সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন রমলা। কাজের মেয়ে পুটু অবাক চোখে দেখলো – কি গো দিভাই, আজ এত ভোরেই উঠে পড়েছো! আবার স্নানও সারা হয়ে গেছে! নতুন শাড়ি পড়েছো! কি ব্যাপার!
সন্ধ্যা
উতরে গেছে। শ্রাবণের বর্ষণসিক্ত আকাশে থোকা থোকা বাদল মেঘ ভেসে চলেছে নিরুদ্দেশের
পথে। তিনদিন আগেই পূর্ণিমা ছিল। রাখীপূর্ণিমা। মস্ত গোল সোনার থালার মতো চাঁদ
সেদিন ঝলমল পূবাকাশে উঠেছিল সন্ধ্যার আগেই। আজও উঠেছে চাঁদ, তবে গোল নয়, চতুর্থীর
ক্ষয়া চাঁদ, কেমন যেন বিবর্ণ, ম্লান, ঔজ্জ্বল্যহীন! মাঝে মাঝে বাদল মেঘগুলো এসে
ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে, কিছুক্ষণ পরেই আবার দৃশ্যমান হচ্ছে চাঁদ – এই অবিরাম
প্রক্রিয়াটা রমলা দোতলার হলঘরে বসেই অলস ভাবে দেখছেন। কিছুক্ষণ আগেই বিদায়
নিয়েছে রমলার ছাত্রীরা। ওরাও আজ মন ঢেলে গেয়েছে। বিশেষ করে শৃণিকার "হে মোর
দেবতা" এবং পৌলমীর "আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে" ছিল আজকের সেরা
নিবেদন। তবে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছিল দুপুরবেলার ছাত্রীদের ব্যাচে! "আমার সকল
দুঃখের প্রদীপ" গানটা গাইতে গাইতে রমলা হঠাৎই কেঁদে ফেলেছিলেন। সবাই তো
হতভম্ব! নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে এগিয়ে এসেছিল সর্বকনিষ্ঠা ছাত্রী, পাঁচ বছরের
দিশা। রমলার গলা জড়িয়ে ধরে আদর করে দিশা বলেছিল- "ও দিদিমণি! কাঁদছো
কেন! তোমার কেউ নেই বলে বুঝি তুমি কাঁদছো! কেঁদো না! আমরা তো আছি!"
ওইটুকু
মেয়ের সান্তনায় আবারও কেঁদে ফেলেছিলেন রমলা। অন্য ছাত্রীরা বুঝতে পারছিল না তাদের
কি করা উচিত! কিছুক্ষণ বাদে প্রকৃতিস্থ হয়ে রমলা বলেছিলেন – "ঠিক
বলেছিস! তোরা তো আছিস! আর আছে আমার ঠাকুর!"
দিশা
চট্ করে বলে উঠেছিল – "তুমি তো খুব ঠাকুরঘরের কথা বলো! কই তোমার ঠাকুরঘরে তো
কোনো ঠাকুর নেই! শুধু আছে রবীন্দ্রনাথ!"
উদাস
হেসে রমলা উত্তর দিয়েছিলেন – "ওরে, ওই তো আমার ঠাকুর রে! আমার প্রাণের
ঠাকুর! কিন্তু দিশা রমলার উত্তরে বিশেষ সন্তুষ্ট হয়নি।
–
দিভাই, তুমি এখনও বসে আছো! খাবে না! চলো! খাবার পরে তো আবার প্রেসারের ওষুধ,
সুগারের ওষুধ...।
– ওসব
হবে 'খন। এখন তুই আমার পাশে একটু বস তো পুটু! তোকে একটা গান শোনাই!
রমলা
গাইতে থাকেন – "পথের শেষ কোথায়... শেষ কোথায়... কী আছে শেষে..."।
রমলার গানের আকুতি পুটুকেও অবাক করে দিয়ে কেঁপে কেঁপে মিশে যেতে থাকে রাতের
হাওয়ায়.... আর আকাশের চাঁদ ক্রমশ ঢেকে যেতে থাকে শ্রাবণের মেঘে মেঘে....।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন