বইয়ের নাম: দেও
লেখক: তমোঘ্ন নস্কর
প্রকাশক: অরণ্যমন
প্রকাশকাল – জানুয়ারি, ২০২১
অলংকরণ – ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৭৬
দেও বইটি অখন্ড উপন্যাস নয়।
২৩ টি ছোট গল্পের সংকলন। গল্পের বিষয় মূলত লৌকিক দেবদেবী, বিভিন্ন পারিবারিক লোকাচার ও লৌকিক সংস্কার
এবং এই সমস্তকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া উপকথা বা অলৌকিক ঘটনাসমূহ। গল্প বলার ধরণটি
আমার শৈশবের ফেলে আসা স্মৃতিকে তরতাজা করে দিল।গল্পে লেখকের বড় দাদামশাই
শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান, কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি
গল্পদাদুর আসর সাজিয়ে বসে এক এক করে গল্প বলে যান।গল্পগুলো হল –
শাস্ত্রীয় দেবতা অপেক্ষা লৌকিক দেবতারা প্রাচীনতর, তবে শাস্ত্রীয় দেবতা বা ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে বহু
লৌকিক দেবতার মৌলিক-রূপ, আদি-নাম পরিবর্তন ঘটেছে। এমন কি এইসব দেব-দেবী শাস্ত্রীয় বলে প্রচারিত
হয়েছেন। এই সকল শাস্ত্রীয়-কথিত দেবতার পূজার বা অনুষঙ্গাদি
অনুসন্ধান করলে ধরা যায় -এরা আদিতে কারা বা এঁদের প্রকৃত উত্থানরূপ কি। উদাহরণ
স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে রঙ্কিণী ও বীভৎস বাসলী দেবীকে।
রঙ্কিণী দেবী, ঘাটশিলার প্রাচীন রাজবংশের
কুলদেবী সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় বিধানে পূজিত হন, কিন্তু এঁর বিশেষ পূজার বিধির বীভৎস আকারগুলি অনুসন্ধানী
দৃষ্টিতে দেখলে ধরা যায় -ইনি আদিতে লৌকিক দেবী। বাসলী দেবীর নৈবেদ্য রূপে
দগ্ধ-মৎস্য দেওয়া শাস্ত্রীয় আচার হতে পারে না।শাস্ত্রীয়
দেবী বলে প্রচারিত ও শাস্ত্রীয় বিধানে পূজিত হলেও ইনি যে শাস্ত্রীয় দেবী নন তা
জানা যায়।এই রকমই বহু দেব – দেবীদের লৌকিক রূপের গল্প ও অলৌকিক শক্তির
কাহিনী নিয়ে এই বই লিখিত হয়েছে।
গল্পের দেব-দেবীরা বা অপদেবতারা মানুষের মধ্যেই মিশে আছেন।
মানুষের মতই কথা বলছেন। উপকার করছেন। অপকার করার চেষ্টা করছেন।বিভিন্ন বিশ্বাস মাথাচারা
দিয়ে ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করে উঠলেও তার থেকে রক্ষা করতে পুরোহিত বা গ্রামের প্রবীণরা
আলোকিত রাস্তা দেখিয়ে উদ্ধার করছেন।প্রতিষ্ঠিত দেব- দেবীদের ভিন্নরূপেও প্রতিষ্ঠিত
করা হয়েছে।ক্ষেত – খামার – পুকুর – তালবন সব নিয়ে নিস্তব্ধ গ্রামীণ সমাজ জীবন ও পরিবেশে গড়ে উঠেছে এই সকল গল্পের পটভূমি।এই সকল গল্প
অল্প ভয় ধরায়, অল্প অবাক করে, শিহরিত করে, ভালো লাগায় মন ভরিয়ে দেয়। বিশ্বাস – অবিশ্বাসের
মাঝে মন দুলতে থাকে বই পড়তে পড়তে। কিন্তু কখনও ক্লান্তি বা বিরক্তি আসেনা।এই সব কাহিনী
বাংলার এমন কিছু প্রায় হারিয়ে যাওয়া লৌকিক সত্যকে উদ্ঘাতিত করে যা কালের পরিক্রমায়
আজ ধূসরতায় মলিন। এই বই এক অজানা না চেনা ইতিহাসের সাথে পরিচয় ঘটায়। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর লেখা
"বাংলার লৌকিক দেবতা" বইটি
থেকে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়। তবে ‘দেও’ তে লেখক তমোঘ্ন নস্কর সহজ সরল সাবলীল
ভাষায় গল্পের ছলে বলা কথাগুলি পড়ার আকর্ষণ নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি করে। এই বইয়ের অন্যতম প্রাপ্তি
ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্যের অসাধারণ অলংকরণগুলি, গল্পে বর্ণিত বিমূর্ত ধারণাকে মূর্ত
করে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছে।অজানা দেব দেবীদের রূপ দান করে পাঠকদের
কল্পনায় নির্দিষ্ট রূপ দান করেছেন। শুধু বইয়ের বেশ কিছু ভুল বানান ও স্বল্প ভুল বাক্য গঠন গল্পের
গতিতে অল্প পরিমানে বিরক্তি উৎপন্ন করে।
চিকিৎসকের মুখ থেকে প্রাচীন দেব – দেবীদের অবৈজ্ঞানিক তন্ত্র মন্ত্র নির্ভর কাহিনী শুনে মনে দ্বন্ধ আসা স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু সময় গল্প কাহিনীকে বিচার বুদ্ধির বাইরে রেখে পড়লে রসস্বাদন করার মজাই আলাদা হয়। তাই আলোচনার শেষে শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বানের মতোই বলতে ইচ্ছে করে
"আমাদের পুঁথিপড়া
বিদ্যা দিয়ে এই বিশ্বাসগুলোকে ঠিক চেনাজানা খোপে ধরানো যায় না রে।"
কলমে - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন