বৃষ্টির স্পর্শে রঙিন হয়ে উঠেছে চারিদিকের পরিবেশ। সামনের পুকুরের জলটা উপচে পড়ে রাস্তাটাকে একেবারে ভরিয়ে তুলেছে। এই এত পরিপূর্ণতার মাঝে সৌমির নিজেকে ভীষণ বিসদৃশ মনে হল। দশদিন আগে যাকে হারিয়েছে , তাকে হারানোর রিক্ততা যেন তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গে বিদ্যমান। এমনভাবে যে কাউকে হারানো যায় সেটা আগে অনুভব করেনি সৌমি। রাস্তায় থাকা গর্তের জন্য যেমন গাড়ির স্লথ হয়ে যায় তেমনভাবে তার মনে সৃষ্টি হওয়া শূন্যতা অবরুদ্ধ করে দিয়েছে তার জীবনের গতি।
অকস্মাৎ 'কুউকুউ' শব্দ তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করে তার ভাবনার জালকে
ছিন্নভিন্ন করে দিল। শব্দের উৎস লক্ষ্য করে বারান্দা থেকে দরজার সামনে গিয়ে
দাঁড়াল সৌমি। একটা কুকুর সাতখানা শাবক নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে তার দরজার কাছে।
তাদের কাঁপা শরীরগুলো দেখে, তার বড়ো মায়া হল । দরজা খুলে রেখে 'আতুতু'
শব্দে তাদের আহ্বান করে ঘরে নিয়ে আসল। সিঁড়ির তলায় চট পেতে দিয়ে ওদের থাকার
ব্যবস্থাও করে দিল। মা কুকুরের শীর্ণ দেহটা কষ্টে ধুঁকছে। বৃষ্টির জলে একেবারে
চুপসে গেছে সবাই।
মা কুকুরটা বড়ো অভাগী। হয়ত এই বর্ষার দিনে কিছু জোটেনি ওর। সৌমি
তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে এক থালা ভাত আর মাছ নিয়ে এল ওর জন্য। অনেকদিন এমন
সম্ভাষণ পায়নি মা কুকুরটা। তাই বিস্মিত চোখে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করল সৌমির মুখটা। তবুও ওর যেন বিশ্বাস হল
না ব্যাপারটা। তাই প্রথমে কুন্ঠা ভরে গন্ধ শুঁকল খাবারটার। তারপর জিভের ডগাটা আলগা
করে ছোঁয়াল। অবশেষে একবারে মুখটা ভাতের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে গোগ্রাসে তার স্বাদ
নিতে শুরু করল। ইতিমধ্যে তার সাতটা শাবক ঘিরে ধরেছে তাকে । চকচক শব্দে দুধ খাচ্ছে
তারা আর আনন্দের ছোঁয়ায় নেচে উঠছে তাদের লেজ। সৌমির মনে পড়ে গেল - তার ছেলেটা
বেঁচে থাকাকালীন অমন ছন্দেই পা নাড়িয়ে দুধ খেত। শিশুর আনন্দের তবে কোন বিভেদ হয়
না।
আলতো করে সে স্পর্শ করল একটা কুকুর
শাবককে। কুকুর শাবকটা তার হাতটা চেটে দিল যেন সে মমতার বিনিময়ে ভালোবাসা বিলিয়ে
দিল তাকে। সৌমির সামনের সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। তার সারা শরীর
কেঁপে উঠছে। এক অদ্ভুত পরিপূর্ণতার আনন্দ গ্রাস করছে তার মনকে। মনে মনে সৌমি ভাবল
- মাতৃত্ব বড়ো ছোঁয়াচে অনুভূতি নিমেষে যে কাউকে কাবু করে দেয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন