ভারতের প্রথম মহিলা পাইলট - সরলা ঠাকরাল

 

সরলা ঠাকরাল

 

" ইচ্ছে করে নীল আকাশে

মেঘের মত ভাসতে। "

-(ইচ্ছে করে, শাওন সারথি )


আকাশের নীল নীলিমায় বেশিরভাগ মানুষের হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে! আকাশের বিশালতা দেখে মন আনন্দে ভরে ঠে! আকাশ নিয়ে আমাদের কৌতুহলের অন্ত নেই। পাখিদের উড়তে দেখে মানুষের মনেও ইচ্ছা জেগেছিল আকাশে ডানা মেলে ড়ার! কিন্তু তা তো প্রকৃতিক ভাবে সম্ভব নয়। তাহলে উপায়? প্রাণীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ সেই উপায়ও বের করে ফেলল। কৃত্রিমভাবে ড়ার যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলল। আজ আকাশ পথে আমরা খুব সহজেই যাতায়াত করতে পারি। বিমানচালনা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা হিসাবে পরিগণিত হয়। আমাদের ভারতও এই ব‍্যাপারে পিছিয়ে নেই। পুরুষদের সাথে নারীরাও সমান ভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে। আজ এমন এক নারীর কথা বলব যিনি শাড়ি পরেই প্রথম বিমান চালিয়ে ভারতের প‍্রথম মহিলা পাইলট হিসাবে স্মরণীয় হয়ে যান। 


জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ 

জন্ম স্থান ঘিমান্ডি, মাদারগেট, আজমে, রাজস্থান, ভারত। 

জন্ম সাল: ১৯১৪ সালের ৮ ই আগস্ট। 

স্বামী: পি ডি শর্মা (প্রথম স্বামী) ছিলেন প্রথম ভারতীয় এয়ারমেইল লাইসেন্স পাওয়া পাইলট এবং ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে এয়ারমেল বিমান করাচি থেকে লাহোর পযর্ন্ত উড়িয়েছিলেন৷, আর পি ঠাকরাল (দ্বিতীয় স্বামী)। 

সন্তান: দুই কন‍্যা সন্তান। 

বিবাহষোল বছর বয়সে পি ডি শর্মার সাথে সরলার বিবাহ হয়। তাঁর প্রথম স্বামী ১৯৩৯ সালে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর ১৯৪৮ সালে আর পি ঠাকরালকে পুনরায় বিবাহ করেন। 


পাইলট হওয়ার পথে 



বালিকা মাত্র ১৬ বছর বয়সে পি.ডি.শর্মার সরলার সাথে বিয়ে হয়ে যায়। তাঁর শ্বশুরবাড়ির নয় জন সদস‍্য পাইলট পদে কর্মরত ছিলেন। তাঁর পাইলট হওয়ার মূল ভিত্তি এইখান থেকেই তৈরি হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ির সবাই তাঁকে এই ব‍্যাপারে উৎসাহ দিতেন। বিশেষ করে সরলা দেবীর স্বামী ও শ্বশুরমশাই। তাঁর শ্বশুরমশাই তাঁকে একটি প্লেন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। 

তিনি এই সম্পর্কে বলেছিলেন

"My husband was the first Indian to get airmail pilot's license and flew between Karachi and Lahore. It wasn't so much of him though. My father-in-law was even more enthusiastic and got me enrolled in the flying club. I knew I was breaching a strictly male bastion but I must say the men, they never made me feel out of place." - Sarla Thakral


সেইসময় ভারতে নারী স্বাধীনতা তেমন ছিল না। সাধারণ নারীদের অবস্থা শোচনীয় ছিল। ন‍্যুনতম শিক্ষাও পাওয়া যেত না। সরলা দেবীর শ্বশুরবাড়ির লোকজন যে তাঁকে পাইটল হতে উৎসাহিত করেছিলেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর। 

তিনি ১৯৩৬ সালে ২১ বছর বয়সে বিমান চালকের লাইসেন্স অর্জন করেন।শাড়ি পরে ককপিটে পা রাখলেন প্রথম ভারতীয় নারী হিসাবে।  'জিপসি মথ'( Gypsy Moth ) এয়ারক্রাফ্ট একক ভাবে উড়িয়ে সৃষ্টি করলেন ইতিহাস।

প্রাথমিক লাইসেন্স ('A' লাইসেন্স) পাওয়ার পর তিনি থেমে থাকেন নি। আগের চেয়ে আরও পরিশ্রম শুরু করেন। কঠোর পরিশ্রমের ফলও হাতেনাতে পেলেন। 'লাহোর ফ্লাইং ক্লাব'-এর মালিকানাধীন বিমানে ১০০০ ঘন্টার উড্ডয়ন সম্পন্ন করেছিলেন। এরপর তিনি আরও কঠোর পরিশ্রম শুরু করে 'B' লাইসেন্স পাওয়ার জন‍্য। এই লাইসেন্সটি পেলে তিনি বাণিজ্যিক পাইলট হতে পারবেন। কিন্তু এই স্বপ্ন তাঁর অধরা থেকে গিয়েছিল। 

প্রথম স্বামীর মৃত্যু এবং পরবর্তী অবস্থাঃ 

 ১৯৩৯ সাল, ২৪ বছরের সরলার যোধপুরে প্রশিক্ষণ চলছিল। দুঃখজনকভাবে তাঁর স্বামী পি. ডি.শর্মা সেইসময়ই একটি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। 

এরপর, তাঁর জীবন অন‍্য খাতে বইতে শুরু করল। সেইসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। সেইকারণে সমস্ত বেসামরিক প্রশিক্ষণ স্থগিত রাখা হয়। এরপর বাণিজ্যিক পাইলটের (Commercial Pilot) লাইসেন্স পাওয়ার চেষ্টা করেও ব‍্যর্থ হলেন সদ‍্য স্বামীহারা তরুণী সরলা। বাণিজ্যিক পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ত্যাগ করলেন। কিন্তু এইভাবে তো বেশিদিন চলতে পারে না! সন্তান মানুষ করতে হবে যে! তাই সবকিছু নতুন ভাবে শুরু করার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন লাহোরে ৷ সেখানে "মেয়ো স্কুল অফ আর্ট"-এ (Mayo School of Art) "বেঙ্গল স্কুল অফ পেন্টিং"-এ (Bengal School of Painting) প্রশিক্ষণ নিয়ে চারুকলায় ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন ৷

লাহোরেও বেশিদিন থাকতে পারলেন না। ভারতের আভ্যন্তরীণ অবস্থা অস্থির হয়ে ওঠে। দেশ বিভাগের ডাক, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতি কারণে অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর তিনি লাহোর থেকে দিল্লিতে চলে আসেন। 

দ্বিতীয় বিবাহ এবং পরবর্তী জীবন

দিল্লিতে আসার পর তাঁর সাথে আর পি ঠাকরলের সাক্ষাৎ হয়। ১৯৪৮ সালে সরলা আর পি ঠাকরালকে পুনরায় বিবাহ করেন এবং সরলা ঠাকরাল নামে পরিচিতি লাভ করেন। 


সরলা ঠাকরাল আর্য সমাজের (বেদের শিক্ষা অনুসরণকারী আধ্যাত্মিক সম্প্রদায়।) একজন নিবেদিতপ্রাণ অনুসারী ছিলেন। সেই সময় ভারতে হিন্দু বিধবাদের পুনরায় বিবাহ হতো না। কিন্তু আর্য সমাজের অনুসরণকারীদের এই ব‍্যাপারে বাধা ছিল না। সরলা দেবী যেহেতু আর্য সমাজের অনুসারী ছিলেন তাই তাঁর পুনরায় বিবাহতে কোনো বাধা ছিল না। 



পরবর্তীকালে তিনি একজন চিত্রশিল্পী, সফল শিল্পপতি হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছিলেন ৷ তাঁর আরেক নাম "মাটি" (Mati) ৷ পোশাক ও গহনা ডিজাইন (designing clothes and costume jewellery) করতেও শুরু করেছিলেন। তাঁর একজন বিখ‍্যাত খদ্দের ছিলেন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত!


গুগল ডুডলে সম্মান


 
৮ ই আগস্ট ২০২১-সালে, ঠাকরালকে তাঁর ১০৭ তম জন্মবার্ষিকীতে 'গুগল ডুডল' সম্মানিত করেছে।


একজন আত্মবিশ্বাসী মহিলা এয়ারক্রাফ্টে উড়ে যাচ্ছেন, চোখে বিশেষ চশমা, উড়ছে হলুদ আঁচল ৷ গুগল হোমপেজ খুললেই চোখে পড়ছে এই ডুডল ৷ ছবিটি এঁকেছেন বৃন্দা জাভেরি (Vrinda Zaveri) ৷ শ্রদ্ধা জানিয়েছে গুগল এই ডুডলে।

তাঁর কথাতেই,"আমি কস্টিউম জুয়েলারি ডিজাইন করার কাজ করেছিলাম, যেটি শুধুমাত্র সেই সময়ের যাঁরা পরতেন তা নয়, ১৫ বছর ধরে কটেজ এম্পোরিয়ামে সরবরাহও করেছিল। এর পরে, আমি ব্লক প্রিন্টিং শুরু করেছি এবং আমার  ডিজাইন করা শাড়িগুলির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল।  ১৫ বছর ধরে সমানভাবে এটির বজারও ধরে রেখেছিলাম। তারপর আমি ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার জন্য ডিজাইন করা শুরু করি এবং আমি সর্বক্ষণ পেইন্টিং করতে থাকি।" - সরলা ঠাকরল [ 

"I dabbled in designing costume jewellery, which was not only worn by the who's who of that time, but also supplied it to Cottage Emporium for 15 years. After that, I took to block printing and the sarees designed by me were well sought after. This too continued for 15 years. Then I began designing for the National School of Drama and all along I kept painting." - Sarla Thakral ]


পরলোক গমন

১৫ই মার্চ ২০০৮ সালে পরলোক গমন করেন। 


সরলা ঠাকরাল এক আত্মবিশ্বাসী ভারতীয় মহিলার মুখের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি সাহস এবং সংকল্পের এক নতুন হাওয়া বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেয়েদের আকাশ চিনিয়েছিলেন, ওড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এবং তা সত্যি করার সাহস দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের সকলের অনুপ্রেরণা। 


তাঁর জীবনের সহজ উদ্দেশ্য ছিল:

"সর্বদা হাসিখুশি থাকুন। সুখী এবং প্রফুল্ল থাকা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই একটি নীতির জন‍্য আমি সংকটের সময়ও স্থিতিশীল থাকতে পেরেছি।" - সরলা ঠাকরল

 [ "Always be happy. It is very important for us to be happy and cheerful. This one moto has seen me tide over the crisis in my life". - Sarla Thakral ]


তাঁর এই কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় কবির লেখনীতে –

 

"স্বপ্ন দেখো স্বপ্ন আঁকো স্বপ্ন নিয়ে থাকো 

সবার ওপরে স্বপ্নটাকেই যত্ন করে রেখ। 

স্বপ্ন কাঁদায় স্বপ্ন হাসায় স্বপ্ন দেখায় আলো

স্বপ্ন দিয়েই মানুষ দেখে তোমার সকল ভালো। 

স্বপ্নহীন জীবন তোমার বিরান মরুভূমি 

স্বপ্ন দেখা বন্ধ হলে জীবন্মৃত তুমি।"

('স্বপ্ন' লেখক কানাডার সাস্কাচেওয়ান প্রদেশের সাস্কাতুনপ্রবাসী)

 

কলমে - সোমা লাই 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন