বাড়ির পার্শ্বে কবিগুরু

 

কবি প্রণাম -  আগামী ২২ শে শ্রাবণ ( ৮ই আগষ্ট) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী।

আমার জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলায়। পাবনা জেলা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এবং প্রাচীন একটি জেলা। জেলাটি মানসিক হাসপাতাল এবং নির্মাণাধীন পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বিখ্যাত। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ দুধ উৎপাদন এই জেলাতেই হয়। জেলাটি অন্যতম শীর্ষ পিঁয়াজ উৎপাদনকারী। এই জেলার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পদ্মা নদী ।

পাবনা জেলার মধ্যে প্রবাহমান অরেকটি উল্লেখযোগ্য নদীর নাম বড়াল। নদীটি একদম আমার বাড়ীর পাশ দিয়ে বয়ে গেছেএই বড়াল নদীতে বাংলাদেশের উল্ল্যেখযোগ্য একটি নদী বন্দর হল বাঘাবাড়ী বন্দর। আর এই বন্দর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মৃতিবিজড়িত রবীন্দ্র কাচারী বাড়ী।

 

রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির প্রধান ফটক


এখানে নদীর প্রসঙ্গটি এই জন্য আনলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী হতে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ হয়ে শাহজাদপুরে এই কাচারী বাড়িতে আসতেন। সেক্ষেত্রে তাঁকে বড়াল নদীতেও আসতে হত। শাহজাদপুর বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলাআওতাধীনসিরাজগঞ্জ জেলাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ে তো বটেই ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাবনা জেলার পদ্মা নদীর ঠিক ওপারেই কুষ্টিয়া জেলা। পদ্মা নদীর তীরবর্তী স্থানেই শিলাইদহের অবস্থান। কুষ্টিয়াতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি ছাড়াও লালনের মাজার এবং বাংলা সাহিত্যের “বিষাদ-সিন্ধু” খ্যাত মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা রয়েছে কুষ্টিয়া জেলাও এক সময় পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

পাবনার প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ টান ছিল। জেনে আশ্চর্য হতে পারেন কেউ কেউ, পাবনা জেলাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়ি করতে চেয়েছিলেন।  চলুন তার লেখাতেই পড়িঃ


পাবনায় বাড়ি হবে, গাড়ি গাড়ি ইঁট কিনি,
রাঁধুনিমহল-তরে করোগেট-শীট্‌ কিনি।
ধার ক'রে মিস্ত্রির সিকি বিল চুকিয়েছি,
পাওনাদারের ভয়ে দিনরাত লুকিয়েছি,
শেষে দেখি জানলায় লাগে নাকো ছিট্‌কিনি

(খাপছাড়া, কবিতার নাম পাবনায় বাড়ি হবে, গাড়ি গাড়ি ইঁট কিনি। কবিতাটা তিনি শান্তিনিকেতনে ৫ বৈশাখ, ১৩৪৪ সালে লিখেছিলেন)


শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের কাছারিবাড়ি তাঁর অসংখ্য স্মৃতি বহন করছে। বর্তমানে এটি একটি জাদুঘর। এখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সোনার তরী, দুই পাখি, আকাশের চাঁদ, যমুনা, চিত্রা, চৈতালি, রচনা করেন। গীতাঞ্জলিও এখান থেকে শুরু করেন। পোস্টমাস্টার গল্পের বিখ্যাত রতন চরিত্র শাহজাদপুরে রচিত।

 

শাহজাদপুরে শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারিবাড়ি (ছবি হাদী উল ইসলাম)


শাহজাদপুর হতে আর একটু দুরেই পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলা। এখানে জন্ম বাংলা সাহিত্যের আরেক প্রতিভাবান ব্যক্তি, প্রমথ চৌধুরী, যিনি বীরবল নামেও পরিচিত প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ইন্দিরা দেবীর বিবাহ হয়েছিল।

জমিদারি কাজের সূত্রে অসংখ্যবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাবনাসেছেন। তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করার জন্য ১৯০৮ পাবনায় এসেছিলেন।

নোবেল পুরস্কার গ্রহনের পরের বছর অর্থাৎ ১৯১৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাবনায় সম্বর্ধনা দেয়া হয়। এই সম্বর্ধনা ১৯১৪ সালের ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। তিনি পাবনার শিতলাই হাউসে অবস্থান করেন। এই সংবর্ধনা শেষে ফিরে গিয়ে তিনি টমসন কে (Edward John Thompson ,9 April 1886 – 28 April 1946 ইংরেজ পন্ডিত, সাহিত্যিক উপন্যাসিক এবং অনুবাদক) লেখেন,

I was dragged to Pabna to take part in a literacy conference. It is over now and I am allowed to come back to my retreat where I am hiding at present.”


১৯১৪ সালে পাবনার শীতলাই হাউসে উত্তরবঙ্গ সাহিত্য-সম্মিলনের আয়োজকদের সঙ্গে (ছবি সংগৃহীত)

 

বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটি প্রসিদ্ধ স্মৃতি সমৃদ্ধ জায়গা রয়েছে। ১) কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ২) শাহজাদপুর এবং ৩) নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার পতিসর। এই জায়গাগুলোকে যদি একটি ত্রিভুজ কল্পনা করি, তাহলে মোটামুটি বাহুগুলোর দূরত্ব 100 কিলোমিটারের একটু বেশি হবে। শাহজাদপুর থেকে শিলাইদহ 100 কিলোমিটার, শিলাইদহ থেকে আত্রাই 110, এবং শাহজাদপুর থেকে আত্রাই 130 কিলোমিটারের মতো দূরত্ব। আমি এই তিনটি জায়গাতেই যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানতে হলে এই তিনটি জায়গা দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কুষ্টিয়াতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি (ছবি হাদী উল ইসলাম)

 

পাবনা ঢাকা মহাসড়কের পার্শে দিলরুবা বাস স্টান্ডে স্থাপিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের একটি ভাস্কর্য। (ছবি হাদী উল ইসলাম)


শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। পাবনা ঢাকা মহাসড়কের পার্শে দিলরুবা বাস স্টান্ডে স্থাপিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের একটি ভাস্কর্য। আর এভাবেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাঝে অমর হয়ে আছেন।

 

লেখকের ক্যমেরায় আরো কিছু ছবিঃ

লেখকের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর লেখা ১৫০ টি বইয়ের একাংশ। বইগুলো তার সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লেখা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইঞ্জিন চালিত  নৌকা।

অসাধারণ দুটি গাছ। কুষ্টিয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ীতে। বৃদ্ধগাছটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য। অপরটি লাগিয়েছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। (ছবি লেখক)

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পালকি চেপেই যাতায়াত করতেন।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত পালঙ্ক

রবীন্দ্রনাথ ব্যবহৃত জলের জগ

 

তথ্যসূত্রঃ

·         প্রমথ চৌধুরী

·         রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়

·         খাপছাড়া

·         রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন