বই - কলকাতা নুয়া (গোয়েন্দা কানাইচরণের
কাহিনী)
লেখক - রাজর্ষি দাশ ভৌমিক
প্রকাশকাল - নভেম্বর ২০১৯
প্রকাশক: বৈভাষিক (ভারত)
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৯৮ (প্রচ্ছদ সহ)
প্রচ্ছদ - রাজর্ষি দাশ ভৌমিক
প্রচ্ছদলিপি - অরিজিৎ গাঙ্গুলি
আমরা
সকলেই প্রায় রহস্য কাহিনীর ভক্ত। ব্যোমকেশ, ফেলুদা,কিরিটি থেকে শুরু করে ইদানিং কালের রুদ্রানী,অধিরাজ, গার্গী, শবর, মিতিনমাসি কেউই
ব্রাত্য নন। এই তালিকায় অন্যতম ও একটু পৃথক চরিত্রের গোয়েন্দা সংযোজন হলেন কলকাতা
পুলিশের একজন অফিসার কানাইচরণ।লেখক রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের সৃষ্ট এই গোয়েন্দা
চরিত্রের সাথে পাঠকের আলাপ হয় "কলকাতা নুয়া" বইয়ের মাধ্যমে।
কিন্তু এই গোয়েন্দা অন্যান্যদের থেকে পৃথক কোন জায়গায়?
একবিংশ শতাব্দীর পাঠককে যে কোন কিছু লিখে বোকা
বানানো অত সহজ নয়। পাঠক এখন অনেক বেশী সচেতন। হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বার করে যারা
বই পড়েন এবং কষ্টার্জিত টাকা খরচা করে যারা বই কেনেন তাঁরা সকলেই বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে
সম্পূর্ণ ওয়াকিবহল না হয়ে এগোন না। তাই গতে বাঁধা একই গল্প যেমন তেমন করে বলে দিলে
আজকাল বই কেউ ছুঁয়েও দেখেন না। এমনকি একই ধরণের গল্পও আজকাল কেউ পড়ার আগ্রহ দেখান না।
তাই সব ক্ষেত্রেই অভিনবত্য দাবী করা পাঠককূলকে এমন একটি বই লেখককে দিতে হয় যা পড়ার
জন্য তাঁরা মুখিয়ে থাকেন। এই জায়গায় লেখক সপ্তর্ষি দাশ ভৌমিক অনেকটা এগিয়ে গেছেন। প্রথমেই
তিনি নতুনত্ব এনেছেন চরিত্র রচনায় এবং অবশ্যই তাঁর সাথে গল্প রচনায় ও গল্প লেখার অভিনবত্ব
ধরে রাখার মুনশিয়ানায়।
এই রহস্য কাহিনীর গোয়েন্দা আমার আপনার মত দোষ-গুনে, ভুল-ঠিকে ভরা একজন সাধারণ মানুষ। অন্যান্য
গোয়েন্দা গল্পের গোয়েন্দাদের মত larger than life চরিত্র নন। একা হাতেই একদল গুন্ডাকে ধরাশায়ী
করে সমস্ত প্রক্রিয়াকে খুঁতহীনভাবে সমাপ্ত করে পাঠকের সামনে পেশ করেন না। তার
চেহারাও অত্যন্ত সাধারণ।গ্রীক দেবতাদের মত সুদর্শনও নন বা সিক্স প্যাক বানিয়ে - পেশী ফুলিয়ে মহিলা মহলে চমক
দেবার অযৌক্তিক চেষ্টাও করেননা।পাঁচজনের ভীড়ে মিশে থাকলে কেউ চিনতেও পারবেনা।
উর্দ্ধতনের কাছ থেকে বকুনি খান, শাস্তিও পান, নিজের ও নিজের বিভাগের অকর্মণ্যতা বা বিভাগীয়
সীমাবদ্ধতাকে সঙ্গী করেই কেসের সমাধান করতে চেষ্টা করেন। বাধা পেলে পিছিয়েও আসেন।
কিন্তু অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও তুখোড় বিশ্লেষণ ক্ষমতা দিয়ে জটিল রহস্যের শেষে
পৌঁছে অপরাধীকে চিহ্নিত করতে পারেন। এখানেই তিনি ব্যতিক্রমী। ঠিক যে তীক্ষ্ণ
বুদ্ধির সাহায্যে তথাকথিত বাস্তবের পুলিশ গোয়েন্দারা রহস্যের জাল ছিঁড়ে অপরাধীকে
ধরতে সক্ষম হন, ঠিক সেভাবেই।
কানাইচরণ লালবাজারের অভিজ্ঞ গোয়েন্দা, পদবীতে সিনিয়র ইন্সপেক্টর।মাথায় কোঁকড়ানো চুল, সাথে ঝোঁপালো গোঁফ। তার সঙ্গী জুনিয়র ইন্সপেক্টর
সৌভিক আর রেকর্ডস সেকশানের পৃথুলা দিদিমণি। দিদিমণির প্রতি তার কিঞ্চিৎ দুর্বলতা
আছে। যদিও তা কি ধরণের সেটা পুরোপুরি পরিষ্কার না।
তাই রহস্যের সাথে সাথে কলকাতা পুলিশের
প্রসিডেরাল সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট চিত্র আঁকা প্রয়োজন ছিল। পুলিশ প্রসিডেরাল
মানেই যে শুধু ফরেনসিক আর প্রযুক্তির লাফালাফি, অপরাধির পেছনে দৌড়ানো বা গুলি বন্দুকের মারামারি থাকবে, সেটা একেবারেই ভুল। খুব সম্ভবত প্রথম কেউ
মন দিয়ে পুলিশের রোজকার কাজকর্ম আর ডিপার্টমেন্টাল ক্রাইসিস নিয়ে লিখলেন। এমনকি পুলিশ বিভাগের বিভিন্ন ধরণের কূটকচালি থেকে
শুরু করে অনৈতিক কর্মকাণ্ডও এই বইয়ের অংশ হয়েছে। গোয়েন্দা গল্পের স্বর্ণযুগে একটা কথা
প্রচলিত ছিল - “the character and motives of the criminal should
be normal.” এই বইয়ের ক্ষেত্রে এই বাক্যবন্ধ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়েছে। অপরাধ করতে
গেলে যে সব সময় কোনো জটিল পশ্চাৎপট থাকতেই হবে এমন নয়। মানুষ খুব সাধারণ কারণেও অনেক
সময় অপরাধী হয়ে উঠতে পারে।
বইয়ে
তিনটি রহস্য গল্প আছে।
এক)
কালাপানির দিশা: সাসপেন্ড অবস্থায় সময় কাটানোর জন্য লালবাজারের
ক্রিমিনাল রেকর্ডস সেকশন থেকে অমীমাংসিত ফাইল চেয়ে সেই সব কেসের সমাধান করে
নিজেকে একটু অভ্যাসে রাখতে ব্যস্ত কানাইচরণকে অফিসের রেজিস্ট্রার একটি বহু
পুরোনো কেসের ফাইল দিলেন। সাজাপ্রাপ্ত এক বন্দিকে নিয়ে আন্দামানের উদ্দেশে রওনা
হওয়া একটা জাহাজ গন্তব্যে পৌছোয়নি। রেকর্ড বলছে, জাহাজটা মোহনার কাছে বালুচরে ধাক্কা খেয়ে
ডুবে গেছিল।ঘটনাটি স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ের। কিন্তু সেই অতীতের ঘটনায় বেশ কিছু
"কিন্তু" বর্তমানেও রহস্য তৈরি করে। আসলে কী হয়েছিল সেই সময়?
অসাধারণ
একটি গল্প। পুলিশের ধুলোমাখা ফাইলের থেকে কিভাবে সেই রহস্যের উন্মোচন ঘটল তা
সত্যিই রুদ্ধশ্বাস কাহিনী তৈরি করেছে।
দুই)
পাইস হোটেলে হত্যা: নিতান্ত নিরীহ, কোনোরকম সাতে-পাঁচে না থাকা সম্পুর্ন
সম্পর্কহীন দু'জন মানুষ হঠাৎ মারা গেলেন কলকাতার অখ্যাত গলির পাইস হোটেলে
খেতে-খেতে। আর কারো কিচ্ছু হয়নি। তারা দু'জন অতিরিক্ত কোনো খাবারও নেননি। টেবিলে আর
কেউ ছিলও না। তাহলে?
গোয়েন্দা
- পুলিশ কানাইচরণের তদন্ত কিছুটা এগিয়ে যখন অন্ধ গলিতে কপাল ঠুকছে, তখন
আবার একটা খুন হল। তাতেও সমস্ত কিছু আগেরটার মতোই। তবে কি কলকাতায় নতুন কোনো
সিরিয়াল কিলারের আবির্ভাব হয়েছে? কীভাবে সে খুনগুলো করছে?কে সেই
খুনী? কেনই বা
সে পাইস হোটেলে খেতে আসা সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে?
অত্যন্ত
চমকপ্রদ ও সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের ও ভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় লেখা এই গল্পটি
আমার সব থেকে ভালো লেগেছে। পাঠক রহস্যের শেষ বাক্যে পৌঁছনোর আগে বিন্দুমাত্র ধারণা
করতে পারবেন না কি হতে পারে।
(৩) চড়াই-হত্যা রহস্য: স্টোনম্যানই
কি একমাত্র সিরিয়াল কিলার কলকাতায়? শিষ্য
শৌভিক ও রেকর্ডস সেকশনের দিদিমণিকে কানাইচরণ জানালেন, হ্যাঁ, তবে
তারপরে কলকাতার কাছে কয়েকটা জেলায় একজন সিরিয়াল কিলারের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল।
সে একেকবারে পঞ্চাশ থেকে সত্তরটা করে খুন করেছিল— তবে মানুষ নয়, চড়ুইপাখি।প্রায়
কুড়ি বছর পুরোনো সেই তদন্তের কাহিনী কানাইচরণের গল্পে উঠে এলো আবার।এক
অদ্ভুত হত্যা রহস্য। যার সমাধানে লেগে গেছিল কয়েক বছর। হত্যার পিছনের কারণও বড়ই
আশ্চর্যজনক। মানুষ কখনো কখনো আদর্শবাদকে নিয়ে এত বেশী আবেগে ভেসে যান যে অপরাধকেও
নিজের সেই আদর্শের সাথে যুক্ত করে ফেলেন। এই গল্পও সেই মানসিকতার, সেই এক
কঠিন সময়ের ও পরিবর্তনের আদর্শে বিশ্বাসী অপরাধীর। কি ছিল সেই হত্যার কারণ?
টানটান
উত্তেজনায় ভরপুর এই বই এক নিঃশ্বাসে পড়ার মত ঠিক নয়, বরং ধীরে ধীরে বুঝে বুঝে এর রসস্বাদন করতে
হয়।কলকাতা নুয়ার লেখক রাজর্ষি দাশ ভৌমিক ওস্তাদ লিখিয়ে।লেখনী দুর্দার্ন্ত। নেশা
ধরানো। মসৃণ, সহজবোধ্য সাবলীল ভাষা। লেখায় খুব সূক্ষ হিউমার আছে
ভদ্রলোকের। পড়ে সাংঘাতিক ভালো লাগে।সব কটি গল্পই এক অন্য
মাত্রার ইন্টেলেকচুয়াল স্তরে নিয়ে গেছেন লেখক।
বইয়ের
প্রচ্ছদ ও মুদ্রণ অত্যন্ত সুন্দর রুচিশীল ও যথাযোগ্য। এককথায়, আগাগোড়া
চমৎকার। এই বইয়ের প্রথম দুটি গল্প লেখক একটি ব্লগ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন।পরে
বইয়ের আকারে প্রকাশ পায়। এই বই রহস্যপ্রেমী এবং মনস্তাত্বিক সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ
পছন্দ করা প্রত্যেক পাঠকের ভালো লাগার মত।
কলমে - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন