যেখানে ভূতের ভয় - ভবতোষ নায়েক


 

সংখ্যায় তারা জনা দুয়েকের বেশী নয় অথচ তার তুলনায় কম কিছু নয়। গড়গড়ির মাঠে বসে থাকতে দেখা যায়। শেষ রাত্রির দিকে কোথা থেকে আসে আবার কোথায় চলে যায় কেউ জানে না। সম্ভবত দারুন তেজী কিছু সামাল দেওয়ার সময় হয়ে উঠে না, চোখের নিমিষে উধাও হয়ে যায় আবার। দূর থেকে দেখলে এক একজনকেই মনে হয় অনেকজন।  

   নিছক মিথ্যে নয়। প্রত্যক্ষদর্শীরাও স্বচক্ষে তাদের দেখেছে। সেবারে যাত্রাপালা শেষ করে মঙ্গল গড়গড়ির মাঠ দিয়ে আসছিল। চোখে তার তখনও যাত্রার নায়িকার অপূর্ব রূপ লেগেছিল। মাঠের শেষ প্রান্তে বড় বট গাছটির সামান্য কাছে আসতে – কি হয়েছে বুঝতে না বুঝতেই সব শেষ।

    দেখে বট গাছটির নিচে একটি বিকট কালো মূর্তি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। 

   চোখ মেললেও সহজে চৈতন্য আসে না। পা ফেলে পালাবার সময় পেলো না ধড়পড় করে মাটিতে পড়ে জ্ঞান এই হারাই সেই হারাই। জ্ঞান হারানোর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মঙ্গল অনুভব করেছিল, সেই কালো মূর্তি আর বুকের উপর পা চাপিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সেকি পা যেন মস্ত বড় ভারী পাথর তার বুকের উপর উঠে পড়েছিলো। এইসব কাণ্ড যখন ঘটছিলো তারই মধ্যে মঙ্গল শুনতে পেয়েছিল ঝপঝপ করে জল ফেলার শব্দ। তারপর সে রামরাম করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

মঙ্গলের বর্ণনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ তার বুকে ব্যথা গোটা সপ্তাহ ধরে বসে ছিল। প্রেতাত্মা ছাড়া কারো স্পর্শে এমন ব্যথা থাকে না।       

এমন নয় যে তাদের শুধু অম্যাবস্যার রাতে মিশমিশে কালো অন্ধকারে দেখা যায়। গত কোজাগারী পূর্ণিমার ফুটফুটে জ্যোৎস্নার মধ্যেও তাদের দেখা গিয়েছিলো। সেদিন সুকুমারের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো। সারাদিন হৈ হৈ ব্যাপার। সাঁঝ সন্ধ্যে কীর্তন গানের আসর বসে। রাতে সুকুমারের আত্মীয়রা পাত চেটে চেটে খেয়েছে। কেউ কেউ মন ভরে খেয়েছে। কিছুজন বেঁধে নিয়ে গেছে, অর্ধেক আত্মীয় থেকে গেছে গানের আসরের জন্য। সব মিলিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে নিতাই আর পঞ্চু বাড়ির উদ্দেশে যখন বেরল তখন রাত দুটো।           

নিতাই পঞ্চুর থেকে পাঁচ বছরের বড়ো, মাসতুতো ভাই পঞ্চু। খুব জেদ না ধরলে এই ঝামেলা পোহানোর কাজে নিতাইটাকে নিয়ে আসতো না। শীত সবে পড়েছে। গাঁয়ে চাদর দিয়ে ভাইয়ের সাথে নিতাই বাড়ির হাঁটা শুরু করে। মাথার উপর পূর্ণিমার ঝলমলে আলো তাই বাড়তি আলোর আর দরকার নেই। টর্চ পাজামার পকেটে পুরে হাতগুলো বগলচাপা করে চাঁদের মিটমিটে আলোর উপর ভর করে তারা হাঁটতে থাকে। নিতাইয়ের না চাইতে খাওয়াটা একটু বেশী হয়ে গেছে। কিন্তু না খেলেও নয়। এতো ভালভাল খাবার বিশেষ করে যখন ছাড়ার উপায় ছিল না। তাই খাদ্যগুলো একবারে পেটে ঢুকিয়ে দেওয়ার মতলব তার। খাবার শেষের পর ঘণ্টা দু’য়েক নিতাইয়ের নড়ার ক্ষমতা ছিল না। দেরিটা সেখানেই করে ফেলেছে। যদি নিতাই লম্বা লম্বা পা ফেলে তাড়াতাড়ি যাবার চেষ্টা করত তাহলে বেশী রাত হওয়ার আগে নদীর ঘাটে পৌঁছে যেত। খেয়াটাও ফসকে যেত না।

পঞ্চুর জন্য সব গণ্ডগোল হয়েছে। তার জন্য ছোট ছোট পা ফেলে এগোতে হছে এখন। গ্রাম সব বেরিয়ে এসছে তারা। দূর থেকে সুকুমারের বাড়ির গানের আওয়াজ হালকা চালে বাতাসে ভর করে তাদের কানে এসে পৌঁছচ্ছে। গ্রাম এখন পুরোপুরি ছাড়া হয়নি। গ্রাম থেকে বেরোনোর পর দু'টো বড় বড় মাঠ আসে। এটা নদীর ঘাটে যাবার পথে পড়ে, আরেকটি নদী পেরোনোর পর গড়গড়ির মাঠ। তারপর নিতাইয়ের গ্রাম।

নদীঘাট যাওয়ার আগে খোলা মাঠের পাশে আবার শ্মশান। নেমতন্ন বাড়ি যাবার পথে পঞ্চু আবার দেখেছিলো দুটো মড়া পোড়াচ্ছিল একসাথে। তবে হ্যাঁ, পঞ্চু ভূতপ্রেত একদম কেয়ার করে না। সাথে তার নিতাইদা রয়েছে।  

ধূ ধূ ফাঁকা মাঠে নেমে নিতাই পঞ্চুর দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে পকেট থেকে একটা ভাঙা বিড়ি বের করে দিব্য টান লাগায়। গলগল করে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করছে। নিতাইদা যে বিড়ি খাবার এতো উস্তাদ সেটা পঞ্চু জানত না।

অবশ্য পঞ্চু এই ব্যাপার যে কাউকে বলবে না সেটা নিজেই ঠিক করে নিয়েছে। এই ব্যপার কাউকে মুখ খুলে বলতে গেলে এই রাতে মাঠের মাঝে বিপদে পড়তে হবে। নিতাইদা তার মনোভাব ধরতে বেশী দেরি করবে না। হয়ত দেখা গেলো তার লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে আর তখন পঞ্চুর বেগ যাবে হারিয়ে, পেছনে পড়ে যাবে। সামনে আবার শ্মশানটা একটু একটু করে এগিয়ে আসছে।

অজান্তে পঞ্চু কেমন যেন নিতাইয়ের গা ঘেঁষে হাঁটতে থাকলো। দেখে মনে হয় দু’জনের যেন কতকালের প্রাণের বন্ধু। নিতাইয়ের জড়াজড়ি করে পথ চলতে ভালো লাগে না।

কি হল? ঠেলছিস কেন ?- পঞ্চু একটু সরে দাঁড়ায়।

পঞ্চু আবার গা ঘেঁষে আসে। কাঁপা গলায় বলে-‘চুপচাপ ভালো লাগে না, গল্পটল্প করো না নিতাইদা।’

পঞ্চুর শিহরণটা নিতাই টের পায়।

-‘গল্পটল্প আবার কি করব, এখন কি গল্প করার সময়! খেয়াটা যদি একবার ফসকে যায়। তুই কি ভূতের ভয় পাচ্ছিস নাকি?’

পঞ্চু কাঁপতে কাঁপতে নিতাইকে জড়িয়ে ধরে বলে-‘দোহাই নিতাইদা থামুন, আমাকে ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলার প্ল্যান আছে নাকি! এমনিতেই সামনে একটা শ্নশান’।

-মিছিমিছি ভয় করছিস কেন! ভয়ের কিছু নেই জানিস তো! ভয় না পেলে ভূত-প্রেত মানুষের কিছু করতে পারে না, আমি যখন সঙ্গে আছি’।

দেখতে দেখতে ঘাট এসে পৌছয়। কিন্তু নদীর ধারে পৌঁছে দেখা গেল ঘাট একদম ফাঁকা। চারিদিকে জনশূন্য। খেয়া নৌকাটি কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। মাঝি নৌকা নিয়ে ওপার গেছে; না খেতে গেছে; না রাতের মতো বিদায় নিয়েছে ভগবান জানে। ঘাটে আর তেমন বিশেষ কিছু নেই। ছোট একটা টিনের চালা চারিদিকে খোলা। চালার নিচে দাঁড়িয়ে দুজনের যে নিরুপায় হয়ে একটু চাওয়াচাওয়ি করবে তারও উপায়টুকু নেই। ঠাণ্ডা হাওয়া বেশ বইছে। জ্যোৎস্না আলোয় নদীর এপার ওপার ধূ ধূ ফাঁকা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

অস্পষ্টভাবে যতটুকু বেশ দেখা যাচ্ছে এতটুকু দেখা গেলে মনে হয়, গড়গড়ির মাঠের শেষপ্রান্তের আমগাছগুলি যেন তাদের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ার জন্য ওত পেতে বসে আছে। ঘাটের ডানদিকে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় জুড়ে শ্মশান। পোড়া কাঠ, মড়ার মাথা, ভাঙা কলসি, যদিও এই সকল চিহ্ন চালার নিচে থেকে চোখে পড়বে না। তবুও যার আগে থেকে জানা আছে তার অনুমান করে নিতে অসুবিধা হবে না যে ওই ফাঁকা জায়গাটাতে মড়া পোড়ান হয়। অদৃশ্য চিহ্নগুলি পঞ্চু অনায়াসে কল্পনা করে নিতে পারে।

-দাঁড়িয়ে থেকে লাভ হবে না, চল হেঁটে পেরোই। এমন একটি মর্মান্তিক কথা যখন পঞ্চুর কানে এলো তখন নিরুপায়, তার কিছু করার নেই। অথচ নিতাইদার কথা উড়িয়ে দিতে পারে না। 

রাত ক্রমেই বাড়ছে। নদীর জল কম। নৌকার জন্য অপেক্ষা করে বিশেষ কোন লাভ হবে না।

ঠাণ্ডা কনকনে জল, নিতাই লম্বা গড়ন চেহারা তার এক হাঁটু জল, কিন্তু পঞ্চু তার চাইতে ছোট তার কি হবে। নদীর জল তার কোমরে ছুঁয়েছে। তবুও পঞ্চু নিরুপায়। জানে কিছু বলতে গেলে খামখা ধমক খাবে সে। নদী পেরিয়ে গড়গড়ির মাঠে ওঠে তারা। পায়ে হাঁটা পথে সেখানে এলোমেলো ভাবে ছড়ানো ছোট ছোট ঝোপজঙ্গলের বুড়ো অশ্বত্থ গাছের পাশ দিয়ে যেখানে গ্রামের ঢুকছে, সেখানেই আসতেই তারা দু’জনেই চমকে উঠলো।   

পঞ্চুর চমকের পরিমাণ এতাই বেশী ছিল যে আর্তনাদ করে গোঙাতে শুরু করে দেয়। নিতাই জোয়ান মর্দ তার ভয় কিসের। কিন্তুর পঞ্চুর ভঙ্গিমায় সে ভিরমি খেতে বসেছিল নিজেকে সামলে নিতে সময় নিলো। 

তারা দেখে গাছের কোলে এক বিকট কালো মূর্তি তদের জন্য ওত পেতে বসে রয়েছে। এতদিনে পঞ্চু গড়গড়ির মাঠের নাম সম্পর্কে নানা কথা শুনে এসেছে। তার ফল কম বেশী দেখেছে। আজ পর্যন্ত যারা এদের খপ্পরে পড়েছে; তাদের দিন এইখানেই শেষ হয়েছে। আজ তাদের কি হবে। নির্ঘাৎ ঘাড় মটকিয়ে ছাড়বে।     

আচ্ছা, ঘাড় মটকাবার সময় কত ব্যাথা হয়? নিশ্চয়ই খুব। তা না হলে প্রাণে মারা যায় কেন!

কাঁদোকাঁদো ভাব পঞ্চুর চোখে মুখে। একি! তার মুষ্টিবন্ধ হাত নিতাইদা কোথায় টেনে নিয়ে যায়। তারা সড়সড়ে করে একটা গাছের আড়ালে এসে পড়ে। নিতাইদা পঞ্চুর ঘাম মাখা হাত ছাড়ার চেষ্টা করে। পঞ্চু ছাড়তে চায় না। হাত কেন ছাড়তে চাইছে। নিতাইদা তাকে ছেড়ে পালাবে নাকি? 

এদিকে নিতাই নাছোড়বান্দা পঞ্চুর হাত না ছাড়া পেতে দেখে এক ঝটকানিতে পঞ্চুর হাতের মুঠো থেকে হাত বের করিয়ে আনে, বুক পকেটে চালান দেয় টর্চ বের করার জন্য। 

উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠে-‘কে গো ওখানে?’

সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো কালো বসে থাকা মূর্তির উপর ফেলতে শুরু করল। 

আশ্চর্য, একি ! চেনা চেনা ভাব।   

গায়ের চাদর হাতে লাঠি, মাথার পিছনে টাক। এ তো আমাদের হারুনচাচা। কোথায় ছুটে পালাছে।

আলো গাছের গোড়ায় ফেলতে দেখে একঘটি জল, হারুনচাচা লজ্জায় সেখানেই ফেলে পালিয়েছে। অবাক হয়ে নিতাই আর পঞ্চু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে।

 

 চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন