা রাতে দেরিতে ঘুমায় আর সকালে ঘুম থেকে দেরী করে ওঠে অনেক পরে। এমন ঘটনা শিশুর জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।শিশুর যদি এমন সমস্যা থেকে থাকে,তাহলে তা বন্ধ করানোই শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য আবশ্যিক। তবে বাচ্চার যদি খুব বেশি দেরীতে ঘুমানোর অভ্যাস থাকে,আর তা পরিবর্তন করতে পরবর্তীতে বেশি অসুবিধা হয়,তাহলে বাচ্চার ঘুমের সময় আগের থেকে ১০-১৫ মিনিট করে এগিয়ে নিয়ে আসতে আসতে তাকে সময়মতো ঘুমানোতে সাহায্য করতে হবে
  • শিশুকে বেশি খাওয়ার প্রতি উৎসাহিত না করে,পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা বাবা-মায়ের দায়িত্ব। একটি শিশুর সঠিক খাদ্যভ্যাস শিশুর স্থূলতাকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। বাবা- মায়ের উচিত শিশুর পুষ্টি চাহিদা সম্পর্কে সচেতন হয়ে,শিশুর খাদ্যের এক তালিকা তৈরি করা, যেখানে প্রাধান্য পাবে স্বাস্থ্যকর পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার।
  • অনেক বাবা-মা কেই দেখা যায়, সব সময় তার শিশুকে খাইয়ে দিতে।সবসময় এমনটা না করে,কখনো কখনো শিশুকে তার নিজ হাতে খাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।শিশু যখন নিজ হাতে খাবার খাবে,তখন একদিকে যেমন সে তার ক্ষুধা অনুসারে চাহিদা মতো খাবার খাবে,অন্যদিকে সে নিজেকে স্বাবলম্বীও মনে করতে শিখবে।
  • অনেক শিশুকে খাবার বেটে বা জলে গুলে জোর করে খাওয়াতে হয়। এই প্রক্রিয়া বন্ধ করাই ভালো। শক্ত খাবার অল্প পরিমানে খেটে দিতে হবে। দাঁত দিয়ে চিবিয়ে খাবার খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করা উচিত। এর ফলে শিশুর পাচক উৎসেচক সমুহের স্বাভাবিক ক্ষরণ হবে এবং খাবার স্বাভাবিক হারে পাচিত হয়ে শরীরে মেদ বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করবে।
  • শিশুর স্থুলতা একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। শিশুর ওজন বেড়ে গেলে তা বাড়তেই থাকে। তাই শিশুর জীবন-যাপন পরিবর্তনে মা-বাবার সচেতনতাই শিশুর স্থুলতাকে প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।তাই সময় থাকতে শিশুর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে সচেতন হতে হবে। প্রতিটি সুস্থ শিশুই গড়ে তুলতে পারে একটি সুস্থ পরিবার ও দেশের ভিত্তি।


 কলমে - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন