সুবি মামী আমাদের সব্বার মামী। বাবা-কাকুরা মামী বলত। আমরাও
বলি। বয়স আশি বছর পেরিয়েছে বোধহয়, মুখের বলিরেখার মানচিত্র থেকে অনুমান করি।
আমাদের গাঁয়ের একপাশে একটা ছোটো পুকুর আছে। তার পাড়েই সুবি মামীর টিনের ঘর। একটা
রুম আর একফালি বারান্দা। জায়গাটা নির্জন। ওদিকটায় কেউ যায় না। এড়িয়ে চলে।
দিনের বেলায় একবার সুবি মামী লাঠিতে ভর দিয়ে পাড়া ঘোরে। যার
যা বাড়তি খাবার থাকে আলগোছে সুবি মামীর হাতে থাকা বাটিতে দিয়ে দেয়। কেউ ভুলেও
বাটিটা ছোঁয় না। ছোটবেলায় এটা নিয়ে আমার খুব কৌতূহল ছিল। সুবি মামীকে কেউ ছোঁয়
না কেন!
পরে জেনেছিলাম, সুবি মামীর পুরো নাম সুবিমলা। বিয়ের বছর খানেক
বাদেই সুবি মামীর নাকি কুষ্ঠ ধরা পড়েছিল।
চিকিৎসায় সেরে উঠলেও শ্বশুরবাড়ির লোকজন আর নেয়নি। বর আবার বিয়ে করেছে। আর সুবি
মামীকে দয়া করে এই ঘর আর জায়গা দিয়েছে। আগে লোকের জমিতে খাটতে যেত। এখন আর পারে
না। বয়সটা অনেক হয়েছে। অগত্যা ভিক্ষাই ভরসা। তবে খাবারের অভাব হয় না।
দিন কয়েক হল লকডাউন চলছে। সব ঘরের দরজা বন্ধ। সুবি মামীও আর
বাইরে আসে না। আসলে, এসেও কিছু পায়নি বলেই হয়তো। আমরা সবাই এত ব্যস্ততার মাঝে
সুবি মামীর কথা ভুলে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে করেই হয়তো ভুলে দিয়েছিল সকলে।
আমাদের গ্রামের বিখ্যাত কৃপণ বৃন্দাবন পাল। বিন্দে পাল বলে
সবাই। তবে বিশেষ দরকার ছাড়া ওই নাম কেউ উচ্চারণ করে না। পাড়ায় ঘরে সবাই বলে, ওই
নাম উচ্চারণ করলে দিন খারাপ যায়। সকালে কেউ বিন্দে দাদুর মুখোমুখি পড়ে গেলে সাথে
সাথে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
বিন্দে দাদুর কাপড়ের দোকান শহরে, চালু দোকান। গ্রামে পাকা
বাড়ি। দুই মেয়ে, বিয়ে হয়ে গেছে। তবে কেউ আসে না সেভাবে। গাঁয়ের সবাই বলে,
বিন্দে বুড়োর কিপটেমির কারণেই কেউ আসে না। শুনছিলাম ইদানিং বিন্দে দাদুর ব্যবসা
বসে গেছে। গাঁয়ের লোকজন বলে, ব্যবসা বসবে না কেন। কখনো কারোকে একটা টাকা দিয়েছে!
কোনো ঠাকুর দেবতার পুজোয় চাঁদা দিয়েছে! অমন টাকা কোনো সৎ কাজে লাগবে না কখনো।
গাঁয়ের লোকজন একটু এড়িয়ে চলে বিন্দে দাদুকে। গাঁয়ের কোনো
পুজোপাব্বনে একটি টাকাও চাঁদা দেয় না কখনো। অনেকদিন আগে ক্লাবের ছেলেরা একবার
কার্তিক ফেলেছিল। বিন্দে দাদু্ নাকি সেই কার্তিক তুলে সামনের পুকুরের জলে ফেলে
দিয়েছিল। কোনো মন্দিরের সামনে কখনো হাতজোড় করে বা মাথা নিচু করে প্রণাম করতে কেউ
দেখেনি। চরম নাস্তিক এবং কৃপণ বিন্দে দাদুকে গাঁয়ের লোক বেশ অপছন্দ করে।
লকডাউন চলছে বলে বাজার-দোকান সব বন্ধ। বিন্দে দাদুর কাপড়ের
দোকান তাই বন্ধ। বাড়ির গেটও বন্ধ। সবারই। আমরাও ব্যালকনি থেকে রাস্তা দেখি, জানলা
দিয়ে আকাশ দেখি।খাঁচায় বন্দি যেন আমরা সবাই।
একদিন সন্ধ্যার সময় দেখলাম বিন্দে দাদু রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে
গেল, একটু পরেই ফিরে এল।একটু অবাক হলাম। ওদিকে কোথায় গিয়েছিল! পরদিনও। তারপর দিন
ঠিক করলাম একটু লক্ষ্য রাখতে হবে, কিপটে বুড়ো রোজ কোথায় যায়।
পরদিন বিকেল থেকে বসে রইলাম। সন্ধ্যে সেই নেমেছে, দেখি বিন্দে
দাদুর হাতে সেই ব্যাগ। দ্রুত পায়ে হেঁটে পেরিয়ে গেল। একটু পরেই ফিরে এল। ব্যাগটা
ভাঁজ করে হাতে ধরা। কৌতূহলী হয়ে পরদিন বিন্দে দাদু পেরোনো মাত্র ঘর থেকে বেরিয়ে
পিছু নিলাম।
এ তো সুবি মামীর বাড়ির পথ! সুবি মামীর ঘরের সামনে এসে
"মামী মামী" বলে ডাকতেই লাঠি হাতে বেরিয়ে এল সুবি মামী। হাতে একটা
থালা। থালাটা নামাতেই হাতের ব্যাগটা থেকে রুটি আর প্লাস্টিক প্যাকেটে তরকারি বের
করে থালায় দিল। এক প্যাকেট মুড়ি নামিয়ে রাখল পাশে। অন্য একটা প্লাস্টিকে মিষ্টি
অথবা গুড় কিছু হবে।
আবছা আলোয় দেখতে পাচ্ছিলাম সুবি মামীর দু'চোখ ছলছল করছে।
আশীর্বাদের ভঙ্গিতে দু'হাত তুলে বিড়বিড় করে আশীর্বাদ করছে বিন্দে দাদুকে। সারা
গাঁয়ের লোক যার কিপটেমির জন্য নাম উচ্চারণ করে না, সেই বিন্দে দাদু হাসিমুখে সুবি
মামীকে বলছে, "এগুলো সব খেয়ে নিও। আমি কাল আবার আসব।"
দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরে এলাম। একটু পরে বিন্দে দাদু পেরিয়ে
গেল। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, সারা গ্রাম সুবি মামীর কথা ভুলে গেছে। সবাই নিজেদের
নিয়ে ব্যস্ত। অথচ যে লোকটা সারাজীবন তাচ্ছিল্য পেয়েছে তার নাস্তিক স্বভাবের
জন্য, কিপটেমির জন্য, সে ঠিক মনে রেখেছে অসহায় মানুষটার কথা।
এই চরম স্বার্থপরতার যুগে বেশিরভাগ মানুষই মুখোশ পরে থাকে, ভালো
মানুষের মুখোশ। কিন্তু কেউ খারাপ মানুষের মুখোশও পরে থাকে এই প্রথম জানলাম।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন