পরপুরুষ - হাদী উল ইসলাম

 


কিছু খাওয়ামমতাজ উদ্দিন কলা ভবনের সামনে আসতেই বন্ধুরা প্রচন্ডভাবে চেপে ধরল। “মমি, যার জন্য গোটা ক্যাম্পাস পাগল সে তোকে দেখা করতে বলেছে আর খাওয়াবি না?” এক প্রকার জোর করেই মানিব্যাগ বের করে নিয়ে নিল চল্লিশ টাকা! সত্য কথা কি মমির প্রতি আমার ভালোবাসা শর্তহীন। ওর জন্য খুঁজে এনে দিতে পারি একশো আটটি নীল পদ্ম। দশ মিনিট আমার সাথে প্যরিস রোডে হাঁটলে আমি ভেসে বেড়াই মহাশূণ্যে।

ইদানিং সকালে নাস্তা করিনা। দুপুরের খাবার সবার আগে গিয়ে ভরপেট খাই। যাতে রাতের খাবার পর্যন্ত ভালোভাবে চলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলে দুপুরের খাবার আট টাকা আর রাতের খাবার সাত টাকা। কাজেই আমার কাছে এই চল্লিশ টাকা অত্যন্ত দামী। তিন দিন চলে যেত। বাড়ি হতে টাকা আনব সে সাধ্য আমার নাই। নিজের হাতে বাবার চেক অগ্রীম বিক্রি করে সাড়ে সাতশো টাকা লিখে সাতশো টাকা নিয়ে এসেছি।

তো আসছে! একদম অনুগতের মত দাঁড়িয়ে রইলাম।এই তুমি এখানে? কি সব আবোল তাবোল নোট সংগ্রহ করে দাও না, একদম বিশ্রীবাজখাই গলাতে মমি এক ঝারি মেরে উঠল আমার উপর।জামিল একটা ভালো নোট দিতে চেয়েছে, তুমি জামিলকে দেখেছ?” বলেই রিক্সায় উঠে জামিলের খোঁজে মমি চলে গেল।

অজয়ের চোখ ঈগলের চেয়েও তীক্ষ্ণ। যা ভেবেছিলাম তাই হল। দেখে ফেলেছে। কাঁধে হাত রেখে বললমামু ঝাড়ি তো বেশ খালি! সকালে খাসনি, এখন যা, দুপুরেরও না খেলে চলবে” “আর শোন একটু স্মার্ট ! ব্যাটা এক প্যান্ট পরে আর কত চলবি? কিন্তু ভালোবাসা তো এইসব মানেনা। মমিকে একদিন বলেছিলাম ভালোবসার কথা। থাক! সেটা আপনাদের আর না বলি! প্রত্যেকের এমন কতগুলো স্মৃতি আছে যা হৃদয় ধারন করে সারা জীবন।

মুকুলকে ইদানিং এড়িয়ে চলি। কিন্তু আজকে পারলামনা। জামার কলার ধরে মুষ্টি উঁচু করে বললশালা তোর জন্য জেলার বদনাম হচ্ছে। পিকনিকের চাঁদা দিস নাই ক্যান?দুহাত দিয়ে শক্তভাবে চেপে ধরল। আর এই সুযোগে আবদুল্লাহ মানি ব্যাগ থেকে বের করে নিয়ে নিল দেড়শ টাকা। বিকেলে বাপকে চিঠি লিখলাম ভীষন সুস্থ, ডাক্তার দুটো টেস্ট দিয়েছে।

থার্ড ইয়ারে মমির বিয়ে হয়ে গেল। ক্যাফেটেরিয়ায় সবার দাওয়াত। বিশাল ধনীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। ডিপার্টমেন্টের সবাই খেতে গিয়েছিলাম। শুনেছি প্রায় নাকি দশ হাজার টাকা খরচ করেছিল। ভাবলাম এই টাকা হলে আমার এক বছর চলে যেত! এই মানের ধনী আমি আজীবন হতে পারব কিনা সন্দেহ! কিন্তু সুন্দরী হবার বদৌলতে মমি এই ধনীর অংশী হয়ে গেল। আহ কপাল!
-------------


ষোল বছর পর আবার সবার দেখা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপার্টমেন্টের এলুমনাই। মাতা-পিতার দেহে আজ আমরা আবার কিশোর-কিশোরী। সবার মুখে আলাপ, দুটো কিশোরী মেয়ে রেখে অপরেশনের সময় লিটু মারা গেছে, আহ্ বড় ভালো বন্ধু ছিল লাঠি ভর দেয়া মুকুলকে দেখে বিশ্বাসই করতে পারলাম না আমার দেড়শ টাকা চাঁদার স্মৃতি। ঝুনু কে বললামবিয়ে কোনটা করেছিলি, তোরটা না খালু ঠিক করাটা?” প্রশ্ন শুনেই জিভ কেটে বলল ছেলেকে নিয়ে এসছি, ঠিকভাবে কথা বলিস।

খাজা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, “মমি তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়শুনেই সবাই হো হে হি হি করে হেসে উঠল। এই ষোল বছর পর আমার আর ভয়-ডর নাই। শান্ত গলায় জানতে চাইলাম কোথায়। খাজা জানালো টিপুর কাছ থেকে শুনেছে। একটু আগ্রহ জানাতেই শফিক বলে উঠল, ব্যাটা নিজের নিজের সংসার তো ভাঙ্গবেই, ওর টাও ভাঙ্গবে। চরিত্রহীন!

টিপুর কাছ থেকে মমির ফোন নং সংগ্রহ করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম নিরিবিলি রাতে ফোন দেব। আবার ভয় করছে যদি ওর স্বামী ফোন ধরে! মনে একটা উত্তেজনা কাজ করছে। মোবাইলে স্ক্রীনে একটি করে সংখ্যা উঠছে, আর আমার হৃদকম্পন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশেষে সেন্ড বাটন টিপলাম।

বেশ সুস্থ, তেমন কথা হলনা। ঠিকানাটাতো পেলাম। আরো নন্দের ব্যপার সত্যিই বাসায় আসতে বলল। হ্যাঁ, যেখানে বাস করে, দাপ্তরিক কাজে মাঝে মাঝে আমি সেখানে যাই। সত্যই আমি ওর সাথে দেখা করব।ওকে জানালাম।

 ------

আজকে ফোন করার চাইতেও বেশী উত্তেজনা কাজ করছে, কারণ প্রায় দেড় যুগ পর আজ ওর সাথে দেখা হবে। তিনবার ফোন দিলাম, ধরল না। ওকে আমার বিশ্বাস করাটাই ভুল হয়েছে। দেড় যুগ পর মনে হয় আবার অপমান করবে। সাহস নিয়ে আবার ফোন দিলাম। ওর মেয়েটা ফোন ধরে বলল, “অঙ্কেল হাসপাতালে আসেন। আম্মু হাসপাতালে আছে।কথা না বাড়িয়ে রিক্সাওয়ালাকে সোজা হাসপাতালে যেতে বললাম।

আশ্চর্য! একবার স্ট্রোক হওয়া সত্ত্বেও চেহারাটা প্রায় আগের মতই আছে। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়েছে, তাই এই অবস্থা। স্বামী কোনো খবর নেয়না, দু’টা সন্তান নিয়ে প্রচন্ড কষ্টে আছে। মাস্টার্সটা কমপ্লিট না করাতে প্রচন্ড দুঃখ প্রকাশ করল, কারণ এটা থাকলে কলেজে ঢোকা যেত। দেখতে পাচ্ছি চোখ দিয়ে ওর অশ্রু বের হচ্ছে। স্যালাইন দেবার জন্য হাতের যে যায়গায় সুঁচ ফুটানো হয়েছে, সেখানে কি সুন্দর রক্তিম হয়ে আছে। ইচ্ছে হল হাত দিয়ে চোখের জলটা মুছে দেই, আলতো করে ছুঁয়ে দেই হাতটা। নাহ! স্ট্রোকের রোগীকে বেশী আবেগ দিতে নাই। তাছাড়া সমাজের দৃস্টিতে হাজার হলেও আমি তো পরপুরুষ!

1 মন্তব্যসমূহ

  1. অনেক সুন্দর লিখেছেন ভাই , অডিও ফর্মে বানাতে পারেন, আমি Kabbik Audiobook এ বই শুনি ভালোই লাগে , https://kabbik.com/#/ এখানে দেখতে পারেন অডিওবুক টি

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন