বাল্যকালের কত ভালোবাসা যৌবনে এসে বিনষ্ট হয়ে যায়, আবার যৌবনের ভালবাসা শুভ পরিণয়ে পৌঁছায় না। কখনো পরিস্থিতি কখনো বা প্রেমিক-প্রেমিকার দোষে ভালোবাসায় ভাঙ্গন দেখা যায়। এমন একটি সম্পর্কের কথা আমি জানি, যাদের দীর্ঘদিনের ভালোবাসা লোভ নামক রিপুর কারণে ভেঙে গিয়েছিল। অনুপম ও অনুরাধার প্রেম। প্রায় দশ বছরের সম্পর্ক। একজন আরেকজনকে না দেখে এক মুহূর্তও থাকতে পারত না। দু'জনেই হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিল --- "যদি বাঁচি একসাথে বাঁচবো আর যদি মরি একসাথে মরবো।" কথা দিয়ে মানুষ কথা রাখে না। অনুপম অনুরাধাকে কথা দিয়ে কথা রাখেনি।
সাধারণ মেয়ে অনুরাধা খুব
কষ্টে বড় হয়েছে। বাবা মাকে ছেড়ে অন্য জায়গায় আরেকটি সংসার পেতেছেন। তাই মা
অন্যের বাড়িতে কাজ করে, সেলাই করে অনুরাধাকে খুব
কষ্টে মানুষ করেছেন। অনেক চেষ্টা করে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাস করিয়েছেন।
মা তাকে বলতেন --- "অনু,
আমাদের
মতো গরীবের কোন বন্ধু হয় না। আজকালকার মানুষ বড় ভয়ঙ্কর। কাউকে বিশ্বাস করিস না।
কারো প্রেম-ভালবাসায় জড়াবি না। তাহলে একদিন না একদিন খুব কষ্ট পাবি।"
সবসময় মায়ের কথা শুনে চলত অনুরাধা। কিন্তু অনুপমের জোঁকের মতো পিছনে লেগে থাকা ও
ভালবাসার অভিনয়, এই গরীব পিতৃস্নেহ থেকে
বঞ্চিত মেয়েটি বুঝতে পারেনি। তাই মায়ের মানা করা সত্ত্বেও মন দিয়েছিল অনুপমকে।
অনুপম রায় মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। অভাব কোনদিন দেখেনি। অল্প সময়ের মধ্যে
অনুপমকে পাগলের মতো ভালবেসেছিল অনুরাধা। কাঁচা বয়সের জাদু লেগেছিল তার দু'চোখে।
অনুপম তার সঙ্গে অভিনয়
করতে করতে সত্যি সত্যি কবে তাকে ভালোবেসে ফেলে তা সে নিজেও বুঝতে পারেনি। অনুরাধা
তার মাকে প্রথম দু'বছর কিছুই জানায়নি। তারপর
একদিন অনুপমকে তাদের বাড়ীতে নিয়ে আসে। তাদের দু'জনের
হাবভাব দেখে অনুরাধার মা তাদের দু'জনের
সম্পর্ককে বুঝতে পারেন। অনুপম চলে গেলে অনুরাধাকে তিনি বলেন, "তুই আমার কথা শুনলি না। সেই একটি ছেলের
প্রেমে পড়লি!! ওর বাড়িতে তোকে মানবে তো! দেখিস, ঠকলে
আমাকে কিছু বলিস না।" মায়ের কথা শুনে অনুরাধা বলে, "মা ও অমন ছেলেই নয়। ও আমাকে কথা দিয়েছে, ও চাকরি পেলেই ওর বাবা-মাকে বলে বিয়েতে রাজি
করাবে।"
তাদের ভালোবাসার যখন দশ
বছর, তখন একদিন মুম্বাইতে একটি
কাজের অফার পায় অনুপম। অনুরাধাকে বলে, মুম্বাই
থেকে মাস ছয়েক পর ফিরে এসে তার বাবা-মাকে যে করেই হোক সে রাজি করিয়ে তাকে বিয়ে
করবে। কিন্তু অনুপম তার কথা রাখেনি। অনুরাধার আশায় জল ঢেলে দিয়ে বিয়ে করে
কৃষ্ণকলি নামের একজন স্কুল টিচারকে। ছয়মাস পরে অনুপম মুম্বাই থেকে ফিরে আসে। তার
বাবা একদিন তাকে বলেন, "তোমার জন্য একজন সুন্দরী
স্কুলশিক্ষিকা মেয়ে আমরা দেখে রেখেছি, দুই
সপ্তাহ পর তোমার বিয়ে।" বাবার সিদ্ধান্তের উপর একটাও কথা বলতে পারেনি অনুপম।
তাছাড়া শিক্ষিকা মেয়ের কথা শুনে সাধারণ মেয়ে অনুরাধার কথা বাবাকে বলতে আর সাহস
পায়নি।
অনুপমের বিয়ের কথা শুনে
অনুরাধা কান্নায় ভেঙে পড়েন। মা তাকে অনেক বোঝান। তিনি বলেন, "তোকে আমি বারবার করে সাবধান করেছিলাম। কিন্তু
তুই শুনিসনি। এখন কেঁদে মর মুখপুড়ি।" মায়ের চোখেও জল দেখা গিয়েছিল। মনের
কষ্টে বিকেলবেলা বাড়ির পাশের চুনি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে যান অনুরাধা।
বারবার অনুপমের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অনুপম তাকে যেন আঙ্গুল দিয়ে বলছে, "তোমার মতো সাধারণ মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা
যায়, মজা করা যায়, কিন্তু বিয়ে নৈব নৈব চ।" যখন অনুরাধা
নদীতে ঝাঁপ দিতে যাবে, তখন পেছন থেকে একজন পুরুষ
তার হাত টেনে ধরে। অনুরাধা তাকে ছেড়ে দিতে বলে পাগলের মতো আচরণ করতে থাকে এবং
কাঁদতে থাকে। এমন সময় পুরুষটি তার গালে একটা চড় কষিয়ে দেয়। এর ফলে অনুরাধা
জ্ঞান হারায়। পুরুষটি তার ব্যাগের মধ্যে থেকে জলের বোতল বের করে অনুরাধার
চোখে-মুখে জল ছিটায়। জ্ঞান ফিরে এলে অনুরাধা কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমাকে আপনি বাঁচালেন কেন? আমাকে মরতে দিলেন না কেন?" পুরুষটি তাকে জিজ্ঞাসা করে, সে মরতে যাচ্ছিল কেন! মরলে কি সব সমস্যার
সমাধান হবে! তার প্রশ্ন শুনে প্রথমে অনুরাধা চুপ করে থাকে, তারপর জীবনের সমস্ত ঘটনা পুরুষটির সামনে খুলে
বলে। পুরুষটি তাকে অনেক বোঝায়। বলে, "জীবনে এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। হাজার হাজার সাধারণ মানুষের সাথে
এমন হয়ে থাকে। তাই বলে জীবন দিয়ে দিতে হবে! তোমায় সাধারণ বলে ও অপমান করেছে।
তুমি তোমার চেষ্টায় বড় হয়ে ওকে উচিত শিক্ষা দাও। বুঝিয়ে দাও সাধারণ মানুষ
চাইলে অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে।" এরপর পুরুষটি অনুরাধাকে তার পরিচয় দেয়। বলে, "আমি একজন ব্রাহ্মণ সন্তান। নাম অনিরুদ্ধ
চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার এক কলেজে আমি শিক্ষকতা করি। আজ গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলাম।
এমন সময় তোমাকে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি সন্দেহ করেছিলাম, তুমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছ। তাই তোমাকে পাপ
কাজের হাত থেকে বাঁচালাম।"
শিক্ষক অনিরুদ্ধ অনুরাধাকে
তার বাড়িতে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে দেয়। এদিকে অনুরাধার মা অনুরাধার চিন্তায় অস্থির
হয়ে ওঠেন। অনেকক্ষণ পর মেয়েকে দেখে ধড়ে প্রাণ আসে তাঁর। অনিরুদ্ধ সমস্ত বিষয়টা
অনুরাধার মাকে জানায়। মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন এবং বলেন, "এই পাগলি তুই একি করতে যাচ্ছিলি? তোর কিছু হয়ে গেলে আমার কি হতো?" এরপর অনিরুদ্ধ বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
অনুরাধার মা তাকে বসতে বললে সে জানায়, "আজ আর বসবো না। আরেকদিন আসব আমি।"
অনুরাধার কাছে শোনা তার
জীবনের সব ঘটনাগুলি যেতে যেতে অনিরুদ্ধর মনে পড়ে এবং খুব খারাপ লাগে তার। তাদের
দারিদ্রতা দেখে ভাবে, এদের কত কষ্ট, তার ওপর এমন কোনো মানুষ নেই যে এদের পাশে এসে
দাঁড়ায়। হঠাৎ তার মনে হয় মেয়েটি দেখতে সুন্দর ও নম্র-ভদ্র। বাবা-মাকে বলে তার
জীবনসঙ্গিনীর জন্য রাজি করাতে পারলে কেমন হয়! এরপর একদিন বাবা ও মাকে নিয়ে
অনিরুদ্ধ অনুরাধার বাড়িতে আসে। অনুরাধার মা কোথায় বসতে দেবেন ভেবে পান না।
অনিরুদ্ধের বাবা বলেন, "অত চিন্তা করতে হবে না
আপনাকে। আমরা মাদুরেই বসছি।" এরপর অনিরুদ্ধের মা বলেন, "দিদি আপনার কাছে একটা দাবি নিয়ে এসেছি।
আপনার মেয়েকে আমার অনিরুদ্ধর বউ করে নিয়ে যেতে চাই। আপনার যদি কোন অমত না
থাকে।" অনুরাধার মা এ কথা শুনে বলেন, "আমার আর অমত থাকবে কেন। এ তো অনুরাধার কপাল। সব জেনেশুনে
অনিরুদ্ধ তাকে বিয়ে করতে চাইছে,
এ
তো ওর মহানুভবতা।"
অনুরাধা তাদের সমস্ত কথা
আড়াল থেকে শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যায়। দু'মাস
পরেই একটি ভালো দিন দেখে অনিরুদ্ধ ও অনুরাধার চার হাত এক করে দেওয়া হয়। বিবাহ
অনুষ্ঠান খুব ভালোভাবে সম্পন্ন হয়।
এদিকে অনুপমের সংসারে
অশান্তির কালোছায়া ঘনীভূত হয়। কৃষ্ণকলি অনুপমের সংসারে মানিয়ে নিতে পারে না।
প্রতিনিয়ত শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া অশান্তি লেগেই থাকে। মুম্বাই থেকে বার বার
অনুপমকে বাড়িতে আসতে হয়। তার সঙ্গেও কৃষ্ণকলির অশান্তি হয়। কৃষ্ণকলি বড়ই
অহংকারী। সংসারের কোনো কাজই সে করতে
চাইত না। ফলে দুই পরিবারের পক্ষ থেকে আপোসে ডিভোর্স হয়ে যায়। অনুপম ভাবে, এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। তাই ডিভোর্সে সে
না করেনি। মনে মনে ভাবে, ভগবান আছেন। অনুরাধাকে
ঠকানোর ফল আমি পেলাম। তাছাড়া মুম্বাইয়ের কাজটাও অনুপমের চলে যায়। বারবার কাজ
ছেড়ে বাড়িতে ফিরে আসায় মালিকপক্ষ তাকে ছেড়ে দেন।
কিছুদিন পর অনিরুদ্ধ অনুরাধাকে কলকাতায়
নিয়ে আসে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তি করে দেয়। দুই বছর পর অনুরাধা সেখান থেকে ইংরেজিতে এম.এ. পাস করে, প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়। নেট পরীক্ষায়
উত্তীর্ণ হয়ে অনিরুদ্ধর সহযোগিতায় কলকাতার একটি নামী কলেজে ইংরেজি পড়ানোর সুযোগ
পায়। ভাগ্য চাকার মতো ঘোরে। কার কখন জীবন পরিবর্তন হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না।
অনুপম অনুরাধাকে ভুলে
গেলেও অনুরাধা মাঝে মাঝে অনুপমের সঙ্গে কাটানো ওর জীবনের কথা ভাবত। একদিন অনুপমকে
কলকাতা থেকে একটা চিঠি লেখে অনুরাধা। সে লেখে, "তুমি কেমন আছো অনুপমদা? বৌদি
কেমন আছেন? তোমার অবহেলা আজ আমাকে
অনেকদূর নিয়ে গেছে। আমি খুব ভালো আছি। আজ আমি কলকাতার এক কলেজে ইংরাজি পড়াই।
আমার বরও বাংলার অধ্যাপক। আমরা সুখী পরিবার। আজ আর কোন সমস্যা নেই। তুমি সাধারণ
বলে অবহেলা না করলে আজ হয়তো আমি এখানে পৌঁছাতেই পারতাম না। সবচেয়ে বড় কৃতজ্ঞতা
আমার বর অনিরুদ্ধকে জানাই। সে-ই আমায় অনুপ্রেরণা দিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য
করেছে।" অনুরাধার চিঠি পড়ে অনুপম বুঝতে পারে, সে
কত বড় ভুল করেছে। আজ এই ভুল শুধরানোর কোনো সুযোগ নেই তার। মনে মনে খুব অনুশোচনা
হয়। সবসময় মনে রাখতে হবে, সময় কথা বলে। তাই কাউকে
অবহেলা করা উচিত নয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন