শিশুর বিকাশে নৈতিকতা

 

 


সকল শিক্ষা-প্রণালীর লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষ তৈয়ারী করা।” - স্বামী বিবেকানন্দ 

 

শিক্ষার অন‍্যতম উদ্দেশ‍্য হল - একজন সত্যিকারের মানুষ হওয়া, যেখানে প্রকৃত মানবিক গুণগুলি বজায় থাকবে। বুদ্ধিতে যা গ্রহণ করলাম, বাস্তব প্রয়োজনে জীবনে তা কাজে লাগাবার নামই শিক্ষা। 

 

স্বামীজীর কথায়,মাথায় কতকগুলি ভাব ঢুকাইয়া সারাজীবন হজম হইল না, অসম্বদ্ধভাবে মাথায় ঘুরিতে লাগিল, ইহাকে শিক্ষা বলে না। …বিভিন্ন ভাবগুলিকে এমনভাবে হজম করিয়া লইতে হইবে, যাহাতে আমাদের জীবন গঠিত হয়, যাহাতে মানুষ তৈয়ারী হয়, চরিত্র গঠিত হয়। যদি তোমরা পাঁচটি ভাব হজম করিয়া জীবন ও চরিত্র গঠন করিতে পার, তবে যে ব্যক্তি একখানা গোটা লাইব্রেরি মুখস্থ করিয়াছে, তাহার অপেক্ষাও তোমার অধিক শিক্ষা হইয়াছে বলিতে হইবে।সকল শিক্ষা-প্রণালীর লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষ তৈয়ারী করা।যাহা জনসাধারণকে জীবনসংগ্রামের উপকরণ জোগাইতে সহায়তা করে না, তাহাদের মধ্যে চরিত্রবল, লোকহিতৈষণা এবং সিংহের মত সাহস উদ্বুদ্ধ করিতে সহায়তা করে না, তাহা কি শিক্ষা নামের যোগ্য?” 

 

আমরা শিক্ষাকে 'মানুষ গড়া বা মানুষ তৈরির শিক্ষা (Man making education)' বলতে পারি। আর মানুষ হতে হলে আমাদের মধ্যে নৈতিকতা, কর্তব‍্যবোধ ও মূল‍্যবোধ থাকতে হবে। শিশুর সার্বিক বিকাশের জন‍্য এইগুলিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 


প্রথমে আমরা দেখব আমরা কেন মানুষের মতো মানুষ হতে পারি না!

প্রকৃত মানুষ হতে বাধা সৃষ্টিকারী 

বাঘকে তার ব‍্যাঘ্রত্বের জন‍্য চেষ্টা করতে হয় না, কিন্তু মানুষকে তার মনুষ্যত্বের জন‍্য চেষ্টা করতে হয়। প্রকৃত মানুষ হওয়া এত সোজা নয়। মহান মনীষীরা বার বার বলেছেন,'মানুষ হও!' নীচে আমরা মানুষ হতে বাধা সৃষ্টিকারী কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।  

আত্মকেন্দ্রিক ভাব

মানুষ সাধারণভাবে আরামপ্রিয় ও আনন্দের অভিলাষী হয়। সে সবসময় চায় তার আনন্দ চিরস্থায়ী হোক। কিন্তু তা হয় না। দুঃখ জীবনে আসে। তখন আমরা সবাই ভেঙে পড়ি। কেউ কেউ এত ভেঙে পড়ে যে জীবন শেষ করে দিতে চায়। আর এইসব কিছুই আসে 'আত্মকেন্দ্রিক' ভাব থেকে। আত্মকেন্দ্রিক ভাব যখন আমাদের পেয়ে বসে তখনই আমরা সমাজের কাছে ভীতির বস্তু হয়ে উঠি। 

যেমন : আত্মকেন্দ্রিক বিজ্ঞানী আমাদের সমাজের জন‍্য ক্ষতিকর। কারণ, সে সবকিছুতেই ব‍্যক্তিগত লাভ দেখবে। তাঁর লাভ, কিন্তু অন‍্যদের ক্ষতি। নিজের বুদ্ধির অপব‍্যবহার করে এমন কিছু আবিষ্কার করতে পারেন যা মানুষের জীবনে অকল্পনীয় দুঃখ ডেকে আনবে এবং শেষ পযর্ন্ত তিনি নিজেও তাঁর সর্বনাশা আবিষ্কারের স্বীকার হবেন। 

ক্ষুদ্র স্বার্থ :

মানুষের 'মানুষ' হয়ে ওঠার আর একটি অন‍্যতম বাধা হল 'ক্ষুদ্র স্বার্থ' 

মহান লক্ষ‍্যের অভাব :

জীবনের সামনে একটা মহত্তর লক্ষ‍্য থাকা চাই, এমন লক্ষ‍্য যা আমাদের ব‍্যক্তিত্বকে উন্নত করবে এবং সেই সঙ্গে অন‍্যের কল‍্যাণও। মহান লক্ষ‍্য না থাকলে ধনসম্পদ, ক্ষমতা এবং বৌদ্ধিক সামর্থ‍্য আমাদের তেমন কোনও কাজে আসে তো আসবেই না, বরং ওগুলি বোঝা হয়ে উঠবে। 

এরপর আলোচনা করব নীতিবোধ কী

নীতিবোধ (Morality) কাকে বলে এই সম্পর্কে নানা মানুষের নানা মত। আমরা বিতর্কে না ঢুকে সাধারণভাবে বলতে পারি,' ব‍্যক্তি ও সমাজের কল‍্যাণের জন‍্য কাঙ্ক্ষিত ও প্রত‍্যাশিত আচরণবলি অনুসরণ করাই হল 'নীতিবোধ'- এর পরিচয়। 

কোহেলবার্গের নৈতিক বিকাশের তত্ত্ব 

এল কোহেলবার্গ দীর্ঘদিন নৈতিক বিকাশের উপর গবেষণা করেন। এতদিন ধরে চলে আসা নৈতিক বিকাশের তত্ত্বের অসারতার কথা ব‍্যক্ত করেন। 

কোহেলবার্গ ও তাঁর সহযোগীগণ বিশ্বাস করতেন, নীতি বিষয়ক চিন্তন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিশুর সক্রিয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোহেলবার্গ নৈতিক বিকাশ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের জন‍্য শিশুদের সম্মুখে নৈতিক দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত বিষয় উপস্থাপন করে জিজ্ঞাসা করতেন -  এই পরিস্থিতিতে তারা কী করবে এবং কেন করবে। 

 উদাহরণ : 

( ক ) চুরি করা অন্যায় জানা সত্ত্বেও কেউ যদি অপরকে বাঁচানোর জন্য চুরি করে তাহলে সে কি অন্যায় করবে

( খ ) মিথ্যা কথা বলা মহাপাপ, কিন্তু সেই মিথ্যাতে যদি কোনো মানুষের জীবন বাঁচে তাহলে তা কী অন্যায়

শিশুর যুক্তির বিচার বিশ্লেষণ করে কোহেলবার্গ নৈতিক বিকাশের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। 

কোহেলবার্গ বলেছেন, শিশুদের নৈতিক বিকাশে জ্ঞানমূলক দ্বন্দ্বের ( Cognitive Dilemma ) বিশেষ ভূমিকা দেখা যায়। পরস্পরবিরোধী চিন্তা (Contradictory thoughts ) বা ব্যক্তির বিশ্বাসের সঙ্গে বাইরের পরিবেশে সংঘাতের ফলেই জ্ঞানমূলক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। 

যেমন - উপরের একটি মিথ্যা কথা বলার ফলে মানুষের জীবন বাঁচার উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। নীচে আর একটি অন‍্যভাবে দেওয়া হল - 

মিথ্যা কথা বলা পাপ এবং পাপের শাস্তি হয় - এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ব্যক্তি যখন দেখে, মিথ্যা কথা বলে কোনো কোনো ব্যক্তি লাভবান হয় তখনই তার মনে জ্ঞানমূলক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। 


 
নীতিবোধ এই জ্ঞানমূলক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে ব্যক্তির মধ্যে সাম্যবস্থা ( Equilibrium ) ফিরিয়ে আনে। এইজন্যই জ্ঞানমূলক দ্বন্দ্ব নৈতিক বিকাশের সহায়ক রূপে চিহ্নিত। 

 একটু সহজ ভাবে বলা যায়, জ্ঞানমূলক দ্বন্দ্ব এবং তার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সাম্যবস্থা বজায় রাখার প্রচেষ্টার ফলেই শিশুর নৈতিক বিকাশ ঘটে। 

নৈতিক বিকাশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ' ভূমিকা গ্রহণের ক্ষমতা' (Role taking activity) 

কোহেলবার্গের মতে, ভূমিকা গ্রহণের ক্ষমতা হল -  কোনো পরিস্থিতিতে অন্যের দৃষ্টি ভঙ্গির মর্যাদা দেওয়া ( Giving dignity to the vision of others ), অন্যের মতো করে দেখা এবং অন‍্যের মূল্যায়নকে বোঝা। 

তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তির ভূমিকা গ্রহণ করার ক্ষমতা (Role taking activity) বেশি এবং অন্যের মতামতকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারে তার নৈতিক বিকাশের সম্ভাবনা বেশি থাকে। 

কোহেলবার্গের মত অনুযায়ী নৈতিক বিকাশের তিনটি প্রধান উপাদান, যথা - 

১ ) জ্ঞানমূলক বিকাশ। 

২ ) জ্ঞানমূলক দ্বন্দ্ব। 

৩ ) ভূমিকা গ্রহণ করার ক্ষমতা। 

এই ৩টি উপাদান পরস্পর নির্ভরশীল এবং মিথস্ক্রিয়া ( Interaction ) সাপেক্ষ। 

জ্ঞানমূলক বিকাশ জ্ঞানমূলক দ্বন্দ্বের কারণ হয়, আবার এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর জন্য ব্যক্তির ভূমিকা গ্রহণের প্রয়োজন হয়। 

এই তিনটি উপাদানের মধ্যে জ্ঞানমূলক দ্বন্দ্বই  নৈতিক বিকাশের মূল নিয়ন্ত্রক। 

মাইকেল গ্রিন ( Michael Green ) এই তিনটি উপাদানের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা একটি মডেল এর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন 

কোহেলবার্গ নৈতিক বিকাশের তিনটি পর্যায় কথা উল্লেখ করেছেন। যথা - 

(ক) প্রাক্- প্রথাগত পর্যায় ( Pre- conventional Stage ) :

বয়স :  ৪ থেকে ১০ বছর। 

নিয়ন্ত্রণ :  এই পর্যায়ে শিশুর নৈতিক আচরণ সাধারণত স্বার্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। 

নৈতিক আচরণের কারণ : শাস্তি এড়ানো এবং ব‍্যক্তিগত সন্তুষ্টি আনা। 

ভালোমন্দ বিচার : এই পর্যায়ে জ্ঞানমূলক বিকাশ এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় না, যার দ্বারা শিশু নৈতিক ভালোমন্দ বিচার করতে পারে। 

এই পর্যায়ে দুটি স্তর দেখতে পাওয়া যায় 

প্রথম স্তর 

শাস্তি ও বাধ্যতা - শাস্তি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য শিশু অন্যের বাধ্য হয় এবং নিয়ম নীতি অনুসরণ করে। কোনো রকম নৈতিক বিচার দ্বারা প্রভাবিত হয় না। 

দ্বিতীয় স্তর 

ইচ্ছামতো আচরণ - কেবলমাত্র স্বার্থরক্ষার জন্য শিশু নিয়ম মেনে চলে। কেন সে নির্দিষ্ট আচরণ করবে তা সে বিচার করে না। অর্থাৎ নৈতিক বিকাশে আত্মকেন্দ্রিকতা দেখা যায়। কোহেলবার্গ এখানে বদলির নীতির কথা উল্লেখ করেছেন। 

যেমন -

১)  তুমি আমার খাতা ছিঁড়েছ, তাহলে আমি তোমার টেডি নষ্ট করে দেব বা পুতুল ভাঙব। 

২) আমার সাইকেল ব্যবহার করলে তোমার বিদ্যুৎচালিত খেলনা আমাকে দিতে হবে 

(খ ) প্রথাগত পর্যায় ( Conventional Stage ) : 

বয়স : ১০ বছর থেকে ১৩ বছর পযর্ন্ত। 

সমর্থন প্রত‍্যাশা : এই বয়সে বালক ব্যাক্তি উভয়ের কাছ থেকে সমর্থন প্রত্যাশা করে। 

সমাজের নিয়ম-নীতির সমর্থন : তারা শুধু সমাজের নিয়ম-নীতি মেনে চলে তাই নয় সমাজে নির্ধারিত আচরণের মানকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে। 

এই পর্যায়ে দুটি স্তর আছে 

তৃতীয় স্তর 

এই বয়সের বালকেরা অন্যের সমর্থন চায়। 

যেমন - 'ভালো ছেলে', 'সুবধ বালক' ইত্যাদি শুনতে চায়। অন‍্য ব‍্যক্তি তার আচরণ সম্পর্কে কী মনে করছি তার দ্বারা বালক নিচের আচরণ বিচার করে। 

চতুর্থ স্তর 

এই স্তরে নিয়ম নীতি প্রাধান্য পায়। আইন, সমাজ, ধর্ম নৈতিকতা আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই স্তরের বালকেরা আইনসংগত সমর্থিত আচরণ কর্তব্য বলে মনে করে। 

উত্তর প্রধানত পর্যায় ( Post - conventional Stage ) : 

বয়স : ১৩ বছর এবং তার বেশি। 

প্রকৃত নৈতিকতা : এই বয়সেই প্রকৃত নৈতিকতা দেখা যায়। 

অন‍্যদের উপর নির্ভর করে না : নীতিবোধ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ব্যক্তি অন্যদের উপর নির্ভর করে না। 

আস্থা : সুসংহত বিবেকের উপরেই সে আস্থা রাখে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।  

এই পর্যায়ে দুটি স্তর দেখা যায় 

পঞ্চম স্তুর 

নৈতিক বিকাশের এই স্তরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, নীতি-সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন‍্য ব্যাক্তি যুক্তির আশ্রয় নেয়।  আইন তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। সে জানে আইন সমগ্র সমাজ দ্বারা স্বীকৃত, তাই আইনকে সামনে রেখেই তার নৈতিক আচরণ প্রকাশ পায়। ব্যক্তির সঙ্গে যদি আইনের দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তাহলে সে আইন ভঙ্গ করে তার নিজের চাহিদা পূরণ করে না। সেক্ষেত্রে আইন পরিবর্তন করে সে চাহিদা পূরণ করবে। 

ষষ্ঠ স্তর

এই স্তরে নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির বিবেক খুব সক্রিয় হয়। কোনো আইন বা সামাজিক চুক্তি দ্বারা নয়, ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণ হয় তার বিবেকের দ্বারা। সকলের কল্যাণ হয় এমন আচরণ সে করে এবং নিচের আচরণে তা প্রকাশ ঘটায়। একেই সর্বজনীন নীতি বলে। কোহেলবার্গের মতে, অনেকেই এই স্তরে পৌঁছতে পারে না, কারণ এর জন্য প্রয়োজন উচ্চস্তরের বিমূর্ত চিন্তনের ( Abstract thinking )  ক্ষমতা। 

 

কোহেলবার্গ ( ১৯৮৪ ) নৈতিক বিকাশের প্রেক্ষিতে ব্যাক্তিদের দুটি ভাগে ভাগ করেছেন 

 

টাইপ -

  এই ধরনের ব্যক্তিদের নৈতিকতা নিয়ন্ত্রিত হয় কর্তৃত্ব ও নিয়মের (authority and rules) দ্বারা। 

 

   ব্যক্তির নীতিবোধের উপর আবেগের (emotion) ভূমিকা অধিক। 

টাইপ -

      এই ধরনের ব্যক্তিদের নৈতিকতা নির্ভর করে তাদের আদর্শ ও উন্নত বিবেকের (Ideal and advanced conscience) দ্বারা। 

 

ব্যক্তি নীতিবোধের উপর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার (Knowledge and wisdom) ভূমিকা বেশি। 

তাৎপর্য 

কোহেলবার্গের তত্ত্ব পড়ে নৈতিক বিকাশের এক নতুন ব্যাখ্যা পেলাম। 

নৈতিক বিকাশ প্রাক্ষোভিক বিকাশের উপর নির্ভরশীল নয় বরং তা প্রজ্ঞামূলক বিকাশের  উপর নির্ভর করে। 

এখানেই তাঁর অভিনবত্ব। ব্যক্তির বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞার বিকাশ নৈতিক বিকাশের পথ সুগম করে। নৈতিকতা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সঠিক নয়। প্রজ্ঞামূলক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক বিকাশে  স্বাভাবিকভাবেই ঘটে। 

পূর্বে  মনে করা হত, সামাজিক-ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া মধ্য দিয়েই ব্যক্তির নীতিবোধের বিকাশ ঘটে। কোহেলবার্গ বলেন, সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ব্যক্তির প্রজ্ঞার বিকাশ ঘটে, আর প্রজ্ঞার বিকাশ ব্যক্তির নৈতিক বিকাশকে সম্ভব করে তোলে। এই কারণেই ব্যক্তির পরিবেশে পার্থক্য হলেও নৈতিক স্তরগুলি একই থাকে। 

 নৈতিক বিকাশের জন্য শ্রেণীকক্ষের বাইরে বিভিন্ন সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলী

 বর্তমানে নৈতিক বিকাশের জন্য শ্রেণীকক্ষের বাইরে বিভিন্ন সহপাঠ্যক্রমিক কার্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু কোহেলবার্গ বলছেন, এর কোনো প্রয়োজন নেই পৃথকভাবে নৈতিক বিকাশ সম্ভব নয়। কৌশল হবে, শিক্ষার্থীদের প্রজ্ঞামূলক বিকাশকে সুসংহত করা (Consolidate) এবং ব্যক্তির যুক্তি ও চিন্তনকে সক্রিয় করে তোলা। 

 সমালোচনা

 সত‍্যতা : কোহেলবার্গ-এর নৈতিক বিকাশের তত্ত্ব সব শিশু এবং সব পরিস্থিতিতে সত্য কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 

 উদাহরণ হিসাবে বলা যায়

 শিশুদের নৈতিক বিকাশে পার্থক্যের উপর পিতা-মাতার ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে। 

যে সমস্ত পিতা-মাতা শিশুদের সঙ্গে নৈতিক বিষয়ে আলোচনা করেন তাঁদের সন্তানদের নৈতিক পরিণমন (Moral Consequences ) উন্নত স্তরের হয়। অন‍্যদিকে যেসব পিতা-মাতা শিশুদের কঠোর শাসনের মধ্যে রাখেন বা শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে শিশুর নৈতিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁদের সন্তানের নৈতিক পরিণমন তেমন উন্নত হয় না। 

ভারতীয় সমাজে নৈতিক বিকাশের জন‍্য পিতা-মাতার ভূমিকার সাথে পরিবারের বাকি সদস্যদের ভূমিকাও যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়। 

তবে এটা ঠিক শিশুদের জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেয়ে বুঝিয়ে বললে সেটা বেশি কাজ করে। আমরা বড়রা যদি নিজেদের জীবনের দিকে তাকায় তবেই তা স্পষ্ট বুঝতে পারব। 

বালক ও বালিকার মধ্যে পার্থক্য :  কোহেলবার্গ বালকদের নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। তাই তাঁর তত্ত্ব বালকদের উপরই প্রযোজ‍্য। বালিকাদের নিয়ে পরীক্ষা করেন নি। তাই বালকদের সমানই যে বালিকাদের নৈতিক বিকাশ হবে তা তাঁর তত্ত্ব থেকে জানা যায় না। পরবর্তীকালে দেখা গেছেনৈতিক বিকাশে বালক-বালিকাদের মধ্যে পার্থক্য আছে

নৈতিক বিকাশে পরিবারের ভূমিকা

উপরে কোহেলবার্গের তত্ত্ব ও তার সমালোচনা পড়ে আমরা অনেক কিছুই বুঝতে পারলাম। এটাও জানলাম নৈতিক বিকাশে পরিবারের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিকতার শিক্ষা প্রাথমিক ভাবে শিশুটি পরিবারের কাছ থেকেই পায়। 

কঠোর শাসনের দ্বারা জোর করে শিশুটির উপর চাপিয়ে দিলে সে অভ‍্যাসের বসে সব কিছু করে যাবে, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা হবে না। যখনই সেই শাসনকারী ব‍্যক্তির কাছ থেকে দূরে চলে যাবে তখনই শিশুটি সেইসব কিছু মানবে না। সে ভাববে, বন্ধ খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু যদি বিষয়ের গুরুত্ব ঠিকমতো বোঝানো হয় তবে সে ভিতর থেকে অনুভব করে কাজ করবে। 

নৈতিক বিকাশে শিক্ষকের ভূমিকা 

পরিবারের পর শিশুর জীবনে শিক্ষকের প্রভাব বেশি দেখা যায়। 

নৈতিক দ্বন্দ্বের অবসান কীভাবে ঘটানো যায় তা আলোচনা করবেন। একদম নীচু ক্লাসের শিক্ষার্থীদের উপর সামান‍্য কর্তত্ব প্রয়োগ করলেও উঁচু শ্রেণিতে আলোচনাই শ্রেষ্ঠ পথ। 

যেসব শিক্ষক নিজে কিছু মানেন না, অর্থাৎ যাঁর নিজেরই নৈতিক বিকাশ ঠিক করে হয় নি বা কর্কশ আচরণের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা দেন, শিক্ষার্থীরা তাঁদের দেওয়া নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করে না। তাই শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার আগে শিক্ষকদের নিজেদের সচেতন হতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের সাথে মধুর সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। তবেই সেই নৈতিক শিক্ষা ভালো ফল দেবে। 

নৈতিক দ্বন্দ্বের উপর আলোচনার সময় শিক্ষার্থীদের সেন্টিমেন্টের (Sentiment) দিকেও লক্ষ‍্য রাখতে হবে। কোনো শিক্ষার্থী যদি মানসিকভাবে আহত হয়, তবে তাকে সবার সামনে না বলে আলাদাভাবে ডেকে শিক্ষক আলোচনা করবেন এবং পরামর্শ দেবেন। সেইসময় শিক্ষার্থী যাতে ভয়হীন ভাবে নিজের সমস্যার কথা বলতে পারে তা বলতে হবে।  

পরে অন‍্য শিক্ষার্থীদের কাছে ঐ শিক্ষার্থীর সমস্যা আলোচনা থেকে শিক্ষকের বিরত থাকা উচিত। অনেক শিক্ষক বর্তমানে এই খারাপ কাজটি করে থাকেন। এতে সেই শিক্ষার্থীর বিশ্বাস ভেঙে যাবে এবং সে নৈতিক দ্বন্দ্বের সমাধান করতে চাইবে না। ফলে, ভুল মানুষের কাছে ভুল ভাবে নিজের দ্বন্দ্বের সমাধানের চেষ্টা করবে। তারফলে, সে ভুল পথেও চালিত হতে পারে। মোটকথা সার্বিকভাবে সমাজের ক্ষতি হবে। 

শিক্ষার অন‍্যতম লক্ষ‍্য হল - নৈতিক বিকাশ। এই নিয়ে দ্বন্দ্ব নেই। শিশুটির যাতে সঠিকভাবে নৈতিক বিকাশ হয় তা আমাদের দেখতে হবে। আজ যে শিশু আগামীকাল সে দেশের ভবিষ্যতের কান্ডারি - এটা মনে রাখতে হবে।



কলমে - সোমা লাই 


কৃতজ্ঞতা – ডঃ দেবাশিস পাল

চিত্র সৌজন্যঃ অন্তরজাল

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন