পরিচালক – আর মাধবন
ভারত
তথা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রকেট বিজ্ঞানী ও মহাকাশ প্রকৌশলী এস. নাম্বি নারায়ন, যিনি
ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞান সংস্থা ইসরোতে কর্মরত ( Indian Space Research Organisation -ISRO) ছিলেন এবং পোলার স্যাটেলাইট ( Polar Satellite Launch Vehicle - PSLV) and the এবং জিওসিন্ক্রোনাইজ স্যাটেলাইট ( Geosynchronous Satellite
Launch Vehicle - GSLV) লঞ্চ করতে ব্যবহৃত লিকুইড ফুয়েল রকেট ইঞ্জিন - “বিকাশ
ইঞ্জিন” তৈরির মূল কারিগর ছিলেন। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের স্নেহধন্য
সুযোগ্য ছাত্র এবং জগৎ বিখ্যাত রকেট বিজ্ঞানী “ দি মিসাইল ম্যান” এ. পি. আব্দুল কালামের
সহপাঠী, প্রিন্সটন ইউনিভারসিটি স্নাতক নাম্বি নারায়ণ ভারতের মঙ্গল গ্রহ অভিযানেরও নেপথ্য
নায়ক ছিলেন।
শুধুমাত্র দেশ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে
এবং ভারতকে মহাকাশ বিজ্ঞানে উচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে যে মানুষ বিশ্ব
বিখ্যাত রকেট মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসার অত্যন্ত লোভনীয় জীবিকার প্রস্তাব হেলায় ছেড়ে
দিয়েছিলেন, তাঁরই বিরুদ্ধে ১৯৯৪ সালে নারীঘটিত ফাঁদে প্ররোচিত হয়ে (honeytrap) পাকিস্তানের
কাছে চরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়। গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। অকথ্য অত্যাচারের মাধ্যমে তাঁকে
দিয়ে স্বীকার করানোর চেষ্টা করানো হয় যে তিনি চরবৃত্তি করেছেন। প্রবল চাপের সম্মুখেও
তাঁর কাছ থেকে বিবৃতি আদায় করতে অপারগ হয়ে প্রশাসন হাল ছেড়ে দিলেও দু’বছর কোর্টে কেস
চলে। বিধ্বস্থ পরিবার, সামাজিক বয়কট – সমস্ত কিছুকে সঙ্গী করেও নাম্বি নারায়ণ এক অসম
লড়াই করে চলেন। এপ্রিল ১৯৯৬ সালে CBI তাদের সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয় ও নাম্বি
নারায়ণকে নির্দোষ ঘোষণা করে। কেরালা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সমস্ত অভিযোগ থেকে তাঁকে
মুক্ত করা হয়। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তাঁকে দুই দফায় ৫ লাখ ও ১.৩ কোটি
টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। মার্চ ২০১৯ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে পদ্মভূষণ পদবীতে
সম্মানিত করা হয়।
রাশিয়াতে গিয়ে কিভাবে নাম্বি
নারায়ণ বিকাশ ইঞ্জিন তৈরির প্রযুক্তি আয়ত্ত করেন, কিভাবে ভারতের জন্য ইঞ্জিনের প্রয়োজনীয়
যন্ত্রাদি ভারতে নিয়ে আসেন থেকে শুরু করে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা ঘৃণ্য অভিযোগের মোকাবিলায়
তিনি কিভাবে এগিয়ে গেছিলেন সেই সমস্ত নিয়েই আর. মাধবনের পরিচালিত চলচ্চিত্র রকেট্রী
– দি নাম্বি এফেক্ট। দক্ষিণী সুপারস্টার আর. মাধবনের প্রথম পরিচালিত এই ছবি সারা
ভারত তথা সারা পৃথিবীকে একজন বিস্মৃতপ্রায় বিজ্ঞানীর
কথা জানিয়েছেন এক অনবদ্য আখ্যানের মাধ্যমে।
ছবি শুরু হয় একটি টিভি চ্যানেলের
জন্য ভারতীয় চলচ্চিত্র তারকা শাহরুখ খানের নেওয়া সাক্ষাৎকার দিয়ে। চ্যানেলের প্রত্যেক
কর্মী সঞ্চালক শাহরুখের দিকে নজরদারিতে ব্যস্ত। কিন্তু সঞ্চালক যে ব্যক্তির সাক্ষাৎকার
নেবেন তাঁর প্রতি চরম উদাসীন- বিরক্ত, কেউ কেউ কটূক্তি করতেও পিছপা নন। এই দৃশ্যের
অবতারণা দর্শকদের বুঝিয়ে দেয় যে আমরা একজন চলচ্চিত্র তারকাকে নিয়ে যত উচ্ছ্বাসে মত্ত
থাকি, বা একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা যে সম্মান পান, আমাদের দেশের একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী
– গবেষক তা পান না। তাঁর পরিচিতিটুকুও অধিকাংশ দেশবাসীর কাছে অজানা থেকে যায়।
সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে দর্শক
পরিচিত হন ব্যক্তি নাম্বি নারায়ণের সাথে, জানতে পারেন তাঁর অবিশ্বাস্য কীর্তিসমূহ সম্পর্কে।জানতে
পারেন ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানে তাঁর অবদান সম্পর্কে। সিনেমা যত এগোয় তত দর্শক বুঁদ হয়ে
যেতে থাকেন এক বিজ্ঞানীর অসম সাহস, দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা – জ্ঞানের আলোয়।
চলচ্চিত্রের প্রযুক্তিগত কলাকৌশল
বা ক্যামেরার প্রযুক্তি সম্পর্কে কোনও কিছু বলার ইচ্ছা আজ আর নেই। এমন এক বিষয় নিয়ে
পরিচালক ছবি বানিয়েছেন যে অন্য যে কোনও বিষয়ই সেখানে তুচ্ছ হয়ে যায়। প্রত্যেক অভিনেতা
যথাযোগ্য ও অনবদ্য অভিনয় করেছেন। পৃথকভাবে ছবির নায়ক নাম্বি নারায়ণের
ভুমিকায় আর. মাধবন এক কথায় অসাধারণ। নাম্বি
নারায়ণনের চরিত্রটি নিজের সর্বস্ব নিংড়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন।বেশভুষা থেকে শুরু করে সংলাপ এবং অঙ্গভঙ্গি পর্যন্ত, মাধবন অত্যন্ত সাবলীলভাবে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে বজায় রেখেছেন।দীর্ঘ ছয় বছর ব্যয় করে গবেষণা করে একটি চলচ্চিত্র
তৈরি করার মধ্য দিয়ে নিজের শৈল্পিক বোধের সঠিক পরিচয় দিয়েছেন। অতিরিক্ত নাটুকেপনাহীন, ঝরঝরে মূল বিষয়কে পেশ করে পরিচালনার
জগতে দৃঢ় পদক্ষেপ রেখেছেন। ছবিতে গানের ব্যবহারও যথাযোগ্য।ছবির শেষ পর্যায়ে সাক্ষাৎকারে
বিজ্ঞানী স্বয়ং দেখা দিয়েছেন।সাক্ষাৎকারকারী শাহরুখ খান তাঁর পায়ের কাছে বসে যখন সমস্ত
ভারতীয়দের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়েছেন, তিনি তখন বলেছেন – “ অনেকেই বলেন ভুল ছিল, ক্ষমা
করে দেওয়াই উচিত। কিন্তু আমি বলি না, কিছু অন্যায় ক্ষমার অযোগ্য হয়। তা কখনও কোনোভাবেই
ক্ষমা করা উচিত নয়।তাই আজও আমি সেই সব বিজ্ঞানীদের জন্য লড়ে যাচ্ছি যাঁদের সাথে আমার
মত প্রতারণা করা হয়, মিথ্যা অভিযোগে জেলে অত্যাচারিত হতে হয়।এবং আজীবন লড়ব। “
গর্বিত, দৃঢ় পদক্ষেপে তিনি
চলে যান তাঁর বিজ্ঞানের জগতে বা বলা ভালো তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় আলোকিত মহাকাশের নক্ষত্রমণ্ডলে,
একজন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতই।
“রকেট্রী – দি নাম্বি এফেক্ট
“ ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র যা
কান ফিল্ম মহোৎসবে প্রথম উন্মোচিত ( premier)
হয়েছে এবং দেশ ও বিদেশের বিখ্যাত সমালোচক ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্বদের দ্বারা প্রশংসিত
হয়েছে। ৭৬ তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভারত আবার বিশ্বের
দরবারে মাথা উন্নীত করেছে।শুধুমাত্র সুন্দর পরিবেশনের জন্যই নয়,অনবদ্য হারিয়ে যাওয়া
একজন বিজ্ঞানী এবং তাঁর গৌরবান্বিত কীর্তি ও তাঁর জীবনের চরম অপমানজনক ঘটনার বিষয়ের
জন্যও। ছবি শেষে তাই যে মানুষগুলো সাক্ষাৎকারের শুরুতে তাঁকে অবজ্ঞা উপহার দিয়েছিলেন,
তাঁরাই চোখে জল, মনে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ান। এখানেই জয় হয় শ্রেষ্ঠত্বের।
কলমে - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন