কল্পনা চাওলা
"হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরেঃ
শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোন 'মঙ্গল' হতে আসছে উড়ে।। "
-
কাজী নজরুল ইসলাম (
সংকল্প )
আমার মনে আছে তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। বিদ্যালয়ে
প্রার্থনা চলছিল। প্রার্থনা শেষ হওয়ার পর দাদাভাই আমাদের কল্পনা চাওলা মারা
গিয়েছেন তা জানিয়েছিলেন এবং সবাইকে ১ মিনিট নীরবতা পালন করতে বলেছিলেন। আমরা তাঁর নির্দেশ মতো তাই করেছিলাম। তখন তো এত ফোন,ইন্টারনেটের রমরমা ছিল না। রঙিন টি.ভি,
কেবল্ লাইনও খুব কম মানুষের বাড়িতে ছিল। খবর এত সস্তা ছিল
ছিল না,ভরসা ছিল
সেই দূরদর্শন কেন্দ্র। তাই তাঁর সম্পর্কে বেশি কিছু জানতেও
পারি নি।ধীরে ধীরে বড় হয়েছি, তাঁর সম্পর্কে জেনেছি, বিস্মিত হয়েছি জেনে যে,
যদি স্বপ্ন আর স্বপ্ন পূরণের জেদ থাকে,তাহলে নিজের লক্ষ্যে মানুষ পৌঁছাতে পারেন। কল্পনা
চাওলা তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আজ আমরা সেই মহীয়সী
নারী যিনি নিজের মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন, তাঁর সম্পর্কে জানব।
কল্পনা চাওলা ভারতের প্রথম মহিলা মার্কিন নভোচারী এবং নভোযান বিশেষজ্ঞ।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
জন্মস্থান : কার্নাল, হরিয়ানা, ভারত।
তাঁদের আদিবাড়ি বর্তমান পাকিস্তানের মুলতানে। দেশভাগের সময় তাঁরা হরিয়ানার কার্নালে
চলে আসেন।
জন্ম তারিখ,সাল : ১৭ই মার্চ ১৯৬২ সালে হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
ভাই-বোন : চার ভাইবোনদের মধ্যে তিনি ছোট ছিলেন। তাঁর ভাইবোনদের
নামগুলি হল - সুনীতা চাওলা, সঞ্জয় চাওলা, দীপা চাওলা।
পিতা : বেনারসি লাল চাওলা। তিনি তাঁর পরিবারের ভরণপোষণের জন্য বেশ কিছু ছোটখাটো কাজ
(রাস্তার ফেরি করা, কাপড় বিক্রি করা এবং ধাতু তৈরির কাজ) করতেন। অবশেষে তিনি টায়ার তৈরির ব্যবসা
শুরু করেন।
মাতা : সংযোগিতা চাওলা। গৃহবধূ ছিলেন।
বিবাহ সাল : ১৯৮৩।
স্বামী : জেন পিয়ের হ্যারিসন। তিনি বিমানচালনা প্রশিক্ষক এবং বিমানচালনা সম্পর্কিত
বিষয়ের লেখক ছিলেন। (flying instructor and an
aviation author)।
নামকরণঃ কল্পনা চাওলা ছোটবেলা থেকেই খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি
নিজের নাম নিজেই পছন্দ করে রেখেছিলেন। ছোট্টবেলায় আনুষ্ঠানিভাবে তাঁর নামকরণ করা হয় নি। বাড়িতে
সবাই "মন্টো" নামে ডাকত। যতদিন বাড়িতে ছিলেন ততদিন সমস্যা হয় নি,
কিন্তু বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় ডাক নামটি তো আর দেওয়া যায় না,
ভালো নাম দিতে হবে যে!
ঠাকুর বাল নিকেতনে ভর্তির সময় অধ্যক্ষ ছাত্রীর নাম জিজ্ঞেস
করেন। কল্পনার কাকিমা উত্তর দিয়েছিলেন, তাঁরা তিনটি নাম ভেবেছেন - কল্পনা,
জ্যোৎস্না এবং সুনয়না। কিন্তু এখনও ঠিক করে সিদ্ধান্ত নিতে
পারেন নি কোন নামটা রাখবেন। তাই অধ্যক্ষ ছোট্ট মেয়েটিকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন,
কোন নামটি তার সবচেয়ে ভালো লেগেছে। সেই ছোট্ট মেয়েটি
দৃঢ়ভাবে উত্তর দিয়েছিল, “কল্পনা। কারণ এর অর্থ কল্পনা করা।" (And she replied firmly, “Kalpana. Because
it means imagination.” ) নামটির
সাথে জড়িয়ে আছে 'স্বপ্ন'!
শিক্ষা জীবনঃ
তিনি তাঁর প্রাথমিক,মাধ্যমিক শিক্ষা ঠাকুর বাল নিকেতন সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল, কারনাল থেকে সম্পন্ন করেন। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। ছোট থেকে কোনও দিন ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করেননি৷ তবে প্রথম থেকে পঞ্চম স্থানের মধ্যে থাকতেন৷
বড় হয়ে তিনি
ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং এই স্বপ্ন পূরণ করতে তিনি ১৯৮২
সালে পাঞ্জাব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন।
সেইখান থেকে মহাকাশ প্রকৌশলের ওপর স্নাতকের পাঠ সম্পন্ন করেন।
উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং
সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট আর্লিংটন থেকে একই মহাকাশ প্রকৌশল বিষয়ে
স্নাতকোত্তর শিক্ষা সমাপ্ত করেন ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। পরবর্তীতে কল্পনা ১৯৮৬
খ্রিষ্টাব্দে ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো বোল্ডার থেকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপ্ত হন।
জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা
ঘটনা নং -১ঃ
কল্পনা চাওলার বাড়ির পাশেই 'কার্নাল এভিয়েশন ক্লাব' নামে একটি 'ফ্লাইং ক্লাব' ছিল,যেটি তাঁর বাড়ির থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিল। তাঁদের ছাদের উপর দিয়ে
উড়োজাহাজ উড়ে যেতে দেখা যাতে। ছোট্ট কল্পনা সেই গর্জনরত উড়োজাহাজ দেখতে ছাদে
উঠতেন। অনেক সময় বিমান একটু নীচু হয়ে গেলে ছোট্ট কল্পনা অতি উৎসাহে পাইলটের দিকে
হাত নাড়তেন। একপ্রকার বলা যায় তাঁর স্বপ্নের পালে হাওয়া দিয়েছিল বাড়ির পাশের সেই
উড়োজাহাজের ক্লাবটি!
ছোট্টবেলায় তিনি ও তাঁর দাদা সাইকেলে চড়ে উড়োজাহাজের সাথে
সাথে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। দেখতে চাইতেন বিমানগুলি কোথায় যায়! কল্পনা চাওলা এবং তাঁর ভাইবোনেরা তাঁদের বাবার কাছে আবদার
করেছিলেন বিমানে চড়ার জন্য। তাঁর বাবা তাঁদের পুষ্পক এবং একটি গ্লাইডারে
চড়িয়েছিলেন। এইসব জিনিসই তাঁকে মহাকাশের প্রতি আরও আকৃষ্ট করে তুলেছিল।
এছাড়াও, বড় হয়ে, তাঁরা J.R.D সম্পর্কে জানলেন। টাটা, ভারতে প্রথম কিছু মেল ফ্লাইট উড়িয়েছিল,
যার মধ্যে একটি এখনও সেখানের এরোড্রোমে ঝুলছে। তিনি সেই বিমানটি দেখেছিলেন এবং খুব আনন্দ
পেয়েছিলেন। স্কুলে, আঁকার ক্লাসে তাঁর সহপাঠীরা যখন পাহাড়,
বন এবং নদী আঁকত, তখন কল্পনা মেঘের মধ্যে উড়ন্ত রঙিন বিমানের ছবি আঁকতেন। তিনি ক্রাফ্ট ক্লাসেও বিমানের মডেল তৈরি
করতে পছন্দ করতেন।
তিনি একজন অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থী হওয়ার সাথে সাথে একজন
সংবেদনশীল মানুষও ছিলেন। একবার শ্রেণিতে তাঁর এক শিক্ষিকাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ;
"মানুষকে কীভাবে শ্রেণী,
সম্প্রদায় এবং ধর্মে বিভক্ত করা যায়,
যখন তারা আকাশ থেকে একই রকম দেখায়?"
( “How can people be divided into classes, sects and religions, when they all
look alike from the sky?” )
ঘটনা নম্বর -২ঃ
তিনি কঠোর পরিশ্রমী, মনোযোগী এবং একজন ভালো ছাত্রী ছিলেন;
যিনি ইংরেজি, হিন্দি এবং ভূগোলের মতো বিষয়গুলি আনন্দের সাথে পড়তেন। তবে
তার প্রিয় বিষয় ছিল বিজ্ঞান। বিদ্যালয় জীবনে নাচ ছাড়াও, তিনি সাইকেল চালানো, দৌড়ানো এবং ব্যাডমিন্টন খেলা উপভোগ করতেন। কল্পনা চাওলা সম্পূর্ণরূপে 'টমবয়' ছিলেন। তিনি তাঁর চুল ছোট রাখতেন,
কখনও কোনও মেক-আপ করেননি এবং খুব কমই ফ্যাশনে মনোযোগ দিতেন।
এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
তাঁর বড় বোনের বিয়ে
ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সবাই খুব আনন্দে আছে। বিয়ের দিন কে কী পরবে এই নিয়ে চিন্তা ভাবনাও করছে।অন্যদের থেকে সুন্দর
দেখানোর চেষ্টায় সবাই ব্যস্ত। কিন্তু কল্পনা চাওলা ছিলেন অন্য
ধাতের মানুষ। তিনি মনে করতেন এইসবে খরচ করা অপচয় এবং অপ্রয়োজনীয়! তাই তিনদিন একই
পোশাক পরেছিলেন। কেউ তাঁকে তাঁর এই সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে
পারেন নি।
ঘটনা নম্বর – ৩ঃ
তাঁর দশম শ্রেনীর বোর্ড পরীক্ষার পর,
তিনি তাঁর উচ্চ শিক্ষার জন্য DAV
কলেজে ভর্তি হন। এখানেই একটি মজার (প্রায় প্রাজ্ঞ) ঘটনা
ঘটেছিল।
গণিতের ক্লাস চলাকালীন, কল্পনা চাওলার শিক্ষিকা নাল সেটের (null
set (empty set in algebra) ধারণাটি
ব্যাখ্যা করছিলেন (বীজগণিতে খালি সেট)। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন যে,
ভারতীয় মহিলা মহাকাশচারীদের সেট 'নাল সেট'-এর একটি ক্লাসিক উদাহরণ। কারণ,
আজ পর্যন্ত কোনও ভারতীয় মহিলা 'মহাকাশচারী' হননি। সেই উদাহরণটি কল্পনা চাওলার পছন্দ হয় নি। তিনি
সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলেন,
"কে জানে,
ম্যাম, একদিন এই সেট খালি নাও হতে পারে!" অন্তর থেকে কিছু
চাইলে ঠিক এইভাবেই মুখ দিয়েও তার প্রকাশ ঘটে! যাইহোক, সেই সময়, ক্লাসরুমের কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে,
যে মেয়েটি এই লাইনগুলি বলেছিল সে নিজেই সেটটি ভবিষ্যতে
পূরণ করবে!
সাফল্যের সাথে ১২তম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা শেষ করার পরে,
কল্পনা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর বাবা
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পক্ষে ছিলেন না। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন যে এটি মেয়েদের জন্য উপযুক্ত
ক্যারিয়ারের বিকল্প নয়। তিনি তাঁকে ডাক্তার বা স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার পরামর্শ
দিয়েছিলেন। কিন্তু কল্পনা ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং তারজন্য
একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অপরিহার্য ছিল।
কল্পনা চাওলা তাঁর মায়ের নিঃশর্ত সমর্থন পেয়েছিলেন এবং
তাঁর বাবা যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে কল্পনা মন থেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চান তখন শেষ
পর্যন্ত তাঁকে অনুমতি দিয়েছিলেন। এরপর কল্পনা চণ্ডীগড়ে চলে যান। যেখানে তিনি পাঞ্জাব
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স বাছাইয়ের জন্য কাউন্সেলিং
করার সময়, তিনি
'অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং'
বেছে নিয়েছিলেন। বিস্মিত কাউন্সেলররা তাঁকে অ্যারোনটিক্যাল
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যোগদান করা থেকে বিরত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন,
কারণ সেইসময় দেশে এইবিষয়ে চাকরির সুযোগ সীমিত ছিল। কিন্তু
কল্পনা নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়তে রাজি হননি। যখন তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে,
'তাঁর কাছে দ্বিতীয় বিকল্প কিছু
আছে কী?',
সে উত্তর দেয় যে, 'তার কাছে কিছুই নেই'।তিনি একজন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্যই দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ
ছিলেন,
এবং পৃথিবীর কিছুই তাঁকে অন্য স্ট্রিম বেছে নিতে রাজি করতে
পারেনি।
সেই কলেজে তিনি একমাত্র মেয়ে ছিলেন যিনি এই কোর্সটি
করছিলেন।
ঘটনা নম্বর – ৪ঃ
তিনি একাগ্র চিত্তে কলেজের পড়াশোনা করেন। সেইসময় কলেজে মেয়েদের হোস্টেল ছিল না। তাই তিনি
একাই থাকতেন গ্যারেজের ওপরের ছোট্ট ঘরে। প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে কলেজে যেতেন। অবসর সময়ে, তিনি কারাটে
শিখতেন ('ব্লেক বেল্ট' পেয়েছিলেন) এবং তাঁর প্রিয় লেখকদের (আলেকজান্ডার সোলঝেনিটসিন,
অ্যান র্যান্ড, ওরিয়ানা ফ্যালাসি এবং রিচার্ড বাচ) বই পড়তেন। তিনি ক্লাসিক রক, বিশেষ করে ১৯৭০-এর দশকের ব্রিটিশ ব্যান্ড ডিপ পার্পল এবং
সুফি সঙ্গীত শুনতেন। এছাড়াও আবিদা পারভীন, নুসরাত ফতেহ আলী খান, রবি শঙ্কর এবং হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সঙ্গীত উপভোগ করতেন।
পরবর্তীকালে ইনাদের
সিডি তিনি মহাকাশেও নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেখানেও তাঁদের সঙ্গীত উপভোগ করতেন।
কল্পনা বিমান চালনার পত্রিকা এবং বই সংগ্রহ করতে পছন্দ
করতেন এবং সেগুলি প্রচ্ছদ থেকে প্রচ্ছদ পড়তেন। তিনি তার কলেজ ম্যাগাজিনের একজন
ছাত্র সম্পাদক এবং কলেজের অ্যারো ক্লাব এবং অ্যাস্ট্রো সোসাইটির যুগ্ম সম্পাদক
হয়েছিলেন।
তিনি নতুন প্রজেক্টে কাজ করার ব্যাপারে সর্বদা উৎসাহী
থাকতেন। তিনি তাঁর প্রথম বছরেই কলেজের বার্ষিক সম্মেলনে 'টাইম-ল্যাপস ইন স্পেস' (একটি বিষয় যা আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বের
সাথে সম্পর্কিত) একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে তাঁর অধ্যাপক এবং সিনিয়রদের অবাক
করে দিয়েছিলেন!
ঘটনা নম্বর – ৫ঃ
১৯৮২ সালে, কল্পনা চাওলা তাঁর ব্যাচে তৃতীয় স্থান নিয়ে প্রথম মহিলা
অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন উড়ানের পথে এটি ছিল প্রাথমিক ধাপ। এরপর আরও
অনেক কিছু অর্জন করতে হবে, তবেই পূর্ণ হবে তাঁর স্বপ্ন।একটি ভাল একাডেমিক রেকর্ড এবং PEC
এর অ্যারো এবং অ্যাস্ট্রো সোসাইটিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ
কল্পনাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যারোস্পেস
ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মাস্টার্স কোর্সে সহজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তবে পথ এত
মসৃণ ছিল না। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি পেতে পরিবারকে রাজি করাতে
তাঁকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। কয়েক মাস লেগে গিয়েছিল রাজি করাতে! ফলস্বরূপ,
তিনি কয়েক মাস দেরিতে সেশনে যোগ দিয়েছিলেন। কল্পনা যখন দেশ
ছেড়ে আমেরিকায় যান, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর।
এই সময়েই কল্পনার দেখা হয় ফ্রান্সের জ্যঁ পিয়ের হ্যারিসনের সাথে। তিনি তাঁর প্রেমে পড়েন। হ্যারিসন একজন ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর এবং একজন এভিয়েশন লেখক ছিলেন। তিনি ১৯৮৩ সালে তাঁকে বিয়ে করেছিলেন এবং স্বামীর কাছ থেকেই কল্পনা প্লেন উড়াতে শিখেছিলেন। কল্পনা একক ইঞ্জিন এবং বহু-ইঞ্জিন ল্যান্ড অ্যারোপ্লেন চালাতে পারতেন। তিনি বাণিজ্যিক প্লেন ওড়ানোর লাইসেন্স পেয়েছিলেন এবং একজন প্রত্যয়িত ফ্লাইট প্রশিক্ষকও ছিলেন। জলে অবতরণ করতে পারে এমন বিমান এবং গ্লাইডারও চালাতে পারতেন তিনি।
দুই বছরের ব্যবধানে, কল্পনা টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহাকাশ প্রকৌশলে তাঁর
স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এর পরে, ১৯৮৬ সালে, কল্পনা তাঁর দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৮৮ সালে, কল্পনা বউল্ডের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহাকাশ
প্রকৌশলে তাঁর ডক্টরেট ( PhD) সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবনঃ
পেশা : গবেষক বিজ্ঞানী।
ভাইস প্রেসিডেন্ট : নাসার ওভারসেট মেথডের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি৷
মহাকাশে অবস্থানকাল : ৩১ দিন ১৪ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট।
অভিযান : এসটিএস-৮৭, এসটিএস-১০৭
১৯৮৮ সালে কল্পনা চাওলা NASA -এর Ames রিসার্চ সেন্টারে কাজ শুরু করেন,
একই বছরে পাওয়ার-লিফট কম্পিউট্যাশনাল ফ্লুইড ডাইনামিক্সের
ওপর গবেষণা শুরু করেন।
তিনি ১৯৯৩ সালে প্রথমবার নাসার কাছে মহাকাশচারী হিসাবে
প্রশিক্ষণের জন্য আবেদন করেছিলেন কিন্তু তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।
১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে কল্পনা চাওলা নাসার জ্যোতির্বিজ্ঞানী
হিসেবে নিয়োজিত হোন।
এরপর ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে, কল্পনা চাওলা জনসন স্পেস সেন্টারে রিপোর্ট করেছিলেন এবং
মহাকাশচারী হিসেবে সেখানে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হোন।
তিনি ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে মহাকাশচারীদের ১৫ তম গ্রুপে একজন নভোচারী প্রার্থী হিসাবে রিপোর্ট করেছিলেন।
১৯৯৬ সালের নভেম্বরে, তাঁকে স্পেস শাটল STS-87 (নভেম্বর ১৯ থেকে ৫ই ডিসেম্বর,১৯৯৭)-এ মিশন বিশেষজ্ঞ এবং প্রধান রোবোটিক আর্ম অপারেটর
হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। এই মিশন ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে 'কেনেডি স্পেস সেন্টার' থেকে যাত্রা শুরু করে ১৫ দিন মহাকাশে অবস্থান করে। সেটাই
ছিল তাঁর প্রথমবারের মতো মহাকাশে পাড়ি দেয়া। সেই স্পেস শাটল ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে
পৃথিবীতে ফিরে আসে।
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে কল্পনা চাওলা নাসাতে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। সব প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের পর অবশেষে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ই নভেম্বর প্রথমবারের মতো মহাকাশে ওড়ার সুযোগ পান কল্পনা চাওলা। এতদিনের 'স্বপ্নের উড়ান' বাস্তবের ছোঁয়া পেল! তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেন।
তাঁর প্রথম মিশনের অংশ হিসাবে,
কল্পনা পৃথিবীর ২৫২টি কক্ষপথে ৬.৫ মিলিয়ন মাইল ভ্রমণ
করেছেন এবং মহাকাশে ৩৭৬ ঘন্টা এবং ৩৪ মিনিট লগ করেছেন,
মহাকাশে যাওয়া প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহিলা হয়েছেন।
পাঁচ বছরেরও কম সময় পরে, তাঁকে দ্বিতীয়বার মহাকাশ মিশনে যেতে নাসা ছাড়পত্র
দিয়েছিল।
২০০০ সালে এসটিএস-১০৭ মিশনে তাঁকে মিশন স্পেশালিস্ট হিসেবে
নির্বাচন করা হয়। স্পেস শাটলটির নাম ছিল 'কলম্বিয়া'। প্রাথমিকভাবে সেই মিশন জানুয়ারি ২০০১ সালে যাত্রা শুরুর
কথা থাকলেও তা বিলম্বিত হয়ে ২০০৩ সালে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে লঞ্চ করা হয়।
স্পেস সাটলটি ১৫ দিন ২২ ঘণ্টা মহাকাশে অবস্থান করে। শাটলটি
উড্ডয়নের ৮১.৭ সেকেন্ড পরেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক টুকরো ফোম শাটলটির
বাম পাশের অরবিটারের ক্ষতিসাধন করে। তা সত্ত্বেও মিশনটি সফলভাবে চলতে থাকে।
২০০৩ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি স্পেস শাটলটি পৃথিবীর
বায়ুমণ্ডলে পুনঃপ্রবেশ করে। কিন্তু এই অভিযানের অভিযাত্রীরা কেউ আর জীবিত পৃথিবীর
মাটিতে অবতরণ করতে পারেননি। কেনেডি স্পেস সেন্টারে অবতরণের ১৬ মিনিট আগেই স্পেস
ক্রাফটটি টেক্সাসের আকাশে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিস্ফোরিত হয়। এতে মিশনের সাত অভিযাত্রী
মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন। কল্পনাও সেই অভিযানে মৃত্যুবরণ করেন। সেটিই তার জীবনের শেষ
মহাকাশ যাত্রায় পরিনত হয়।
পুরস্কারঃ
তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছিলেন। কর্মজীবনের নাসার
তরফ থেকে পেয়েছেন একাধিক মেডেল ও সম্মান৷
কল্পনা চাওলাকে 'কংগ্রেশনাল স্পেশ মেডেল অফ অনার',
'NASA স্পেস ফ্লাইট মেডেল'
এবং 'NASA বিশেষ সার্ভিস মেডেল' সম্মানে ভূষিত করেছিল মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
পরলোক গমনঃ
" আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥“
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ--
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে ॥ " - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভারতের প্রথম মহিলা মহাকাশচারী কল্পনা চাওলার জীবন পর্যালোচনা করলে এবং দুর্ঘটনার ফলে তাঁর
মৃত্যু বরণ আমাদের রবি ঠাকুরের এই কবিতাটি মনে করিয়ে দেয়।
১লা ফেব্রুয়ারি ২০০৩ সালে ৪০ বছর বয়সে টেক্সাসের ওপরে আকাশে কলম্বিয়া মহাকাশযানটির বিপর্যয়ের
ফলে কল্পনা চাওলা সহ সাতজন মহাকাশচারী এবং ক্রু মৃত্যুবরণ করেন।
পাঞ্জাব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের কাছে তাঁর শেষ ইমেলে
কল্পনা লিখেছেন:
“স্বপ্ন থেকে সাফল্যের পথ বিদ্যমান। তোমাদের
কাছে এটি খুঁজে পাওয়ার দৃষ্টি,
এটিতে যাওয়ার সাহস
এবং এটি অনুসরণ করার অধ্যবসায় থাকতে পারে।"
(
“The path from dreams to success does exist. May you have the vision to find
it, the courage to get onto it, and the perseverance to follow it.”)
তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী 'উথার ন্যাশনাল পার্কে'-এ সমাহিত করা হয়।
অন্যান্য তথ্যঃ
১৯৯১ সালে আমেরিকার নাগরিকত্ব পান কল্পনা ।
তাঁর ব্যস্ত সময়সূচী সত্ত্বেও,
তিনি ভারতে তাঁর স্কুল এবং কলেজের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন।
তাঁর এই সাধু প্রচেষ্টার জন্য 'ধন্যবাদ' দেওয়া উচিত! এর থেকে তাঁর সরল,
নিরহঙ্কারী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি প্রতি বছর 'ঠাকুর বাল নিকেতন'-এর দুই ছাত্রকে নাসা পরিদর্শনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ছাত্ররা
তাঁদের ‘কল্পনা দিদি’র সাথে থাকত। তাদের জন্য বিশেষ করে ভারতীয় খাবার তৈরি করা
হত।
মহাকাশে পৌঁছনোর পর 'কলোম্বিয়া'র প্রত্যেক সদস্য এবং কল্পনার সঙ্গে কথা বলেছিলেন তৎকালীন
প্রধানমন্ত্রী (১২তম) আই কে গুজরাল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে পৃথিবীতে পৌঁছে ভারতে
আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কল্পনা চাওলা।
কল্পনা চাওলার দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন মহাকাশযান
তৈরি করে NASA। যার নাম দেওয়া হয়, ‘ওরিয়ন’ - বাংলায় ‘কালপুরুষ’।
তাঁর আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়ে ভারত প্রথম মেটোরোলজিকাল
স্যাটেলাইট এর নাম ‘কল্পনা-১’ রাখে।
২০০৪ সালে তরুণ মহিলা বিজ্ঞানীদের উৎসাহে 'কল্পনা চাওলা পুরস্কার' চালু করে কর্নাটক সরকার।
তাঁর মৃত্যুর পর কল্পনা চাওলার স্মৃতিতে মঙ্গল গ্রহের
কলম্বিয়া হিল চেইনের একটি চূড়াকে 'কল্পনা হিল' নাম দেওয়া হয়।
মৃত স্ত্রীর জীবন অবলম্বনে বই লিখে ফেলেছেন
হ্যারিসন। বইয়ের নাম ‘দি এজ অফ টাইম: দি অথরিটেটিভ
বায়োগ্রাফি অফ কল্পনা চাওলা।’
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন