ভিক্ষা করতে করতে জীবন অতিষ্ঠ। সংসার আর চলে না। সংসার বলতে মা ও পাগলা মত একমাত্র খোকা। মা বিনতা নিজের পদবিও নিজে মনে করে ঠিক মত বলতে পারে না। খোকার বয়স যখন সাড়ে ছ’মাস তখন খোকার বাবা, পাঁড় মাতাল ছত্রিশ বছর বয়সের নন্দলাল উপাধ্যায় হল মগরাহাট
বিষমদ কান্ডে যে একশো সাতাত্তর জন মারা যান তার মধ্যে একজন। সেদিনের মদ খাওয়া থেকে শুরু করে মড়া পোড়ানো পর্যন্ত স্বামীর নরক যন্ত্রণা দেখতে
দেখতে শোকে কাতর হয়ে বাপ মায়ের পদবী সহ স্বামীর পদবীও ভুলে গেছে বিনতা, কিচ্ছু করার নেই। এবং এটাই স্বাভাবিক। মা ও খোকার পেটে রাবণের চিতা,
টাকা পয়সা
ধনদৌলত যা অল্পসল্প ছিল তাও সব শেষ। সরকারি সাহায্য যেটুকু আগে পাওয়া যেত,
তাও আর পাওয়া
যায় না বতর্মানে। হরিশংকরপুরে ভাঙাচোরা মেটে বাড়িতে বসবাস। আর গোটা মগরাহাটের
পাড়ায় পাড়ায় বিনতার ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনযাপন। খোকার কাজকর্ম নেই, খোকা কাজ পেলে করে, না পেলে না করেই মায়ের রোজগারে কোন মতে
দিন কাটিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে মা লক্ষীর পূজার্চনায় খোকার দিন কাটতে থাকে। পাড়ার সবাই মা ও খোকাকে চেনে জানে। বিপদ আপদ হলে সবাই ছুটে আসেন মা ও খোকার পাশে। জীবন চলমান।
সুখ দুঃ খ তো জীবনের অঙ্গ।
মা ও খোকা নিত্যদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে গল্পটল্প করে মুড়ি
বাতাসা খেয়ে রাতে শুয়ে পড়ে। ঘড়ি দেখাদেখির বালাই নেই। ঘড়ি খায় না মাখে এজীবনে তাদের কাছে প্রশ্নাতীত ঘটনা। শুধু একটি ঘটনা তাদের জীবনে একদম সত্য, অস্বীকারের রাস্তা নেই। ঘটনাটি হল, মায়ের বয়স এখন সত্তর হলেও খোকার হবে
টেনেটুনে বিয়াল্লিশ। মাথা যতই মোটা
হোক, খোকার জীবনে আজও কিছু সস্তা স্বপ্ন
কিলবিল করে এবং সেটাই তার জীবনের এক বাস্তব চিত্র। মাঝে মাঝে ঘুমালেও ঘুম আসে না। খোকা মাকে প্রায় প্রশ্ন করে বিরক্ত করে তোলে। যদিও মায়ের মাঝে মাঝে খোকার কথাবার্তা খারাপ লাগে না। বরং ভালোই লাগে। হঠাৎ একদিন খোকা মাকে প্রশ্ন করে বসে,
--- মা,
সবাই লটারিতে
কোটি কোটি টাকা পায়, আমরা পাই না কেন ?
--- কোটি কোটি টাকা ? চুপ কর্ খোকা। এসব চোর ডাকাত শুনতে পেলে সত্যি ভেবে
আমাদের ঘরে চুরি ডাকাতি করতে আসবে,
আর টাকা না পেলে
চোর ডাকাতরা আমাদের আস্ত রাখবে ? ধারালো চাকু দিয়ে আমাদের গলার নলি কেটে
মেরে ফেলে দিয়ে যাবে। বাবা আমার...
সোনা আমার... চুপ্ কর্।
--- মা,
চোর ডাকাতের কথা
বাদ দাও, খুব ভয় লাগছে কিন্তু...।
--- তাই তো বলছি, ঘুমিয়ে পড়্ খোকা।
--- কিন্তু মা,
আমি তো রোজ রোজ
মা লক্ষীকে বলি, হে মা লক্ষী, সবাই তোমার আশীর্বাদে লটারি কেটে কোটি কোটি টাকা পায়, আমি কেন পাই না ? আমি তো তোমার ভক্ত, আমি তো তোমার সন্তানের মত একজন। হে মা লক্ষী, আমি তো শুধু তোমাকেই চাই, তোমাকেই মনেপ্রাণে পূজার্চনা করি। মা লক্ষী, আমার এই দুঃ খ কষ্টের জীবনে একবারটি দেখা
দাও, অন্ততঃ
বঙ্গশ্রী লটারির প্রথম পুরস্কার এক কোটি টাকা পেতে আশীর্বাদ করে যাও...।
মা ও খোকার কথাবার্তার ফাঁকে মা কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। খোকার চোখেও কখন ঘুম চলে এলো, তা খোকাও জানে না। নিত্য দিন একই
ভাবে আসে আবার চলেও যায়।
এসব ঘটনার মধ্যে আর একটা ঘটনা ঘটে গেল একদিন রাতে। মা ও খোকা অন্যান্য রাতের মত ঘুমিয়ে পড়েছে। একটু একটু করে রাত গভীর হচ্ছে। যাকে বলে নিশুতি রাত ! গোটা পাড়া আর পাড়ার সমস্ত লোকজন
ঘুমিয়ে পড়েছে, এমন সময়ে ভাগ্যদেবী মা লক্ষী স্বয় খোকার
ঘরে গুটি গুটি পায়ে উপস্থিত হলেন। মুহূর্তে ঘর স্বগীয় আলোয় ভরে উঠলো। তিনি বলে উঠলেন,
--- খোকা,
আজ আমি তোর
কাছেই এলাম, খোকা এবার উঠে পড়্ দেখি। তোর আরাধনায় পূজার্চনায় আমি খুশি, আমি তৃপ্ত, এখনই বল্,
তুই কি চাস্
আমার কাছে ? আমি তোর সাধ পরিপূর্ণ করবোই।
--- মা গো,
তুমি সত্যিই
এসেছো ? আমি ধন্য। আমি ধন্য। আমি ধন্য।
--- হ্যা এসেছি। তোকে আশীর্বাদ করবো। তোর আজ থেকে আর কোন দুঃ খকষ্ট থাকবে না জীবনে।
--- একদম ঠিক। তাই হোক মা,
তাই হোক মা। জয় লক্ষী মায়ের জয়...।
--- বল্ তোকে কি আশীর্বাদ করবো ?
--- বেশী কিচ্ছু চাই না মা লক্ষী, শুধু একটি বঙ্গশ্রী লটারির প্রথম পুরস্কারটা যেন কাল সকালেই আমি পাই। মানে এক কোটি টাকা ! শুধু এই আশীর্বাদই করুন আমায়।
--- ত..থা...স্তু....। তাই হবে। খুশী তো ?
--- একদম খুশী। বলেই মাকে মাথা নত করে প্রনাম করলো খোকা। মা লক্ষীও বলে উঠলেন,
--- এখনই বার কর্ খোকা, তোর বঙ্গশ্রী লটারির টিকিটটা, আমি স্পর্শ করে দিলেই ঐ টিকিটে কালই
প্রথম পুরস্কার, এক কোটি টাকা পেয়ে যাবি। বুঝলি...?
মুহূর্তে খোকার কপাল খুলে যাওয়ার আনন্দে খোকা আনন্দে বিহ্বল
হয়ে পড়লো। কিন্তু পরের মুহূর্তে দুঃ খে প্রায়
চিৎকার করে খোকা বলে উঠলো,
--- টিকিট ?
টিকিট নেই তো
আমার কাছে, টিকিট কাটি নি, সর্বনাশ... !
--- কি হল খোকা ? টিকিট কোথায় গেল ? এক টাকার একটা টিকিট কাটতে পারিস্ নি ? তাহলে এক কোটি টাকা পাওয়া তোর পক্ষে অসম্ভব ...। আমার কিচ্ছু করার নেই, আমি এখন আসি...। বলেই তৎক্ষণাৎ উধাও হয়ে গেলেন মা লক্ষী। পুনরায় ঘর প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল।
--- না...। চলে যাবেন না...। আমি কোটিপতি হতে
চাই। আমি এখনই টিকিট কেটে আনছি...। বলেই
চিৎকার করে খোকা কেদেঁ উঠলেই খোকার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আর স্বপ্ন ?
স্বপ্নই রয়েই
গেল...।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন