দশ হাজারের বউ - হারান চন্দ্র মিস্ত্রী

 


প্রীতি তিতিবিরক্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। প্রতিদিন খাবার সময় একই কথা শুনতে হয় তাকে। বিয়ের পর থেকে একদিনের জন্য শান্তি পায়নি সে। তার নতুন দাম্পত্য জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত চোখের জল দিয়ে ভেজা। বাপেরবাড়ির আদরযত্নের সঙ্গে সে শ্বশুরবাড়ির হেনস্থার কোনোরকম সাম্য খুঁজে পায়নি। যন্ত্রণাময় জীবনে একটু নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে পারাটাই একটা কঠিন কাজ হয়ে পড়েছে তার কাছে।

    প্রীতি মনে করে, গরিবের ঘরে এরকমই দুর্ঘটনা লেগে থাকা স্বাভাবিক। কারণ যেখানে অর্থের অভাব সেখানে অনর্থের প্রাধান্য বেশী। খিদে পেলে মানুষের মাথা গরম থাকে। সংসারে যাবতীয় প্রয়োজনের কথা উঠতেই গোলমালের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পড়ে ঘরের বউ। সদ্য আসা এই সদস্য কিভাবে নিজেকে গড়ে তুলবে সংসারের সবার মনের মতো করে? সংসারের বাকি সদস্যরা কিভাবে মানিয়ে নেবে তাকে? উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও কারো মনে জায়গা করে নিতে পারছে না সে। অন্যের সমস্যায় তাকে জড়িয়ে নিয়ে শুরু হয় তীব্র আলোচনা। এর থেকে কোনোভাবে নিস্তার পায় না প্রীতি।

    প্রীতির বাবা কৃষিজীবী মানুষ। তার এক ছেলে দুই মেয়ে। একমাত্র ছোটো মেয়ে প্রীতিই লেখাপড়া শেখার সুযোগ পেয়েছে। বয়সে সবার ছোটো হওয়ায় সংসারের কোনোরকম দায়-দায়িত্বের মোকাবিলা তাকে করতে হয়নি। মা-বাবার যত্ন পাওয়া তার কাছে স্বাভাবিক। তাছাড়া, দিদি ও দাদার অত্যন্ত আদরের ছিল সে। তার দাদা কাজ থেকে ফেরার সময় তার জন্য হয় খাবার, নয়তো সাজের জিনিস আনতই আনত। দিদিও কোথাও গেলে তার জন্য মিলত উপহার। তার দিদির বিয়ের পরে তার জামাইবাবুও কম স্নেহ করে না। সেই জামাইবাবুর দেখে দেওয়া পাত্রের বাড়িতে আজ সে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব।

    প্রথমে তার জামাইবাবুর কোনো দোষ দেখত না প্রীতি। পরিচিত পরিবার হলেও প্রথমে তার জামাইবাবু এই বিয়েতে সম্মতি দেয়নি। শেষপর্যন্ত ছেলের মায়ের নাছোড়বান্দা অনুরোধে বিয়েতে মত দিয়েছে সে। প্রীতিও অভিজ্ঞতার অভাবে কোথায় মত দিতে হবে বা কোথায় মত দেওয়া উচিত নয় তা জানত না। বিয়ের পর সে বুঝতে পেরেছে সাংসারিক জীবন ভয়ানক কঠিন। সংসারের প্রতিটি মানুষের মন জয় করা নিঃসন্দেহে জটিল কাজ। যে কাজ মন দিয়ে করতে গিয়ে সে সম্মানের পরিবর্তে কুৎসা ভরে নিয়েছে নিজের আঁচলে।

 ঘটনার সূত্রপাত অষ্টমঙ্গলার পরে। তার স্বামী নিত্যানন্দ একান্তে বিছানায় শুয়ে বলেছিল, "বিয়েতে অনেক খরচ হয়ে গিয়েছে। সংসার চালানো কঠিন। বাবার ব্যবসা ভালো চলছে না। তোমার বাবাকে বলে হাজার দশেক টাকা আনাও। বেশকিছু চাল কিনে নেব। তরকারি না জুটুক, নুন-ভাত খেয়ে দিন পার করে দেব।"

 সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে ওঠে প্রীতি। সে নিত্যানন্দকে বলল, "আমার বাবাও মেয়ে বিয়ে দিয়ে ঋণী হয়েছে। এই মুহুর্তে সে টাকা দেবে কি করে?"

নিত্যানন্দ তাকে বলে, "তোমার বাবা টাকা কোথায় পাবে তা জানার আমার দরকার নেই। তুমি বাপেরবাড়ি গিয়ে টাকা আনবে।"

প্রীতি সাফ জানিয়ে দেয়, "আমার বাপেরবাড়ি থেকে আমি টাকা আনব না, আনতে দেব না। তুমি বিয়ে করেছ, আমাকে রোজগার করে খাওয়াবে।"

নিত্যানন্দ চেঁচিয়ে বলে, "আমি কি মোট বইব?"

প্রীতি বলল, "তাতে আমার অসুবিধা নেই। স্বামীর উপার্জনে আধপেট খেয়ে দিন কাটালে তাতে অনেক সুখ।"

ক্রমশ আলোচনা উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। নিত্যানন্দ বলল, "আমি চুরি করে খাওয়ালে তুমি খুশি হও?"

প্রীতি বলল, "আমি চাই না আমার স্বামী কাপুরুষের মতো চুরি করুক। একান্তই তুমি যদি তা কর, জানব আমার বাবা চোরের হাতে আমাকে তুলে দিয়েছে। অগত্যা আমাকে চোরের ভাত খেতে হবে।"

 নিত্যানন্দ খুব চটে গেল। সে দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বলল, "যেখান থেকে পারিস রাত পোহালে দশহাজার টাকা আমাকে এনে দিবি, নয়তো বাপেরবাড়ি চলে যাবি।"

 প্রীতি বলল, "আমার বাবা কি এখানে ঠুঁটো বরের জন্য রোজগার করতে পাঠিয়েছে?"

 নিত্যানন্দ এবার আর ধৈর্য রাখতে পারল না। সে প্রীতির ঘাড় ধরে দেওয়ালে মাথা ঠুকে দিল। ডুকরে কেঁদে উঠল প্রীতি। জোরে চিৎকার করে নিত্যানন্দ বলতে লাগল, "যত বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা! আমি ঠুঁটো জগন্নাথ!"

 নিত্যানন্দর বাবা-মা ছুটে এলো। তার মা বলল, "দরজা খোল খোকা। কি হয়েছে?"

 নিত্যানন্দ দরজা খুলে মাকে বলে, "তোমার বৌমা আমাকে ঠুঁটো জগন্নাথ বলল।"

 প্রীতির শাশুড়ী বলল, "হ্যাঁগো বউমা, স্বামীকে কি কেউ এইভাবে বলে?"

 প্রীতি বলল, "তোমার ছেলে দশহাজার টাকা আমার বাপেরবাড়ি থেকে আনতে চাপ দিচ্ছে। তোমরা তো সব শুনতে পাচ্ছ। আমার মাথা দেওয়ালে ঠুকে দিল। এখন আমাকে দোষ দিচ্ছ?"

 তার শ্বাশুড়ী বলল, "বিয়েতে প্রচুর খরচ হয়েছে। তাই আনতে বলেছে। "

 প্রীতি বলল,"বিয়ে হয়েছে আমার বাপের দেওয়া পণের টাকায়। তোমার ছেলে কি এখনও রোজগার করতে শেখেনি? তাহলে তোমার ছেলের বিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি।"

 নিত্যানন্দ স্ত্রীর গালে চড় কষিয়ে বলল, "তোর এতো সাহস, আমার মায়ের মুখের উপর কথা বলিস!"

 প্রীতির শাশুড়ী বলল, "রাতের বেলা গোলমাল করিস না বাবা। এই হারুন মেয়ের সঙ্গে পারবি না। কাল সকালে ওর বাবা-মাকে আসার জন্য খবর দে। পাড়ায় আমাদের সম্মান আছে। এই মেয়েটা তা বুঝবে না।"

পরদিন বিকালে প্রীতির বাবা-মা এলো, দিদি-জামাইবাবু এলো। সন্ধ্যার সময় বসাবসি হলো।আলোচনায় সমস্ত দোষ গিয়ে পড়ল প্রীতির উপর। নতুন বউ অযথা কথা বলে বাড়ির সম্মান নষ্ট করেছে। তাছাড়া জামাইয়ের বিপদে শ্বশুরকে এগিয়ে আসতে হবে। অতএব, দশহাজার টাকা প্রাপ্য হলো জামাইয়ের। আর প্রীতির মাথা দেওয়ালে ঠুকে দেওয়ায় অল্প কেটে গিয়েছিল। তার জন্য বরাদ্দ হলো তুলসীপাতার রস। এরজন্য কোনো খরচের প্রয়োজন নেই। প্রীতির আপত্তি সত্ত্বেও তার বাবা ছোটো জামাইয়ের হাতে টাকা দিয়ে গেছে।

এভাবে প্রায়ই গোলমাল এবং সালিশি চলছিল। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে থাকা চিড় ক্রমশ বড়ো ফাটলে পরিণত হল। নিত্যানন্দ কথায় কথায় প্রীতির গায়ে হাত তোলে। সম্প্রতি প্রীতির শাশুড়ী তাকে মারা শুরু করেছে।

নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনবার বাড়ি ছেড়ে বাপেরবাড়িতে গিয়েছিল প্রীতি। প্রতিবার তার বাবা তাকে রেখে যায়। আর ছোটো মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে চাল, সব্জি ও টাকা বয়ে দিয়ে যায়। প্রীতির দাদা বারবার বলেছিল, "বাবা, এটা ভুল হচ্ছে। আমাদের ভাবা উচিত। এতে বোনের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।"

প্রীতির বাবা বলেছিল, "মেয়েকে চাপে রাখলে একসময় ঠিক তার সংসারে মন বসে যাবে।"

বাপেরবাড়িতে ঠাঁই পায়নি প্রীতি। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পুরোপুরি পর করে দিয়েছে তার বাবা। দিদি জামাইবাবুর কাছে আশ্রয় চেয়েছিল প্রীতি। তারাও পরিস্কারভাবে জানিয়েছে, অন্যের সংসারে তারা মাথা দিতে চায় না। নিঃসহায় হয়ে পড়ে সে। 

একদিন সকালে প্রীতি বাসন মাজছিল। তখন নিত্যানন্দ এসে বলল, "তুমি বাসন মাজছ কেন? এদিকে এসো। এবার বাসন মাজার জন্য একটা লোক রাখব।" প্রীতিকে টেনে নিয়ে খাটে গিয়ে বসে।

প্রীতি বলল, "এবারের ধান্দা কি?"

নিত্যানন্দ বলল, "এভাবে বোলো না। তুমি শেষবারের মতো শ্বশুরমশায়ের কাছ থেকে কুড়িহাজার টাকা এনে দাও। আমি ট্রেনে ফেরি করে সংসার চালাব।"

প্রীতি ঠান্ডা মাথায় বলল, "তোমার কোম্পানির চাকরী কোথায় গেল? বিয়ের আগে বাবাকে বলেছিলে মাসে ত্রিশ হাজার টাকা মাইনে পাও।"

নিত্যানন্দ বলল, "বিয়ের সময় একসপ্তাহ কাজে না যাওয়ায় কাজ ছেড়ে গেছে। নয়তো তোমাকে এতো করে অনুরোধ করি!"

প্রীতি বলল, "আমি তোমার জন্য একটি পয়সাও আনতে পারব না। আমি বাবা, মা, দাদা, দিদি, জামাইবাবু সবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি।"

নিত্যানন্দ বলল, "তুমি গিয়ে একবার বাবার সামনে দাঁড়ালে টাকার অভাব হবে না।"

প্রীতি বলল, "তুমি একটা ভ্যাম্পায়ার।"

"কি বললে আমাকে?" বলেই নিত্যানন্দ চড়, কিল, ঘুষি মারতে থাকে প্রীতিকে। তার কপাল ফেটে ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। ডুকরে কেঁদে ওঠে প্রীতি। নিত্যানন্দ তাকে ঘাড় ধরে বার করে দিল ঘর থেকে। বাড়ির সামনে লোক জমে গিয়েছে। সে বলে, "চেঁচিয়ে লোক জড়ো করছিস! আমাকে কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না।"

নিত্যানন্দর মা এসে বলল, "সকালবেলা গন্ডগোল করিস না বাবা। বউমার বাবাকে খবর দে। ফাইনাল একটা কিছু করে যাক।"

নিত্যানন্দ প্রীতিকে দোষারোপ করে সবাইকে ফোন করে আসতে বলল। সে পাড়ায় বেরিয়ে পাড়ার নেতাদের সন্ধ্যার সালিশিতে থাকার অনুরোধ করে এলো।

গেটের সামনে রাস্তায় বোবার মতো সারাদিন না খেয়ে রোদে বসে আছে প্রীতি। তার কপালের ক্ষতস্থান ফুলে আলুর মতো হয়ে গেছে। সারা মুখে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে। বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া মহিলারা কেউ দুঃখ প্রকাশ করছে, আবার কেউ তাকে দোষারোপ করছে।

সন্ধ্যার আগে সবাই এসে হাজির। বাড়ির ছাদে সালিশি বসেছে। প্রীতির বাবা, মা, দাদা, দিদি ও জামাইবাবু এসেছে। পাড়ার একটি ছেলেকে দিয়ে প্রীতিকে ডাকানো হলো। পড়ার শীর্ষনেতা চেয়ারে বসে আছেন, বাকিরা ত্রিপলে। তিনি প্রথমে প্রীতির কথা শুনলেন। তারপর একে একে সবাই বলল। শীর্ষনেতা প্রীতিকে বললেন, "তুমি কি চাও?"

প্রীতি বলল, "আমার সংসার করার সাধ মিটে গেছে। আমি বাপেরবাড়ি চলে যেতে চাই।"

নিত্যানন্দ বলল, "কি ধরনের মেয়ে দেখুন।"

শীর্ষনেতা বললেন, "ছাড়।" তারপর প্রীতির বাবাকে বললেন, "আপনার মেয়ে সংসার করতে চায় না। আপনি কি করবেন।"

প্রীতির বাবা বলল, "আমি মেয়েকে এখানে রেখে যাব। দরকার হলে জামাইয়ের ব্যবসার জন্য কুড়িহাজার টাকাও আমি দেব।"

প্রীতি বলল, "ওটা বাবার মত। আমি সপ্তায় দু-তিনবার মার খাচ্ছি। আমার বাবার সেদিকে নজর পড়ে না। এরা কোনদিন আমাকে মেরে ফেলবে। আমি সংসার চাই না। আমি বাঁচতে চাই।"

শীর্ষনেতা বললেন, "সংসার করতে না চাইলে তোমাকে সই দিয়ে যেতে হবে।"

প্রীতি বলল, "আমি সই দেব, আমার স্বামীও সই দেবে। আপনারা সাক্ষী থাকবেন। আমার গয়না আমাকে ফেরত দিতে হবে।"

প্রীতির বাবা বলল, "গয়না, খাট-বিছানা আমি জামাইকে দিয়েছি। আমি ওগুলো ফেরত নেব না। আমার মেয়ে বিয়ে বিচ্ছেদ চায়, করে দিন।"

প্রীতি বলল,"আমার বাবা-মা বিয়ের আগে পর্যন্ত আমাকে অনেক যত্ন করেছে। সেজন্য তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। মেয়ে যতই শ্বশুরবাড়িতে মার খাক, জামাই বাবার কাছে বেশী আপন। তার সম্পদ সে যাকে ইচ্ছা দিতে পারে। আমার জীবনের দায়িত্ব আমার। আমি শুধু জীবনের অধিকার চাই।"

শীর্ষনেতার নির্দেশে বিবাহ-বিচ্ছেদ পত্র লেখা হলো এবং তাতে সই সাক্ষর করা হলো। ছেলে-মেয়ে দু'জনে একটি করে কাগজ পেল। সেদিনের রাতের জন্য শ্বশুর-শাশুড়ী জামাইবাড়িতে থেকে গেল। মেয়ে বেরিয়ে গেল শ্বশুরবাড়ি থেকে।

প্রীতির বাবা বড় জামাইয়ের কাছে ফোন করে খবর নিয়ে জানল প্রীতি সেখানে আছে। প্রীতির জামাইবাবু রাতে খাবার পর প্রীতিকে পরিস্কার জানিয়ে দিল, "এই গভীর রাতে আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিতে পারি না। কিন্তু কাল সকাল হলে আর তোমাকে বাড়িতে রাখতে পারব না।"

প্রীতি কোনো উত্তর না দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। এভাবেই কী আপন পর হয়ে যায়! পরদিন দিদি-জামাইবাবুকে বলে তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল প্রীতি।

এবার তার শেষ আশ্রয় বাবার কাছে। তার বাবা ততক্ষণে বাড়িতে পৌঁছেছে। প্রীতি সেখানে গিয়ে হাজির। নিজের দরজায় দ্বাররক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে তার বাবা। উদ্দেশ্য, আদরের ছোটো মেয়েকে ঘরে ঢুকতে না দেওয়া। তার বাবা বলল, "তুমি এখান থেকে চলে যাও। তোমার স্বামীর বাড়িতে গিয়ে ফোন করবে। আমি গিয়ে তোমাদের দু'জনকে একসাথে আনব। তা যদি না করো তাহলে যেখানে খুশি যেতে পার। মনে করব, আমার ছোট মেয়ে মরে গেছে।" 

তারপর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল তার বাব। কয়েকঘন্টা চোখের জলে ভাসিয়ে নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করল প্রীতি।

    প্রীতির বাবা রাতে ফোন করে জানল মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে কিনা। বড়ো মেয়ের কাছে ফোন করে খবর নিল। সেখানেও যায়নি। এবার চিন্তায় পড়ল তার বাবা। দু'দিন কেটে যাওয়ার পর প্রীতির বাবা মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার ডায়েরি করল থানায়। মাসের পর মাস কেটে গেল। কোনো খোঁজ মেলে না প্রীতির। চোখের জল ফেলতে ফেলতে একসময় প্রীতির মায়ের চোখের জল শুকিয়ে গেল। কয়েকবছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর প্রীতির আশা ছেড়ে দিল তারা।

নিত্যানন্দ আবার মহানন্দে বিয়ে সেরে নিয়েছে। মেয়ের গায়ের রঙ চাপা হলেও মেয়ের বাপের প্রচুর পয়সা। ভদ্রলোকের দুই ছেলেমেয়ে। মেয়েকে দিয়েছে তার অর্ধেক সম্পদ। দু'হাত ভরে খরচ করে নিত্যানন্দ। এখন সে এক ছোট্ট শিশুর জনক। বাবা-মাকে ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে সে। তার মা-বাবাকে কষ্ট করে খেতে হয়। তার স্ত্রীর পূর্বের স্বামী মাঝে মাঝে চা খেতে চলে আসে তার শ্বশুরবাড়িতে। সে প্রতিবাদ করেও তার যাতায়াত বন্ধ করতে পারেনি। তার শ্বশুর-শাশুড়ী তীব্র প্রতিবাদ করায় তার স্ত্রী পুরানো স্বামীর সঙ্গে পার্কে গিয়ে গল্প করে আসে। একাধিকবার এ ঘটনা দেখেছে নিত্যানন্দ। হতাশা আর মানসিক ক্লান্তি দূর করতে সে এখন বাইজি বাড়ি যায় এবং সুরা পান করে।


 গতকাল নিত্যানন্দ শুনে এসেছে বাইজি বাড়িতে এক মক্ষিরাণী আসছে যার রেট ঘন্টায় দশহাজার টাকা। একদিন থাকবে সে। তাকে একঘন্টা পাওয়ার জন্য পয়সাবান লোকেদের লাইন পড়ে গিয়েছে। সময় ফাঁকা নেই। মাসির কাছে অনেক অনুরোধ করে তিনটের দিকে একঘন্টা সময় পেয়েছে সে। তার জন্য একহাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে এসেছে নিত্যানন্দ।

 সময়ের দশ মিনিট আগে বাকি টাকা জমা দিয়ে মক্ষিরাণীর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। যেন রেশন ধরার জন্য দাঁড়িয়েছে সে, পাছে অন্য কেউ আগে ঢুকে পড়ে।

 সময়ের একমিনিট আগে একটি মেয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। সে বলে গেল, "এবার ভিতরে যান।"

 এই ঘরটাতে নিত্যানন্দ আগে কখনও প্রবেশ করেনি। আলো আঁধারি পরিবেশ। সুগন্ধির সুবাসে মক্ষিরাণীর নির্যাস চুঁইয়ে পড়ছে। লাল-নীল আলোর প্রভাবে নিত্যানন্দ তার মুখ ঠিকমত দেখতে পাচ্ছিল না। তাই সে স্যুইচ টিপে টিউবলাইট জ্বেলে দিয়ে খাটের দিকে এগোল। মক্ষিরাণী তখন মোহময়ী ভঙ্গিতে খাটের উপর বসে কুমারীসুলভ দৃষ্টিতে তার দিকে আড়চোখে তকাল। খাটের উপর বসে কামাশক্ত নিত্যানন্দ তার শাড়ি টেনে খুলল। ছোট্ট টপ পরা অষ্টাদশী কিশোরী বেরিয়ে এলো খোলস ছেড়ে। তার মুখের কাছে ঠোঁট নিয়ে যেতেই চমকে উঠল নিত্যানন্দ।

 "প্রীতি না! তুমি এখানে কি করে?" জানতে চাইল সে।

 মক্ষিরাণী বলল, "আমাকে সবাই মক্ষিরাণী বলে জানে। আমার জীবনের অর্ধেক ইতিহাস তুমি জান। বাকিটা তোমার না জানাই ভালো।"

 সে বলল,"আমি ভালো নেই প্রীতি।"

 প্রীতি বলল, "আমি ভালো আছি। তোমার সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।"

 নিত্যানন্দ বলল, "আমাকে তুমি সময়ের হিসাব দেখাচ্ছ?"

 প্রীতি বলল, "তুমি আমার কাছে পিছনের সম্পর্ক শোনাতে এসো না। আমার সময়ের দাম ঘন্টায় দশহাজার টাকা। তুমি খেতে পাও না। তাও এখানে এসেছ। সময় নষ্ট করলে তোমার অনেক ক্ষতি হবে।"

 নিত্যানন্দ প্রীতি চলে আসার পর থেকে সংক্ষেপে তার জীবনের গল্প বলল। তারপর জানতে চাইল সে, প্রীতি কিভাবে এই জগতে এলো।

 প্রীতি বলল, "তোমরা আমাকে বাঁচতে দিতে চাওনি। আমার দিদি-জামাইবাবু আমাকে আশ্রয় দেয়নি। আমার বাবাও আমাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তোমরা সবাই মিলে আমাকে এই পথে ঠেলে দিয়েছ।"

 নিত্যানন্দ জিজ্ঞাসা করল, "বেশ্যাবৃত্তিতে এলে কি করে?"

 প্রীতি বলল, "নিজের ইচ্ছায় এই পেশায় আসিনি। সেদিন বাবা আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর কোথায় যাব বুঝতে পারছিলাম না। হেঁটে হেঁটে স্টেশনে এসে ট্রেনে উঠে পড়লাম। কত ট্রেন চড়েছি ঠিক নেই। শেষে একটা স্টেশনে ট্যাপ থেকে জল খেতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ি। গভীর রাতে আমার ঘুম ভাঙে। তিনচার দিনের মধ্যে আমি সুস্থ হয়ে উঠি।"

 নিত্যানন্দ বলল, "তারপর?"

 প্রীতি বলল, "তারপর আমাকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলে দেওয়া হয় এক হায়নার মুখে। প্রথম রেট হাজার টাকা। খুব কেঁদেছিলাম। আমাদের ঠেকের মাসি আমকে খুব গালি দিয়েছিল। আমাকে পেয়ে সেই শেঠ খুব তৃপ্ত হয়েছিল। পাঁচহাজার টাকা বকসিশ দিয়েছিল।"

 "হারামজাদা তাকে পেলে খুন করে দিতাম।" বলল নিত্যানন্দ।

 "তুমি তাকে মারতে যাবে কেন?" জিজ্ঞেস করল প্রীতি।

 নিত্যানন্দ বলল, "তুমি আমার বউ।"

 প্রীতি বলল, "তখন তুমি প্রাক্তন স্বামী হয়ে গিয়েছিলে। তুমি ভবিষ্যতে গোলমাল করতে পারো ভেবে পৃথক হয়ে যাওয়ার কাগজটা সঙ্গে নিয়ে ঘুরি। তাতে তোমাদের নেতা থেকে আমার বাবার সই পর্যন্ত রয়েছে। যাইহোক, আর কুড়ি মিনিট বাকি আছে। তুমি সময় নষ্ট করছ।"

 নিত্যানন্দ বলল, "আমাকে সময়ের মাপকাঠিতে মাপছ প্রীতি!"

 প্রীতি বলল, "শুধু তুমি কেন, যেকোনো পুরুষ আমার সময়ের খরিদ্দার হতে পারে। সে হতে পরে তোমার বাবা কিংবা আমার বাবা।"

 নিত্যানন্দ বলল, "কি বলছ প্রীতি!"

প্রীতি উত্তরে বলল, "আগে আমি ভয়ে সিঁটকে থাকতাম। এখন প্রত্যেক পুরুষকে উপভোগ করি, তারপর ছুঁড়ে ফেলে দিই। এখন ভারতবর্ষের বড়ো বড়ো পাঁচটি শহরে আমার ফ্ল্যাট আছে। আছে একটা আলাদা বাড়িও। বহু নামী দামি লোক আমার পায়ে চুমো খেয়ে টাকা দিয়ে যায়।"

 নিত্যানন্দ বলল, "তুমি ফিরে চলো প্রীতি।"

 প্রীতি তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, "তুমি সময় নষ্ট করেছ। আর পাঁচমিনিট বাকি আছে। কি করবে করো।" বলেই সে এক অপুর্ব ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে নিত্যনন্দর মাথার চুলে আঙুল ঢুকিয়ে আদর করল।

 নিত্যানন্দ বলল, "অপুর্ব সুন্দরী তুমি। আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। ফিরে চলো প্রীতি।"

 প্রীতি বলল, "আমি কী পাগল? সুন্দর সুন্দর ফ্ল্যাট, সুন্দর বাড়ি, সেবাদাসী ফেলে আমি কি আত্মহত্যা করতে যাব তোমার কাছে? সময় শেষ। এবার বেরিয়ে যাও।"

 নিত্যানন্দ ঘর থেকে বেরোতে চায় না। কলিংবেল টিপতেই এক স্বাস্থ্যবান যুবক এসে ঘরে ঢুকল। প্রীতি বলল, "ঘর থেকে বার করে দাও একে।"

নিত্যানন্দ বলল, "প্রীতি, দয়া করো। আমাকে তাড়িয়ে দিয়ো না।"

 প্রীতি যুবককে বলল, "শুনতে পাচ্ছ না! পাগলটাকে নিয়ে যাও।"

 যুবকটি প্রথমে ভেবেছিল, লোকটি মক্ষিরাণীর পরিচিত। তাকে পাগল বলে সম্বোধন করতেই সে বুঝল লোকটি মক্ষিরাণীর সৌন্দর্যে পাগল হয়ে ঘর থেকে বেরোতে চাইছে না। তখন সে নিত্যর ঘাড় ধরে বাইরে নিয়ে গেল। প্রীতি ধপ করে বসে পড়ল খাটের উপর। সে মুঠো করে কাপড় তুলে নিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল।

  

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন