স্মৃতিচারণা - কৈশোরে দুর্গাপূজার স্মৃতি

 


 

শিশুকাল যে গ্রামটিতে কেটেছে তার নাম হলো রামনগর। কলকাতা থেকে ১৩৩০ বাংলা সালে প্রকাশিত পাবনা জেলার ইতিহাস গ্রন্থে এই গ্রামটির নাম খুব ভালোভাবে দেখতে পাওয়া যায়। সে হিসেবে অনুমান করতে পারি গ্রামটির বয়স তো ২০০ বছর হবে! গ্রামটির পার্শ্ববর্তী  আরেকটি গ্রামের নাম কৃষ্ণনগর। আরেকটির নাম বৃলাহিরীবাড়ি! নিকট দূরেই রেলস্টেশন, নাম লাহিড়ী মোহনপুর! উইকিপিডিয়া ইংরেজি সূত্রে জানা যায় নামকরা সংগীত ব্যক্তিত্ব বাপ্পি লাহিড়ীর বাবা মাএই "লাহিড়ী মোহন" পরিবারভুক্ত! বাংলাদেশের জনপ্রিয় পত্রিকা যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাপ্পি লাহিড়ী বলতেন "আমি পাবনার সন্তান!" এলাকাটি চলনবিল বিধৌত। 

 

১৯৮৩ সাল, পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। রামনগর থেকে আমরা পার্শ্ববর্তী গ্রামে চলে এলাম। ‌ বাড়ির চতুর্দিকে বন জঙ্গল, পাশে বড়াল নদী! সে কি মনোরম দৃশ্য! স্বপ্নের মতো মনে হয়! এখানে দুটো নতুন অভিজ্ঞতা সম্মুখীন হলাম! প্রথমতঃ রাত-বিরাতে, দিনে নানা বিচিত্র পাখি ডাকেশুনে মাঝে মাঝে ভয় লাগে! দ্বিতীয়তঃ ঢাক-ঢোল বাজার প্রচুর শব্দ শোনা যায়। এই জীবনের প্রথম শারদীয় দুর্গ উৎসবের ঢাকঢোল বাজানোর শব্দের অভিজ্ঞতা সম্মুখীন হলাম। আমরা শিশু মানুষ। মোটামুটি যেকোন বাড়িতে প্রবেশাধিকার আছে। কাছে দাঁড়িয়ে কাকাদের ঢোল বাজাতে দেখতাম। বেশ মনে পড়ে, আমরা হিন্দুদের কাকা এবং মুসলমানদের চাচা বলে ডাকতাম। দুর্গাপূজার প্রতিমা বিসর্জন পর্বটি আমাদের বাড়ি থেকে মোটামুটি ৫-৬ কিলোমিটার দূরে গোপালনগরে হতো। বাল্যকালে আমাদের এতটাই কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকতে হতো যে গ্রামের বাইরে যাওয়ার প্রশ্নই উঠত না। ফলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শিশুকালে কখনো শারদীয় উৎসব দেখার সুযোগ হয়নি।

 

পাবনা জেলার খুবই নামকরা ঐতিহ্যবাহী একটি এলাকার নাম হল হান্ডিয়াল। ‌ স্বনামধন্য চাটমোহর উপজেলার পশ্চাদপদ একটি ইউনিয়ন। আমার নানার বাড়ি। এখনকার     ছেলেমেয়েরা হাসপাতালে জন্ম নিলেও আমারা জন্মগ্রহণ করতাম নানার বাড়িতে! সেই হিসেবে এটি আমার জন্মস্থান। পাবনা জেলার ইতিহাস বইটিতে আরো জানা যায়, এক সময় এই হান্ডিয়ালে সমগ্র ভারতবর্ষের তিন চতুর্থাংশ রেশম ব্যবসা পরিচালিত হতো। বর্ষাকালে আমার মা এবং তার বোনেরা একসঙ্গে বাবার বাড়ি এসে কয়েক সপ্তাহ থাকত। ‌ তখনকার ভাষায় এটাকে "নাইওর" বলা হত ওই যে শচীন দেব বর্মনের গানে আছে আমার ভাইধন রে কইও নাইওর নিতো বইলা...  মার সঙ্গে আমারও থাকার সুযোগ হতো। 

 

হান্ডিয়ালে খুবই জাঁকজমকপূর্ণভাবে দুর্গ পূজার উৎসব হত। স্পষ্ট তো মনে পড়ে জীবনের প্রথম প্রতিমা বিসর্জন উৎসবটি দেখেছিলাম এই হান্ডিয়ালে। তখন ছিল বর্ষাকাল। মা নাইওরে গিয়েছে। হঠাৎ এক বিকেলে লক্ষ্য করলাম বড়রা বেশ সেজেগুজে নৌকা নিয়ে বের হচ্ছে। আমিও যাবার বায়না ধরলাম। বায়না অগ্রাহ্য হলো না, শর্ত হলো নৌকা চুপিচুপি বসে থাকতে হবে, নড়াচড়া করা যাবে না। মেনে নিলাম! এবং শুরু হল জীবনের প্রথম প্রতিমা বিসর্জন দেখার যাত্রা।

 

চতুর্দিকে সেকি সাজসজ্জা! অসংখ্য নৌকা। এমনি তো চলনবিল, (চলনবিল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিল) তারপরে বেশ প্রশস্ত নদী। সমগ্র নদীতে নৌকার বিশাল সমারোহ। অনেক নৌকায় প্রতিমা উঠানো হয়েছে। আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম প্রতিমা থাকা নৌকোগুলোতে অনেকেই নাচছে। ধুপের ধোঁয়া হাতে নিয়ে সেকি নাচ! আমাদের বয়সী শিশুরাও সেখানে নাচছে! আমারও নাচতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে! কিন্তু কঠিন শর্ত নৌকায় কোন নাড়াচাড়া করা যাবে না! শর্ত লজিক্যাল; কারণ নৌকায় এত লোক যে নড়াচড়া করলে ডুবে যেতে পারে!


ছবি সৌজন্যঃ স্নেহলতা রাণী অনিতা 

ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যা এগিয়ে আসছে। ঢাক ঢোল এর শব্দে নাচ মনে হচ্ছে আরো বেড়ে চলছে! হঠাৎ লক্ষ্য করলাম নাচ থেমে গেল! তারপর শুরু হল প্রতিমা বিসর্জন পর্ব। নিজের চোখে জীবনের প্রথম প্রতিমা বিসর্জন দেখলাম! সেই হান্ডিয়াল! শিশুকালে কত আনন্দ মুহূর্ত কেটেছে সেখানে! কত প্রিয়! নানা-নানি বেঁচে নাই। আর সেখানে যাওয়া হয় না! তবে জাদুঘরে রাখার মত সযত্নে রেখে দিয়েছি স্মৃতিগুলো! 

 

বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময়ে আমরা দল বেঁধে শারদীয় উৎসব দেখতে যেতাম। বিনয় এবং অজিত এদের কথা এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। ওরা আমাদের আড্ডার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ ছিল।

 



একবার বর্ষাকালে আমরা নৌকা ভাড়া করলাম শারদীয় প্রতিমা বিসর্জন দেখতে যাব বলে। ‌ এলাকার গোপালনগর গ্রামে সবচাইতে বড় প্রতিমা বিসর্জন অনুষ্ঠিত হত। আধুনিক ভারতীয় বাংলা গানের খুবই প্রভাবশালী গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ১৯২৪ সালে ৫ ডিসেম্বর এই গোপালনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

 

আমাদের নৌকাটিকে বেশ ভিআইপি ভিআইপি মনে হল! কারণ আমরা এই নৌকাটিতে সবাই বাংলাদেশের নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। গান গাচ্ছি, অফুরন্ত খাওয়া দাওয়া চলছে, এবং চলছে নানাবিধ আড্ডা। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ আমাদের এলাকা আরো নদীমাতৃক! এলাকায় চার-পাঁচটি নদী, সঙ্গে চলন বিলের অববাহিকা! বর্ষার পানিতে আমাদের আনন্দ তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়। নৌকা নিয়ে আমরা প্রতিমা বিসর্জনের এই উৎসব দেখছি। সঙ্গে সমবয়সী বন্ধু-বান্ধদের আড্ডা! এখন হাজারবার মাথা ঠুকলেও আনন্দের ওই মুহূর্তগুলো আর ফিরে পাবো না! ঈদের দিন গুলোতেও আমরা এরকম মজা করতাম, ঘুরতাম, সিনেমা দেখতাম! যে যেখানেই থাকি আড্ডা দিতে আমরা শঙ্করের দোকানে হাজির হতাম! শঙ্করের দোকান ছিল আমাদের হাব! কে কোথায় আছি, কার কি সমস্যা, কে আড্ডাতে এসেছে, কে আসবে না, এ সকল তথ্য শঙ্করের দোকানে মিলতো! তখন তো ফেসবুক বা ফোন ছিল না যে এক স্ট্যাটাসেই সব পেয়ে যাব! চা খেতে ৬ কাপ চা ১০ কিংবা ১২ কাপে দিতে কত যে বলেছি! আহা দিনগুলো! 

 

প্রায় দুই যুগ হল এলাকাতে আর সেভাবে যাওয়া হয় না। ঘরমুখো বাঙালির ট্রেনের ছাদে উঠে ঈদে ঘরে ফেরা ছবি আপনার অনেকেই দেখেছেন। এবার ঈদে বাড়ি গিয়েছিলাম তাও পাঁচটি ঈদ পর। ‌ সেই শঙ্করের চায়ের দোকান, সেই হান্ডিয়াল, সেই গোপালনগর এর প্রতিমা বিসর্জনের নৌকা ভ্রমণ আজ পরম স্মৃতি!

 

কলমে - হাদী উল ইসলাম


ছবি সৌজন্য – আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন