গর্ভাবস্থায় জন্ডিস



গর্ভাবস্থায় জন্ডিস


গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরে নানাবিধ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। গর্ভাবস্থার মাধ্যমে একজন নারী যে মাতৃত্বের স্বাদ লাভ করেন, সেটি যেকোন নারীর কাছেই এক বিশেষ সুখানুভূতি। কিন্তু এই পরিবর্তনগুলির সাথে শারিরীক কিছু বিশেষ পরিবর্তনেরও আবির্ভাব হয়। গর্ভাবস্থার শেষ তিনমাসে প্লাসেন্টা থেকে নিঃসৃত হরমোনের প্রভাবে লিভার অর্থাৎ যকৃতের কার্যকারিতার‌ পরিবর্তন বিদ্যমান হতে পারে যকৃতের পিত্ত সংরক্ষণ এবং পিত্ত প্রবাহমানতার পরিবর্তন দেখা দেয়। এরফলে বিপাকক্রিয়ার গতি হ্রাস পায়। যকৃৎ যখন সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, তখন রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। বিলিরুবিন নামক হলুদ বর্ণের রঞ্জকটি আমাদের শরীরের একটি বর্জ্য পদার্থ এই বিলিরুবিনকে রক্ত থেকে সংগ্রহ করে যকৃৎ সেটিকে পিত্ততে রূপান্তরিত  করে পিত্তাশয়ে  নিঃসরণ করে এবং সর্বশেষে সেটি অন্ত্রে গিয়ে নিষ্কাশিত হয় এই জন্য গর্ভাবস্থায় যকৃতের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায় এবং জন্ডিস দেখা যায়‌।


 গর্ভাবস্থায় জন্ডিস কেন দেখা যায় 

  • যকৃতের কোন সংক্রমণের প্রভাবে জন্ডিস দেখা দিতে পারে। 
  • হিমোলাইসিসের প্রভাবে যদি লোহিত রক্তকণিকা প্রভূত পরিমাণে বিনষ্ট হয়। তবে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে এই অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। 
  • পিত্তাশয়ের পথ যদি অবরুদ্ধ থাকে কোন ক্যানসার বা টিউমারের মাধ্যমে তবে সেরকম অবস্থাতেও এটি দেখা যায়। 
  • কোলেস্ট্যাসিসের ফলে অনেকসময় যকৃতে পিত্তের প্রবাহ স্তব্ধ হয়ে যায়। এরফলে অতিরিক্ত পিত্তলবণ রক্তে মিশে যেতে পারে সাধারণত গর্ভাবস্থার ট্রাইমিস্টারে এটি দেখা যায়। এইরকম অবস্থায় অনেকসময় গর্ভবতী মা বলে থাকেন যে তার সারা শরীরে অসহ্য চুলকানি হচ্ছে বিশেষত হাত ও পা তালুতে চুলকানি হতে দেখা যায়। 
  • প্রি-এক্ল্যাপসিয়া (Preeclampsia)  বা হেল্প সিন্ড্রোমের ( HELLP syndrome)  ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং মূত্রে প্রোটিনের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় কিছুক্ষেত্রে এই কারণের জন্য যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জন্ডিস দেখা দিতে পারে। 
  • ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের দ্বারা প্রদত্ত জানার্লের মাধ্যমে জানানো হয়েছে যে ৪২৯ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজন জন্ডিসের শিকার হতে পারেন

 

গর্ভাবস্থায় জন্ডিস কি ক্ষতিকারক

গর্ভাবস্থায় জন্ডিস সাধারণত গুরুতর আকার ধারণ করে না। জন্ডিসকে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ ও সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব

তবে প্রি-এক্ল্যাপসিয়া বা অনান্য শারিরীক সমস্যার প্রভাবে যদি জন্ডিস দেখা যায়, সেক্ষেত্রে মা এবং সন্তান উভয়েরই কিছু শারিরীক সমস্যা দেখা দিতে পারে

 

মায়ের যে সমস্যা দেখা দিতে পারে – 

  • যকৃতের খারাপ হয়ে যাওয়া এবং মৃত্যু। 
  • স্নায়ুর বিবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। 
  • রেচন তন্ত্রের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। 
  • রক্ত নিঃসরণ হতে পারে


শিশুর ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত সমস্যা 

  • সময়ের পূর্বে সন্তানের জন্ম 
  • শিশুর স্বল্প বৃদ্ধি এবং শিশু অপুষ্ট হতে পারে। 
  • জরায়ুতে থাকাকালীন শিশুর মৃত্যু

 

গর্ভাবস্থায় জন্ডিস চিহ্নিতকরণের উপায়

জন্ডিসের জন্য প্রাথমিক কিছু লক্ষণ দেখা যায়। এই প্রাথমিক লক্ষণগুলিকে পর্যবেক্ষণ করলে জন্ডিসকে চিহ্নিতকরণ করা সম্ভব। প্রাথমিক লক্ষণগুলি হল – 

  • চোখ ও ত্বকের হলুদাভ বর্ণ। 
  • হলুদ অথবা কমলা বর্ণের মূত্র নিঃসরণ 
  • মলের বর্ণ হালকা হলুদাভ হওয়া


তাছাড়া আরো আনুষাঙ্গিক যেসব লক্ষণগুলি দেখা যায়  সেগুলো হল

  • মাথা ঘোরা, বমিভাব। তাছাড়া কোন সংক্রমণ হলে জ্বর দেখা দিতে পারে। 
  • কোলেস্ট্যাসিসের ফলে জন্ডিস হলে সারা শরীরে চুলকানি দেখা যায়। 
  • পেটের উপরিভাগে ব্যাথা ও জ্বালাভাব এবং কোন অ্যান্টাসিডের প্রভাবেই সেটা লাঘব না হওয়া। 
  • যকৃৎ যদি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তবে মানসিক স্থিতাবস্থা বিনষ্ট হতে পারে তাছাড়া শরীরের অস্বাভাবিক স্ফিতিও পরিলক্ষিত হতে পারে

 

তবে ডাক্তার কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে জন্ডিসকে চিহ্নিতকরণ করে। এই পরীক্ষার মধ্যে- লিভার ফাংশান টেস্ট, উদরগহ্বরের আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকে।

 

গর্ভাবস্থায় জন্ডিস হলে কি নরমাল ডেলিভ্যারি সম্ভব ?

যদি মা এবং শিশুর  কোন শারীরিক সমস্যা না থাকে, তবে নরমাল পদ্ধতি মেনে অর্থাৎ যোনি দিয়ে বাচ্চা প্রসব করা যেতে পারে। কিন্তু যদি প্রসবের আগে বা পরে কোন বিশেষ সমস্যা দেখা যায়। তখন সিজিরিয়ান পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।

গর্ভাবস্থায় জন্ডিসের সময় কি কি খাদ্য গ্রহণ করা উচিৎ

গর্ভাবস্থায় জন্ডিস হলে কোন নির্দিষ্ট খাদ্যগ্রহণ করার নিয়ম নেই। তবে এইসময় পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করাই যথোপযুক্ত সবজি, বিন্স, ডাল, চাল অথবা গম দিয়ে তৈরি খাবার, টাটকা ফল এই সময়ে খাওয়া উচিৎ বাইরের খাবার এবং তেলেভাজা খাবার এড়িয়ে চলাই শ্রেয়

 

জন্ডিস মোকাবিলার উপায়

  • গর্ভাবস্থায় জন্ডিস কিছু উপায় অবলম্বন করলে মোকাবিলা করা সম্ভব – 
  • স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রয়োজন এবং গর্ভাবস্থায় বাইরের খাবার একদম নৈব নৈব চ। 
  • খাবার খাওয়ার আগে ও পরে ভালো করে হাত ধোঁয়া দরকার। 
  • ডুবো তেলে ভাজা খাবার না খাওয়াই ভালো এরফলে শরীরে বাজে কোলেস্টেরল বাসা বাঁধতে পারে.
  • সংক্রামক ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে ভ্যাক্সিন নেওয়া দরকার

গর্ভাবস্থায় জন্ডিসের চিকিৎসা

গর্ভাবস্থায় জন্ডিসের চিকিৎসা নির্ভর করে জন্ডিসের পিছনে জড়িয়ে থাকা কারণের উপর। এই অবস্থায় শারীরিক অবস্থার উন্নতি, কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখতে পাওয়া এবং উৎসের অনুসন্ধান করাই হল চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য এই চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে থাকতে পারে-  

  • ইন্ট্রাভেনাস তরল প্রয়োগের মাধ্যমে শরীরে জল এবং পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখা। 
  • বমি রোধের জন্য বিশেষ ওষুধ 
  • জ্বরের ওষুধ 
  • কোলেস্ট্যাসিস হলে সেটি নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ 

কিছুক্ষেত্রে জন্ডিসকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল  করার স্বার্থে সময়ের পূর্বে সন্তান প্রসবের ব্যবস্থাও করা হয়।


কলমে - সুকৃতি দাস 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন