অন্যদিন একটু দেরি হয়। আজ একটু সকাল সকালই শুরু হয়ে গেল। কি শুরু হয়ে গেল? না, তেমন কিছু না। মার চিৎকার।
"হতচ্ছাড়া, পাজি, নচ্ছার ছেলে, আজ যদি তোর চৌদ্দ
দুগুনে পঁচিশ, আরে যন্ত্রনা, আটাশ পুরুষের বংশ আমি উচ্ছেদ না করি তবে..."
চোখ মুছতে মুছতে বাইরে এসে বললাম, “মা, সকাল সকাল কী
শুরু করলে? হয়েছেটা কি?’’
এই সেরেছে! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে না, নুন, মরিচ,
গোলমরিচ সবকিছুর ছিটে পড়ল যেন। মা গলার স্বর ভীষণ করে বলল, "তুমি হচ্ছ আরেক
গুণধর। এত সব হয়ে গেল এখন এসেছ কি হয়েছে তা জানতে? বেরোও সামনে থেকে।"
ধমক খেয়ে চোখ থেকে ঘুম-টুম সব চলে গেল। খুব ভদ্র মেয়ের
মত বললাম, "মা, এতো চিৎকার করলে তোমার ভোকাল কর্ড ছিড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা
আছে। তোমার গলার স্বর হচ্ছে জাতীয় সম্পদ । আর তোমাকে তো অনেক দূর যেতে হবে। আজই
যদি সব এনার্জি শেষ করে ফেল, তবে কাল কিভাবে চিৎকার করবে?”
মা এবার সপ্তমে, অষ্টমে না গিয়ে গলার স্বর একেবারে দশমে
চড়িয়ে বলল,“যা দূর হ এখান থেকে এক্ষুনি! কোত্থেকে যে এসব ছেলেপুলে এসে জুটেছে
আমার কপালে।”
''এই রে!'' অবস্থা বেগতিক বুঝে আমি মানে মানে সরে পড়লাম
উত্তপ্ত ঘটনাস্থল থেকে।
যাই হোক, সকালবেলা এসব ধমক খেয়ে যদিও মনে হচ্ছিল নাস্তা
খাওয়ার দরকার হবে না তবু খাবার টেবিলে বসতেই দেখি খাবার আছে।
কিন্তু অবাক কাণ্ড! একটাও চামচ নেই।
সেই সময় আবারও ঝঞ্ঝার মত মার আবির্ভাব। এসেই মার লেকচার
একদম স্পোর্টস কারের বেগে চলতে থাকল, "আল্লাহপাক জানেন কবে এই ছেলের মাথা
থেকে উল্টাপাল্টা কাজের ভূত নামবে। আমার হাড়মাংস ভাজা ভাজা করে ফেললো এই অপদার্থ।
সে নাকি তার বন্ধুদের নিয়ে গানের দল খুলবে। আরে খোল না। আমি কি তোকে বারণ করেছি?
ঘরে গিটার, তবলা আছে সেগুলো নিয়ে গানের দল কর। তুই আমার রান্নাঘরে চড়াও হোস কেন?
হ্যাঁ, এটাই তো তোমার ভাইয়ের দোষ, সে নাকি ব্যতিক্রমধর্মী গানের দল খুলবে। আর
সেই গানের ইন্সট্রুমেন্ট হবে খুন্তি,
চামচ, হাঁড়ি, কড়াই, পাতিল এইসব। এইসব দিয়ে আহাম্মকগুলো সুর তুলবে।"
এতক্ষণ মার কথার দিকে তেমন পাত্তা না দিয়ে আমি খাবারের
দিকেই মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছিলাম তাড়াতাড়ি। সাড়ে ন'টায় ভোম্বল স্যারের
ক্লাস। ওনার ক্লাসে একটু দেরি করে গেলেই হাসিমুখে বাঁশ দিয়ে ক্লাসশুদ্ধ পাবলিকের
সামনে মান ইজ্জত সব শেষ করে দেন।
কিন্তু শেষ দিকে মার কথা শুনে আমি একদম যাকে বলে কিনা
বাকরুদ্ধ, তাই হয়ে গেলাম। অপুর এই সব কীর্তি কাহিনী আবার শুরু হয়েছে তাহলে।
বিকেলবেলা বাসায় ফিরলে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন হল
প্র্যাকটিস?”
বিমর্ষ মুখে অপু বলল, “ধুর ছাই, কেউ তো ওসব দিয়ে
বাজাতেই পারল না। গিটার বাজানো এর চেয়ে হাজারগুণ সোজা। নাহ, এবারের
ব্যতিক্রমধর্মী আইডিয়াটাও মনে হচ্ছে মাঠে মারা গেল।”
আমার বেশ মায়াই হচ্ছিল ওর জন্য, "তা এসব নিয়ে তোর
সুর তোলারই বা দরকার কি? আরো অনেক কিছুই তো রয়েছে।"
অপু এবার বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠল, ''আপু তুমি কিছুই বোঝ না, এসব
দিয়ে কি স্টেজে উঠতাম নাকি? শুধু একটু ব্যতিক্রমী কিছু করার জন্যই তো!" বলে
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘরের দিকে রওনা হল।
অপু ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম। যাকে বলে কিনা
ব্যতিক্রমধর্মী আর কি। ওর বয়সের বাচ্চাগুলো যখন বাবলগাম ভেবে টিকটিকির ডিম খেতে
ব্যস্ত, অপু তখন বাগানের সমস্ত গাছের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাটি দিয়ে দেওয়াল আর
বাসার অন্য জায়গায় লাগানোর প্রজেক্ট নিয়েছিল। ওর বিশ্বাস ছিল ওখান থেকে সব জায়গায়
গাছ গজাবে। তখন থেকেই সবসময় আজগুবি কিছু না কিছুতে চরম নিষ্ঠার সাথে মনোনিবেশ
করতে দেখা যেত ওনাকে। তবে সেই উদ্ভট কার্যকলাপ শুরু করতেই বেশিরভাগ সময় মা এসে ওর
সৃজনশীল (!) কাজে বাগড়া দিত, আর কিছু উত্তম মধ্যম পড়ত পিঠে।
এতো গেল একদম ছোটবেলার কথা। বড় হওয়ার পরেও কিন্তু থেমে
থাকেনি সে। যেমন, একবার সে আর তার চেলারা (ওর চেলাগুলো ওর বন্ধু নামে পরিচিত, আসলে
নামেই বন্ধু। সবগুলো অপুর কথায় ওঠে বসে) চিন্তা করল, তারা আসলে বেশি ভাল ছেলে
হয়ে যাচ্ছে। এজন্য বড়রা তাদের ওপর বেশি সুযোগ নিয়ে নিচ্ছে। তখন সিদ্ধান্ত হল,
সবাইকে বুঝাতে হবে তারা ঠিক সুবিধার মানুষ না, তাদেরকে ঘাঁটাতে আসলে সমস্যা আছে।
এই প্রজেক্টের প্রথম কার্যক্রম ছিল বড়োদের মুখের ওপর কথা বলা। একদিন সে মোটামুটি
সন্ধ্যা পার করে বাসায় ফিরল। মা চরম রেগে ছিল এমনিতেই, "কি করিস বাইরে
এতোক্ষণ! যত বড় হচ্ছিস ততই পাখনা গজাচ্ছে নাকি তোর পিঠে?"
এ কথা শুনে অপুর চটপট রেডিমেড উত্তর, "বাইরে থাকার জন্য পাখনা গজানো লাগে না মা, হাত-পা থাকলেই হয়।"
"কি বললি? রাত করে বাড়ি এসে আবার মুখের ওপর
তর্ক!" বলেই মার মোক্ষম এক চপেটাঘাত এসে পড়ল অপুর গালে। ব্যস, আর কথা নেই।
অপু বোধ হয় চিন্তা করেছিল, তার দাঁতের জীবনের ঝুঁকি আছে এই কার্যক্রমে। তাই এটা
স্থগিত করা হল।
খুন্তি, চামচ প্রজেক্টের পর অপুর সর্বশেষ ব্যতিক্রমধর্মী
প্রজেক্ট ছিল পা উপরে আর মাথা নিচে দিয়ে হাঁটা। একদিন কলেজ থেকে ফিরে দেখি, সে
মাথা নিচে দিয়ে আর পা উপরে তুলে আছে। পা উপরে তুলেও সে থেমে নেই, মাটিতে রাখা দুই
হাত দিয়ে আবার হাঁটার চেষ্টা করছে। অনেক চেষ্টার পর সে পা দু'টো উপরে তুলেছে ঠিকই
কিন্তু ব্যালেন্স রাখতে সমস্যা হচ্ছে। অপুকে উৎসাহ দিয়ে বললাম, "পারবি,
পারবি ।চেষ্টা কর, তাহলেই হয়ে যাবে।”
কিছুদিন পর আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সে সত্যি সত্যি দুই
পা উপরে তুলে হাঁটার প্র্যাকটিসটা ভালোভাবেই করছে। আর মা তো সারাদিন এ কারণে কানে
মধুবর্ষণ করতে লাগল। “এমন বলদ ছেলেও হয়। পা উপরে মাথা নিচে দিয়ে হাঁটা শিখতে
চায়। আরে আহাম্মক, আল্লাহ যদি চাইতেন মানুষ পা উপরে আর মাথা নিচে দিয়ে হাঁটবে,
তবে তো তিনি সেভাবেই সৃষ্টি করতেন আমাদের।"
অপু আবার না জানি কোনদিন রাস্তায় এভাবে হাঁটাহাটি শুরু
করে দেয় এটা নিয়ে মার খুবই দুশ্চিন্তা ছিল। আর কিছুদিনের মধ্যে সে বোধহয় এই
চিন্তাভাবনাও করতে শুরু করত। কিন্তু তার সব ব্যতিক্রমধর্মী প্রজেক্টে যা হয়,
এবারেও তার ব্যতিক্রম হলো না।বাড়াবাড়ি করতে গিয়েছিল সে একদিন। বেশি আত্মবিশ্বাসী
হয়ে মাথা নিচে আর পা উপরে রাখা অবস্থায় পিছনদিকে হাঁটা শুরু করেছিল। কিন্তু
দুর্ভাগ্য মাথা নিচে থাকায় সে আর পিছনের স্ট্যান্ডিং ফ্যানটা দেখতে পায়নি। তারপর
যা হবার তাই হল। নিষ্ঠুর নির্মম ফ্যানটা আমার ভাইয়ের ওপর বিনা দ্বিধায় পড়ে গেল।
দু'জনের (অপু আর ফ্যানের) চিৎকার সেদিন মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। দু'হাতে ভর
দিয়ে হাঁটার এখানেই সমাপ্তি।
মা খুব কড়া ভাষায় ঘোষণা করেছিল, “আর যদি কখনও এরকম
বাদুড়ের মত হাঁটতে দেখি তাহলে ফ্যানের সাথে তোকেও উল্টো করে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখব।”
অপু এটা শুনে একটু উৎসাহিত হয়ে বলেছিল, ‘’মা বাদুড়রা
কি এভাবে হাঁটে?"
"আবার কথা? একদম চোপ।” মার ধমক খেয়ে আপাতত চুপচাপই
আছে অপু। তবে আজকাল ওকে খুব চিন্তিত দেখা যায়। নতুন কোন ব্যতিক্রমধর্মী
প্রজেক্টের চিন্তায়ই হয়তো, কে জানে!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন