একবছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে দুর্গাপুজো আসন্ন। নীল আকাশে সাদা মেঘ, সোনা রোদে মৃদু হাওয়ায় কাশফুলের দোলা, ঢাকের বাদ্যি সবকিছুই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে দুর্গাপুজোর সঙ্গে। আর পেটপুজো? তার কথা ভুললে চলবে কেন! ভোজনরসিক বাঙালি শুধু সুযোগ খোঁজে একটু ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য। সেখানে মহোৎসবের দিনগুলোয় পেটপুজো হবে না তাও কি হয়! সোনামুগ ডাল, সঙ্গে একটু ভাজাভুজি, মাছের কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারি আর শেষপাতে চাটনি কিম্বা মিষ্টি দই; কোনোদিন আবার গরম গরম ফুলকো লুচির সঙ্গে আলুরদম আর পনীরের তরকারি, সঙ্গে রসগোল্লা, সন্দেশ; কখনও বা পরোটার সাথে কষা মাংস – পুজোর ক'দিন খাওয়ার উপর খাওয়া চলতে থাকে। আর বাইরে তো বিরিয়ানি, রোল, চাউমিন, পিৎজা, আইস্ক্রিম লেগেই রয়েছে। কিন্তু এসবের বাইরে পুজোর খাওয়া প্রসঙ্গে আসা যাক অন্যরকমের কিছু গল্পে। সেইসব গল্প বনেদী বাড়ির পুজোকে কেন্দ্র করে। বনেদী বাড়ির পুজোর আয়োজন ও জাঁকজমক স্বাভাবিকভাবেই মণ্ডপের পুজোর তুলনায় অনেকাংশে আলাদা হয়। আলাদা হয় পুজোর নৈবেদ্য প্রস্তুতিও। সব অভিজাত বাড়ির পুজো আবার একরকমের হয় না। একেক বাড়িতে রয়েছে একেকরকম ভোগ নিবেদনের পালা। নৈবেদ্য থেকে শুরু করে বাড়ির রান্নাতেও ধরা পড়ে বৈচিত্র্যের সমাহার।
বনেদী বাড়ি বলতে প্রথমেই মনে আসে শোভাবাজার রাজবাড়ির কথা।
আজও এই বাড়ির পুজো দেখতে বহু দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। এখানে মা দুর্গাকে নৈবেদ্য
হিসাবে অন্নভোগ দেওয়ার রীতি নেই। বংশানুক্রমিকভাবে ব্রাহ্মণ রাঁধুনিরা তৈরি করে
থাকেন বিশালাকার সব মিষ্টি। পাঁচ সাতখানা লাড্ডু একসাথে মেশালে যেমন হয় তেমন
সাইজের মন্ডা, থালার সাইজের জিলিপি, বিরাট বিরাট মিঠেগজা, চৌকোগজা,
ধবধবে সাদা
মোতিচুর ইত্যাদি নানারকম দুর্লভ মিষ্টি ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় ঐতিহ্যমন্ডিত এই
রাজবাড়ির পুজোয়। রাধাবল্লভীর সাইজও নজরকাড়া। নৈবেদ্য ছাড়াও শোভাবাজার রাজবাড়ির
রান্নায় থাকে বিশেষ বিশেষ কিছু পদ। ষষ্ঠীর দিন লুচির সঙ্গে শোভা পায় স্পেশ্যাল
আলুরদম। এই আলুরদম কিন্তু যে সে আলুরদম নহে বৎস! এর মধ্যে পড়ে বিশেষ এক মশলা যা
তৈরি হয় শুকনো লঙ্কা, গোটা সাদা জিরে, গোটা ধনে, গরমমশলা,
দারচিনি, লবঙ্গ, ছোট এলাচ সহযোগে। এই উপকরণগুলি আগে শুকনো
খোলায় ভেজে গুঁড়িয়ে নিতে হবে। তারপর এই মশলা আলুরদমে মিশিয়ে দেওয়ার পর ছড়িয়ে দিতে
হবে আমচুর।
ব্যস, অমনি জিভে জল এসে গেল! তা পুজোর সময়
একদিন শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোটা দেখে এলেই তো হয়! যদি এই ফাঁকতালে একটু
স্পেশ্যাল আলুরদম চেখে দেখার সুযোগ মেলে! তারপর স্বাদ বুঝে নিজেরাই বাড়িতে
বানিয়ে ফেললে কেল্লা ফতে! তবে শুধুমাত্র খাওয়াদাওয়ার বিশেষত্বই নয়, এককালে এই বাড়ির পুজো ছিল সুতানুটির অন্যতম বৃহত্তম পুজো। ১৭৫৭ সালে দেব
পরিবারের নবকৃষ্ণ দেব গোবিন্দপুর ছেড়ে সুতানুটি প্রাসাদ গড়ে তোলেন। যেখানে আজও
পুজোর দালানে পূজিতা হন দশভূজা। খাওয়াদাওয়ায় ব্যতিক্রমী রীতির চমক তখন থেকেই।
শোনা যায়, এই বাড়িতে বিশেষ অভ্যাগতদের জন্য থাকত
টিপসি পুডিং নামের এক মিষ্টি পদ। সেই সময়ে অভ্যাগতদের তালিকায় থাকত ব্রিটিশরাও।
ইংরেজ সরকারের অতিথিদের নাকি বড়ই প্রিয় ছিল এই পুডিং। কেক ও পুডিংয়ের সমন্বয়ে এই
পদ তৈরিতে ব্যবহার হত ব্র্যান্ডি কিংবা রাম। সেই কারণেই হয়তো এই মিষ্টি খেলে
হালকা ঝিম ধরত। এছাড়াও এখানকার আরেকটি প্রিয় পদ নবাবি রুই কোপ্তা কারি। মাছের এই
পদ আলাদা কীসে? কীসে আবার! মাছের কাঁটা বেছে খাওয়ার
ঝামেলা নেই। রুই মাছ নুন হলুদ মাখিয়ে আগে থেকেই কাঁটা বেছে রাখা হত। তারপর কোপ্তার
আকারে গড়ে গ্রেভি সহ পরিবেশন করা হত। বর্তমানে রাজপরিবারের বউ নন্দিনী দেববউরানি
নবমীর দুপুরে পােলাওয়ের সঙ্গে ভেটকি মাছের দুর্দান্ত একখানি পদ রাঁধেন। নাম
ভেটকির কোর্মা। বলে দিলেন রন্ধনপ্রণালীও।
উপকরণ:
- ঘি - ৩ টেবলচামচ
- টক দই - ৬ টেবলচামচ
- পেঁয়াজবাটা - ৩ টেবলচামচ
- আদাবাটা - ১ টেবলচামচ
- রসুনবাটা - ১ টেবলচামচ
- লঙ্কা গুঁড়াে - দেড় টেবলচামচ
- হলুদ গুঁড়াে - ১ টেবলচামচ
- টোম্যাটো পিউরি - ৩ টেবলচামচ
- জয়িত্রী গুঁড়াে - ২ চিমটে
- কুচিয়ে ভাজা পেঁয়াজ - ২টি
- নুন ও চিনি স্বাদমতো
প্রণালী:
তবে পেঁয়াজ রসুন ছাড়া রান্না কিন্তু নেহাত পানসে হয় না। শোভাবাজার রাজবাড়ির স্পেশ্যাল আলুরদমের কথাই ধরা যাক। ওদিকে নিরামিষ আলুরদমে যেমন কেল্লা ফতে করেছে শোভাবাজার, ঠিক তেমনই বিনা পেঁয়াজ রসুনে চিংড়ির মালাইকারি করে মধ্যাহ্নভোজ মাতিয়ে দেয় সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা। প্রণালীটা চুপিচুপি সংক্ষেপে বলে দিই। প্রথমে তেল আর ঘি মিশিয়ে কড়াইতে দিতে হবে। তার মধ্যে গরমমশলা, নুন ও আদাবাটা দিয়ে কষানোর পর হলুদ আর লঙ্কা গুঁড়ো জলে গুলে ওর ভেতর ঢেলে দিতে হবে। এবার যোগ করতে হবে চিংড়িমাছগুলো, যেগুলো আগে থেকে নুন হলুদ মাখিয়ে রাখা আছে। এর মধ্যে কাজুবাদাম বাটা, চিনি আর নারকেলের দুধ দিয়ে দশ মিনিট ভাপালেই রান্না তৈরি।
সাবর্ণদের মতো প্রাচীন না হলেও জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়ির পুজোও বেশ পুরাতন এবং স্বনামধন্য। ১৮৪০ সালে গোকুলচন্দ্র দাঁ শিবকৃষ্ণ দাঁ-কে দত্তক নেন। সেই বছরই মহা ধূমধাম করে তিনি শুরু করেন দুর্গাপুজো। বৈষ্ণব মতে দেবী এখানে পূজিতা হন কন্যারূপে। নৈবেদ্য স্বরূপ দেওয়া হয় ঘরে তৈরি মিষ্টি, চাল ও লুচি। এছাড়া অন্য কোনোপ্রকার রান্না ভোগ নিবেদন করার প্রচলন নেই। কথিত আছে মা দুর্গা এখানে গয়না পরতে আসেন। দাঁ বাড়ির পুজোর অন্যতম বিশেষত্ব হলো, সন্ধিপুজো শুরু হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে এখানে কামান চালানো হয় এবং তারপর সন্ধিপুজো শুরু হয়। সেই সময়ে দুর্গাপুজোতে কীরকম জাঁকজমক আর খরচ হত, ‘হুতুম প্যাঁচার নকশা’, ‘কলকাতার বারোয়ারী পূজা’ সহ বেশ কিছু বইতে তার বর্ণনা দিয়েছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ।
জোড়াসাঁকোর প্রসঙ্গ উঠলে ঠাকুরবাড়ির কথা না বললেই নয়। তখন ১৭৮৪ সাল। নীলমণি ঠাকুরের উদ্যোগে ঠাকুরবাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয়। নীলমণি ঠাকুরের পরে তাঁর পৌত্র প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো আলাদা মাত্রা পায়। প্রিন্স দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী। কথিত আছে তাঁর আমলে ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপ্রতিমার মুখাবয়ব দিগম্বরী দেবীর মুখের আদলে তৈরি করা হতো। পুজোর দিনগুলিতে মূর্তিকে দু’বেলা বেনারসী শাড়ি বদল করে পরানো হতো, আবার কখনও পরানো হতো মূল্যবান তসর কিংবা গরদের শাড়ি। প্রচুর সোনার গহনা, মাথায় সোনার মুকুট, কোমরে চন্দ্রহার ইত্যাদি সহযোগে শোভা পেতো ঠাকুরবাড়ির মা দুর্গা। সেকালে জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়ির পুজোর সঙ্গে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পুজোর রেষারেষি লেগে থাকতো। এমনকি দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের সময় দাঁ বাড়ির দুর্গাপ্রতিমাকে ঠাকুরবাড়ির সামনে দিয়ে বেশ কয়েকবার ঘুরিয়ে এনে তারপর বিসর্জন করা হতো। দাঁ বাড়িতে মা দুর্গা সেজে উঠতো দেশবিদেশের নকশার সোনার গহনায়। একবার দ্বারকানাথ ঠাকুর সিদ্ধান্ত নিলেন, দশমীর দিন প্রতিমাকে তার অঙ্গের গহনা সমেত বিসর্জন করা হবে এবং সেটি করাও হয়েছিল। এই ঘটনা সেসময় কলকাতায় প্রতিটি ঘরে লোকের মুখে মুখে ঘুরে ফিরেছিল।
শুধু পুজোর আড়ম্বর বা প্রতিমাসজ্জাই নয়, ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোর ভোগও ছিল বলার মতো। দু’বেলা অন্ন থেকে মিষ্টান্ন সব
মিলিয়ে একান্ন রকমের পদ মা দুর্গার ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হত। সঙ্গে থাকত নানারকমের
ফল, ডাবের জল ইত্যাদি। সেগুলো পরে ঠাকুরবাড়ির
পুজোর দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করা হতো। শেষপর্যন্ত দেবেন্দ্রনাথ
ঠাকুরের সময় থেকে প্রায় সকলেই ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে প্রাচীন
ঐতিহ্যসম্পন্ন এই দুর্গাপুজো বন্ধ হয়ে যায়।
লাহা পরিবার উত্তর কলকাতার অন্যতম অভিজাত পরিবার। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির নিকটে লাহা বাড়ির পুজো ১৭৫ বছরের পুরোনো। কথিত আছে, এই পরিবারের নবকৃষ্ণ লাহার স্ত্রী দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশ পান। তারপরই লাহা পরিবারে দুর্গাপুজোর পত্তন। এখন একবছর পুজো হয় ঠনঠনিয়ার লাহা বাড়িতে, পরেরবার কৈলাস বোস স্ট্রিটের লাহা বাড়িতে পুজো হয়। এই বাড়ির বিখ্যাত রান্নাগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য সুজির নাড়ু ও শিঙি মরিচ। সুজির নাড়ু প্রচলিত মিষ্টি হলেও লাহা বাড়ির নাড়ুর আলাদাই খ্যাতি। এছাড়া আমিষ পদের মধ্যে শিঙি মরিচ বেশ অন্যরকম খেতে। এহেন সম্ভ্রান্ত বাড়ির পুজোয় মাকে ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় ছয় রকমের নাড়ু। সুজির নাড়ু থেকে শুরু করে তিলের নাড়ু, ছোলার নাড়ু, চাল নারকোলের নাড়ু, আরও নানারকম। এছাড়া মোয়া, গজা, লুচি, কচুরি, নিমকি, ফুলুরি, বেগুনী ইত্যাদিও ভোগে দেওয়া হয়।
দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়িতে মা দুর্গার নৈবেদ্যর বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মতো। এখানকার পুজোয় কোনও রান্না করা ভোগ হয় না। বিশেষভাবে মাখনের নৈবেদ্য মাকে নিবেদন করা হয়। ভোগের অন্যান্য পদের মধ্যে বিশেষভাবে স্থান অধিকার করে রেখেছে আচার ও বড়ি। বাড়ির মেয়েরা ভোগের জন্য তৈরি করে রাখে কুলের আচার। আমের সময় কাঁচা আম রোদে জাড়িয়ে তৈরি হয় আমের আচার। বাজারে পালংশাক উঠলে সেই শাক কুচিয়ে ডালবাটার সাথে মিশিয়ে বড়ি তৈরি করা হয়। পুজোর ভোগে থাকে পোস্তর বড়ি, ধনেপাতার বড়ি, বাদামের বড়ি, আলুবোখরার আচার ও তেঁতুলের আচার।
উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ির মধ্যে মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের চট্টোপাধ্যায় পরিবার অন্যতম। জমিদার রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একসময় ইংরেজ সরকারের খুব কাছের লোক ছিলেন। তাঁর বাড়ির পুজো ছিল সে যুগে শহরে প্রসিদ্ধ। এই বাড়িতে পুজোর ভোগের ক্ষেত্রে একখানি বিশেষত্ব রয়েছে। পুজোর কাজে বাড়ির মহিলারা নিয়োজিত থাকলেও দেবীর ভোগ রান্নার দায়িত্ব শুধুমাত্র ছেলেদের। কাঁচা তেঁতুলের চাটনি এই বাড়ির পুজোর খাবারের সেরা আকর্ষণ। কাঁচা তেঁতুল কিন্তু কেটে নইলে চলবে না, হাত দিয়ে ফাটিয়ে রান্না করতে হবে। এই চাটনিতে যোগ করা হয় সরষে বাটা।
আরেক অভিজাত পরিবার, বিধান সরণির চন্দ্রবাড়ির ভোগ আর নৈবেদ্য দু'ক্ষেত্রেই রীতিমতো এলাহী ব্যাপার। প্রতিবছর নিয়ম করে পুজোর সময় এখানে ভিয়েন বসে। প্রতিদিন মা দুর্গাকে ১৭টি থালায় চাল, কলা ও মিষ্টি দিয়ে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। ভোগের মধ্যে থাকে লুচি, আলুভাজা, নারকেল নাড়ু, রসবড়া, চন্দ্রপুলি ইত্যাদি। দশমীর দিন মাছ রান্না করে খাওয়ার নিয়ম রয়েছে।
অপরদিকে হাটখোলার দত্তবাড়ির নৈবেদ্য প্রস্তুতিতে চিনি বেটে তারপর রান্নায় দেওয়া হয়। ঘিয়ে ভাজা লুচি আর বাটা চিনি এই বাড়ির বিশেষ ভোগ। এদিকে যুগ যুগ ধরে হালদারবাড়ি মেনে আসছে ‘পাঁচ পো’ প্রথা। এর মানে হল এখানে চাল, ডাল, দুধ, নুন, তেল সব কিছুই থাকবে পাঁচ পো। যদি একচুলও কম বা বেশি হয় তাহলে সেই ভোগ আর দেবীকে নিবেদন করা যায় না। নেতাজী সুভাষ রোডের হালদার বাড়ির পুজো প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর ধরে চলে আসছে। এখানে সপ্তমী থেকে দশমী অবধি ভোগের আয়োজনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে থাকে সাদা ভাত, ডাল, তরকারি, এঁচোড়ের ডালনা, পাঁচ রকমের ভাজা ও পোলাও। অষ্টমীতে ভোগের পাতে অবশ্যই থাকে গর্ভমোচার তরকারি। ভোগ রান্না করেন বাড়ির দীক্ষিত মহিলারা।
রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। ইতিহাসের পাতায় রাজা কংসনারায়ণের পুজোই এখনও পর্যন্ত বঙ্গদেশের সবথেকে পুরোনো পুজো বলে মনে করা হয়। এখানে বোধনের দিন থেকে অষ্টমী পর্যন্ত দেবীকে নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হয়ে থাকে। খিচুড়ির সঙ্গে থাকে তরকারির বিভিন্ন পদ ও নানারকমের মিষ্টি। নবমীতে থাকে বোয়াল মাছ এবং দশমীতে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচু শাক।
পাথুরিয়াঘাটার ঘোষবাড়িতে আবার কোনও অন্নভোগ দেওয়া হয় না মা দুর্গাকে। তার পরিবর্তে থাকে নানারকমের মিষ্টি যেমন চন্দ্রপুলি, পেস্তার বরফি ইত্যাদি। সঙ্গে তামার থালায় দেওয়া হয় পাঁচকলাই, আদা কুচি আর সৈন্ধব নুন। অষ্টমীতে মাকে সিঙারা, নিমকি দিয়ে ভোজ দেওয়া হয়৷ শীতলভোগে মা খান লুচি এবং চন্দনী ক্ষীর। এই চন্দনী ক্ষীর সকলের থেকে আলাদা, বিশেষভাবে বানানো হয়ে থাকে। খাঁটি চন্দন কাঠের গুঁড়ো দিয়ে বানানো চন্দনী ক্ষীর মাকে নিবেদন করা হয়।
নৈবেদ্যর দিক থেকে শীলবাড়ির পুজো মনে রাখার মত। এখানে ২৮ কেজির নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এতে থাকে ২৮টি পাত্রে এক মণ করে চাল, কলা ও মিষ্টি। ঘোষবাড়ির মতো শীলবাড়িতেও কোনও অন্নভোগ হয় না। তার পরিবর্তে মাকে লুচিভোগ দেওয়া হয়। পঞ্চমীর দিন এখানে ভিয়েন বসিয়ে প্রস্তুত করা হয় কচুরি, শিঙাড়া, নিমকি, লেডিকেনি, মালপোয়া, গজা, নারকেল নাড়ু ইত্যাদি।
পুজোর ইতিহাসের সঙ্গে নানান কাহিনীতে সমৃদ্ধ হয়ে রয়েছে বেহালার সোনার দুর্গা বাড়ির মুখোপাধ্যায় পরিবারের ২৫০ বছরের পুজো। এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্বর্গীয় জগৎরাম মুখোপাধ্যায়। তাঁর হাতেই এই পরিবারে সূচনা হয়েছিল দেবীর আরাধনা। তবে তার পিছনে রয়েছে এক অবহেলার ইতিহাস। জগৎরাম মুখোপাধ্যায়ের চারটি ছেলে এবং তিনটি মেয়ে ছিল। বড় মেয়ে জগত্তারিণী পুজো উপলক্ষ্যে মামারবাড়িতে গিয়ে মায়ের প্রসাদ না পেয়ে অবহেলিত হয়ে বাবার কাছে ফিরে আসে। মেয়ের কষ্ট দেখে তৎক্ষণাৎ ঘটে মায়ের পুজো শুরু করেন জগৎরাম বাবু। সেদিন ছিল অষ্টমী, অথচ বাড়িতে ভোগ নিবেদনের জন্য সেভাবে কিছুই ছিল না। ঘরে থাকা সামান্য বিউলির ডাল দিয়ে বানানো হয় খিচুড়ি। সেই খিচুড়ি ভোগ দেবীকে উৎসর্গ করেন এবং পরে মেয়েকে প্রসাদ রূপে দেন। সেই বিউলির ডালের খিচুড়ি ভোগ মা দুর্গাকে নৈবেদ্য হিসাবে দেওয়ার রীতি এখনও চলে আসছে।
এছাড়াও মায়ের জন্য বিশেষ আমিষ ভোগের আয়োজন করা হয়ে
থাকে। এর মধ্যে থাকে সাতটি ভোগ যার মধ্যে একটি থাকে মায়ের জন্য মাছ ভোগ। বাকি
ছয়টি হয় নিরামিষ। এগুলি উৎসর্গ করা হয় ভগবান শিব,
গণেশ, সিংহ, অসুর,
লক্ষ্মী এবং
নারায়ণের উদ্দেশ্যে। তবে এইসময় বিউলির ডালের খিচুড়ি ভোগের সাথে অবশ্যই রাখতে
হয় মায়ের জন্য মাছ ভোগ। কোন কারণে মাছ না পাওয়া গেলে বেগুন পোড়ার ব্যবস্থা
করতে হয়। সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী এই তিনদিনে ভোগে রাখা
হয় খিচুড়ি, সাত রকম ভাজা, তরকারি, পায়েস ও চাটনি। এর সাথেই বিশেষভাবে থাকে
পোড়া শোল মাছ। তবে এই শোল মাছ শুধুমাত্র মা দুর্গা,
মা চন্ডী এবং
কুলদেবতার জন্য। দালানে মায়ের সামনে বড় বারকোশে সাজানো হয় নৈবেদ্য, তার সাথেই দেওয়া হয় সাদা ভোগ। এছাড়াও থাকে দন্ড ভোগ, এক্ষেত্রে বিভিন্ন থালা বাটি সাজিয়ে দেওয়া হয় ফল ভোগ। দশমীর দিন বিশেষভাবে
মাকে নৈবেদ্য দেওয়া হয় পান্তা ভাত। তার সাথেই থাকে চালতা দিয়ে অড়হড়ের ডাল আর
কচু শাকের ঘন্ট। থাকে কতবেলও।
বনেদী বাড়ি কি শুধু কলকাতাতেই রয়েছে! কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ীর কথা কে না জানে! এখানকার দুর্গাপুজোর মাধুর্যই আলাদা। অনেক আগে থেকে পুজো হয়ে এলেও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই জনসাধারণের মধ্যে প্রথম দুর্গাপুজো প্রচলন করেছিলেন যা পরবর্তীকালে সার্বজনীন রূপ পায়। রাজবাড়ীর ভোগের বৈচিত্র্যও কম নয়। ষষ্ঠীর দিন খিচুড়ির সঙ্গে থাকে নানারকমের ভাজা, তরকারি, চাটনি এবং সুজির পায়েস। সপ্তমীতে এর সাথে সাত রকমের ভাজা থাকে। অষ্টমীতে হয় পোলাও, ভাত, ছানার ডালনা, আট রকমের ভাজা ও ক্ষীর। নবমীর দিন থাকে ভাত, নয় রকম ভাজা, তিন রকম মাছ ও আরো অনেক কিছু। দশমীতে শীতল ভোগে লুচি, তরকারি, ভাজা ও সুজি নিবেদন করা হয়। তবে কৃষ্ণনগরের পুজো দেখতে গিয়ে এখানকার বিখ্যাত সরপুরিয়া না চেখে ফেরত চলে এলে পরে কিন্তু আফসোস হবে এই আমি বলে রাখলাম।
কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ী ছাড়াও বীরভূমের সুরুলের সরকার জমিদার বাড়ীর দুর্গা মন্দিরের পুজোকে অন্যতম সম্ভ্রান্ত পরিবারের পুজো হিসাবে গণ্য করা হয়। ২৮৭ বছর পেরিয়ে এই পুজোয় আভিজাত্যের ছাপ এখনও স্পষ্ট। দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকদের সমাগম ঘটে। এমনকি জমিদার বাড়ীর বাইরে মেলাও বসে, দিব্যি হয় বিকিকিনি। প্রথা অনুযায়ী এখানে তিনদিন বলি হয়। সপ্তমীর দিন ছাগ বলি, অষ্টমীতে আখ এবং নবমীর দিন চালকুমড়ো বলি। এই পুজোয় কোনো অন্নভোগ হয় না। কাছারী বাড়ীতে ভিয়েন বসিয়ে প্রস্তুত করা হয় নানারকমের মিষ্টি। দশজন কারিগর এই কাজে নিযুক্ত থাকেন। মাকে নৈবেদ্য হিসাবে দেওয়া হয় গাওয়া ঘিয়ের লুচি, সুজি ও ছানা। সরকার জমিদার বাড়ীর ২০০টি পরিবারের প্রায় এক হাজারের বেশি সদস্য দেশবিদেশে ছড়িয়ে রয়েছেন যাঁদের আগমন ঘটে এই পুজোর সময়েই।
মা দুর্গা নিজেই নিজের ভোগ রান্না করে খেয়ে থাকেন, এমনটা শুনেছেন কি কখনও? হ্যাঁ, ঝাড়গ্রামের চিল্কিগড়ের কনকদুর্গা মন্দিরে এমনটাই হয় বলে জনশ্রুতি। ৫০০ বছরের প্রাচীন এই পুজোয় অষ্টমীর গভীর রাতে মন্দিরে পাতকুয়োর সামনে মোষ অথবা পাঁঠা বলির পর নবমীর অন্নভোগের আগে সেই বলির মাংস নতুন মাটির হাঁড়িতে সেদ্ধ করে রাজবাড়ীর বিরাম কক্ষে রাখা হয়। নবমী তিথির যজ্ঞের পরে সেই হাঁড়িতে রাখা বলির মাংস রান্না করে মাকে নৈবেদ্য হিসাবে দেওয়া হয়। মন্দিরের পুরোহিতের কথায়, একেই বিরাম ভোগ বলে। এই বিরাম পুজোতে বাইরের কোনও মানুষের উপস্থিতি নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র পুরোহিত এবং কয়েকজন চর্চক উপস্থিত থাকেন যাঁরা বলির কার্যে বংশ পরম্পরায় অংশ নেন।
কিন্তু মা দুর্গা এই ভোগ রান্না করেন কীভাবে? সেই প্রসঙ্গেই আসছি। অষ্টমীর রাতে বলির পর চিল্কিগড়ের রাজবাড়ীর বিরাম কক্ষে
নতুন মাটির হাঁড়িতে জল ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে শালপাতা দ্বারা ওই হাঁড়ির মুখ
বেঁধে উনুনে চাপানো হয়। ওই উনুনের তিনটি কাঠে আগুন জ্বেলে ঘরের দরজা বন্ধ করে
তালাচাবি লাগানো হয়। এখানকার বাসিন্দাদের বিশ্বাস,
কনকদুর্গা
স্বয়ং এই বিরাম ভোগ পাক করেন। এছাড়াও পুজোর চারদিন কনকদুর্গাকে হাঁসের ডিম, মাছপোড়া ইত্যাদি দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন,
অষ্টমী তিথিতে
হাসের ডিমের পদ ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। তাকে বলে গঞ্জভোগ। দশমীর ভোগে কনকদুর্গাকে
দেওয়া হয় পান্তা ভাতের সাথে শাকভাজা।
বনেদী বাড়ির পুজোর আখ্যান প্রায় শেষের পথে। এই সময়ে
মায়ের নৈবেদ্যের মধ্যে থেকে অন্ততপক্ষে একখানি পদের রন্ধনপ্রণালী বিবৃত না করলে
মহা অন্যায় হয়। সেই উপলক্ষ্যে আসে শিবপুর রায়চৌধুরী বাড়ির পুজোর প্রসঙ্গ। রাজা
রামব্রহ্ম রায়চৌধুরীর স্বপ্নে ১৬৮৫ সালে এখানকার দুর্গাপুজোর উৎপত্তি। মা দুর্গাকে
নৈবেদ্য হিসাবে দেওয়া বিভিন্ন খাদ্যের মধ্যে নিরামিষ আমিষ নির্বিশেষে অন্যতম হলো
কলার বড়ার পায়েস। চালের পায়েসে ডোবানো কলা আর নারকেলের এই অভূতপূর্ব মিষ্টান্নটি
বছরের পর বছর ধরে পুজোর সময় প্রতিদিন দেবীর সামনে ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। সেই
পদটিরই রন্ধনপ্রণালী রইলো আপনাদের জন্য।
- পাকা কাঁঠালি কলা মাখা - ২ টি
- নারকেল কুচি - ১ কাপ
- ময়দা - আধ কাপ
- গুড় - আধ কাপ
- ভাজার জন্য তেল
পায়েসের জন্য :
- গোবিন্দভোগ চাল - ১/৬ কাপ
- কাজু - ৩ চামচ
- কিসমিস - ২ চামচ
- গুড় - ১/৪ কাপ
- এলাচ গুঁড়ো - আধ চামচ
- তেজপাতা - ২ টি
প্রণালী :
কলার বড়ার পায়েস প্রস্তুতি :
তাহলে জেনে গেলেন বনেদী বাড়ির পুজোতে হেঁশেল ঘরের হালহদিশ।
এবার চটপট পুজো পরিক্রমার পরিকল্পনাটা সেরে ফেলুন দেখি! পাড়ার মণ্ডপ থেকে শুরু
করে নামীদামী মণ্ডপের প্রতিমা দর্শনের সাথেই তালিকায় রাখুন বনেদী বাড়ির পুজো
প্রত্যক্ষ করার ভাবনা। এর সঙ্গে ঘরেই বানিয়ে ফেলতে পারেন সেখানকার বিশেষ বিশেষ
পদগুলির মধ্যে থেকে দু'একখানি কিংবা তারও বেশি পদ। আহারে বাহারে
ভরে উঠুক মহোৎসবের আনন্দ।
কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী
ছবি সৌজন্যঃ আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন