আজ সেই মধুই বলল, সে নাকি সুন্দরী ।
সে সুন্দরী-- এটা অনেকবারই
বলেছে তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু কেয়া ।
কেয়ার মতে যে কোনো ছেলেই
তার প্রেমে পড়তে চাইবে । তবু নিজেকে কখনো সুন্দরী বলে মনে হয়নি তার ।
মধু মাথায় বেশ লম্বা
হয়েছে । একাদশ শ্রেণীর ছাত্র । বুদ্ধি শুদ্ধি যে হয়নি এটা সবাই বলে । তারও মনে
হয় মধু বোকাই । তবে ওর সরল আবেদন যে কাউকে মুগ্ধ করে । মিতাকে ও করে । একদিন ও না
আসলে কিচ্ছু ভালো লাগে না তার । তাই মধুর কথায় অবাক হলেও রাগ হলনা । বলল, তাই বুঝি! তোমার ভালো লাগে ?
মিতা ওর মুখের দিকে চেয়ে
থাকে অপলক নেত্রে । ওর চোখের ভাষায় মুগ্ধতা । বেশ কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর বলে, এই বইটা লাইব্রেরি থেকে বদলে আনবে ।
মধু বইটা নিয়ে নীরবে চলে
যায় ।
কিন্তু পরপর দুদিন কেটে
গেলেও সে আসেনা । ফলে সময় ও যেন কাটতে চায় না । তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় টেবিলের ওপর
বইটা দেখে মিতা আশ্চর্য হয় । এমনতো কখনো হয়নি । মধু এসে তার সঙ্গে কথা না বলে চলে
গেছে ।
বেশ কয়েকদিন দেখা না
হওয়ায় অনেক গল্পও জমা হয়ে আছে । তবু তার একমাত্র শ্রোতা মধুর দেখা নেই ।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায় । এমনসময় মধুদের বাড়িতে এসে হাজির হল মিতা । মাসিমা
খুব খুশি হলেন । কিন্তু মিতার দৃষ্টিটা শুধু একজনকেই খুঁজে ফেরে । অথচ সেই তার
দেখা না পেয়ে আশা হত হল সে । বেশ কিছুক্ষণ মাসিমার সঙ্গে গল্প করার পরে ফিরে আসবে
বলে ঠিক করছে এমনসময় খেলার মাঠ থেকে ফিরল মধু । ক'দিনের
না দেখায় ওকে বেশ কিছুটা অচেনা বলে মনে হয় । মনে হয় এই মধুকে বুঝি সে চেনেনা ।
কিন্তু মধু তার সঙ্গে কথা বলল না ।সোজা ওপরের ঘরে উঠে গেল । আহত হল মিতা । কি
হয়েছে মধুর? কেন সে তার সঙ্গে এমন
ব্যবহার করছে ?
ভাবতে থাকে মিতা ।
মাসিমা বললেন , মিতা, তুমি একটু বসো মা । আমি ঠাকুরঘরে সন্ধ্যা
প্রদীপ জ্বালিয়ে আসি ।
মিতার সম্বিত ফেরে । সে
বলে , আসুন । আমিও আসি । মাকে
বলে আসিনি ।
-- সে কি, মাকে
বলে আসোনি । তাহলে তো তোমার দেরি করা উচিত নয় । কিন্তু একা যেও না । মধুকে সঙ্গে
নিয়ে যাও ।
-- না না, একাই
পারব পর মধু এসে হাজির হল সেখানে ।
মা বললেন , যা মিতাকে বাড়ি পৌঁছে
দিয়ে আয় ।
মায়ের কথা অমান্য করতে
পারলনা মধু । মিতাকে বলল, এস।
ওরা দুজন পথে নামল ।
এমনিতে বাড়ি দুটো পাশাপাশি । তবে রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে হয় । তাই দূরত্বটা একটু
বাড়ে । কিন্তু কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলল না । মাথার ওপরে উজ্জ্বল চাঁদ ওদের পথ
দেখিয়ে নিয়ে চলেছে । বাঁক ফিরতেই মোড়ের মাথায় কালভার্টের ওপরে বসে থাকা বেপাড়ার
কয়েকটা ছেলে ওদের দেখে শিষ দেয়। কেউ বলে, বেড়ে
জুটিয়েছে মাইরী ।
মধুর ইচ্ছে হল ওদের একটু
শিক্ষা দেয় । মিতাকে বলে, একটু দাঁড়াও ।আমি আসছি ।
মিতা ওর হাত চেপে ধরে বললে, না ওদের স্বভাবই এই ।
-- তাই বলে ?
-- তা হোক ।
ওরা চলতে থাকে । বেশ
কিছুটা এগিয়ে আসার পর মিতা বললে,
তুমি
পরপর তিনদিন আমার সঙ্গে দেখা করোনি কেন ?
মধু নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে
থাকে মিতার মুখের দিকে । চাঁদের আলোয় ওকে আজ অপূর্ব সুন্দরী বলে মনে হয় ।
-- প্রতিদিন আসবে বলো ?
মিতা মধুর হাতটা ধরে থাকে
।
মধু কিছু বলতে পারে না ।
তার বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটার শব্দ । বেশ কিছুক্ষণ পরে বলল, তুমি চাইলে আসব ।
ঘরে ফিরে মধুকে বিদায়
দিতে ইচ্ছে হলনা ।
মা বললেন, মধু এস এস । কতদিন তোমাকে দেখিনি । বেশ বড়
হয়ে গেছ ।
তারপর মিতাকে বললেন মধুকে
কিছু খাইয়ে তবে ছাড়তে ।
মিতা খাওয়াল । মধুর মনে
হল এতখানি যত্ন বুঝি সে আগে কখনো পায়নি ।
সেদিন সারারাত ভাবল মিতা ।
না না, এ হয়না । মধু তার
ভালোবাসার ব্যক্তি হতে পারেনা । কিন্তু ঘুমের মাঝে মধুর মুখটা বারবার তার চোখের
সামনেভেসে উঠতে লাগল ।
নতুন ক্যামেরা কিনেছে মধু
। তার ইচ্ছা মিতার ছবি নিয়েই শুরু হবে তার ফটোগ্রাফি । কিন্তু মিতা যদি রাজী না
হয় ?
কয়েকদিন পরে মন্দির থেকে
পূজো দিয়ে ফিরছিল মিতা । পূজারিণী বেশে মিতাকে দেখে মধুর মনে হল সে বুঝি দেবকন্যা
।
মিতাকে বলল , মা তোমাকে ডেকেছেন ।
-- তাই বুঝি! তুমি ডাকোনি ?
-- না না, আমি
কেন?
কিন্তু ওদের বাড়িতে আসতেই
দেখে বাড়িটা ফাঁকা ।
মিতা বললে, মাসিমা কোথায় ?
-- বাজারে ।
-- তবে যে বললে--
-- মিথ্যে বলেছি । আসলে তোমার এই পূজারিণী সাজের
একটা ছবি নেব । তাই সত্যি বললে তো তুমি আসতে না ।
মিতা হাসল । প্রশ্রয়ের সে
হাসি ।
মধু ক্যামেরা নিয়ে এসে বেশ
কয়েকটা ছবি তুলল । ডিসপ্লে তে ছবিগুলো দেখে খুশি হল মিতা । বলল, এবারে তুমি খুশি তো । আজ আসি ।
ক্যামেরা কেনার পর থেকে
পাড়ার অনেকেই ছবি হতে চাইল । তাদের মতে মধুর হাতও নাকি বেশ ভালো । ব্যস্ত হতে হল
মধুকে ।কিন্তু মিতার মতো ওদের কাউকে সুন্দরী বলে মনে হল না ।
কল্পনাদির হবু বরের কাছে
ছবি পাঠাতে হবে । ডাক পড়ল মধুর । সাজিয়ে নিতে হল মধুকে ।তার মনে হল কল্পনা কি
মিতার মতো সুন্দরী ? তা কেন হবে ? কিন্তু কল্পনার মধ্যে দিয়ে আবিষ্কার করল
নারীর ভেতরের আর এক রহস্যময়ীকে । যে রহস্যের আকর্ষণে চঞ্চল হয়ে উঠল তার কৈশোর ।
বেশ কিছুদিন পরে স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানে মিতাকে আমন্ত্রণ জানাল মধু । মিতা যাবেনা ভেবেও শেষ পর্যন্ত এলো ।
অনুষ্ঠানে মধু অভিনয় করবে সেটাই ছিল ওর কাছে বড় আকর্ষণ । তাছাড়া ওর অভিনয় ও সবার
মন জয় করল । সে অভিমন্যু । অপরদিকে নিজের অজান্তেই নিজেকে উত্তরার ভূমিকায় নিয়ে
এল মিতা । উত্তরার মতো সে কি অভিমন্যুকে ভালোবাসে ?
এখন নাটকের শেষ অঙ্ক ।
অভিমন্যুর মৃতদেহ শিবিরে আনা হয়েছে ।সুভদ্রা, দ্রৌপদী
এবং অন্য মায়েরা কাঁদছে । এলোলায়িতা কুন্তলা উত্তরা এল মঞ্চে । নিজের অজান্তেই
কেঁদে উঠল মিতা । না , এ হতে পারেনা । অভি তার ।
একান্তভাবেই তার ।
কখন যেন নাটকটা শেষ হল
মিতা বুঝতেই পারেনি । সমস্ত দর্শকরা চলে গেছে । সাজপোশাক খুলে অভিমন্যু ওর সামনে
এসে বলে , উত্তরা ।
-- অভি ।
কিন্তু একি বলল সে ! সে কি
উত্তরা হতে চায় ?
-- চলো ।
নিঃশব্দে মধুকে অনুসরণ করে
মিতা । রাস্তায় আলো থাকলেও তা যথেষ্ট নয় । দুপাশে ইউক্যালিপ্টাসের সারি । বেশ
কিছুটা আসার পর কয়েকটি ট্রাককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় । এরকম প্রতিদিনই থাকে ।
হঠাৎ একজায়গায় থামে মধু । একটা ট্রাকের পাশে মিথুনরত দুজন নারী পুরুষকে দেখে
মিতাকে জিজ্ঞেস করে , ওরা কি করছে?
মিতা ওকে চট করে সরিয়ে আনে
। বলে, ওসব দেখতে নেই ।
-- কি হয় দেখলে ?
-- জানিনা ।
বেশ রাগ দেখায় মিতা ।
আকাশে তখন শুক্লা দ্বাদশীর
চাঁদ । ফাঁকা মাঠের ওপর দিয়ে পথ । কেমন যেন একটা ভয় ভয় করে মিতার । সে মধুর
হাতটা চেপে ধরে । যেন পরম নির্ভরতার সে হাত । নির্ভয়ে সে হাত ধরে পথ চলা যায় ।
চাঁদের আলোয় ওকে আজ অপূর্ব সুন্দরী বলে মনে । মধু বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর বললে, তুমি উত্তরার পাঠ করলে খুব ভালো হতো ।
-- হতো বুঝি ? কিন্তু
আমি তো অভিনয় করতে পারিনা ।
-- আমি শিখিয়ে নেব । করবে তুমি অভিনয় ?
মিতা বেশ কিছুক্ষণ থেমে
থাকার পর বলে, না ।
মধু হতাশ হয় । ধীরে ধীরে
মিতার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় । একা একাই চলতে থাকে । মিতা কোনো কথা বলে
না । শুধু মধুকে অনুসরণ করে । হঠাৎ চাঁদটা মেঘের আড়ালে চলে যেতেই বেশ কিছুটা ভয়
পেয়ে যায় সে । দৌড়াতে দৌড়াতে মধুকে ধরে ফেলে । ওকে গভীর আলিঙ্গনে ধরে বলে, আমি সত্যিকারের উত্তরা হতে চাই । তুমি আমার
অভিমন্যু ।
মধু দেখে এক নারীকে ।
উত্তরাকে । তার জীবনের প্রথম নারীকে । যার দৃষ্টিতে মায়াবী স্নিগ্ধতা ।
ঘরে ফিরে মিতা দুচোখের
পাতাকে এক করতে পারেনা । এরই নাম হয়তো প্রেম । যে প্রেমের জন্য তার তৃষিত হৃদয়
অপেক্ষা করছে । কিন্তু এতো অসম্ভব । তবু নিজেকে বোঝাতে পারেনা । মধুর আজকের স্পর্শ
তাকে তার নিজের কাছ থেকেই বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে ।
পরপর দুদিন কেমন যেন একটা
ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে যায় । দিবা রাত্রি শুধু একটাই ভাবনা । তৃতীয় দিন মধু এসেছিল
কয়েকটা ছবি হাতে নিয়ে । মিতা ভেবেছিল ওকে ফিরিয়ে দেবে । কিন্তু পারলনা ।
মধু বলল, মা তোমাকে আগামীকাল যেতে বলেছেন ।
-- তুমি বলোনি ?
-- না মানে-- আসবে তো ?
-- হ্যাঁ ।
মিতা আজ একান্তে দেখল
মধুকে । বেশ লম্বা হয়েছে । সেই সঙ্গে স্মার্টও ।
মধু ফিরে যেতেই অনেক ভাবল
মিতা । এ সে কোথায় চলেছে ? এক কিশোরের ভালোবাসার
প্রার্থী সে । যা অন্যায়, অসম্ভব ।স
তবু পরদিন নিজেকে
নিয়ণ্ত্রণ করতে পারলনা । বিকেলের দিকে বেরিয়ে পড়ল অবুঝ প্রেমের নিমন্ত্রণ রক্ষা
করতে । মধুদের বাড়িতে আসতেই বুঝতে পারল মাসিমা নয় মধুই নিমন্ত্রণ জানিয়েছে ।
বেশ দুষ্টু হয়েছে আজকাল ।
মধু বলল, আমি মিথ্যে বলেছি ।
-- কেন, কেন
মিথ্যে বলেছ ?
-- তোমার জন্য ।
-- আমার জন্য ?
ওর চোখদুটোর দিকে চেয়ে
থাকে মিতা ।
ওর দৃষ্টিতে বোধহয় জাদু
আছে । কিছুতেই সেই দৃষ্টি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেনা । মিতা কোনো এক স্বপ্নের
জগতে হারিয়ে যায় । যেখানে এক কিশোরের বাহুডোরের মাঝে নিজেকে সমর্পন করে । যে
কিশোর গ্রহণ করে তার অনাঘ্রাত যৌবনের নৈবেদ্য । সে কিশোর আর কেউ নয় -- তার অভি, অভিমন্যু ।
-- উত্তরা ?
-- অভি ।
অভিমন্যুর হাতে উত্তরা
সমর্পন করে তার নারীত্বের নৈবেদ্য ।
মিতার জীবনে প্রথম পুরুষের
স্পর্শ ।
মিতার চোখে জল ।
এই ঘটনার পর থেকে মিতা
কেমন যেন একটা অজানা আশঙ্কায় শুকিয়ে যেতে থাকে । কারোর সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে
পারেনা । ভেতরে ভেতরে একটা ভয় ওকে কুরে কুরে খায় । সবসময় মনে হয় ' অভি ' যদি
তার কাছ থেকে হারিয়ে যায় ? শেষ পর্যন্ত এক জটিল অসুখে
আক্রান্ত হয় সে । কিন্তু অসুখটা যে কি সেটা ডাক্তাররাও বুঝতে পারছিলনা ।
কলকাতার মহাজাতি সদনে
সারাবাংলা স্কুল ড্রামা কম্পিটিশন হবে । সেখানে উত্তরা অভিমন্যু নাটকের অভিনয় হবে
। বিদায় নিতে এসেছিল মধু । মিতা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে , ফিরে এসে আর উত্তরা কে
দেখতে পাবেনা -- দেখো ।
মধু ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে
বললে, তুমি সবসময় খারাপ কথা বলো
। দেখো আমরা বেঁচে থাকব আকাশে গায়ে নক্ষত্রদের মতো ।
মধু চলে যায় । মিতা চোখের
জলে ভাসতে থাকে ।
সেদিন রাতে এক অদ্ভুত
স্বপ্ন দেখল মিতা । এক মহাজাগতিক প্রাণী নেমে এল আকাশ থেকে । সেই মহাজাগতিক প্রাণী
বললে, এস আমার সঙ্গে ।
-- কোথায় ?
-- আমি যেখানে বলব ।
-- সেখানে অভির সঙ্গে দেখা হবে ?
-- না ।
' তবে কেন এসেছ এখানে ? যাও, যাও
এখান থেকে । ' মিতার চিৎকারে ঘুম ভেঙে
গেল সবার । ওর মা জানতে চাইলে উত্তর দিতে পারল না । ক্রমে ঠাণ্ডা হয়ে এল ওর শরীর
। ডাক্তার ডাকা হল । কিন্তু সবার প্রচেষ্টাকে থামিয়ে দিয়ে ভোরের দিকে মারা গেল সে
।
মধু কলকাতা থেকে ফিরে যখন
মিতার কথা শুনল তখন উদ্গত কান্নাকে কোনোভাবে সংযত করল । নিজের ঘরে এসে মিতার ছবিটা
বের করে বললে, উত্তরার মৃত্যুর তো কথা
ছিলনা ।
কিন্তু অবরুদ্ধ কান্নাকে
কিছুতেই আবদ্ধ রাখতে পারল না ।
চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন