ডায়াবেটিস অর্থাৎ মধুমেহ রোগটির সম্পূর্ণ নাম হল
ডায়াবেটিস মেলিটাস (Diabetes Mellitus) ।
গ্রিক ভাষা অনুযায়ী ডায়াবেটিস শব্দটির অর্থ হল প্রবাহমান
আর ল্যাটিন ভাষা অনুযায়ী মেলিটাস শব্দের অর্থ হল মিষ্টি। এই প্রকার নামকরণের কারণ-
ডায়াবেটিস রোগে রক্ত ও মূত্রে শর্করার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এই রোগের জন্য যে হরমোনটি দায়ী তার নাম হল ইনসুলিন।
ডায়াবেটিস তিনপ্রকারের হয় –
টাইপ ১ ডায়াবেটিস – এটা হল স্বতঃঅনাক্রম রোগ ( autoimmune disorder)। এর প্রভাবে শরীরের অনাক্রম্যতার দ্বারা অগ্ন্যাশয়ের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন উৎপন্ন হয়। তাই অগ্ন্যাশয় ক্ষতিগ্রস্ত হলে শরীরে ইনসুলিনের ঘাটতি দেখা যায় ও রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়।
টাইপ ২ ডায়াবেটিস – এটা সাধারণত সেইসময় দেখা যায় যখন আমাদের শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন সরবরাহ করতে পারে না। এটা কোন স্বতঃঅনাক্রম রোগ নয়।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস - গর্ভাবস্থায় অনেক সময় রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে যায় এবং তার সাথে ডায়াবেটিসের আনুষাঙ্গিক উপসর্গ দেখা যায়। একে বলে জেস্টেশানাল ডায়াবেটিস ( Gestational diabetes) বা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস দুপ্রকারের হয় –
A1 শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত গর্ভবতী মহিলারা খাদ্যসংযম ও শরীরচর্চার মাধ্যমে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন
A2 শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত গর্ভবতী মহিলাদের এই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ওষুধ ও ইনসুলিনের প্রয়োজন পড়ে।
শিশু জন্মের পর এই জেস্টেশানাল ডায়াবেটিসের প্রভাবে দূরীভূত হয়ে যায়। কিন্তু এই রোগের অনেক খারাপ ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকে গর্ভস্থ শিশুর উপর।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের কুপ্রভাব
- শিশুর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তবে গর্ভস্থ শিশুর রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কারণ গর্ভস্থ শিশু তার পুষ্টি মায়ের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে। শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ইনসুলিনের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়ে যায়। এরফলে শিশুর বৃদ্ধি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এরফলে শুধুমাত্র যে মায়ের কষ্ট বৃদ্ধি পায় তা নয়, বাচ্চা প্রসবের সময় মাকে বিভিন্ন রকম জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। এরকম ক্ষেত্রে অনেকসময় প্রসবের সুবিধার্থে সি-সেকশন পদ্ধতির দ্বারস্থ হতে হয়। তাছাড়া প্রসবের সময় কাঁধে অতিরিক্ত চাপের প্রভাবে শিশুর স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
- অকালপ্রসবের সম্ভাবনা
রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে অকালপ্রসবের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া শিশুর অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য অনেক ক্ষেত্রে অকালপ্রসবের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
- শ্বাসকষ্টের সমস্যা
ডায়াবেটিসের প্রভাবে যেসব শিশু নির্ধারিত সময়ের পূর্বে জন্মগ্রহণ করে তাদের ক্ষেত্রে রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিন্ড্রোম দেখা যায়। এর প্রভাবে শিশুর শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়।
- জন্মগত ত্রুটি
ডায়াবেটিসের প্রভাবে গর্ভস্থ শিশুর কিছু জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে। হৃদয় ও রক্তবাহিকা , মস্তিষ্ক ও সুষুম্নাকান্ড , বৃক্ক অর্থাৎ কিডনি এবং অন্যান্য অঙ্গে ত্রুটি পরিলক্ষিত হতে পারে
- হাইপোগ্লাইসিমিয়া
- শিশু মৃত্যু
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসকে যদি নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তবে
জন্মের আগে বা পরে শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস অনেক ক্ষেত্রেই উপসর্গের মাধ্যমে নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। নিয়মমাফিক পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে এটিকে শনাক্তকরণ করা হয়। তবে যে লক্ষণগুলি সাধারণত দেখা যায়। সেটি হল-
- সাধারণের থেকে বেশি মাত্রায় তেষ্টা পাওয়া।
- সবসময় খিদে পাওয়া এবং বেশি খাবার খেয়ে ফেলা ।
- প্রস্রাবের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের কারণঃ
ইনসুলিন একপ্রকার হরমোন। এটি রক্তে স্থিত শর্করাকে কোষে নিয়ে যেতে সহায়তা
করে এবং এটির সাহায্যে শর্করা বিপাক ক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। যখন
শর্করা কোষে প্রবেশ করতে পারে না এবং বিপাক ক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তিতে রূপান্তরিত
হতে অক্ষম হয়, তখন
রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলে।
গর্ভাবস্থায় অমরা বা প্লাসেন্টা শিশুর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়
পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহ করে। এই অমরা থেকে কিছু হরমোন নিঃসৃত হয়। এই
হরমোনগুলো যেমন ইস্ট্রোজেন, কর্টিসল ইত্যাদি ইনসুলিনকে কাজে বাধা দেয়। এরফলে গর্ভাবস্থার
অন্তিম পর্যায়ে রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
কাদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ?
- হৃদয় সংক্রান্ত কোন সমস্যা থাকলে
- উচ্চ রক্তচাপের উপস্থিতি
- গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস পূর্বে পরিবারের কোন সদস্যের দেখা দিলে
- পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম থাকলে
- পূর্বে শিশুর ওজন চার কেজি বা তার বেশি হলে
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিরাময়ের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। ডাক্তার রোগিনীর বয়স এবং আনুষঙ্গিক অসুবিধার কথা মাথায় রেখে চিকিৎসা শুরু করে থাকেন। সাধারণত যে পরামর্শগুলো ডাক্তার দেন সেগুলো হল-
- সঠিকভাবে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং কম শর্করাযুক্ত পানীয় ও জল গ্রহণ
- শরীরচর্চা
- রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা
- ইনসুলিন ইনজেকশনের প্রয়োগ
- রক্তে শর্করার মাত্রা কমে গেলে কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ সেবন করা
বর্তমানে ৮-৯ শতাংশ গর্ভবতী মহিলা এই গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের দ্বারা আক্রান্ত। তবে সঠিক
চিকিৎসা এবং ডাক্তারের নির্দেশিত পরামর্শ মেনে চললে এই রোগকে কাবু করা সম্ভব। আমাদের
সবসময় মনে রাখতে হবে –
“ সুস্থ শিশু হবে তখন
মা সুস্থ থাকবে যখন।।”
কলমে - সুকৃতি দাস
চিত্রঃ সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন