জীবনদীপ - সুদীপ ঘোষাল

 


  

অনিমেষ বোস বারান্দায় বসে আছেন। তাঁর দুই ছেলে, সবুজ ও বিজয়। সবুজ সরকারী চাকরি করে আর বিজয় লেখক। সে একটা প্রাইভেট স্কুলে কাজ করে। অনিমা সবুজের স্ত্রী তার রান্নার লোক আছে, কাজের মাসি আছে। বড়বৌমা অনিমা খুব মুখরা, কাউকে সম্মান দিতে জানে না।  সারাদিন মোবাইলে দিন কাটে অনিমার। সে খুব প্রাকটিক্যাল। একদম রোবোটিক। শ্বশুর শ্বাশুড়িকে পাত্তা দেয় না। কেউ কিছু বললেই তর্ক করে না-বুঝে, অথচ ছেলেরা মা বাবার সঙ্গে মুখ তুলে কথা বলেনি কোনোদিন। বিজয় বৌ নিয়ে কাটোয়ায় থাকে। তার সংসার সে নিজে বুঝে নেয়। তার স্ত্রী খুব ভালো। 

অনিমেষবাবু রাশভারি মানুষ। তিনি বুঝলেন, এখানে থাকা কষ্টকর। তাঁর কাজে ব্যাঘাত ঘটে। তিনি আর কবিতা দেবী কৃষ্ণমন্দিরের লাগোয়া ঘরে চলে গেলেন বড় ছেলেকে বলে ছোটো ছেলে দূরে শিক্ষকতা করে, সেখানেই ভাড়া নিয়ে আছেন তিনি অয়াদিপাউসের মত অনিমেষবাবু সত্যের অনুসন্ধান করেন, আজীবন করে এসেছেন। রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের সেবক তিনি চিরকাল আর কবিতা দেবী রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সংসারের কাজ করতেই তাঁর ভালো লাগে। পুরোহিত এলে একবার মন্দিরে যান, প্রসাদ আনেন ঘরে। স্বামীকে দিয়ে তারপর নিজে খান।

 

অবসর সময়ে কবিতা দেবীর মনে পড়ে পুরোনো কথা। আগে খুব মজা হত শ্বশুরবাড়িতে।  

সব জায়েরা একত্রে মিলিত হতো ননদ বা দেওরের বিয়েতে। একবার বাসু দেওরের বিয়েতে পুণ্যলক্ষী বৌদি ছেলে সেজেছিলো। প্যান্ট, জামা পরে চার্লি চ্যাপলিনের মতো একটা লাঠি নিয়ে অভিনয় করে চমকে দিয়েছিলে বিয়েবাড়িতে। সব জায়েরা প্যান্ট পরা ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে যখন ভাশুরদের সামনে দাঁড়ালো, মাথা লজ্জায় নিচু করেছিলো পুরুষদল। তখনকার দিনে এটা একটা ভীষণ সাহসের ব্যাপার ছিলো। অভিনয়ের শেষে যখন জানতে পারলো প্রকৃত ঘটনা তখন সকলে হাসাহাসি আর চিৎকার শুরু করলো। নতুন বৌ কবিতা বুঝতে পারতো একান্নবর্তী পরিবারের আনন্দ। বিয়ের শেষে যে যার চাকরীর জায়গায় চলে গেলে বাড়ি ফাঁকা লাগতো। কবিতার ভালো লাগতো না। স্বামী চলে যেতো চাকরীর জায়গায়। বাড়িতে মা, বাবা আর বেকার দেওরের দল। তারপর জলের ধর্মে যেকোনো পাত্রের আকার ধারণ করতো নতুন বৌ। বাবা মায়ের সেবা, দেওরের খাওয়া, রান্নাবান্না সব নজরে রাখতে হতো নতুন বৌকে। প্রাণমন ছটফট করতো বাপেরবাড়ি যাওয়ার জন্য। শ্বশুর, শ্বাশুড়িকে রাজী করে শর্ত মেনে যেতে হতো বাবার বাড়ি। তখন পুরোনো মাটির গন্ধে নতুন বৌ ভুলে যেতো সব না পাওয়ার দুঃখ। কিন্তু এখন পরিবারগুলো ভেঙ্গে টুকরো হয়ে গেছে। স্বার্থপরের মত নিজেরটা ছাড়া কিছুই বোঝে না। মা বাবার খোঁজ নেয় না। কিসের এত ব্যস্ততা! মনগুলো যান্ত্রিক হয়ে গেছে যন্ত্রযুগে। ছেলেদের জন্য খুব চিন্তা হয়

অনিমেষ বি.ডি.. অফিসে কাজ কর কাজের সূত্রে তাকে ঘুরে বেড়াতে হতো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। অনিমেষ ঝিনুকঘাটা স্টেশনে ট্রেন ধরত। কোনো কোনোদিন রাত হয়ে যেত। একদিন রাতে স্টেশনে বসে আছে। সামনেই একটা ঠান্ডা সরবতের স্টল। খুব গরম পড়েছে। অনিমেষ একটা স্প্রাইট কিনে পান করলো। ঠান্ডা সরবত খেয়ে শরীরটা বেশ শীতল হলো। ট্রেনটা লেট করছে। গ্রামে গ্রামে ঘোরার ফলে পরিচিতি একটু বেড়েছে। অনেকে কথাও বলছে। একজন বললো, কি ক্যাশিয়ার বাবু আজ রাত হলো কেন?

----আর বলবেন না। কাজ সারতে দেরী হয়ে গেলো।

----বেশি রাত করবেন না। আপনার কাছে তো টাকাপয়সা থাকে। এই জায়গাটা হলো ডাকাতের জায়গা। জামাইমারি আর ঝিনুকঘাটা এই দু'টো গ্রামের নাম মনে রাখবেন। আচ্ছা চলি।

অনিমেষ ভাবছে লোকটা জানে তার কাছে টাকা থাকে অফিসের। অনেক টাকা। ব্যাগটা চেপে ধরলো, তারপর স্টলের দোকানদারের সঙ্গে গল্প করতে লাগলো।

অনিমেষ  বললো, ভাই তুমি কখন বাড়ি যাও?

----এই ট্রেনটা চলে গেলেই যাব। আপনাকে একা ফেলে যাব না।

হঠাৎ একটা লম্বা ষন্ডা গোছের লোক ছুটে এসে ঠান্ডা সরবতের স্টলে বরফের ভেতর কি একটা ঢুকিয়ে রাখলো। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বললো, কে আপনি? অন্ধকারে বসে কেন?

দোকানদার বললো, ও আমাদের ক্যাশিয়ার বাবু গো। তুমি তো চেন?

 -----ও আপনি। তা এত রাত কেন??

----ট্রেনটা লেট করছে তাই

----- বসুন। আমি জলে হাত ধুয়ে আসি। আমি না আসা অবধি নড়বেন না।

অনিমেষ  লোকটার মুখে মদের গন্ধ পেলো, নেশা করেছে বোঝা গেলো। অনিমেষ ভয় পেলো।

অনিমেষ  বললো, ভাই দোকানদার তোমার দোকানে বরফের ভেতর কি রাখলো?

দোকানদার বললো,যতটুকু দেখলাম তাতে মনে হলো কোনো মেয়েছেলের সোনার গহনা ভরতি কাটা হাত। বরফের ভেতরে রাখলো, কাল কোনো সময়ে এসে নিয়ে যাবে।

অনিমেষের হার্টফেল হওয়ার মত অবস্থা। স্টলের লোকটা বললো, আপনাকে চেনে তো। আপনার ভয় নেই।

অনিমেষ ভাবলো অনেক টাকা সঙ্গে আছে। কি জানি কপালে কি আছে!

ট্রেনটা আসছে না। জানতে পারলো অনিমেষ, আজ ট্রেন তিন ঘন্টা লেটে আসছে।

স্টলের লোকটা বললো,আপনার তো পরের স্টেশনেই নেমে বাড়ি। আপনি মাঠে মাঠে হেঁটে চলে যান। ছয় কিলোমিটার রাস্তা। মাঠে মাঠে গেলে চার কিলোমিটার হবে।

অনিমেষ বললো, ঠিক বলেছো ভাই। আমি তবে যাই।

লোকটা বললো, খবরদার, ফন্টেকে বলে যাবেন। তা না হলে সব কেড়ে নেবে।

হনহন করে হেঁটে ফন্টে এলো। বললো, বাঃ, আপনি তো খুব ভালো লোক। এখনও বসে আছেন?

অনিমেষ বললো,আপনার সঙ্গে দেখা করে যাবো বলে বসে আছি। ট্রেন অনেক লেটে আসছে। মাঠে মাঠে যাবো। যদি আপনি অভয় দেন।

----হুঁ, সঙ্গে ব্যাগ আছে। টর্চ আছে দেখছি। আমার তিন ব্যাটারির টর্চটা নিন। আর আপনারটা আমাকে দিন। আমার টর্চে নীল ফোকাস আছে। সবাই চেনে এই আলো। কেউ আটকালে শুধু টর্চ জ্বালবেন। কথা বলবেন না। যান কোনো ভয় নাই আপনার। আমি এই দোকানে দু'দিন পরে টর্চ নিয়ে নেব। আপনি আমার টর্চ এই দোকানেই রাখবেন।

অনিমেষ বললো, আপনাকে নমস্কার জানাই। আমার অনেক উপকার করলেন। তা না হলে আজ বাড়ি যেতে পারতাম না।

কোনোরকমে কথা বলে অনিমেষ টর্চ নিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে এলো মাঠ পেরিয়ে পুকুরপাড়ে। এবার নির্ভয়ে সে একটু বিশ্রাম নিতে বসেছে, এমনসময় হেঁড়ে গলায় একটা লোক বললো, কে রে? ব্যাগ রেখে এখানে বসে পড়লি!

অনিমেষের মনে আছে কথাবলা যাবে না। উত্তরে টর্চ জ্বাললো। টর্চের আলো দেখে ওরা ভয়ে পালালো। বললো, পালা পালা। এ তো ফাটা ফন্টের লোক। 

অনিমেষের জল পান করে বীরবিক্রমে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। একটা টর্চের কি মাহাত্ম্য! সে টর্চটা জ্বেলে হাঁটতে হাঁটতে আনন্দে গান করতে শুরু করলো।

বিজয় শখের লেখক। চাকরী করে একটা প্রাইভেট স্কুলে। যখনই তার লেখা কোনো ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় সে রেলওয়ে স্টেশনের স্টলে গিয়ে ম্যাগাজিনটি কিনে বাড়ি ফেরে। কিন্তু রেলওয়ে স্টেশনে ঢুৃকতে গেলে প্ল্যাটফর্ম টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। এখন দশ টাকা লাগে একটা প্ল্যাটফর্ম টিকিটে। খুব গায়ে লাগে বিজয়ের। কিন্তু কিছু করার নেই। টিকিট না থাকলে আবার টিকিট চেকার ফাইন করতে পারেন। অতএব টিকিট নিয়ে স্টেশনে ঢোকাই উচিত বলে মনে করলো বিজয়।

আজ থার্ড আই পত্রিকায় বিজয়ের একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

খুব আনন্দিত হয়ে সে তার বন্ধু সুমনকে বললো, তুই একটু দাঁড়া, আমি প্ল্যাটফর্ম টিকিট কেটে বইটা নিয়ে আসি। 

শুনে সুমন বললো, আরে প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম দশ টাকা। তুই দাঁইহাটের টিকিট নিলে পাঁচ টাকায় পাবি। একটা টিকিট থাকলেই হলো।

বিজয় বললো, এটা তো জানা ছিলো না। তাহলে এতদিন ধরে আমার অনেক টাকা সেভ হতো।

ঠিক আছে তাই হবে। তোকে অনেক ধন্যবাদ।

----বন্ধুকে, শালা ধন্যবাদ জানানোর কি আছে? যা, তাড়াতাড়ি যা। একসঙ্গে বাড়ি যাবো।

তারপর বিজয় একটা দাঁইহাটের টিকিট কেটে ম্যাগাজিন কিনে মহানন্দে বাড়ি চলে এলো। বন্ধুও তার বাড়ি চলে গেলো।

বাড়িতে এসেই বিজয় বৌকে বললো, বেশ ভালো করে আদা দিয়ে চা করো তো। একটু রসিয়ে সব গল্পগুলো পড়বো। বিজয় ভালো করে বিছানায় বসলো।

বিজয়ের বৌ মুন চা করে কাপদু'টি টেবিলে রাখলো। তারপর বসলো বিজয়ের পাশে। গল্পে ডুব দিয়েছে বিজয়। 

মুনের মন ফিরে গেলো, পাঁচ বছর আগে কলেজ জীবনে। তখন ওরা দু'জনে দু'জনকে চিনত না। একদিন কলেজের কমন রুমে বিজয় বসে আছে। এমনসময় মুন গিয়ে বসলো তার পাশে। একবার মুখ তুলে তাকিয়ে বিজয় আবার নিজের কাজ করতে লাগলো। মুন বললো, আপনি কোন ইয়ার?

------ থার্ড ইয়ার, বাংলা।

------আমারও বাংলা। ফার্ষ্ট ইয়ার।

-----ও তাই। কোথা থেকে আসেন।

------টিকিয়াপাড়া।

------ও আমি পটুয়াপাড়া থেকে।

-----তাহলে তো একই দিকে। খুব ভালো হলো, একসঙ্গে যাওয়া আসা করা যাবে।

-----অবশ্যই।

তারপর থেকে ওরা একসাথে সময় কাটাতো ভালোলাগা ক্রমশ ভালোবাসায় পরিণত হলো, তারপর বিয়ে।চাকরিস্থলে এখন ওরা ঘর ভাড়া নিয়ে সুখে আছে।

 

মুন একটা গান গাইছিলো। বিজয়ের জামাটা আলনা থেকে টেনে গন্ধ শুঁকে দেখলো কাচতে হবে কি না। কাচতে হবে, তাই পকেট হাতড়ে টাকাপয়সা কাগজ বের করে টেবিলে রাখলো। মুন দেখলো, কাগজের সঙ্গে একটা রেলের টিকিট। মুন ভাবলো, অফিস তো সাইকেলে যায় তাহলে দাঁইহাটের টিকিট কেন? দাঁইহাটে আমাদের সাতকুলে কেউ থাকে না। তাহলে ওখানে কেন? কই বিজয় তো বলেনি, সে ওখানে গিয়েছিলো? তাহলে কি বিষয়টা বলার মত নয় বলে এড়িয়ে গেছে। সন্দেহ দানা বাঁধলো মুনের মনে। গান থেমে গেছে। অকারণে থালা, বাটি, গ্লাস ফেলে আওয়াজ করছে। বিজয় বললো, আস্তে কাজ করো।গল্প পড়ছি।

----আমি খেটে মরবো আর তুমি বাবুমশাই বসে গল্পের বই পড়বে?

---- কি হলো, ইভাবে কথা বলছো কেন?

----না বলবে না! আমি একা একা বাড়িতে থাকি আর উনি হিল্লি দিল্লি করে বেড়াচ্ছেন।

-----কি বলছো, বুঝতে পারছি না। পরিষ্কার করে বলো।

-----দাঁইহাট কেন গেছিলে? কার কাছে? নিশ্চয় প্রেমিকার কাছে। আমাকে তবে বিয়ে করলে কেন?

----আরে দাঁইহাটে কেন যাবো?

-----আবার মিথ্যে কথা। আমার কাছে প্রমাণ আছে।

----কি প্রমাণ? কই দেখাও।

মুন দাঁইহাটের টিকিট এনে খাটে ফেলে দিলো। বিজয় হেসে উঠলো জোরে। বললো, আজ বই কিনতে প্ল্যাটফর্মে গেছিলাম। প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম দশ টাকা আর দাঁইহাটের টিকিট পাঁচ টাকা। টিকিট একটা থাকলেই হলো। তাই পাঁচ টাকা বাঁচাতে দাঁইহাটের টিকিট কাটলাম। সুমন আমার সঙ্গে ছিলো। ওকেই জিজ্ঞাসা করো।

তারপর মোবাইলে সুমনকে ধরে ফোনটা দিতে গেলো বিজয়। মুন ফোনটা কেটে দিয়ে হাসিমুখে বললো, আমার বুঝতে ভুল হয়েছে। তারপর বিজয়ের গলা পেঁচিয়ে ধরে বললো, তুমি এমনি করেই শুধু আমার হয়ে থেকো চিরকাল।

 

 সবুজ মায়ের কাছে শিক্ষা পেয়েছে সততার।  মনে পড়ছে মায়ের কথা। সে আপন মনেই ভেবে চলেছে তার মায়ের কথা। মা রক্ষাকালীর পুজো দিতে দিতে গেয়ে উঠতেন ভক্তিগীত। মা কালীর আশীর্বাদ মাথায় রেখে সুন্দর ছন্দে ছেলেদের নিয়ে সংসার চালাতেন  । অভাব থাকলেও কোনোদিন তার ছাপ পরেনি মায়ের চোখেমুখে। আসল মূল্যবান রত্নের সন্ধান তিনি পেয়ে গেছিলেন পুজোর আসনে বসে। কোনোদিন তার কথায় প্রকাশ পেতো না সেসব কথা। তার চলনে, বলনে ফুটে উঠতো মাতৃরূপের জলছবি। মাকে দেখেই মাথা নত হয়ে যেতো সকলের। দাদু মাকে, মা বলেই ডাকতেন। তিনি সময়ে অসময়ে মাকে রামপ্রসাদী শোনাতে বলতেন। মায়ের গান শুনতে শুনতে একদিন চলে গেলেন পরপারে তৃপ্ত মুখে। একবার বৈশাখি ঝড়ে আম গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়লো। মা বললেন,তোদের দাদুর আত্মা মুক্তি পেলো। ই ডালে বাঁধা ছিলো দাদুর মুক্ত হবার লাল চেলি। অবশ্য এটা ছিলো এক সাধুবাবার তুকতাক। বুড়ি ঠাকুমা সেদিন কেঁদে উঠেছিলো জোরে। ঠাকুমা বলে উঠলেন, চলে গেলো, ও চলে গেলো। কোনোকিছুই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তবু কিছু ঘটনা বারবার তার অস্ত্বিত্বের কথা স্বীকার করে নেয়। একটা দেশি কুকুর আমাদের বাড়িতে থাকতো ছোট থেকে। তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানি না? সে অমাবস্যা, পূর্ণিমায় কিছু খেতো না। রক্ষাকালী পুজোয় উপবাস করতো। তার সামনে খাবার দিয়ে দেখা গেছে সে খাবারের ধারের কাছে যেতো না। শুধু কথা বলতে পারতো না। কিন্তু ভাবে, ভঙ্গিমায় সব বোঝাতে পারতো মানুষের মতো। মা বলতেন, পূর্বজন্মে তোর সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা নিশ্চয় ছিলো। তাই তোর আমাদের বাড়িতে আগম। যেদিন জিম দেহ রেখেছিলো সেদিন ওকে মাটি চাপা দিয়ে ধূপ আর ফুলে শেষ বিদায় জানিয়েছিলো সারাপাড়ার বাসিন্দারা। তাহলে কি বলবে তুমি এই ঘটনাকে। কোন যুক্তিতে অস্বীকার করবে তার সারাজীবন ধরে পালন করা ব্রত, উপবাস। বলবে কাকতালীয়। সেসব তো এক আধবার হয়। সারাজীবন ধরে নিয়মিত হয় না!

 

সবুজের মনে পড়ছে, বিজয়ার সময় আমার মা জিমকে প্রথম মিষ্টিমুখ করাতেন। ধান রাখার গোলার তলায় একবার গোখরো সাপ দেখে, ঘেউ ঘেউ শব্দ করে জিম আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলো সাপটা। তারপর সাপুড়ে ডেকে সাপটি বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। বড়দার বিছানার মাথার কাছে সে শুয়ে থাকতো। কোনো বিপদ বুঝলে ঝাঁপিয়ে পরতো নিঃস্বার্থ ভাবে। প্রত্যেক প্রাণীর কাছে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।

 

সবুজ ভাবে, মা ছোটো ভাইয়ের কাছে ভালো থাকতো। সবাই ভালো। শুধু আমি হয়তো খারাপ। তাই মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। আর তার দেখা পাই না। মন্দিরের ঘরে যেতে ভয় লাগে।তার মনে পড়ছে বাল্য জীবনের স্মৃতি।

 

তেঁতুলতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেড়ে নিতাম কাঁচা তেঁতুল। একজন বহুরূপী হনুমান সেজেছিলো। আমাদের এক বন্ধু তার লেজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেলো। আর হনুমান লাফিয়ে শেষে জলে ঝাঁপ দিলো। চারদিকে প্রচুর লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা মজা দেখছে আর হাততালি দিচ্ছে। আমরা সবাই ওকে চাঁদা তুলে পাঁচশো টাকা দিয়েছিলাম।

 

তালগাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো তাড়ি ব্যবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাবো। সকালের তালের রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পড়ে রাতে সকালের তালের রস খেতে গেছিলাম। কারণ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তালের রস তাড়িতে পরিণত হয়। মদের মতো নেশা হয়। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউ এলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেড়ে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেড়ে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছে উঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সন্ধেবেলায় হাড়ি রসে ভরে যেতো। ব্যবসায়ীর কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত।  অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। কোনো পাকামি ছিলো না। সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো।   আনন্দ ছিল জীবনে। শয়তানের  বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেত বালকদের আচরণে, কর্মদক্ষতায়। হাসিখুশি সহজ সরল জীবন।

ছোটোবেলার কার্তিক পুজো, গণেশ পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো পুজোর দু'দিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পীকে তারপর প্যান্ডেলের জোগাড়। বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল। তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর । সেই ঘরে থেকেই আমরা ভয় দেখাতাম সুদখোর মহাজনকে। সুদখোর ভূতের ভয়ে চাঁদা দিতো বেশি করে। বলতো, তোরা পাহারা দিবি। তাহলে চাঁদা বেশি দেবো।

 

এখন তার বৌ পরকীয়ায় মত্তআজ একটা চিঠি সমেত খাম পেয়েছে সবুজ ।  খামের মুখ খুলে গেছিল। চিঠিটা বের করে দেখলো বৃন্দাবনের চিঠি। লেখা আছে, এবার বিয়ে হয়ে গেছে,  কি মজা বলো। মনে পড়ে প্রথম নরম অনুভবের কথা…” সবুজ আর পড়লো না। রেখে দিলো। অল্প বয়সে এইসব হয়। কিন্তু বিয়ের পরে এইসব করবে? বিয়ের পরে তো সব ঠিক হয়ে যায়। সবুজ ভাবে আমিও তো পিউকে ভালোবাসতাম। ওর বিয়ে হওয়ার পরে তো আর দেখা করিনি। কিন্তু সবাই তো একরকমের হয় না।

 

 

তারপর খাওয়া দাওয়া করে শুতে রাত দশটা বেজে গেলো। অনিমা বিছানায় উঠেই বললো, ন শরীর ভালো নেই। শুয়ে পড়ো। সবুজ  সুযোগ পেয়ে বললো, মন খারাপ কেন? তুমি কোনো ছেলেকে ভালোবাসো?

------কি হবে এসব কথা শুনে?

------না, বলো না!

-----হুঁ

------কি নাম ছেলেটার?

-----বৃন্দাবন

-------ও আজকে ছেলেটা এসেছিলো না কি?

-----হ্যাঁ, এসেছিলো

----আচ্ছা ও তোমাকে কিছু করেছে?

-----কিস করেছে

------আর কিছু?

------একবার বুকে হাত দিয়েছিলো।

-----ও, আর কিছু?

-----আর শুনতে হবে না। শুয়ে পড়ো।

 

সবুজের সারারাত ঘুম এলো না।

 

পরের দিন সবুজ বৃন্দাবনকে বাজারে ধরেছিল। বলেছিল, শালা বিয়ের পরে হারামীগিরি আমি সহ্য করবো না। এরপর যদি দেখি তোকে তাহলে তোর বৌকে তোর বিয়ের পিঁড়ে থেকে তুলে সকলের সামনে শালা...। আর বললাম না। বৃন্দাবন জোড়হাতে ক্ষমা চেয়ে পালিয়েছিল। সে দেখেছিলো পরে বৃন্দাবন আর একটা সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে ঘুরছে।

 

সবুজ ভাবে, ভালোবাসা কি তাহলে ফালতু ? একমাস কথা বন্ধ। কোনোদিন অনিমা তাকে সুন্দরভাবে গ্রহণ করেনি বিছানায়। মুখ ঢাকা দিয়ে হয়তো বৃন্দাবনের কথা ভাবতো।

 

অনিমা ভাবে এমন জায়গায় পড়লাম যেখানে ভালোবাসা নেই, আনন্দ নেই। এরকম বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। সে ঠিক করে ফেললো যখন মেয়েটা স্কুলে যাবে তখনই নিজেকে শেষ করে দেবে।

 

সকালে সবুজ অফিসে গেলে, বেনারসী শাড়িটা পরে গলায় দড়ি দেবার জন্য একটা চেয়ার নিয়ে এলো। বিয়ের সাজে মরতে তার শখ খুব। দড়ি কই?  তাড়াতাড়ি জলপাই রঙের শাড়িটা দড়ির মত পাকিয়ে নিলো। অনিমা ভাবলো, বিষফলটা ও নিজেই পুঁতেছে। সেই ফল আজকে চারা থেকে বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। কি হবে এই জীবনে? শুধু ঝগড়া, মারামারি।এর শেষ করাই ভালো।

হঠাৎ মেয়ের মুখ ভেসে উঠল অনিমার চোখে। থমকে গেল অনিমা। জলপাই রঙের দড়ি পাকানো শাড়িটা জড়িয়ে স্বপ্ন দেখলো ভবিষ্যতের। ভাবলো মরার আগে একবার নতুন করে মেয়ে, শ্বশুর শ্বাশুড়ি আর স্বামী, জা-দেওরকে নিয়ে থাকবে। সে দেখলো,সবুজ মাঠ। উদার বিস্তীর্ণ আকাশ। সেই আকাশের গালিচায় একটা সুগন্ধি গোলাপের বাগান। দূরে তার জন্য অপেক্ষা করছে এক রঙীন জীবন। সে ভাবলো, আমি যাবো, নিশ্চয় ই বাগানে যাবো। পচা নরমাংসের গন্ধটা ঢাকার জন্য একটা সুগন্ধি গোলাপ  তুলবোই...।।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন