-- ও কালুর মা, এদিক পানে একটু আয় না! -- ক্ষীণ কন্ঠে শীর্ণকায় হারুন
ডাকে তার ২৫ বছরের বিয়ে করা বউ রুমেলাকে।
একেবারেই ঝুঁকে পড়া শরীর নিয়ে রুমেলা তক্তার সামনে এসে দাঁড়ায়
-- কি কইবে কও?
-- বলি কে যেন কইতাছিল করোনে মরলে সরকারে লাখ পাঁচেক টাকা দিবে?
খানিক চুপ থেকে রুমেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে -- জানিনে।
হারুনও চাপ দেয় -- দেখ না খোঁজ নে --
-- তুমার কি কাম আসবে, কও দিকি?
-- না, হ্যাঁরে আমার কি করোনা হতে পারে না?
-- ছিঃ ছিঃ এ আবার কেমন কথা?
-- তোরা দু'টো বাঁইচা যাবি--।
রুমেলা শতছিন্ন শাড়িতে মুখ ঢেকে সরে যায়।
সরে যায় বর্তমান। ফিরে আসে অতীত। হারুনের জীবনে অতীত বর্তমানকে
হারিয়ে দেয়। মনে পড়ে যায় অতীতের আশা মাখা দিনগুলোর কথা।
একদিন শহরে বৃষ্টিপাত হয়ে চলেছিলো সারাদিন।
হারুনের হাতে টানা রিক্সা এই সুযোগের অপেক্ষায় দিন গোনে। এই
যোগাযোগ কিছু বেশি কামানোর শুভ সময়। পাঁজিতে হয়তো বা এটা ওর শুভযোগ।
সময় ভাল না হয়ে খারাপ হয়ে গেল। এক দীন দুঃখিনী তার রিক্সায় চড়ে
বসলো। হারুনের আশঙ্কা ঠিকই ছিল -- ও ভাড়া দিতে পারবে না।
দু'-দু'বার নেমে যেতে বললো -- তুই কি ভাড়া দিবি?
-- কেনে দিব না? আগে রিক্সো উঠা! -- প্রায় অর্ডার করে মেয়েটি।
রেগে লাল হয় হারুন। তেড়ে যায় মেয়েটির দিকে।
-- এই মেয়ে নেমে আয় বলছি ---না হলে টেনে নামাই দিব।
-- নামা না দেখি তোর মুরদ কতো?
-- তবে রে মাগী -- বলে মেয়েটির হাত ধরে মরদের বাচ্ছা হারুন এক হ্যাঁচকা
টান মারে। মেয়েটি দুর্বল ছিল , একেবারে ছিটকে হারুনের পায়ের কাছে উল্টে পড়ে। থুতনি
কেটে যায়। রক্ত বেরোতে থাকে। রক্ত দেখলে হারুনের ভয় লাগে। হারুন বিপদে পড়ে। তাড়াতাড়ি
মেয়েটিকে তুলে ধরে। শীর্নকায়া মেয়েটি নেতিয়ে পড়ে হারুনের বুকে। রিক্সোর পাদানিতে বসিয়ে
দেয় সে। সীটের তলা থেকে প্লাস্টিকের জলের বোতল বার করে, তার মুখে চোখে জলের ঝাপটা মারে।
মেয়েটির জ্ঞান ছিল। বৃষ্টির জলে তারা দু'জনেই ভিজে চপচপে হয়ে যায়। কাঁপুনি লাগে। মেয়েটিকে
রিক্সোয় বসিয়ে হাতল ধরে টানা শুরু করে হারুন। উদ্দেশ্য নিজের ঘর।
বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটিকে গরম দুধ খাইয়ে চাঙ্গা করে হারুন।
মেয়েটি ক্ষুধার্ত ছিল। খানিক পরে নিজেকে সামাল দেয় সে। করুণ অথচ ক্ষীণ কন্ঠে জানতে
চায় -- আমাকে কেনে ধরলেন?
-- তুমার নাম কি আছে?
-- রুমেলা খাতুন। মোর কেউ লাই। মুই একা।
হারুন কি বলবে বুঝে উঠতে নারে। এই বৃষ্টির রেতে এ এক ঝেমেলা !
কি করে বার করে দেয়?
হারুনের বাসি ভাত ছিল। কাঠ জ্বালিয়ে গরম করে ওকে খেতে দেয়।
রুমেলা আপত্তি জানিয়েও, খেয়ে নেয়। পেটের জ্বালা যে বড় জ্বালা। লাজলজ্জার বালাই
গরীব দীনের ঘরে থাকতে পারে না। সেই রাত হারুনের তক্তায় তার রাত্রিযাপন হয়। হারুন
ভাংগা মেঝেতে শুয়ে থাকে। সারারাত শুধু ভাবে আগামীর চিন্তায়।
এরপর আর কথা নয়, কাজ শুরু করে হারুন দাস। লোককথা ভুলে
নিজের দায়িত্বে রুমেলার পথ্যের কাজে লেগে পড়ে। টানা বৃষ্টির দু'দিন রিক্সো না বের
করে রুমেলার জন্য প্রাণপাত করে সে। সেকি রুমেলাকে তবে ভালোবেসে ফেলেছে?
প্রশ্নটি তাকেও ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে।
রুমেলা সুস্থ হতে থাকে। হারুনের হাত ধরে ওঠে। চলাফেরা করে। আবার
ডূকরে কেঁদে ওঠে ভয়ে।
হারুনের কাঁধে মাথা রাখে, নির্ভরতায়। হারুন ওর মাথায় হাত বুলায়,
সাহস দিতে ওকে নিজের হাড় পাঁজর বার করা বুকে চেপে ধরে। রুমেলাও ওই বুকে কেঁদে
ভাসিয়ে দেয়। হারুন বোঝে রুমেলা বেশ ভালো, দেখতে একেবারে মন্দও নয়, বেশ ছিমছাম
শরীর।
এরপর? এরপর আর জীবন থেমে থাকে? প্রেম জীবনে জোয়ার
আনে, স্বাদ বদল ঘটে। দু'টি প্রানী একজন খাতুন, আর অন্যজন দাস পদবী, জাতপাতের কোন
বাঁধা হয় না। সমাজ জানে না, ধর্ম শোনে না, কোন নিয়ম ছাড়াই হারুন দাস, রিক্সোওয়ালা,
রুমেলা খাতুন, সহায়সম্বলহীনা, এক নারীর সিঁথিতে সিঁদুর চড়িয়ে দেয়। প্রকৃতি-পুরুষের
মিলন ঘটে।
সংসার জমে যায়। দু'বছর পর ওদের ফুটফুটে উত্তরাধিকার পুত্র কালু
জন্মায়। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবার। বেশ অভাবে আনন্দে চলছিল।
হঠাৎই শরীর খারাপ হয়ে পড়ে হারুনের, তবুও কষ্ট করে রিক্সো
টানছিলো, মাথার উপর বাজ ভেংগে পড়লো, করোনার ছোবল এই লকডাউনে। পুরো সময় বাড়িতে
বসে গেল। জমানো অল্প সম্বলে দু'দিন আর অপর্যাপ্ত ত্রানের সাহায্যে আরো কিছুদিন।
তারপর একেবারে বেহাল হয়ে পড়লো।
চিকিৎসা তো দূরের কথা, অন্য দু'জনের খাওয়ার পয়সাও জুটলো না।
বিনি পয়সার রেশন নতুন কার্ডের অভাবে, ছবি আর শোনা কথা হয়েই রইলো। মাথায় বাজ ভেঙে
পড়লো হারুনের। এখন মৃত্যুর ভয় আর ভয় নেই। এখন তাদের পরিবারের দৈন্য দশা তাকে ভয়
দেখাচ্ছে। পাঁচ বছরের পুত্র কালুর মাকে তাই ডাকে, মনে মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা চায়
অর্থের বিনিময়ে, যদি তার দায়িত্ব নেওয়া বউ রুমেলা আর কালুকে বাঁচাতে পারে।
চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন