(১ )
আজ বড়ই আনন্দের দিন। তাড়াতাড়ি সকাল
সকাল ঘুম ভেঙেছে নির্মলার। ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা বানিয়ে নিল নিজের জন্য। চিনি
ছাড়া। বহুদিনের অভ্যেস। ডাক্তার কড়াকড়ি ভাবে মানা করে দিয়েছে। চিনি একদম
খাওয়া চলবে না। অগত্যা ! চা খেয়েই নিত্যদিনের অভ্যেস একটু হাঁটাহাঁটি করা। তারপর
চান করে ঠাকুরঘরে যাওয়া। আজ চান করে
ঠাকুরঘরে যাওয়া মাত্র মনটা যেন খুশিতে
ভরে উঠল। সাজিতে
রাখা ফুলগুলো উপচে পড়ছে। গোলাপ, জবা,
টগর আরো কত কি।
চন্দনচর্চিত ফুলগুলো ভগবানের পায়ে উৎসর্গ করছিল নির্মলা। তার অশ্রুসজল চোখ। কত কি
মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। কত স্মৃতি--- কত মধুর... কত বেদনাদায়ক। নাহ্! অত ভাবলে তার
চলবে না। একটু পরেই হসপিটালে যেতে হবে। ধীর মনে পুজোটা সারা দরকার।পুজো সেরে যখন
নির্মলা উঠবে তখনই অয়নের ডাক কানে এলো।
---- "চা কখন পাবো ?
(২)
----" চা কখন পাবো?"
---- "আসছি, এই নাও তোমার চা।"
হাসিমুখে নির্মলা সমীরের হাতে চায়ের
পেয়ালাটা তুলে দেয়।
--- " সময়মতো কি চা-টাও করে দিতে
পারো না? সারাটা দিন তো বাড়িতেই থাকো। কী এমন রাজকার্যটা কর শুনি। পায়ের ওপর
পা তুলে খাচ্ছ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার যদি করতে
তাহলে বুঝতে কত ধানে কত চাল।"
নির্মলার হাসিমুখে মেঘের ছায়া ঘনিয়ে
এলো। সত্যিই কি সে সারাটা দিন পায়ের ওপর পা তুলে রাখে? কিছুই কি সে করে না? সেই কখন ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে। তারপর
শুরু হয় রোজকার দিনলিপি। সংসারের কাজকর্ম,
রান্নাবান্না
সবই তো নির্মলার কাঁধে। হাসিমুখে নির্মলা সব করে। কোন কিছুতেই তার "রা" নেই। শাশুড়ির ঠাকুরঘরের ফাইফরমাশ খাটা, শ্বশুরের চটিজোড়া খুঁজে দেওয়া, স্বামীর হুকুম তামিল করা। পান থেকে চুন খসলেই নির্মলার গর্দান
আটকায় কার সাধ্যি! বাবা মায়ের একটি মাত্র সন্তান নির্মলা।
একটু টানাটানির সংসার হলেও বাবা- মা তাকে তা কোনোদিনও বুঝতে দেননি। ভালোবাসার
অভাব তাদের সংসারে কোনদিনই ছিল না। হেসেখেলে দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে বি.এ পাশ করল নির্মলা। মায়ের
শরীরটাও খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। মা চাইছিলেন নির্মলার বিয়েটা যেন তিনি দেখে
যেতে পারেন। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে অজিতেশ রায় এর সাথে নির্মলার বাবা সনাতন চৌধুরীর যোগাযোগ হয়। অজিতেশ
বাবু তাঁর ছেলে সমীরের জন্য তখন "সর্বগুণসম্পন্না" পাত্রী খুঁজছেন। একমাস কথাবার্তা চলার পর সমীরের সাথে
নির্মলার বিয়েটা হয়ে যায়। এর মাঝে অজিতেশ বাবু নির্মলার বাবার কাছ থেকে বেশ মোটা একখানা ব্যস্ত আদায় করে নিয়েছেন। মা - বাবাকে
চোখের জলে ভাসিয়ে নির্মলা পা বাড়ালো শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে। জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো নির্মলার স্বামী, শ্বশুর,
শাশুড়ি ও এক
অবিবাহিতা বড় ননদের সাথে। বউ বরণের সময়ই শাশুড়ির কড়া আদেশ, বছর ঘুরতেই রায়বাড়ীর উত্তরাধিকারী চাই। প্রথম যেন পুত্রসন্তানই হয়। মায়ের আদেশ পালন করতে সমীর বদ্ধপরিকর। ফুলসজ্জার রাতে একে অপরকে
চেনার আগেই সমীর নির্মলার শরীরে "উত্তরাধিকারীর" বীজ রোপণেই বেশী ব্যস্ত ছিল। সত্যিই! মায়ের যোগ্য পুত্রসন্তান সে। স্বামীকে কতটুকুই বা
পেত নির্মলা। সারাটা দিন খাটাখাটুনির পরও শ্বশুরবাড়ীর মন পেত না সে। শ্বশুরমশাই যদিও বা সাংসারিক কুটকাচালির
মধ্যে থাকতেন না, কিন্তু শাশুড়ি ও বড় ননদের গঞ্জনা ছিল
নির্মলার নিত্যদিনের সঙ্গী। সকাল থেকে রাত অবধি শুধুই চলত নির্মলার
বিভিন্ন কাজের খুঁত ধরার পর্ব যা সন্ধ্যাবেলায় সমীরের কর্ণগোচর হয়। সারাদিনের পর বাড়ি ফিরে এসে মা আর বড় দিদির বাক্যগুলো শুনে সমীর ধৈর্যহারা হতো। তার
ফলপ্রসূত: নির্মলার গায়ে মাঝে মাঝেই হাত ওঠা।
একবছর সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পরও যখন রায় পরিবারে উত্তরাধিকারী এলো না,
তখন যেন
অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে গেল।
মানসিক ও
শারীরিক অত্যাচারে বিপর্যস্ত নির্মলার জীবন। উঠতে বসতে "বাঁজা মেয়েমানুষ" শুনতে শুনতে নির্মলার প্রাণ ওষ্ঠাগত। প্রতিদিন রাতে সমীরের
জৈবিক চাহিদা মেটানোর পর নির্মলার বালিশ ভেসে যেত
চোখের জলে। দু'চোখ বেয়ে নামত অশ্রুধারা। কতরাত যে
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে চেয়ে থাকত তার ইয়ত্তা ছিল না। মা-বাবার কথা মনে পড়ত। মনে
হত একছুটে তাঁদের কাছে চলে যায়। সমাজের রক্তচক্ষুর কথা ভেবে নিজেকে আবার খোলসের মধ্যে গুটিয়ে নিত নির্মলা।
নিজেকে বড় অসহায় লাগতো। অপূর্ণ মনে হত। মাতৃসুখ কি তার কপালে নেই? সত্যিই তো স্বামী, শ্বশুরবাড়ির তার কাছে একটা চাহিদা থাকতে পারে। সে কি পেরেছে তাদের সেই সুখ দিতে? পারেনি। তাই তার এই শাস্তিই কাম্য। এইসব ভেবে নির্মলা নিজেকে নিজে শাস্তি দিত। দাঁতে দাঁত
চেপে লড়াই করে যেত। ভাবত কোনদিন হয়তো ঈশ্বর তার দিকে মুখ
তুলে চাইবেন। মা ততদিনে প্রায় শয্যা নিয়েছেন। যতটুকু কথা হয় নির্মলার সাথে, তা ফোনেই হয়। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এসে মেয়েকে চোখে দেখা তাঁর বোধহয় আর কপালে নেই। তাই এক রবিবারে
নির্মলার মা সনাতন বাবুকে পাঠালেন মেয়েকে দু'দিনের জন্য বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য। রবিবার জামাইও বাড়িতে থাকবে। অফিস ছুটি। তাই
সনাতন বাবু খুব
খুশিমনে বিকেল বিকেল তাঁর সাধ্যমতো দই মিষ্টি কিনে নির্মলার শ্বশুর বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা দিলেন। মনটা আজ বড় খুশি। কতদিন পর
মেয়েটাকে দেখবেন। ফোনে ভালো করে কথাই হয় না নির্মলার সাথে। শ্বশুর- শাশুড়ি বেশ রাশভারী লোক। নানা কথা
ভাবতে ভাবতে সনাতন বাবু যখন নির্মলার শ্বশুরবাড়ী পৌঁছলেন তখন বেলা বোধকরি চারটে
বাজে।
(৩)
----- নির্মলা, কোথায় রে মা?
নির্মলা তখন সারাদিনের পর ভাতের থালা
নিয়ে বসেছে। সাথে ডাল আর গতরাতের বাসী তরকারি।
---- মা রে , খেতে বসেছিস? এত বেলা হয়ে গেল এখনো খাসনি?
অশীতিপর বৃদ্ধ বাবার দিকে সজল নয়নে
তাকিয়ে রইল নির্মলা। তার মুখে কথা ফুটল না। পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল নির্মলার
শাশুড়ি মা।
----- কী, বেয়াই মশাই কী মনে করে?
---- নির্মলার কথা বড্ড মনে পড়ছিল। ওর মায়ের শরীরটাও বিশেষ ভালো নেই। তাই ওর মা চাইছিলেন মেয়েটা যাতে দু'টো দিন ওর কাছে
গিয়ে থাকে।
--- হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিয়ে যান আপনার মেয়েকে। যত তাড়াতাড়ি বিদায় হয় ততই মঙ্গল।
---- এ আপনি কি বলছেন বেয়ান?
আমার মেয়ে কি
এমন করেছে যে আপনি এসব কথা বলছেন?
ততক্ষনে স্বামী, শ্বশুর,
বড় ননদ সবাই এসে উপস্থিত হয়েছে সেখানে।
---- বলবো না তো কি করব?
আপনার মেয়ে
একটা অলক্ষ্মী, বাঁজা মেয়েমানুষ!
--- কি যা তা বলছেন?
---- যা তা বলছি?
জিজ্ঞেস করুন
আপনার মেয়েকে। সে কি পেরেছে আমার ছেলেকে সন্তানসুখ দিতে?
বাঁজা মেয়েমানুষটাকে এতদিন বাড়িতে পুষেছি, সেই অনেক। খাইয়েছি, পরিয়েছি, আর না। অনেক হয়েছে। একে নিয়ে যান। এবার আমি আমার ছেলের আবার বিয়ে দেব।
---- "সমীর, তোমারও কি তাই মনের কথা? "
সনাতনবাবু জামাইকে প্রশ্ন করলেন।
--- "আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে যান।"
অপমানে,
গ্লানিতে ধুলোয় মিশে যাচ্ছিল নির্মলা। ওইদিনটাই ছিল শ্বশুরবাড়িতে তার জীবনের শেষ দিন। নির্মলা
সেই এক কাপড়ে, অভুক্ত অবস্থায় বাবার হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করল।
( ৪)
হসপিটালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে নির্মলা আর
অয়নের আধঘন্টার মতো লেগে গেল। রাস্তায় প্রচুর যানজট। তীব্র নাজেহাল অবস্থা। তবুও
মনে হাজার তারার আলোকের আনন্দ। গাড়ি পার্কিং লটে রাখতে গেছে অয়ন। নির্মলা রিসেপশনে বসে
অপেক্ষা করছিল। অয়ন সমস্ত ফর্মালিটিস্ সেরে তবে তাকে নিয়ে নীনার ওয়ার্ডে যাবে। আশেপাশে রোগীদের আনাগোনা। আজ নীনা তার সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে।
নির্মলা বড়ই খুশি। খুশির পরশ আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। চোখেমুখে তার প্রকাশ। ঠিক তখনই
বহুদিনের একটা চেনা কন্ঠস্বরে তার আবেশ কাটলো।
---- "নির্মলা, তুমি এখানে?"
নির্মলা এক লহমায় পিছিয়ে গেল বেশ
কয়েকটা বছর। অপমানের, যন্ত্রণার আর মানসিক অবসাদের বছর।
সামনে দাঁড়িয়ে সমীর, "বন্ধ্যা" অপবাদে
বাড়ি থেকে বের
করে দিয়েছিল যে স্বামী। একই শহরে তো আছে দু'জনে বহুবছর। কই এতকাল তো দেখা হয়নি! আজ কি ভবিতব্য তাদের একসাথে নিয়ে এসেছে!
---- হ্যাঁ আমি। তুমি এখানে?...
হসপিটালে? ডাক্তার দেখাতে এসেছে নিশ্চয়ই!
--- হ্যাঁ,
তবে আমার জন্য
নয়। আমার স্ত্রীর জন্য।
.... বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা, মনে হলো অনন্তকালের। নীরবতা ভেঙে সমীরের প্রশ্ন।
---- "কেমন আছো তুমি?"
---- " ঈশ্বরের আশীর্বাদে ভালো আছি। ভালোই রেখেছেন তিনি।"
----- "জিজ্ঞেস করলে না তো আমি কেমন আছি।"
---- " ভালোই আছ নিশ্চয়ই পরিবার নিয়ে, সন্তান নিয়ে। ভগবানের আশীর্বাদে উত্তরাধিকারী নিশ্চয়ই পেয়েছ।"
---- না, না নির্মলা আমি ভালো নেই। তোমার প্রতি অন্যায়, অবিচার হওয়ার শাস্তি ঈশ্বর আমায় দিয়েছেন। যেই
সুখের আশায় তোমার ওপর আমি অবিচার করেছি, সেই সুখ আমার অধরাই রয়ে গেছে। মরীচিকার
মতো তাকে খুঁজতে খুঁজতে আমার স্ত্রী আজ মানসিক অবসাদের শিকার।"
কোন কথা কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। অতল জলে
হারিয়ে গেছে সব শব্দেরা।
তারপর..........
---- " তুমি বিয়ে করেছো নির্মলা?
তোমার স্বামী কী
করেন? কোথায় আছ এখন?"
নির্মলার অশ্রুসজল চোখে কত না বলা কথা। কিন্তু দৃপ্তকণ্ঠে তার
উত্তর...
----" না, সে ভুল আমি আর দ্বিতীয়বার করিনি। যেদিন অপমানিত হয়ে তোমাদের বাড়ি থেকে
বিতাড়িত হলাম তার কিছুদিন পরেই ডঃ সেন জানালেন আমার ইউরিন টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে।"
নিস্তব্ধতা.........
----"ম্যাডাম, মিঃ রায় আপনাকে কেবিনে যেতে বললেন। ওনার সমস্ত
ফর্মালিটিস কমপ্লিট হয়ে গেছে। আপনারা এবার মিসেস
রায়কে নিয়ে বাড়ি যেতে পারেন।"
নার্সের কথায় চিন্তার তরঙ্গের সুতো ছিঁড়ে গেল।
---- "আমার ছেলে অয়ন। অয়নদীপ রায়। চারদিন আগে ওর স্ত্রীর
পুত্রসন্তান হয়েছে। আমার উত্তরাধিকারী। আজ আমি আর অয়ন আমার পুত্রবধূ নীনা ও
নাতিকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছি।"
এই বলে নির্মলা ধীরপায়ে নীনার কেবিনের দিকে
এগিয়ে গেল। পেছনে পড়ে রইল "সমীর আর সমীরের অনুশোচনা"। সমীরের দৃষ্টি
ধেয়ে গেল নির্মলা তার সুখী পরিবারের দিকে। পুত্র- পুত্রবধূ ও কোলে তার হাজার তারার আলো.... নির্মলার নাতি।
তার উত্তরাধিকারী।।
চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন