সূর্যতপা - রথীন্দ্রনাথ রায়

 


 

বোনের ফোনটা পাওয়ার পর থেকেই বেশ কিছুটা খুশি হল অমলা। বোন বিমলা একথা সেকথা বলার পর বলল, দিদি অনেকদিন তোর ফোন পাইনি। হয়তো ভুলেই গেছিস ? আরও অনেক কিছু। সবশেষে বলল, তোর ছেলেকে অনেকদিন দেখিনি, একবার পাঠিয়ে দেনা -- পৌষ সংক্রান্তিতে আমাদের এখানে মেলা হয় জানিসতো -- একবার দিসনা পাঠিয়ে ? আমি মা হতে পারিনি ; তোর ছেলেকে কাছে পেলে মাতৃত্বের তৃষ্ণা তবু কিছুটা মেটে। 

মোবাইলটা রেখে দেয় অমলা। বিমলার কষ্টটা বুঝতে পারে। বিমলা ওর থেকে দুবছরের ছোট হলেও প্রায় বন্ধুর মতো। তাই উভয়ে উভয়ের দুঃখ কষ্ট সব ভাগ করে নিতে পারে।‌‌‌ অনেক কিছু করেও বিমলা মা হতে পারেনি। ওর জন্য বেশ কষ্ট হয় 

ছেলে সূর্য কলেজ থেকে ফিরতেই অমলা বলল, তোর মাসি তোকে যেতে বলেছে। 

-- কবে গো মা

-- পৌষ সংক্রান্তিতে। 

-- তাই ? কিন্তু বাপি যদি রাজী না হয়

-- ওকে আমি বুঝিয়ে বললেই রাজী হবে। 

রাত্রে ছেলে এবং স্বামীকে খেতে দিয়ে কথাটা পাড়ল অমলা। সব শুনে অজিতবাবু বললেন, যেতে পারে, যদি ওর পড়াশোনার অসুবিধা না হয়

বাবার কাছ থেকে সম্মতি পেতেই আনন্দে দিন গুনতে থাকে সূর্য। আসলে এই বাঁধা ধরা জীবন থেকে একটু মুক্তি পেতে চায় সে। তাছাড়া বিমলা মাসি তার গুণগ্রাহী। তার গোপন শিল্পচর্চার একমাত্র পৃষ্ঠপোষক। সে যে ছবি আঁকে তা মা বা বাবাকে কখনো বলতে পারেনি। বাবা তো সব সময়ই বলেন, “পড়াশোনায় আরও বেশি মনোযোগী হও।”উচ্চ মাধ্যমিকে রেজাল্ট আশানুরূপ হলেও মেডিকেলে সুযোগ না পাওয়ায় বাবার কঠোর নির্দেশ পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়া চলবেনা। পরের বছর আবার “নিট”এ বসতে হবে। সুতরাং বেড়াতে যাওয়া বা একটু আধটু আমোদ প্রমোদ একেবারে বন্ধ। তবু শেষ পর্যন্ত মাসির বাড়ি যাবার ছাড়পত্র মিলেছে তার জন্য বাবাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় সে। সাম্প্রতিক আঁকা ছবিগুলো গুছিয়ে রাখে মাসির জন্য

বীরভূম জেলার একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম খেজুরিয়া। আগেও বেশ কয়েকবার এসেছে। সেজন্য এখানকার পথঘাট সব কিছুই তার জানা। নিজেদের বাড়িতে বাবার ভয়ে সে অতি শান্তশিষ্ট। কিন্তু এখানে সে এক অন্য সূর্য। বাস থেকে নেমে ক'মিনিটের পথ। এক প্রকার দৌড়েই আসল সে। তারপর বাড়িতে ঢুকেই’মাসিবলে একটা চিৎকার। 

কিন্তু হঠাৎ এক তরুণীর সামনে পড়ে যাওয়ায় দ্বিতীয়বার আর শব্দ করতে পারলনা। কে এই মহিলা ? আগে তো কখনো দেখেনি। তাহলে ? ইতিমধ্যে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো বিমলা মাসি। সূর্য প্রনাম করে উঠে দাঁড়াল। 

ওর চিবুকে হাত ঠেকিয়ে বিমলা মাসি বলল, তোর মা'র তাহলে আমার কথা মনে পড়েছে। তা, মা বাবা সবাই ভালো আছে তো

ওর মেসোমশাই সুরেনবাবু বাড়িতেই ছিলেন। ওদের কাছে এগিয়ে এসে বললেন, দেখো এই খবর নেওয়ার ব্যাপারটা পরে হলেও চলবে। এখন ওকে একটু জিরিয়ে নিতে দাও। 

খাওয়ার সূর্য বলল, মাসি আগে তো ওই মহিলাকে দেখিনি। 

-- রমার কথা বলছিস? ও তো আমাদের পেয়িং গেস্ট। বাজারের কাছে যে ব্যাঙ্কটা রয়েছে না, ওখানেই চাকরি করে। বেশ ভালো মেয়ে। বিকেলেই তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। 

সেদিনটা ছিল ছুটির দিন। তাই রমা বাড়িতেই ছিল। খাওয়ার পরে মাসির সঙ্গে সাম্প্রতিক আঁকা একটা ছবি নিয়ে কথা বলছিল সূর্য। ঠিক তখনই আসল রমা। মাসি বলল, এসো রমা, এ আমার বোনপো সূর্য। তোমাকে যে ছবিগুলো দিয়েছিলাম না, সেগুলো ওরই আঁকা। ও যে পড়াশোনার সঙ্গে ছবি আঁকুক এটা আমার দিদি জামাইবাবু চাননা। সেজন্য ওকে গোপনেই শিল্পচর্চা করতে হয়। 

-- এটা আপনার দিদি জামাইবাবুর ভারি অন্যায়।

রমা সূর্যকে একবার জরিপ করে। ছবিগুলো দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল শিল্পী বুঝি বা বেশ পরিণত। বয়স বুঝি তাকে থেকেও বেশি হবে। এখন সামনাসামনি দেখে বেশ কিছুটা হতাশ হল। ছবিগুলো দেখতে দেখতে ওর পরিণত মনস্কতার জন্য নিজের অজান্তেই বুঝি ওর প্রতি কিছুটা দুর্বলতা জন্মেছিল। এখন মনে হল এতো কম বয়সে এতো দক্ষতা এলো কিভাবে

সে সোফায় বসে বলল, ছবিগুলো কিন্তু আমার বেশ ভালো লেগেছে। 

সূর্য প্রায় একটু লজ্জিত হয়ে বলল, এ আপনি ঠিক বলছেন না। আমি জানি ছবিগুলোর ত্রুটি কোথায়।

-- কোথায়

বিমলা মাসি উঠে বলল, এবার এই গম্ভীর আলোচনা থেকে আমি আসি। তোমরা কথা বলো। 

বিমলা চলে যেতেই রমা বলল, বললেন না তো ত্রুটি কোথায়

কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর সূর্য বলল, আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারবনা। তবু আমি জানি ত্রুটি রয়েছে। আসলে যখনই কোনো মহিলার ছবি আঁকতে যাই তখনই আমার মনে হয় আমি বুঝি ঠিকমতো পারছিনা। 

রমা ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। অনুভব করতে পারে এক শিল্পীর যণ্ত্রণা। পাশের টেবিল থেকে একটা বই তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পরে বলল, কাছ থেকে কোনো মহিলাকে দেখলেই এই অসুবিধা থাকবেনা। 

না, আর কোনো কথা হলনা। নিজের ঘরে এলো সে। আসলে সূর্যর ছবিগুলো দেখতে দেখতে ওকে বুঝি বেশ কিছুটা ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু এতো অসম বয়সের ভালোবাসা। যদিও চারপাশে এরকম ঘটনা আকছার ঘটে চলেছে। তবু তার সঙ্কোচও কম নয়। এম কম পাশ করার পর চার বছর হল ব্যাঙ্কের চাকরি করছে সে। তার শরীরটা বাড়তে শুরু করার পর থেকেই অনেক লোভাতুর চোখ তাকে গিলে ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের প্রতি কোনো আকর্ষণ অনুভব করেনি সে। কিন্তু সূর্যকে না দেখেই শুধুমাত্র তার আঁকা ছবিগুলো দেখেই তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। সে জানে, যে ভালোবাসা সাধারণত পূর্ণতা পায়না। 

পরদিন বিকেলে ওরা সবাই মেলায় আসল। ময়ূরাক্ষীর তীরে উত্তরায়ণ উপলক্ষে এই মেলা বিশেষ করে আদিবাসী নরনারীরাই এই মেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে। তাদের মাদলের সুর আর ধামসার তাল এই মেলায় অন্য মাত্রা এনে দেয়। অজস্র মানুষ আজ এই নৃত্যের সাথে একাত্ম হয়েছে। 

ঘুরতে ঘুরতে সূর্য আর রমা হঠাৎই বুঝতে পারল যে তারা মাসি মেসোমশাইয়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ওরা হাঁটতে হাঁটতে ময়ূরাক্ষীর তীরে এসে থামল। রমা বলল, আর পারছিনা। সে বালির ওপরে বসে কি যেন একটা লিখল। সূর্য কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসতেই বালির ওপরে লেখাটা মুছে দিল। 

নিজের আঁকা একটা ছবির কথা মনে পড়ল সূর্যর। ছবিটার নাম দিয়েছিল অব্যক্ত। একটা নৈর্ব্যক্তিক ভালো লাগা ছিল ওই ছবিতে। এক কিশোরীর সামনে ছিল অস্তায়মান সূর্য। মেয়েটার মুখের এক্সপ্রেশন ছিল চোখের আড়ালে। কিন্তু ভাবনাটা ছিল নৈসর্গিক দৃশ্যপটে। কি ভাবছিল মেয়েটা। ওই মেয়েটার মুখের বদলে রমার মুখটাকে কল্পনা করে। 

না, তা কি করে হয় ! রমা তার থেকে কতো ওপরে। না, না, সে হয়না। 

দুজনে কাছাকাছি বসে। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারেনা। শেষ পর্যন্ত রমাই নীরবতা ভেঙে বলে, তুমি আরো একটা ছবি আঁকবে। 

-- কার

-- সে একটা মেয়ের।

-- কে সে মেয়েটি ? তাকে না দেখলে আঁকব কিভাবে

-- সে একটা মেয়ে। অনেকটা আমারই মতো। 

চুপ করে থাকে সূর্য। বক্তার দুচোখের দিকে চেয়ে থাকে। রমা চোখ দুটো নামিয়ে নেয়। ওর বুকের ওপর শাড়িটা সরে গেছিল। সেটা ঠিক করে নেয়।

সূর্যর মনে হয় রমা কি সেই নারী যাকে দেখার জন্য তার পথ চলা। 

ইতিমধ্যে পশ্চিমদিগন্তে ঢলে পড়ে সূর্য। ময়ূরাক্ষীর জলে অস্তায়মান সূর্যের প্রচ্ছায়া। তার মাঝে রমা দেখে তার পাশে তার ভালো লাগার সূর্য। 

ময়ূরাক্ষীর চড় থেকে উঠে আসে ওরা। সূর্যর হাত ধরে ভিড় ঠেলে চলতে থাকে রমা। সূর্য অনুভব করে একটি নারীহস্ত তার মুঠোয়। ভিড়ের বাইরে এসে লজ্জিত হয় রমা। যদি কেউ দেখে ফেলে ? না, এটা তার উচিত হয়নি। বেশ কিছুটা আসার পর শাল পলাশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ। অন্ধকার। বার দুই হোঁচট খেল রমা। বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে সূর্য। এখন রমা ওকে ডাকতেও পারছেনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডাকতেই হল। সূর্য কাছে আসতেই কেমন একটা আতঙ্কে ওকে জড়িয়ে ধরল রমা। সূর্য অনুভব করল এক নারীদেহের স্পর্শ ওর সর্বাঙ্গে। 

ওরা ঘরে ফিরতেই দেখল মাসিমা মেসোমশাই অনেক আগেই ফিরে এসেছেন। 

সুরেনবাবু বললেন, যাক আশ্বস্ত হলাম।

নিজের ঘরে চলে গেল রমা। আলোর সুইচটা টিপে বড় আয়নাটার সামনে দাঁড়াল। মনে হল আয়নার ওই প্রতিবিম্বটা বুঝি বড্ড অচেনা। কিছুক্ষণ পরে হাত মুখ ধুয়ে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে শাড়িটা বদলে নিচ্ছে ঠিক সে সময়ই রমাকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকল সূর্য। রমা বুকের ওপর শাড়িটা চেপে ধরে বলল, প্লীজ একটু বাইরে যাব

সূর্য বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু লজ্জিত রমাকে দেখে মনে হল এ বুঝি সেই নারী যার লজ্জিত অবয়ব সে আঁকতে গিয়েও পারেনা। 

রমা শাড়িটা বদলে সূর্যকে ডাকে, জগৎপতি এদিকে 

 সূর্য ঘরে আসে বলে, কে জগৎপতি

 

-- যে সূর্য, সেই জগৎপতি। অল্প একটু হাসে রমা। কি জানি কেন আজ তার আজ বেশ ভালো লাগে। সূর্য দেখে রমাকে। এ এক অন্য রমা। প্রদীপ হাতে দেবতার কাছে সমর্পিতা এক মানবী। 

রমার চোখ থেকে নিজের চোখদুটো নামিয়ে নেয় সূর্য। যাবার সময় বলে, মাসিমা আপনাকে ডেকেছেন। 

সূর্য নিজের ঘরে ফিরে আসে। কিছুক্ষণ আগেও রমাকে বড্ড অচেনা মনে হচ্ছিল। এখন মনে হয় সে কতো কাছের ? কিছুক্ষণ পরে সূর্যর কাছে এল রমা। সেসময় একটা ছবি আঁকতে ব্যস্ত ছিল সূর্য। রমা ওর অনেক কাছে সরে এসে বলল, একটা ছবির নেপথ্যের কথা শোনাতে হবে। 

-- ছবির নেপথ্যের গল্প

-- ছবির নেপথ্যের গল্প ? দেখুন আমি ঠিক ভেবেচিন্তে ছবি আঁকি না। যখন যেমন ইচ্ছে হয় আঁকি। তবে কোনো কোনো ঘটনা আমাকে বেশ ভাবায় -- সেরকমই একটা হল অপরেশের শোচনীয় মৃত্যুর ঘটনা। যেটা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গেছে। 

অস্থির হল রমা। বলল, এ গল্প নয়। 

মাসিমা এসে বলল, না, আর কোনো গল্প নয়। এবার খাবার পালা। 

খেতে বসেও অপরেশের কথা ভুলতে পারলনা রমা। তার ভালো লাগার পাত্র ব্যক্তিও যদি রাত্রে ঘুমাতে গিয়ে অপরেশের পরিবর্তে বারবার সূর্যর কথা মনে হল। পাশের ঘরে গিয়ে দেখল বিছানাটা খালি। এক বিজাতীয় ভয়ে গলাটা শুকিয়ে গেল। খুঁজতে খুঁজতে ছাদে এসে দেখল সূর্য অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক গভীর আশঙ্কায় জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে

সূর্য কথা না বলে রমার দিকে চেয়ে রইল। কালো নাইট গাউনে ঢাকা এক নারীমূর্তি। ওর অনেক কাছে সরে এসে বলল, জানিনা।

-- আমি জানি। 

-- কি

-- তুমি একটা মেয়ের কথা ভাবছ।

-- যাঃ  !

-- বেশ আমি আসছি তাহলে। 

-- শুনুন। 

-- কি?

-- আপনি কুন্তী হতে পারেননা

-- কুন্তী ?

-- হাঁ, মহাভারতের কুন্তী।

রমা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, পারি। কিন্তু সূর্যকে হারাতে পারবোনা। আমি চাই সূর্য আমার আকাশে চিরকাল উজ্জ্বল থাকবে। 

যেন এক আচ্ছন্নের মতো রমাকে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে সূর্য বলল, থাকবে। 

পরদিন ব্যাঙ্কে যাবার আগে রমা সূর্যর কাছে এসে বলল, বিকেলে তৈরি থাকবে। 

আর কিছু বললনা। শুধু একটা তির্যক দৃষ্টি আর একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে চলে যায় রমা। 

সূর্যর বুকের ভেতরটা কেমন যেন হালকা হয়ে গেল। না, এর আগে কোনও নারীর ভালো লাগার পাত্র সে হতে পারেনি। আজ রমার ভালো লাগার পাত্র হতে পেরে খুশিতে উদ্বেল হয়ে ওঠে তার দেহমন। কি করবে ঠিক করতে পারেনা। বিকেলটা কখন আসবে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রমা তার জীবনের প্রথম নারী। সেই প্রথম নারীকে কিভাবে সম্ভাষণ করবে তা ঠিক করতে পারেনা। রমার ঘরে আসে। ঘরের সব কিছুতেই সে অনুভব করে তার প্রিয় নারীর স্পর্শ। টেবিলের ওপর দেখে একটা আ্যলবাম। যার মধ্যে রয়েছে রমার জীবনের কয়েকটা মুহূর্ত। অপূর্ব সুন্দরী মনে হয় ছবির রমাকে। তার কুন্তীকে। সমুদ্রতটে দণ্ডায়মানা সূর্যমুখী রমার একটা ছবি নিজের কাছে রেখে দিল সে। 

ইতিমধ্যে বিকেল হল। চারটে বাজার কিছু আগেই ফিরল রমা। কিছু খেয়ে নিয়ে শাড়িটা বদলে একটা শালোয়ার চুড়িদার পড়ে নিল সে। 

তারপর সূর্যর কাছে এসে বলল, চলো

আশ্চর্য হল সূর্য। বলল, খুব নাইস লাগছে। ময়ূরাক্ষীর তীর বরাবর হাঁটতে হাঁটতে রমা অনুভব করল, সে বুঝি এমন একজনের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সূর্য তার জীবনের সেই ভালো লাগার ব্যক্তি। যাকে ঘিরে ভালোলাগা, ভালোবাসায় ভরে উঠবে তার জীবন। 

না, আর এগোতে পারলনা। শীতের বিকেল। সুতরাং তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে এল দিনের আলো। পশ্চিম দিগন্তে অস্ত গেল সূর্য। চলতে চলতে কুয়াশা মাখা নদীর তীর বরাবর হাঁটতে হাঁটতে রমা সূর্যর ডানহাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, তুমি আমাকে ভুলে যাবেনা তো

-- না। মহাভারতের সূর্য কুন্তীকে ভুলে গেলেও এই সূর্য পারবেনা। 

রমা সূর্যর মুখে হাত দিয়ে বলল, আমি কুন্তী হতে চাইনা। আমি রমা হয়েই থাকতে চাই তোমার পাশে। 

তখনও নদীর জলে দুটো পানকৌড়ি ভেসে বেড়াচ্ছিল। সেদিকে রমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সূর্য বলল, চলুন না, আমরাও পানকৌড়ি হয়ে যাই। 

-- দুষ্টু ! 

ওর মুখটাকে অনেক কাছে নিয়ে এসে এসে একটা চুম্বন করল রমা। তারপর বালির ওপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে ওর কাছে এগিয়ে এল সূর্য। বালির বিছানায় শায়িতা রমার চারপাশে এক নিঃসীম শূন্যতা। শায়িতা রমার কপালে একটা চুম্বন করল সূর্য। সে দেখল একটা নারীদেহকে। যাকে এ পর্যন্ত রহস্যময়ী বলেই মনে হতো। সেই রহস্যময়ী নারী তার চোখের সামনে। রমা গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে সূর্যকে।

প্রকৃতি অন্ধকারের চাদর দিয়ে ঢেকে দিল ওদের। কিছুক্ষণ পরে বালির বিছানা থেকে উঠে বসে ওরা। রমা নিজের বিস্রস্ত পোশাক ঠিক করে নেয়। এখন দুজনের চোখেই লজ্জা। রমা মনে করে এতোটা না এগোলেও চলত এরপর যদি কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে লজ্জায় মুখ দেখানোর উপায় থাকবেনা। চলতে থাকে দুজনে। কিন্তু কেউ কোনও কথা বলেনা। শুধু একজন অপরজনকে অনুসরণ করে। ঘরে ফিরেও কেউ কাউকে কথা বললনা। মাসিমাও বুঝতে পারেনা সূর্য হঠাৎ এতটা চুপচাপ হয়ে গেল কেন ? এ দিকে দিদিও ফোন করেছে। সূর্যকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিতে হবে। ওর বাবার আদেশ। 

 পরদিন ফিরে যাবার জন্য সূর্য প্রস্তুত হতেই নিজের ঘরেই কাঁদতে শুরু করল রমা। সূর্য ওর ঘরে এসে বলল, আমি মহাভারতের সূর্য নই। তাই আমার কুন্তীকে ত্যাগ করতে পারবনা। বাড়িতে এই মুহূর্তে কেউ মেনে নেবেনা। তাই আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। 

সূর্য ওর মুখটা তুলে ধরে। পরম মমতায় ওর চোখদুটো মুছিয়ে দিয়ে বলে, বলো পারবেনা

রমা কোনো রকমে কান্না থামিয়ে বলল, পারব। আমি সূর্যতপা হয়ে সূর্যের জন্যই অপেক্ষা করব। সূর্য যাবার জন্য পা বাড়াতেই রমা বলল, দাঁড়াও। 

ওকে প্রনাম করে উঠে দাঁড়াতেই সূর্য দেখল এক চিরায়ত নারীকে। 

বাসে তুলে দিতে এসেও রমা চোখের জলকে বাধা দিতে পারলনা। বলল, ভুলে যেওনা। 

সূর্য পকেট থেকে সূর্যমুখী রমার ছবিটা বের করে বলল, এটাই আমাকে তোমার কথা মনে করিয়ে দেবে। 

ইতিমধ্যে বাস আসতেই রমাকে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠল সূর্য। ধীরে ধীরে বাসটা রমার চোখের সামনে থেকে দূরে অনেক দূরে মিলিয়ে যায়। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ওর চোখদুটো কখন যে জলে ভরে এসেছে তা বুঝতে পারেনি সে। 

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন