দেখতে
দেখতে গ্রীষ্মকাল এসে গেল। প্রখর রোদ্দুরের তাপে ছোট থেকে বড় সকলেরই প্রাণ ওষ্ঠাগত।
অতিরিক্ত ঘামের ফলে শরীর জুড়ে ক্লান্তি। বড়রা যদিও বিভিন্ন উপায়ে নিজেদের কঠিন এই আবহাওয়ায়
মানিয়ে নিতে পারেন, সমস্যা হয় শিশুদের নিয়ে। বিশেষত এক বছরের কম বয়সী শিশুরা নিজেদের
অসুবিধার কথা জানাতেও পারে না। গরমে সঠিক পুষ্টি বজায় রাখার
জন্য এবং গ্রীষ্মকালীন বিভিন্ন রকম অসুখের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সঠিক পুষ্টি খুবই জরুরি। এই গরমে যে কোনো খাবারে অরুচি আসতেই পারে। তার
উপর অসুখ তো আছেই। তাই এই সময় শিশুকে কী খাওয়ানো উচিত তা নিয়ে বাবা-মায়ের চিন্তা
থেকেই যায়। তীব্র গরমে খাবার গ্রহনে অরুচি থাকা অবস্থাতেই
শিশুরা কখনো না বুঝেই খেয়ে নেয়
অস্বাস্থ্যকরভাবে তৈরি করা আইসক্রিম বা শরবত। এর ফলেই সর্দি, জ্বর, আমাশয় প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হতে থাকে। এইসব সমস্যা প্রতিরোধে মা-বাবাদের সচেতন থাকা একান্ত প্রয়োজন।
জন্মের পর থেকে পাঁচ
বছর পর্যন্ত শিশুকাল ধরা হয়। এই সময়েই শিশু সবচেয়ে দ্রুত বড় হয়। তাই প্রতি একক
ওজনের জন্য পুষ্টির চাহিদাও বাড়তে থাকে।এই সকল চাহিদা পূরনের জন্য দেহ গঠনকারী
খাদ্য উপাদান যেমন- প্রোটিন, আয়োডিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ইত্যাদি সঠিক পরিমাণে শিশুর খাবারের তালিকায়
থাকা জরুরি।এই ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার।
১। সহজে হজমযোগ্য খাবারঃ শিশুরা সারাক্ষণই
প্রায় প্রচুর ছোটাছুটি ও দৌড়াদৌড়ি করে।
ফলে অতিরিক্ত শারীরিক শ্রমের পর যে কোনো ভারি খাবার শিশুদের হজমে ব্যাঘাত ঘটায়।
এমনকি বমি বমি ভাবের সৃষ্টি করে। তাই অতিরিক্ত তেলের খাবার,
ভাজাপোড়া খাবার শিশুদের দেওয়া উচিত নয়। অতিরিক্ত তেল-মশলাদার খাবার বা বাজারজাত খাবারও না দেওয়াই উচিত। গ্রীষ্মে শিশুদের চিপস,
বাদাম, পাপড়, চানাচুর, চিকেন ফ্রাই ইত্যাদি না খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। বরং নরম, সুস্বাদু, ঘরে তৈরি খাবার যা সহজে হজম হয় সেগুলো শিশুকে দিতে হবে।
পুডিং,
সিদ্ধ নুডলস, নরম ভাত, মাছ, মুরগির মাংস, নরম সুজি, ঘরে
তৈরি ফলের জুস ইত্যাদি খাওয়ানো উচিত।
২। সময়ানুবর্তীতা মেনে চলা : গরমের সময় সঠিক পুষ্টি ও ক্যালরির চাহিদা বজায় রাখার
লক্ষ্যে সঠিক সময় মেনে খাবার খেতে হবে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাবারকে
৬/৭ টি ছোট খাবারে ভাগ করে নিতে হবে। সকাল ৭টা
থেকে ৮টার মধ্যে সকালের জলখাবার খেতে
হবে। দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে
দুপুরের খাবার খেতে হবে।বিকালে ৫টা থেকে ৬ টার মধ্যে সন্ধ্যাবেলার খাবার। রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে
রাতের খাবারের সময় বেঁধে রাখা ভালো। এরপর ভোরের দিকে, মধ্যসকাল এবং রাতে শোয়ার আগে শিশুকে হালকা খাবার, বিশেষ করে তরল খাবার দিতে হবে।
৩। খাবারে পরিমাণ নির্দিষ্ট করাঃ প্রতিবারের খাবারের পরিমাণ নির্দিষ্ট
করা দরকার। অল্প পরিমানে খাবার বারংবার খেলে তা সহজপাচ্য হয়। প্রত্যেক বয়সের জন্য নির্দিষ্ট
পরিমাণ খাবারই দেওয়া দরকার। শিশুর বয়স ও খাবারের পরিমাণ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। পরিমানের
তারতম্যে শিশুর স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। বেশি পরিমাণ খাবার যেমন বদহজম,
স্থূলতা জনিত সমস্যার সৃষ্টি করে, তেমনি
কম পরিমাণ খাবার অপুষ্টিজনিত সমস্যায় স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
৪। দুগ্ধজাত খাবারঃপ্রত্যেক
শিশুর জন্য দুধ একটি অত্যাবশ্যকীয় খাবার যা শিশুর শরীরে ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের যোগান
দেয়। কিন্তু গরমের সময় শিশুকে দুধ খাওয়ালে
অনেক শিশুর ক্ষেত্রেই তা হজমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। বদহজম হওয়ার সাথে
সাথে পেটের অন্যান্য সমস্যারও সৃষ্টি করে। তাই
গরমের সময় দুধের পরিবর্তে বাড়িতে তৈরি দই, ছানা ইত্যাদি দেওয়া
যেতে পারে। দইয়ের পাতলা ঘোল শিশুদের জন্য গরমে অত্যন্ত উপযোগী পানীয়।
৫। তাজা খাবারঃ গ্রীষ্মকালে শিশুদের তাজা খাবার খাওয়াতে হবে। কেননা এ সময় আমাশয়,কলেরা,
ফুড পয়জনিং বহুল
পরিমানে বৃদ্ধি পায়। এছাড়া
গরমে খাবারে দ্রুত পচন ধরে। তাই শিশুকে বাসী খাবার খাওয়ানোর পরিবর্তে তাজা টাটকা
খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে। গরমে শিশুর
খাদ্যতালিকায় হালকা, পুষ্টিকর, টাটকা
এবং সহজপ্রাপ্য খাবার রাখতে হবে। সেটা হতে পারে নরম খিচুড়ি বা সবজির স্যুপ বা ফল ও ফলের রস। তবে মাছ-মাংসও থাকতে পারে
পরিমিতভাবে। গরমের এই সময়টায় খাবার নষ্ট হওয়ার
আশঙ্কা খুব বেশি থাকে। তাই শিশুকে খাবার দেওয়ার আগে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিতে হবে,
খাবার আদৌ ঠিক আছে কি না।একদিনের রান্না করা খাবার ফ্রিজে
রেখেও শিশুকে অন্যদিন খাওয়ানো ঠিক নয়। অতিরিক্ত নুন মেশানো খাবার শিশুদের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া অতিরিক্ত মেয়োনিজ বা তৈলাক্ত
খাবারও গরমের সময় শিশুকে অসুস্থ করে তুলতে পারে।
৬। তাজা মরশুমি ফলঃ গরমে তরলের চাহিদা ও ভিটামিন মিনারেলের দৈনিক
চাহিদা পূরণে গ্রীষ্মকালীন বিভিন্ন ফল অত্যন্ত উপকারী
ভূমিকা গ্রহন করে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধ ও সংক্রমণের বিরুদ্ধেও ফল
কার্যকরী হয়। তাই এই সময় তরমুজ,
আম, লিচু, পাকা পেঁপে, জাম, কাঁঠাল,সবেদা, কলা ইত্যাদি
ফল শিশুদের জন্য বেশ উপকারী। তবে একেবারে খালি পেটে ফল না খাইয়ে দুপুরের দিকে
খাওয়ানো উচিত।
৭। পর্যাপ্ত তরল পানঃ অতিরিক্ত
গরমে স্বাভাবিক নিয়মেই শরীর থেকে বেশী পরিমানে ঘাম বের হয়। শিশুদের
ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমের ফলেও ঘাম বেশী হয়। ফলে শিশুদের
জল ও ইলেকট্রোলাইটসের ঘাটতি দেখা দেয়। অনেক শিশুকে
ডিহাইড্রেশন ও হিটস্ট্রোক নিয়েও হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখা যায়। তাই শিশু সারাদিনে জল ও তরল খাবার পরিমাণ মত পান করল কিনা সে বিষয়টি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা একান্ত জরুরী।প্রতিদিন বয়স অনুযায়ী
ন্যুনতম ১ লিটার থেকে ২/২.৫লিটার জল পান করা একান্ত আবশ্যক।অনেক সময়ই স্বাদহীন জল খেতে
শিশুরা আগ্রহী হয় না। সেক্ষেত্রে ডাবের জল, লেবুর জল, বিভিন্ন ফলের রস, দইয়ের ঘোল ইত্যাদি পান
করানো উচিত। এতে জলের ঘাটতি পূরণের সাথে সাথে পুষ্টির ঘাটতিরও
পূরণ হয়।
৮। মাতৃদুগ্ধঃ শিশুর বয়স যদি ছয় মাসের কম হয় তাহলে তাকে শুধু স্তনদুগ্ধ পান করাতে হবে। মনে রাখতে হবে, ছয় মাসের কম বয়সের শিশুকে আর কোনো খাবার দেওয়ার দরকার নেই,
এমনকি জল ও না। শিশুকে বারবার মাতৃদুগ্ধ দিতে হবে। এর মাধ্যমে শিশু তার সব প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেয়ে যাবে।
৯। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা খাবার বর্জনীয়ঃ গরমের সময় খুব স্বাভাবিক ভাবেই গরমের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার
জন্য ঠাণ্ডা পানীয়, আইস্ক্রিম, বরফ দেওয়া ফলের রস প্রভৃতি খাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
শিশুদের ক্ষেত্রে এইসব খাবার একান্তই বর্জন করা দরকার। ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার খাবারই
খাওয়ানো উচিত। ফ্রিজের খাবার বা পানীয় খাওয়ালে তার থেকে বিভিন্ন ভাইরাস বাহিত রোগে
আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে বিভিন্ন ধরণের জ্বর, গলার সংক্রমণ, জন্ডিস প্রভৃতি
রোগ হতে পারে। তাই এইসব খাবার খাওয়া থেকে শিশুকে বিরত রাখাই উচিত।
১০। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাঃ গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়ায় কীট পতঙ্গ, জীবাণু প্রভৃতির প্রকোপ
বৃদ্ধি পায়। তাই খাবার বানানোর সময় এবং খাওয়ার
সময় পরিষ্কার – পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা দরকার। জলের ক্ষেত্রেও যথা সম্ভব ফোটানো জল,
বা ভালো করে পরিশুদ্ধকৃত জলই শিশুকে পান করানো উচিত।
কলমে - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
চিত্রঃ সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন