কোটালপাড়া গ্রামীণ হাসপাতালে একটা অদ্ভুত বিষয় সম্প্রতি ঘটে চলেছে । কয়েকদিন পর পর থেকেই লাশকাটা ঘর থেকে একটা করে লাশ গায়েব হচ্ছে । সাধারণত দুর্ঘটনা অথবা আত্মহত্যা হলে বডি পোস্টমর্টেম করে দেখা হয় আত্মহত্যার কারণ । মূলত লাশের মাথাটা খুলে ব্রেনটাকে বিশ্লেষণ করে দেখা হয় যেই সময় ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল তখন তার মনে কি চলছিল । যদি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা হয় তবে পাকস্থলীর চিরে ডাক্তাররা দেখেন কি বিষ, কত পরিমাণে খাওয়া হয়েছে ইত্যাদি । অবশ্য এমন অনেক বিষ আছে যেগুলি পাকস্থলীতে পাওয়া যায় না, রক্তের মধ্যে পাওয়া যায়, যেমন সাপের বিষ । সে যাই হোক, মৃত্যুর যেকোনো কারণই হোক না কেন কোটালপাড়া হাসপাতাল থেকে যে লাশ গায়েব হচ্ছে তা মৃত্যুর কোন কারণকে অপেক্ষা রাখে না ।
এখানে একটা কথা
বলা প্রয়োজন, কোটালপাড়া জায়গাটি হল হাওড়া ও হুগলি জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম
। হুগলির চাঁপাডাঙ্গা থেকে দামোদরের বাঁধ
ধরে উদয়নারায়ণপুরের দিকে আসতে রাস্তার মধ্যে পরে এই কোটালপাড়া গ্রাম । আশপাশ
গ্রামের মধ্যে এই একটি সরকারি হাসপাতাল, তাই এতে রোগীর চাপ একটু বেশি । তথাকথিত
সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল বলতে উত্তরে তারকেশ্বর, পশ্চিমে আরামবাগ, দক্ষিণে
উদয়নারায়ণপুর । কৃষিপ্রধান গ্রাম, তাই মূলত লোকে এই গ্রামীণ হাসপাতালকে ব্যবহার
করে । এই গ্রামীণ হাসপাতালের ডাক্তারবাবু যদি মনে করেন কোন রোগীকে এখানে সারিয়ে
তোলা সম্ভব নয় তখন তিনি অন্য কোনো বড় হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন । এছাড়া ছোটোখাটো রোগের সমস্ত চিকিৎসায় এখানে
হয় । গ্রামীন ছোট হাসপাতাল হলেও এখানে
একটি মর্গ আছে, তাই পোস্টমর্টেম এখানেই হয়। একজন ডাক্তার আছেন তিনি পোস্টমর্টেম
করেন আর একজন ডোম আছে, সে সব কিছু দেখাশোনা করে । কিন্তু এই লাশ গায়েব হওয়ার
কারণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বোধগম্য হচ্ছে না । এক মৃত ব্যক্তির পচাগলা শরীর নিয়ে
কার কিই বা কাজ হতে পারে । স্থানীয় চায়ের দোকানের বৈঠকে এই বিষয়টি সকলের কাছে
মুখরোচক আলোচ্য বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে ।
অবসরপ্রাপ্ত স্কুলটিচার সুরেন মিত্র মহাশয় বললেন, "এটা হতে পারে কোন
একটা দলের কাজ যারা মানবশরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবসা করে " । অখিলবাবু
বললেন, ”দেখ গে যাও হাসপাতালে কোন লোক এই লাশ পাচারের সঙ্গে যুক্ত আছে, তা না হলে
একটা বদ্ধ ঘরের মধ্যে থেকে একটা মৃত ব্যক্তির লাশ তো নিজে পায়ে হেঁটে উধাও হয়ে
যেতে পারে না “ ।
এইরকম নানা
মুনির নানা মত, নানা মন্তব্যে পুরো পাড়া সরগরম ।
কিন্তু সঠিকভাবে কেউই লাশ পাচারের সঠিক কারণ, উপায় এবং উদ্দেশ্য বলতে
পারছে না । এত সবের মধ্যে হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষের একটা ভয় আছে। যদিও এখানে পোস্টমর্টেমের পর অনেকসময়েই মৃত ব্যক্তির
শরীর নিতে আসে না তার আত্মীয়-স্বজন, কিন্তু কেউ যদি নিতে আসে তবে হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষ তা দিতে বাধ্য থাকবে । কারণ পোস্টমর্টেমের পর মৃত ব্যক্তির শরীরের উপর
তার আত্মীয়-স্বজনের একটা অধিকার আছে । এইজন্যে হাসপাতাল সুপার সূর্যকান্তবাবু
পুড়শুরা থানায় একটি এজাহার দাখিল করলেন এবং যদি সম্ভব হয় তবে একজন কনষ্টেবলকে যেন
হাসপাতালে পোস্টিং করেন বিশেষ করে মর্গে সেই কথাও থানাতে জানালেন । রাতে পাহারা দেওয়ার জন্য থানা থেকে কোন লোক
এখনও আসেনি, ইতিমধ্যে আরও একটা লাশ গায়েব হয়েছে । মৃত ব্যক্তির নাম সমীরণ মজুমদার, বয়স আনুমানিক
চল্লিশ বছর হবে, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে শ্মশানের ধারে যে অশ্বত্থ গাছ আছে, তাতে
গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, গত দু-তিন দিন আগে । পুলিশ এসে লাশ
নামিয়ে রিপোর্ট লিখে মর্গে পাঠিয়ে দেয়
। তার স্ত্রী এসে লাশ সনাক্তকরণ করে গেছে
। কিন্তু বাড়ির অন্য আত্মীয়-স্বজন বডি
নিতে আসে একদিন পরে । মর্গে গিয়ে ডোম
কালু দেখে চার নম্বর টেবিলের লাশ নেই, শুধু সাদা কাপড়টা পড়ে আছে টেবিলের ওপর
। ঘর চারিদিকে বন্ধ, সম্প্রতি একটা নতুন তালা লাগানো হয়েছে মর্গের
মেন গেটে, তারপরও এই দুর্ঘটনা ঘটে কীকরে
। কালু প্রথমে ঘটনাটি সুপারের কাছে বলে ।
সুপার নিজে গিয়ে ব্যাপারটি তদন্ত করেন ও নিশ্চিন্ত হন যে সমীরণ মজুমদারের বডি
গায়েব । ততক্ষনে মৃত ব্যক্তির
আত্মীয়-স্বজন হইচই, চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে । ব্যাপারটা হাতের বাইরে যাচ্ছে দেখে
সূর্যকান্তবাবু তাদেরকে নিজের চেম্বারে ডেকে নিয়ে গিয়ে ভালো করে বোঝালেন । তারপর তারা চলে গেল ঠিকই, কিন্তু
সূর্যকান্তবাবুর মনে মূল প্রশ্ন এখনো অনুত্তরিত হয়ে রইল । সমীরণ মজুমদারের লাশ
কে, কোথায়, কিভাবে, কেন সরিয়েছে।
এটা নিয়ে এখন
পর্যন্ত তিন তিনটে লাশ গায়েব হয়েছে । ব্যপারটা এখন আর কোনভাবে সামলানো যাচ্ছে না
। এই ঘটনার পর পুড়শুরা থানা থেকে একজন কনস্টেবল এখানে পোস্টিং করানো হয়েছে । পাড়ার কয়েকজন যুবক ছেলে মিলে স্ব-ইচ্ছায়
হাসপাতালে চারিদিকটা রাতের বেলায় পাহারা দেবে বলে ঠিক করেছে । অবশ্য এতে সূর্যকান্তবাবু অনুমতি দিয়েছেন এবং
তিনি তাদের কয়েকটি বড় টর্চলাইট কিনে দিয়েছেন । এই দলের মধ্যে আছে পল্টু, বিশু,
রাখাল, কেষ্ট এবং হাবা লালু । লালু কথা
বলতে না পারলেও বুদ্ধি খুব বেশি । একবার
চক্রবর্তীদের বাগান থেকে কে আম পেড়ে নিয়ে পাঁচিল টপকে চলে যায় সেইটা জানার জন্য
সে সারারাত আমগাছের উপর বসে ছিল । চোর যেই আসে অমনি সে তার ওপর ঝাঁপিয়ে
পড়ে, তারপর তার হাত-পা বেঁধে ফেলে দড়ি
দিয়ে, সেই থেকে গ্রামের কোন সাহসিক কাজ করতে হলে লালুর ডাক পরে সর্বপ্রথম । এই পাঁচ ছয় - জন যুবক, দু'জন করে এক একটা দলে
ভাগ হয়ে হাসপাতালে বিভিন্ন দিকে পাহারা দিচ্ছে ।
মাঝরাতে লালুর পেটখারাপ হয়, লালু আর বিশু দায়িত্ব নিয়েছিল হাসপাতালের
পূর্বদিক পাহারা দেবে । আসলে দামোদর নদীর
পশ্চিম পাড়ে আছে এই হাসপাতাল, তাই হাসপাতালের পূর্বদিক মানে দামোদর নদীর দিক
। অতএব বিশুর পরামর্শমতো লালু দামোদরের
চরে গেল পায়খানা করতে । শেষকালে শৌচকর্ম
করার জন্য যখন সে দামোদর নদীতে নেমেছে তখন হঠাৎ তার মনে হল নদীর পাড়ে শ্মশানের
কাছে যে অশ্বত্থ গাছটা আছে তার মধ্যে যেন কেউ নড়াচড়া করছে । প্রথমটায় সে ভাবল শিয়াল বা ভোঁদড় হবে কারণ এরা
নদীর চরে গর্ত করে দিনেরবেলায় ঘুমিয়ে থাকে, রাত্রিবেলা বের হয় শিকারের সন্ধানে । এরা হাঁস মুরগি এমনকি ছোট ছাগলছানাও বাদ দেয়
না । একটু ভালোভাবে দেখবে বলে সে এগিয়ে
গেল । ঝোপের ধারে খানিকটা যেতেই তার মনে একটা অজানা ভয় মিশ্রিত আশঙ্কা উপস্থিত
হল, এটা তো ভোঁদড় বা শিয়ালের কীর্তি নয়।
সে ছুটে বিশুকে ডাকতে যাবে ভাবল হঠাৎ একটা কি সে হোঁচট
খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল । বিশু তার থেকে বয়সে কয়েকবছরের ছোট , তাই টর্চ লাইটটা
তাকে দিয়ে সে চাঁদনী রাতে খালি হাতে এসেছিল পায়খানা করতে । সেই আবছা চাঁদের আলোয় সে বুঝতে পারলো এটা কোন
হাঁস বা মুরগীর পা নয়, এটা একটা মোটা প্রমাণ সাইজের মানুষের শরীর । তাহলে কি শিয়াল বা বড় কোন জন্তু একটা গোটা মানুষকে গ্রাম থেকে ধরে এনেছে
। তা তো সম্ভব নয়, তাছাড়া একটা জ্যান্ত
মানুষকে যদি কোন জন্তু ধরে সে তো স্বাভাবিক ভাবেই চিৎকার করবে বা নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করবে । এটা তো নিথর
হয়ে মরার মত পড়ে আছে । তবে কি শিয়ালের
দল হাসপাতাল থেকে লাশ গায়েব করেছে । এইরকম একটা সূত্র পাওয়া গেছে এই ভেবে লালু
একটু পুলকিত হলো বটে কিন্তু পরমুহূর্তে তার সমস্ত আনন্দ কর্পূরের মত উবে গেল
। সে সামনে দেখতে পেল একজোড়া জ্বলন্ত চোখ
তার দিকে তাকিয়ে আছে । অন্ধকারে চোখটা যখন আরেকটু অভ্যস্ত হয়ে গেল তখন সে দেখল
শুধু চোখ নয়, একটা নরকঙ্কাল তার থেকে ১০ -১৫ হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে । তার একটা
হাতে এই মৃত ব্যক্তির কাটা হাত যেটা শরীর থেকে বিছিন্ন করা হয়েছে । সেই ভয়ঙ্কর
কঙ্কালটি এই কাটা হাত থেকে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে । এহেন দৃশ্য দেখে সে
প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে বিশুকে ডাকার চেষ্টা করল কিন্তু ব্যর্থ হলো । অতএব সে প্রাণপণে দামোদরের চরে বালির উপর দিয়ে
ছুটতে লাগল হাসপাতালের দিকে । বিশুর কাছে
গিয়ে সে কোন কথা বলতে পারলো না, শুধু ইশারাতে দামোদরের চরের দিকে একবার আঙ্গুল
দিয়ে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করল । বিশু তা বুঝতে পারল না । চিৎকার শব্দ, তাই সে
শুধু হাত নেড়ে ইশারা করে আবার জিজ্ঞাসা করল সে কি বলতে চায়। তার উত্তর দেওয়ার
আগেই লালু হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল ।
বিশু তাড়াতাড়ি বাকি সব ছেলেদের ডাকলো, এরপর লালুকে একটা স্ট্রেচারে করে
হাসপাতালে নিয়ে এলো । ডাক্তারবাবু তাকে দেখে ওষুধ দিলেন । সবাই মিলে সেই রাতে
তাকে ধরাধরি করে বাড়ি পৌঁছে দিল । বাকি সবাই যে যার ঘরে চলে গেল, সেই রাতে কারো
আর পাহারা দেওয়া হলো না । পরেরদিন সকালে সকলে মিলে লালুর বাড়িতে গিয়ে দেখল তার
ধুম জ্বর হয়েছে, তার মা মাথায় জলপট্টি দিয়েছে আর সে জ্বরের ঘোরে
বিকার বকতে শুরু করেছে । কেউ এটা ভুলতে
পারল না কাল পর্যন্ত এই দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাহসী শক্তিমান যে ছেলে, এক রাতে
কি দেখলো যে সে অসুস্থ হয়ে পড়ল । হঠাৎ বিশু বলল গতকাল রাতে ও পায়খানা করতে নদীর
চরের দিকে গিয়েছিল, ওখান থেকে যখন সে ফিরে আসে সে অত্যন্ত ভীত ছিল এবং কিছু একটা
ভয়ংকর জিনিস সে দেখেছিল ওখানে, সেটাই
বারবার আঙ্গুল দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করছিল ।
লালুর পর পল্টু হল এই দলের মধ্যে একটু সাহসী । সে বলল,
"চল একবার আমরা সবাই মিলে যাই ওখানে” । রাখাল ছাড়া বাকি সবাই চলে গেল
দামোদরের চরে । এই দিকটায় লোকেরা বেশি
আসা-যাওয়া করে না । প্রথমত শ্মশান তারপর এখানে অশ্বত্থ গাছ । গ্রামের লোকেদের
ধারণা রাত্তিরে যদি কেউ একলা এই গাছের কাছে আসে তবে তাকে ভূতে ধরবে অবশ্যই ।
অনেকে নাকি নিশির ডাক শুনে রাত্রে এখানে এসেছে আর বাড়ি
ফিরতে পারেনি, সকালে তার লাশ পাওয়া যায় নদীর ধারে । এছাড়া অন্য কারণও আছে ।
এইদিকে নদীটা একটু বেশি গভীর । অশ্বত্থ গাছ থেকে ডালপালা ও ঝুরি নেমে একটা জঙ্গলে
পরিণত হয়েছে । যদি কেউ এই গাছে চড়তে
গিয়ে পা পিছলে নদীতে পড়ে তবে তার মৃত্যু অবধারিত ।
বল্টু বলল, "তোরা একটা পচা গন্ধ
পাচ্ছিস?" বাকিরা প্রায় একসাথে বলে
উঠল, “ হ্যাঁ পাচ্ছি” ।
ইতিমধ্যে পাড়ার একটা ঘিয়ে ভাজা কুকুর একটা বড় হাড়
মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে । তারপর তারা আরও খানিকটা অশ্বত্থ গাছের দিকে এগোতে গিয়ে
যেটা দেখতে পেল সেটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর । একজন মৃত ব্যক্তির লাশ পড়ে আছে নদীর
চরে, শরীরটা পচে গেছে তার থেকে দুর্গন্ধ
বের হচ্ছে । তার শরীরে দু'টো হাত নেই এবং পেটের কাছে একটা বড় গর্ত । মনে হচ্ছে
কেউ ওখান থেকে মাংস খুলে খেয়েছে । দু'টো
কুকুর তখনও এই লাশটাতে কামড় দিয়ে চলেছে । এমন দৃশ্য দেখে বিশু ভয়ে
চেঁচিয়ে উঠল ।
পল্টু বলল, "তাহলে এই এটা মনে হচ্ছে হাসপাতাল থেকে
গায়েব হয়ে যাওয়া একটি লাশ । এই কুকুরের দল নিয়ে এসেছে” । বিশু বলল,” কুকুর
কিকরে আনতে পারবে ? হাসপাতালের গেটে তো তালা বন্ধ” ।
পল্টু বিশুকে বলল, “ তুই একবার দৌড়ে গিয়ে সূর্যবাবুর
কাছে এই কথা জানাবি, ততক্ষণ আমরা এখানে
দাঁড়িয়ে আছি” ।
বিশু চলে গেল, কিছুক্ষনের মধ্যেই সূর্যবাবু সঙ্গে একজন
ডাক্তার, ডোম কালু এবং আরও দুই একজন লোক নিয়ে এসে হাজির হলেন। প্রথমেই সূর্যবাবুর
মুখটা দেখেই চিনতে পারলেন এটা সমীরণ মজুমদার ।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে বন্ধ মর্গ থেকে এই লাশটাকে এখানে এলো কিকরে ।
ডাক্তারবাবু বললেন, “ স্যার বন্ধ মর্গ থেকে এটা কিভাবে এখানে এল সেটা পরে আলোচনা
করা যাবে, আগে এই লাশটাকে দাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে । কারন পচা লাশ থেকে যা
দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে তাতে রোগ ছড়িয়ে পরতে পারে” । কথাটা সূর্যবাবুরও মনে হয়েছিল
। তাই তাঁর অনুরোধে পাড়ার কয়েকজন লোক
মিলে এবং কালু ডোম শ্মশানে লাশটার দাহ করার ব্যবস্থা করল ।
এরপর প্রায়
একসপ্তাহ কেটে গেছে । ইতিমধ্যে লালু সুস্থ হয়ে উঠেছে, সে আকারে ইশারায় সবাইকে
বোঝাতে চেষ্টা করল সেই রাতে কি দেখেছিল কিন্তু কেউ তা বুঝতে পারলো না । সকলে তাকে
হাবার প্রলাপ বলে এড়িয়ে গেল । এরপর প্রায়
আরও একমাস কেটে গেছে, মর্গ শূন্য কারণ কোনো দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যার খবর নেই এই
গ্রামে । তাই রাত্তিরেতে পাহারাদারি উঠে গেছে । একদিন স্থানীয় কোটালপাড়া স্কুলের
বাংলার শিক্ষক সুরেন মিত্র মহাশয় হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মারা যান । তাঁর স্ত্রী
বিয়োগ হয়েছে গত বছরে, এক পুত্র কলকাতায় থাকে । গ্রামের বাড়িতে সুরেনবাবু একাই
থাকতেন। পাশের বাড়ির উমা বউদি সুরেনবাবুকে দুইবেলা খাবার দিয়ে যান । গতকাল রাতে
খাবার দিয়ে যাওয়ার পর সুরেনবাবু গেট বন্ধ করেন ।
আজ সকালে উমা বউদি চা দিতে এসে দেখেন গেট বন্ধ । অনেক ডাকাডাকির পরও যখন
গেট খুললনা, তখন তাঁর একটু ভয় হল । তিনি পাড়ার সকলকে ডাকলেন । পাড়ার লোক এসে দরজা
ভেঙ্গে ঢুকে দেখে সুরেনবাবু বিছানায় শুয়ে আছেন চিত হয়ে। পাড়ার হাতুড়ে ডাক্তার
বিরেন ঘোষ দেখে বলেন হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে ইনি মারা গেছেন, বোধহয় ঘুমের মধ্যে হার্ট
অ্যাটাক হয়ে গেছে । তাঁর একমাত্র পুত্রকে খবর দেওয়া হয়েছে । তার আস্তে আস্তে প্রায় রাত দশটা তারপর শব
নিয়ে সুরেনবাবুর পুত্র পিতার অন্তিমযাত্রায় চলল, সঙ্গে কয়েকজন লোক শ্মশানে গেল
শ্মশানযাত্রী হিসাবে । যারা শ্মশানযাত্রী ছিল সকলেই মদ খেয়ে চুর, শুধুমাত্র
সুরেনবাবুর একমাত্র পুত্র সন্তোষ ছাড়া । কোটালপাড়া শ্মশানের চিতাটি নদীর দিকে,
এছাড়া একটা ছোট আটচালা মত আছে সকলের বসার জন্য ।
সেখানে দু'চারজন লোক বসে মদ খাচ্ছে এবং মাঝেমধ্যে হরিবোল দিচ্ছে । সুরেনবাবুর চিতা জ্বলছে, তাঁর পুত্র অশ্রুসজল
চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বসে আছে । একটা
লোক মাঝেমধ্যে গিয়ে চিতার আগুনটা ঠিক করে দিচ্ছে এবং কাঠের যোগান দিচ্ছে যাতে করে আগুনটা ঠিকভাবে জ্বলে
। হঠাৎ সন্তোষের মনে হল যে চিতার মধ্যে
শুধু কাঠ জ্বলছে মৃত ব্যক্তির শরীর নেই । এইকথা মনে হতেই প্রথম সে একজনকে জানালো
। শ্মশানযাত্রীরা অধিকাংশই মদ খেয়ে চুর
ছিলো তাই তারা উল্টে সন্তোষকে সান্তনা দিলো বাপ মরলে এইরকমই মনে হয় বাবা । এর মধ্যে একজন ব্যক্তি যে চিতায় কাঠের যোগান
দিচ্ছিল সে বিষয়টি লক্ষ্য করলো । তখন আর
বাকি লোকরা তার কথা ফেলতে পারল না । এক
মৃত ব্যক্তির লাশ জ্বলন্ত চিতা থেকে কে নিয়ে যাবে আর এটা তার কি কাজে লাগবে
। তাই সকলে মিলে আশ-পাশটা দেখতে লাগল
। হঠাৎ একজন বলে উঠল, ”ওই দেখো লাশ” ।
সবাই একসাথে
সেইদিকে তাকিয়ে দেখল । একটা নরকঙ্কাল
দাঁড়িয়ে আছে, তার শরীরে কোন মাংস-চামড়া নেই । শুধু হাড়, চোখদু'টো যেন আগুনের
গোলা, দু'টো হাত দিয়ে আধপোড়া শবটাকে
ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে । ইতিমধ্যে উপস্থিত
সকলের নেশা ছুটে গেছে, তারা মোটামুটি
স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে । কাজেই এটা সকলের একসাথে চোখের ভুল নয়, কঠিন কঠোর
বাস্তব । এর মধ্যে একটা লোক পিছন থেকে গিয়ে সেই নরকঙ্কালের মাথায় এক সজোরে
বাঁশের বারি মারতে উদ্যত হয় । সেই আঘাত
তার গায়ে লাগার আগেই কঙ্কালটি ভূতের মত অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তার হাত থেকে আধপোড়া
সুরেনবাবুর লাশটি মাটিতে পড়ে যায় ।
তারপর সবাই সেটাকে ধরাধরি করে চিতায় তোলে । বাকী রাতটুকু মরা পোড়াতেই চলে
যায় । পরেরদিন এই কথা আগুনের ফুলকির মতো সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে । কালীজ্যাঠা গ্রামের সব থেকে বয়স্ক এবং পন্ডিত
ব্যক্তি এবং তন্ত্রবিদ্যা কিছু জানেন,
সারা গ্রামের লোক তাঁকে মান্য করে । পরেরদিন সন্তোষ, পিতার শ্রাদ্ধের কথা
কালীজ্যাঠাকে বলতে গিয়েছিল । কথায় কথায়
শ্মশানের সেই রাত্রির কথাটা এসে পাড়ে ।
এই কথা শুনে কালীবাবু বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর হাত চেলে দেখলেন একটা অমঙ্গলের ছায়া যেন
গোটা গ্রামটাকে ঘিরে আছে ।
তিনি বললেন,”
তোমাদের ভাগ্য ভালো তোমরা সব থেকে বেঁচে
ফিরে এসেছ । একটা অতৃপ্ত
প্রেতাত্মা গোটা গ্রামের দিকে কুদৃষ্টি দিয়ে বসে আছে । তাই নানা অমঙ্গল হচ্ছে । শ্মশানে একটা কালীপূজো করা দরকার এবং সেটা
সাধারণ ব্রাহ্মণ দিয়ে নয়, বর্ধমানের
রায়না থেকে বিশেষ তান্ত্রিক ব্রাহ্মণকে নিয়ে আসতে হবে । তিনি পরেরদিনই গ্রামসভায় এই কথাটি পাড়লেন, অমঙ্গলের কথা শুনে সকলেই একবাক্যে রাজি হলো ।
পাড়ার ছেলেরা তখন বাড়ি বাড়ি কালীপুজোর চাঁদা আদায় করতে ছুটে গেল । এর মধ্যে একজন
রায়নাতে চলে গেল তান্ত্রিকের সন্ধানে । কালীবাবু এক তান্ত্রিককে জানতেন তাঁর কাছে
লোক পাঠানো হয়েছিল । তিনি শ্মশান জাগাতে
পারেন এবং বেতালসিদ্ধ তান্ত্রিক ।
কোটালপাড়া কালীবাবুর কাছ থেকে আসছে শুনে সেই তান্ত্রিক যত্নপূর্বক এদের
কথা শুনলেন । তারপর একটা চক দিয়ে মাটিতে
অনেকক্ষণ নানা আঁকিবুকি কাটলেন এবং গণনা করে বললেন, “ কোন এক অতৃপ্ত আত্মার শব
এখনও তোমাদের গ্রামে আছে, সেইই সব অপকর্ম করছে ।
তিনি কে বা কোথায় আছেন সেইসব কিন্তু আমি এখনই বলতে পারব না । তার জন্য শ্মশানে বিশেষ পূজা ও শ্মশান জাগানোর
ব্যবস্থা করতে হবে । আগামী অমাবস্যায় একটা ভালো দিন আছে, তোমরা চাইলে ঐদিন
আমি পূজা করতে পারি । " সেই ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল, তান্ত্রিক মহাশয় তার হাতে পূজার সামগ্রীর
তালিকা তুলে দিলেন ।
আজ অমাবস্যা
সকলে মিলে শ্মশানে চারিদিক পরিষ্কার করেছে, আটচালায় পুজো হবে । শ্মশানকালী পূজার নিয়ম হলো, ওই দিনই ঠাকুর
তৈরি হবে, সারারাত পুজো হবে এবং সূর্য ওঠার আগে বিসর্জন হবে । তান্ত্রিক মশাই সকালেই এসে গেছেন, তিনি মাটি দিয়ে একটা কালী প্রতিমা
বানাচ্ছেন, মূর্তির পাশে একটা পাত্রে আগুন
জ্বলছে, তার তাপে মূর্তিটা শুকাচ্ছে । তালিকা অনুযায়ী জিনিসপত্র সব এসে গিয়েছে,
এখানে বিজলিবাতি আনা সম্ভব নয়, তাই কয়েকটি কেরোসিন তেলের বাতি জ্বালানো হয়েছে
। সন্ধ্যেবেলায় কালীজ্যাঠা এসে একবার
দেখে গিয়েছিলেন এবং তান্ত্রিক মশাইয়ের
সঙ্গে কথাও বলেছিলেন । তান্ত্রিক
মশাই তার একজন সঙ্গীকে নিয়ে এসেছেন কারণ শ্মশান জাগাতে গেলে একজন পুরোহিত ও একজন
তন্ত্রধারকের প্রয়োজন হয় । ইতিপূর্বে কোটালপাড়া শ্মশানে এত বড় কালীপুজো হয়নি,
তাই পল্টুর দল খুব খুশি ।
বিশু জিজ্ঞাসা করল,” ঠাকুরমশাই এখন ঠাকুর গড়ছেন আর আজ
রাতেই পুজো হবে, এই সময়ের মধ্যে ঠাকুর শুকিয়ে যাবে তো, কারণ কুমোরপাড়ায় দেখেছি সরস্বতী ঠাকুর
অনেকদিন আগে তৈরি হয়, আমরা পুজোর দিন
ঠাকুর আনতে যেতাম” । তান্ত্রিক মশাই তার
কথাগুলো শুনে একটু মুচকি হাসলেন আর সহকারী মশাই উত্তর দিলেন, “ সেই জন্যই তো আগুন জ্বালিয়ে রেখে ঠাকুরকে শুকানো হচ্ছে” ।
এখন রাত্রি
দশটার বাজে । আটচালার মধ্যে ঠাকুর বসিয়ে পুজোর ব্যবস্থা হয়েছে । একদিকে কাটা ফল
ও মিষ্টান্ন আছে অন্যদিকে ফুল-বেলপাতা ও
পূজার অন্যান্য সামগ্রী আছে । একটা বোতলে
কারণসুধা, যাকে বাংলায় বলে দেশী মদ এবং
একটা জীবন্ত মাগুর মাছ । মাগুর মাছ ও কারণসুধা শ্মশানকালী পুজোর বিশেষ উপকরণ, যেটা
না হলে পুজো অসম্পূর্ণ থাকে বলে তান্ত্রিকদের ধারণা ।
তান্ত্রিক মশাই
আসনে বসে পূজা শুরু করলেন, সহকারী মশাই
তাকে নানাভাবে পূজোর সামগ্রী হাতে হাতে জুগিয়ে দিয়ে সাহায্য করলেন । তিনি পুঁথি খুলে নানান মন্ত্র বলে একটা করে ফুল
মায়ের পায়ে দিতে লাগলেন । ছেলের দল
একদিকে বসে ছিল, উল্টোদিকে গ্রামের কিছু লোক বসে ছিল । তারাও বেশ কিছুক্ষণ ধরে পূজা দেখছিল ।
এখন রাত্রি বারোটা বাজে, চতুর্দিক নিশুতি । একটা ঠাণ্ডা
হওয়া বইছে, দূরে কোথায় শিয়ালের দল প্রহর গুনিয়ে যাচ্ছে । বলির সময় উপস্থিত । একটা
কাঠের পাটার উপর মাগুর মাছটাকে রেখে, কাটারি দিয়ে দু'টুকরো করে দিলেন । মাছের ধড়ের দিকটা বেশ খানিকক্ষণ ছটফট করতে লাগলো । সেই মাছের রক্ত একটা কলাপাতায় দিয়ে তাতে
ফুল-বেলপাতা পূজার অন্যান্য উপকরণ দিয়ে একটু কারণসুধা দিয়ে মায়ের কাছে রাখলেন
। এইভাবে পূজা করতে করতে আরও প্রায়
ঘন্টাখানেক কেটে গেল ।
এখন রাত্রি
দ্বিপ্রহর, চারিদিক আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেছে । এইসময় ঠান্ডা বেশি তারপর নদীর ধার,
কুয়াশার হিমেল একটা চাদর যেন পুরো গ্রামটাকে
ঢেকে দিয়েছে । তান্ত্রিক মশাই ও তাঁর সহকারী কিছু পুজোর উপকরণ
নিয়ে চললেন শ্মশান জাগানোর জন্য । উপস্থিত সমস্ত লোককে তিনি বললেন,- “তোমরা
ওইদিকে যাবে না, যদি আমরা ডাকি তবে যাবে”
।
আটচালা থেকে
শবদেহ দাহ করার জায়গাটি একটু দূরে, কিন্তু
তা হলেও আটচালা থেকে সবই স্পষ্ট দেখা যায় ওখানে কি হচ্ছে, না হচ্ছে ।
তান্ত্রিক মশাই চিতার উপর আসন পেতে বসলেন
। প্রায় সপ্তাহখানেক আগে গ্রামের এক ব্যক্তি মারা গেছেন তারই শব দেহ পোড়ান
হয়েছিল । ভাঙা কলসিটা এখনও তার মাথার কাছে
আছে । একটা নামাবলী ঢাকা দিয়েছিল, সেটা
গুটিয়ে গিয়ে একদিকে পড়ে আছে, একটা ফুলের মালা শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে, একটা গীতার
বুকের ওপরে আছে, মাথার পাশে তুলসী গাছ
শুকিয়ে গেছে জলের অভাবে । তান্ত্রিক মশাই
তার ওপর বসে নানান মন্ত্র বলে পূজা করতে লাগলেন ও
মধ্যে মধ্যে একটু করে কারণসুধা তার মুখে দিতে লাগলেন । এইভাবে কতক্ষন কেটে গেছে তার ঠিক নেই । হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা হাওয়ায় চারদিকটা ভরে গেল,
অশ্বত্থ গাছের ডালপালাগুলো যেন কেমন জোরে জোরে দুলতে লাগল, এরপর সহকারী মশাই
উপস্থিত কয়েকজন লোককে ডাকল । তান্ত্রিক
মশাই তখনও চিতার ওপর বসে পূজা করছিলেন ।
হঠাৎ দূর থেকে একটা তীক্ষ্ণ ও তীব্র চিৎকার শোনা গেল । তান্ত্রিক মশাইের
মাথাটি ধীরে ধীরে আন্দোলিত হতে লাগল, তাঁকে যেন মনে হলো একটা গভীর ঘুম পেয়েছে,
তারপর তিনি ধীরে ধীরে চাপা আওয়াজে
সহকারীকে জিজ্ঞেস করলেন - কেন তোরা আমাকে
ডেকে এনেছিস ?
সহকারী মশাই প্রত্যুত্তরে বলল, - কে তুই ? কি চাস ?
তান্ত্রিক মশাইয়ের কন্ঠ দিয়ে আবার আওয়াজ আসলো , - আমি
এক কালীসাধক ছিলাম, আমার মৃত্যুর পর তোরা আমার শরীরটাকে যথাবিধি দাহ না করে
অর্ধদগ্ধ অবস্থায় দামোদরের চরে ফেলে দিয়েছিস । আমি এখনও মুক্তি পাইনি, অশ্বত্থ
গাছের নীচে যে ঝোপ আছে সেইখানে এখনো আটকে পড়ে আছি। শরীরে বড় যন্ত্রণা, যতদিন না
তোরা আমার দেহকে যথাবিহিত দাহকর্ম করবি, ততদিন আমি তোদের উপর অত্যাচার করবো ।
সহকারী বলল, - ঠিক আছে আমরা তোর মুক্তির
ব্যবস্থা করছি তুই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবি,
আর এখন গুরুজীর শরীর ছেড়ে চলে যা,
যাবার সময় ওই অশ্বত্থ গাছের একটা ডাল ভেঙে দিয়ে যা ।
এর খানিক পরেই
মড়মড় করে অশ্বত্থ গাছের একটা ডাল ভেঙে দামোদরের জলে পড়লো আর যে ঠাণ্ডা হাওয়াটা
বইছিল সেটাও কমে গেল এবং তান্ত্রিক মশাইও ধীরে ধীরে খানিকটা সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক
অবস্থায় ফিরে এলেন । সকলে মিলে আবার তাকে
ধরে আটচালায় নিয়ে আসল ।
প্রতিমার সামনে
বসে তান্ত্রিক মশাই সহকারীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ কী হয়েছিল” ।
সহকারী তাঁকে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলল । তারপর তান্ত্রিক মশাই উপস্থিত লোকদেরকে
উদ্দেশ্য করে বললেন, “ কে এই কালীসাধক ছিল,
তিনি কিভাবে মারা গিয়েছিলেন ?”
উপস্থিত লোকদের
মধ্যে একজন মাতব্বর গোছের লোক ছিল । সে বলল, ” প্রায় বেশ কয়েকবছর আগে এক সাধু
কোথা থেকে এসে এখানে তার আস্তানা বানিয়েছিল ।
তাকে আমরা অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম
কিন্তু তিনি উত্তর সামান্যই দিতেন
। এই শ্মশানটা ছিল গ্রামের বাইরে,
দামোদরের পাড়ে । তখন এই এলাকায়
চুরি-ডাকাতি খুব হতো । রাত্তিরে এখানে সকলে এসে জমায়েত হতো তারপর গ্রামে চুরি
করতে যেত । এই সাধু থাকায় চোরের দল আর এখানে আসতো না । তাই
গ্রামের লোকেদের বিশেষ আপত্তি ছিল না ।
তিনি মাঝেমধ্যে গ্রামে গিয়ে ভিক্ষা করে নিয়ে আসতেন তারপর তা রান্না করে
খেতেন । এরকমভাবে বেশ কয়েকবছর কেটে গেছে । হঠাৎ একদিন এক ছেলে বলল সেই সাধুবাবা
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে আটচালার মধ্যে, নড়েও
না চড়েও না । ওরা নদীর পাড়ে বল খেলতে
গিয়েছিল, হঠাৎ বলটা ঐদিকে চলে যায় । সেটা আনতে গিয়ে একটা ছেলে দেখেছিল । তখন আমরা কয়েকজন মিলে এখানে দেখতে আসি । দেখি সাধুবাবা মারা গেছেন, বোধহয় ঘুমের মধ্যে
হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মারা গেছেন । হরিশ
ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে সার্টিফিকেট দিয়েছিল । তারপর গ্রামের কয়েকজন লোক মিলে তাকে দাহ করে
দেয় । যেহেতু তার আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই
তাই দায়ভার গ্রামের লোকেরা নিয়েছিল । তখন
বর্ষাকাল, বাঁশ-কাঠ সবই ভিজে । আমার মনে হয় যারা দাহ করতে এসেছিল তারা কোন উপায়ে
খানিকটা দাহ করে বাকি শবদেহ নদীতে ফেলে চলে যায় । এরপর দেহটার যথাবিহিত অন্তিম
সংস্কার হয়নি তাই জন্যই তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। বর্ষাকালে তখন দামোদরে বন্যা এসেছে
। সবাই ভেবেছিল ওর শব নদীতে ভাসতে ভাসতে
অনেকদূর চলে যাবে, কিন্তু তা হয়নি, যার
মাটি যেখানে কেনা আছে অন্তিমকালে সে সেইখানে অবশ্যই যাবে । ওনার মাটি এখানে কেনা আছে, তাই বর্ষাকালে ভরা নদী জলে ফেলে দিলেও শবদেহ
অশ্বত্থ গাছের নীচে ঝোপের মধ্যে আটকে যায় । শরীর থেকে মাংস পচে-গলে নদীর জলে মিশে
যায়, কিন্তু কঙ্কালটি এখনো আটকে আছে “ ।
এতক্ষণ কথা বলার
পর মাতব্বর ব্যক্তি খানিকটা থামলেন । তান্ত্রিক মশাই বললেন,” ঠিক আছে, কাল এখান
থেকে শবটাকে তুলে আমি পুজো করে দেবো । তারপর তোমরা দাহ করবে “ ।
এই বলে তিনি
কালীপুজোর বাকি অংশটা সারতে লাগলেন । পূজান্তে আরতি শুরু করলেন এবং তারপর সমস্ত জিনিসপত্র এবং কালীর মূর্তিসহ দামোদরের
জলে বিসর্জন দিলেন । তখন ভোর হয়ে এসেছে ।
পরদিন সকালে
তান্ত্রিক মশাই কালী জ্যাঠার বাড়ি গিয়ে তাদের রকে বসে সব কথা বললেন । তিনি শুনে
একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেন । তারপর বললেন, “ মৃত ব্যক্তি কারো শত্রু হয় না, কারো মিত্র
হয় না । মৃত ব্যক্তির নিজের ধর্ম
অনুযায়ী যথাবিহিত সংস্কার না করলে সংসারে অমঙ্গল হয়” ।
এরপর তান্ত্রিক
মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,” তুমি ভাই এর
যথাবিহিত পূজা করে শব দাহের ব্যবস্থা করে দিও” ।
তান্ত্রিক মশাই
তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, “আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সব কাজ ঠিক করে দেব” ।
এরপর একজন এসে
বলল,” তান্ত্রিক মশাই শবদেহ নদীর থেকে তোলা হয়েছে, আপনি যাবেন ?” ।
অতঃপর তান্ত্রিক
মশাই নিজে গিয়ে সেই শবকে যথাবিহিত পূজা
করার পর শবদেহের ব্যবস্থা করলেন । সমস্ত
কাজ সম্পাদন করতে করতে দুপুর গড়িয়ে গেল ।
তান্ত্রিক মশাই ও তাঁর সহকারী দুপুরে কালী জ্যাঠার বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন
করলেন । হাসপাতালের সুপার সূর্যবাবু
তান্ত্রিক মশাইকে একটা এক হাজার টাকার নোট দিয়েছিলেন । এরপর আর কোটালপাড়া গ্রামে
কোন শবদেহ গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটেনি । সবাই এখন নিশ্চিন্ত ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন