একটু ভাতের জন্য - শুভ্রা ভট্টাচার্য



  
আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে একটু পোস্ট অফিসের কাজ নিয়ে বেরিয়েছিলাম। দিনটি এক অনন্য অভিজ্ঞতায় কাটলো। গ্রীষ্মের কাঠফাটা গরমের দুপুরে মাঠের ধার দিয়ে হেঁটে হেডপোস্ট অফিসের দিকে যাওয়ার পথে রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয় এক বছর ৪২-৪৫ এর মহিলার সাথে। হাঁটতে পারে না সে, প্রখর রোদে তেতে পোড়া মাটিতে ঘষতে ঘষতে খুব কষ্টে এগুচ্ছে, সম্বল বলতে একটা প্লাস্টিকের খালি বোতল আর হাতে কিছু খুচরো পয়সা। দেখে কেমন জানি মানুষটিকে ভদ্র ঘরের বলে মনে হলো। আমি দাঁড়িয়ে পড়ে কিছুক্ষন দেখার পর তার দিকে এগিয়ে গিয়ে খাবার ও টাকা দিতে চাইলাম। কিন্তু সে কিছুই নিতে চাইলো না প্রথমে। একটু অনুরোধ করায় ক্যাডবেরি নিল কিন্তু টাকা নিতে চাইলো না। বুঝলাম ঠেকে শিখেছে, আমি ওর নিরাপদ জোনে আছি কিনা সেটা দেখে নিচ্ছিল হয়তো। বললাম, "টাকা নেবে না কেনো?"

 সে বলে "ওই ভাইরা টাকা সব কেড়ে নেয়।"

 পাশেই আখের রস বিক্রি হচ্ছিল, দু'গ্লাস কিনে দিলাম। এক গ্লাস খেলো আর এক গ্লাস ওর বোতলে রেখে দিলাম। রসবিক্রেতাকে আমি টাকা দিতে গেলে মেয়েটি নিজের কাছে থাকা "১৮ টাকা নাও" বলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি বিস্ময়ে অবাক অভিভূত। বুঝলাম লেখাপড়া জানা মহিলা সে। তাই টাকার হিসাবও খুব জানে। জানতে চাইলাম "তুমি হাঁটতে পারো না কেনো?"

 বললো, "ওই ভাইরা মেরেছে তাই।"

 বললাম "কোন্ ভায়েরা?"

 সে বলে "ওইযে রাতের বেলা আসে খারাপ ভাইগুলো।"

 এরপর আর বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না সমাজের কোন অন্ধকারে ডুবে ও শোষিত নিপীড়িত। ধিক্ সমাজ! ধিক্ পুরুষ!! ওই অসহায় নিঃস্ব মানুষটিও তোমাদের খাদ্য খাদকের সম্পর্কে জড়িত! টাকাপয়সা শরীর সব চুষে নিতে হবে, সাহায্য করার পরিবর্তে!! এরপরও আমরা মেয়েরা নাকি স্বাধীন!! তীব্র রাগ ঘৃনা কষ্টে ভিতরটা গুলিয়ে উঠলো আমার!!

 তারপর দেখি এক বৃদ্ধ ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসে ১০ টাকা আমাকে দিলো। একজন সাহেবের গাড়ির ড্রাইভার হঠাৎ ওকে ১০০ টাকা দিতে এগিয়ে এলো। মেয়েটি টাকাটা না নিয়ে বললো, "আমি অত টাকা নেবো না, ওই টাকা ভাইরা আমাকে মেরে নিয়ে নেবে"। ওই ড্রাইভার তখন ওকে খাওয়ানোর জন্য আমার হাতে টাকাটা দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে চলে গেলো। "কি খাবে?" জানতে চাইলে করুণ চোখে বললো, "দুটো ভাত দেবে গো, ভাত?? কতদিন ভাত খাইনি।"

 আমি এদিক ওদিক খুঁজে ওই দুপুরে কাছাকাছি কোথায় ভাতের দোকান না পেয়ে কাছে একটা লুচি ঘুগনির দোকান দেখে ওকে এগিয়ে আসতে বললাম। সেই দয়ালু বৃদ্ধ তখন ওকে রাস্তা পার করে দিতে এগিয়ে এলো। মাঠের এক পাশে গুমটির দোকানটিতে খাবার কিনতে গিয়ে বাঁদিকের বেশ চাতাল করা বড়ো বসার জায়গার এক কোন এক বৃদ্ধার সাথে দেখা, সেও ওইখানেই রাতে পড়ে থাকে বুঝলাম। তাকে দেখেও খুব কষ্ট হলো, মনে হলো দু'জনকেই খাওয়াই। ওনাকে খাবেন কিনা জিজ্ঞাসা করতেই হাসিমুখে এগিয়ে এলো। তারপর ডিমের ওমলেট আর লুচি ঘুগনি কিনে দিলাম ওদের। মেয়েটি বলে হাত ভালো করে না ধুয়ে সে খাবে না। সানিটাইজার ও জল দিয়ে হাত ধুতে সাহায্য করলাম। তারপর হাতে খাবারটা তুলে দিতেই সে বলে "তুমি খাবে না? একটুখানি খাও তুমি?"

 আমি বিস্ময়ে থতমত খেয়ে গেলাম! এতো দারিদ্রতা এতো কষ্টের মাঝেও মন মনুষ্যত্ব কোনোটাই হারিয়ে যায়নি। আমি খেয়ে এসেছি বলাতে পরম তৃপ্তিতে সে খেতে থাকলো। আর আমি অবাক হয়ে শুধু ভাবতে লাগলাম এই মানুষটির এতো বিবেক মনুষ্যত্ববোধ, তবে তার জন্য কেন এমন পৈশাচিক কষ্ট! আর মনে মনে সংকল্প করলাম ওকে ভালো রাখতেই হবে। এরপর দু'জনকেই রাতের খাবারটাও দিয়ে দিলাম কিনে। দু'একটা ফটো তুলে বললাম, "পুলিশের সাহায্য নিয়ে তোমার জন্য আমরা কিছু করতে চাই, কাল সকালে আবার আসবো, তুমি এইখানেই বেদীর উপর থেকো।"

 চলে এলাম বটে, কিন্তু মেয়েটির অস্তিত্ব সমগ্র মন জুড়ে রয়ে গেলো। বাড়ি এসে স্নান করে ভাতের থালা সামনে নিয়ে বসতেই চোখ ফেটে জল এল। শুধু হৃদয়জুড়ে একটাই প্রতিধ্বনি, "একটু ভাত দেবে গো, কতো দিন ভাত খাইনি!"      


চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত  

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন