মায়ের ভোগ, কলকেতা ও বাঙালির রসনা


 

 

সে কালে বলা হত, মা দুর্গা কলকাতায় শোভাবাজারের দেববাড়িতে(রাজবাড়িতে) আসেন গান শুনতে, জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়িতে আসেন গয়না পরতে, আর চোরবাগানের মিত্র বাড়িতে আসেন খেতে।

চূড়ান্ত cliché headingটা লিখে ফেলেই জিভ কাটলাম। পত্রিকার পক্ষ থেকে বিষয় দেওয়া হয়েছিল, দুর্গাপূজায় বনেদী বাড়ির ভোগ নিয়ে লিখতে। এখন, 'ভোগ' বলতে 'ভোজ্যরূপ নৈবেদ্য' বোঝানো হয়েছে, তা আমি বিলক্ষণ বুঝলেও, সাথে সাথে মনের কোণে খোঁচা মারা একটা চরম সত্যকে কিছুতেই অস্বীকার করতে পারি না - আসলে, কলকাতা-বনেদী বাড়ি-দুর্গোৎসব এই ত্র্যহস্পর্শের পুরোটাই একটা বড়-সড় 'ভোগ',  সেই মহাভোগ চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়-নাটক-কীর্তন-কথকতা-বাঈনাচ-রৌশনচৌকী-জলসাঘর-মদিরা-গণিকা-আতশবাজী-মোসাহেবী-আতর-রেশম-সোনা-রুপো-জহরত-সোনা-আতর-গণিকা-কীর্তন-কথকতা-বাঈনাচ-রৌশনচৌকী-জলসাঘর-মদিরা-গণিকা-আতশবাজী-মোসাহেবী-আতর-রেশম-সোনা-রুপো-জহরত-সোনা-আতর-রেশম-সোনা-রুপো-জহরত ইত্যাদি যতরকমের ইন্দ্রিয়বিলাস হতে পারে, সেই সমস্ত রকমফের সমন্বিত আদি ও অকৃত্রিম 'ভোগ', এবং সে ভোগে অধিকার দেবতার নয়, বরঞ্চ মানুষের,বা বলা ভালো হাতে গোনা চরম জাগতিক তমসাচ্ছন্ন মানুষের। অতএব যতই আমরা জানি না কেন যে 'কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা' নামক সর্বজনাদৃত বস্তুটি আসলে একটি সামন্ততান্ত্রিক, ধনতান্ত্রিক, আভিজাত্যবাদী এবং ক্ষেত্র-বিশেষে বর্ণাশ্রমবাদী উৎসব, যার শিকড় ভক্তির চেয়ে বেশি ঔপনিবেশিক শাসনের শুরুর দিকের অযাচিত আর্থ-সামাজিক স্বচ্ছলতায় অন্তর্নিহিত রয়েছে, এই দরিদ্র দেশের অভাগা সমাজে বেড়ে ওঠা আমরা তবুও তাকে এড়িয়ে যেতে, বা সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করতে পারি নানা, কারণ সেই প্রাচুর্যের উৎসবে আমরা চিরকালই বহিরাগত, অনাহুত, রবাহুত হয়ে রয়ে গিয়েছি, তাই তার প্রতি আকর্ষণ আমাদের মনে রয়েই যাবে, এমনটাই স্বাভাবিক। সমাজ-সংস্কারক থেকে রাজনৈতিক নেতা, গীতিকার থেকে চিত্রকর, সাহিত্যিক থেকে চলচ্চিত্র পরিচালক - কে বা আজ অবধি বাঙালি হয়ে 'কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা'কে এড়িয়ে থাকতে পেরেছেন?('সমাজ-সংস্কারক ও রাজনৈতিক নেতা' পড়ে ঘাবড়াবেন না, খোদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর্থিক অবস্থার উন্নতির পরে বীরসিংহ গ্রামের ভিটেয় দুর্গোৎসব শুরু করতে চাইলে তাঁর জননী ভগবতী দেবী সেই অর্থ জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের পরামর্শ দেন। আবার অন্য দিকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বাগবাজার সর্বজনীন বারোয়ারি দুর্গোৎসব সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন, এবং একাধিক বার)। বিলক্ষণ জানি যে আজ যে বাঙালিকে পর্দায় চকমেলানো টানা বারান্দায় পাতা আলবোলার নল আর আরামকেদারার থেকে ঠাকুরদালানে উপবিষ্ট ডাকের সাজ দেখিয়ে এক মাস ধরে অন্তঃসারশূন্য ধারাবাহিকের পর্দায় বসিয়ে রাখা যায়, পঞ্চাশ বছর বাদেও তাই যাবে, এবং হয়তো আরও বড় আকারে সম্ভব হবে - UNESCOর 'Intangible Cultural Heritage' তকমা পাওয়া গিয়েছে যখন!

 

আরে মশাই, খোদ হুতোম প্যাঁচা লিখে গিয়েছেন :

 

পাঠকবর্গ! এ সহরে আজকাল দু-চার এজকেটেড ইয়ংবেঙ্গলও পৌত্তলিকতার দাস হয়ে, পূজো-আচ্ছা করে থাকেন; ব্রাহ্মণভোজনের বদলে কতকগুলি দিলদোস্ত মদে ভাতে প্রসাদ পান; আলাপি ফিমেল ফ্রেণ্ডেরাও নিমন্ত্রিত হয়ে থাকেন। পূজোরো কিছু রিফাইণ্ড কেতা। কারণ, অপর হিন্দুদের বাড়ী নিমন্ত্রিত প্রদত্ত প্রণামী টাকা পুরোহিত-ব্রাহ্মণেরই প্রাপ্য; কিন্তু এদের বাড়ী প্রণামীর টাকা বাবুর অ্যাকাউন্টে ব্যাঙ্কে জমা হয়, প্রতিমের সামনে বিলাতী চরবীর বাতী জ্বলে ও পূজোর দালানে জুতা নিয়ে ওঠবার এলাওয়েন্‌স থাকে। বিলেত থেকে অর্ডার দিয়ে সাজ আনিয়ে প্রতিমে সাজান হয়–মা দুর্গা মুকুটের পরিবর্তে বনেট পরেন, স্যাণ্ডউইচের শেতল খান, আর কলাবউ গঙ্গাজলের পরিবর্তে কাৎলীকরা গরম জলে স্নান করে থাকেন। শেষে সেই প্রসাদী গরম জলে কর্ম্মকর্ত্তার প্রাতরাশের টী ও কফি প্রস্তুত হয়।...হায়! পৌত্তলিকতা কি শুভ দিনেই এ স্থলে পদার্পণ করেছিল। এতে দেখে শুনে, মনে স্থির জেনেও আমরা তারে পরিত্যাগ কত্তে কত কষ্ট ও অসুবিধা বোধ কচ্চি; ছেলেবেলা যে পুতুল নিয়ে খেলাঘর পেতেছি, বৌ বৌ খেলেছি ও ছেলে-মেয়ের বে দিয়েছি, আবার বড় হয়ে সেই পুতুলকে পরমেশ্বর বলে পুজো কচ্চি, তার পদার্পণে পুলকিত হচ্চি ও তার বিসর্জ্জনে শোকের সীমা থাকচে না–শুধু আমরা কেন, কত কত কৃতবিদ্য বাঙ্গালী সংসারের ও জগদীশ্বরের সমস্ত তত্ত্ব অবগত থেকেও, হয় ত সমাজ, না হয় পরিবার পরিজনের অনুরোধে, পুতুল পুজে আমোদ প্রকাশ করেন, বিসর্জ্জনের সময় কাঁদেন ও কাদা রক্ত মেখে কোলাকুলি করেন; কিন্তু নাস্তিকতায় নাম লিখিয়ে বনে বসে থাকাও ভাল, তবু “জগদীশ্বর একমাত্ৰ” এটি জেনে আবার পুতুলপূজায় আমোদ প্রকাশ করা উচিত নয়।...‘কার প্রতিমা উত্তম’ ‘কার সাজ ভাল’ ‘কার সরঞ্জাম সরেস’ প্রভৃতির প্রশংসারই প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু হায়! ‘কার ভক্তি সরেস’ কেউ সে বিষয়ের অনুসন্ধান করে না–কর্ম্মকর্ত্তাও তার জন্য বড় কেয়ার করেন না!

 

তাই 'কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা'র মোহে না জড়িয়ে আমিও পারলাম না, পারার চেষ্টাও করলাম না, এবং এই ক্ষেত্রে poetic justiceএর অভাবটা বেমালুম চোখ-কান বুজে গলাধঃকরণ করলাম! না পেরে অবশ্য কোনও আফসোস করি না আমি; সদা-সর্বদা আঁতলামি অপরিহার্য এমন কোনও কুসংস্কার আমার নেই!

 

তা, যাক গিয়ে, বাজে কথা থাক। কথা হচ্ছিল বনেদি বাড়িতে দুর্গাপূজার ভোগ নিয়ে। বনেদি বাড়িগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাক্তন জমিদারবাড়ি, এবং হাতে গোনা কিছু ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই কৃতি সন্তানদের খ্যাতিতে উজ্জ্বল কিছু পরিবারের প্রতি দিকনির্দেশ করে। তাই দেখনদারিটাও তেমনই হওয়া চাই বৈ কি! আলাদা করে মিষ্টান্নের জন্য বাড়ির উঠোনেই ময়রার ভিয়েন বসানো বা রসুয়ে বামুন রেখে ভোগ রান্না করানো তো সাধারণ পরিবারগুলিতেই হত। তবে চিন্তা করুন, যে কলকাতায় 'মা দুর্গা জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়িতে আসেন গয়না পরতে' প্রচার হওয়ার পরে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রতিবেশীর প্রতি প্রতিশোধপরায়ণতা-বশতঃ নিজের বাড়ির দুর্গাপ্রতিমাকে বিসর্জনে পাঠাতেন গায়ে খাঁটি স্বর্ণ-রৌপ্য-রত্নখচিত-রত্নখচিত অলঙ্কারসমেত, এবং সেই গয়নার কিয়দংশ গঙ্গার ঘাটের উপর ভেঙে ছড়িয়ে আসা হত, সেই কলকাতায় তবে ভোগের ঘটা কেমন হত! সে কালের অনেক সাহিত্যিকের রচনায় নিদর্শন রয়েছে এ হেন বনেদি বাড়িতে দুর্গাপূজার নৈবেদ্য হিসেবে ঠাকুরদালানের ছাদ অবধি চালের চূড়া, মণ্ডার স্তূপ, লুচির পাহাড়ের কথা, এবং সে সব যে সব ক্ষেত্রেই দরিদ্র নারায়ণের সেবায় লাগার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হত, এমন কথা মনে করার কোনও কারণ নেই। একে অপরকে টেক্কা দেওয়া ছাড়া এই সব পরিবারগুলির পূজার আয়োজনের মধ্যে আর তেমন কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। অতএব, খাদ্যদ্রব্যও নষ্ট হত সেই রকম তাল মিলিয়ে! সেই হুতোমেরই কথায় যদি ফিরি, তবে,

 

কোন কোন বাড়ীর গিন্নী সামগ্রী পেয়ে হাঁড়ি পূরে শিকেয় টাঙ্গিয়ে রাখলেন; অধিক অংশ পচে গেল, কতক বেরালে ও ইঁদুরে খেয়ে গেল, তবু গিন্নীরা পেট ভরে খেতে কি কারেও বুক বেধে দিতে পাল্লেন না—বড়মানুষদের বাড়ীর গিন্নীরা প্রায়ই এই রকম হয়ে থাকেন, ঘরে জিনিষ পচে গেলেও লোকের হাতে তুলে দিতে মায়া হয়। শেষে পচে গেলে মহারাণীর খানায় ফেলে দেওয়া হয়, সেও ভাল। কোন কোন বাবুরও এ স্বভাবটি আছে, সহরের এক বড়মানুষের বাড়ীতে দুর্গাপূজার সময়ে নবমীর দিন গুটি ষাইটেক পাঁঠা বলিদান হয়ে থাকে; পুৰ্ব্ব পরম্পরায় সেগুলি সেই দিনেই দলস্থ ও আত্মীয়ের বাড়ী বিতরিত হয়ে আসছে। কিন্তু আজকাল সেই পাঁঠাগুলি নবমীর দিন বলিদান হলেই গুদামজাত হয়; পূজার গোল চুকে গেলে, পূর্ণিমার পর সেইগুলি বাড়ী বাড়ী বিতরণ হয়ে থাকে, সুত্রং ছয় সাত দিনের মরা পচা পাঁঠা কেমন উপাদেয়, তা পাঠক আপনিই বিবেচনা করুন। শেষে গ্রহীতাদের সেই পাঁঠা বিদেয় কত্তে ঘর হতে পয়সা বার কত্তে হয়!

 

হ্যাঁ, বলিদানও ভোগের একটা বড় অঙ্গ বৈ কি? চিরাচরিত পাঁঠা ও ভেড়া বলি বাদেও এ শহর দেখেছে দুর্গার পায়ে ঘোড়া বলি, মোষ বলি, মাগুর মাছ বলি এমন কি বৈষ্ণব পরিবারে নিরামিষাহারের ঐতিহ্য বজায় রাখতে লঙ্কা, চালকুমড়ো, শসা ইত্যাদি সবজিও বলি হয়েছে। আবার, সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারে অষ্টমীর সন্ধিপূজার সময়ে ভোগ দেওয়া হয় ল্যাটা মাছ পোড়া।

 

দশমীর দিন অবশ্য পৃথক ব্যবস্থা। দেবী-বিদায়ের মধ্যে কন্যা বিবাহের রেশ ধরে রাখতে দশমীর দিন দেবীকে দেওয়া হয় দধিকর্মা ভোগ। আবার বড়ির টক, সুক্তো, মাছের ঝাল, কচু শাক দিয়ে ইলিশের মাথা, নানা রকম ভাজা ও চালতার চাটনির সহযোগে পান্তা ভাতের প্রথাও রয়েছে অনেক বাড়িতে - সবই সাধব্যের চিহ্ন হিসেবে।

 

আগেই বলেছি, এই শহরের দুর্গোৎসবের অনেকগুলো ধারার মধ্যে একটি ধারা নিঃসন্দেহে বর্ণাশ্রমবাদী। অব্রাহ্মণ পরিবারগুলিতে প্রায়শই অন্নভোগ দেওয়া হয় না দেবীকে, বড়জোর লুচি ছাড়া কোনও রান্না করা খাদ্যই দেওয়া হয় না - খোদ রাণী রাসমণির বাড়ি এবং শোভাবাজার রাজবাড়িতে অবধি এই নিয়ম মানা হয়। পটলডাঙ্গা বসুমল্লিক বাড়ির একটি প্রথার কথা শুনেছিলাম - সেখানে খাদ্যের উপকরণ হিসেবে চাল ডাল ইত্যাদি ওজন করে নৈবেদ্য দেওয়া হয়, কিন্তু অব্রাহ্মণের স্পর্শদোষ রক্ষা করতে তা রান্না করা হয় না। একটি পরিবারের কথা পড়েছি - চোরবাগান চট্টোপাধ্যায় বাড়ি - সেখানে নিয়মাবলী আরও এক কাঠি উপরে -  উপবীতধারী ছেলে ও ভাগ্নেরা ছাড়া অন্য কারও ভোগের ঘরে প্রবেশের অধিকার অবধি সেই পরিবারে নেই!

 

নাহ্, আর এত কিছু হজম করা যাচ্ছে না!

অনেক ভেবে-টেবে দেখলাম, এত কিছুর মধ্যে সর্ববাদীসম্মতভাবে সংরক্ষণের যোগ্য যা, তা হল একমাত্র এই সব পরিবারগুলির ভোগের রন্ধনপ্রণালী। তাই এখানে তুলে ধরলাম দুটি বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজার ভোগের বিশেষ রন্ধনপ্রণালী।

 

পক্কান্ন :


কলকাতার যে বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজাটি বর্তমানে সর্ব সাধারণের কাছে সর্বাধিক উন্মুক্ত, সেটি হল শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপূজা। শোভাবাজার রাজবাড়ির ভোগের তালিকায় থাকে দরবেশ, খাজা, পেরাকি, মোতিচুর লাড্ডু, পদ্ম নিমকি, খাস্তা কচুরি, ডাল ও সিঙারা। ভোগে আলুর ব্যবহার হয় না, কারণ আলু হল 'ম্লেচ্ছ' সবজি, বিদেশী ঔপনিবেশিক শাসকদের নিয়ে আসা(ভাবা যায়?)! এর মধ্যে সব চেয়ে যা নজর কাড়ে, তা হল 'পক্কান্ন' বলে একটি পদ - খাস্তা কচুরি, ডাল, সিঙারা বাঙালি, বিশেষ করে উত্তর কলকাতার আম বাঙালির বিকেলের জলখাবারের পদ, পদ্ম নিমকিতে কেমন যেন 'বিজয়া-বিজয়া' গন্ধ, খাজাটা ঠিক পুরী ছাড়া অন্যত্র কেমন বেমানান, আর দরবেশ-পেরাকি-মোতিচুর লাড্ডুগুলো বাঙালি কম, উত্তর ভারতীয় আমেজ বেশি। অগত্যা, পক্কান্নই সই!

 

পক্কান্ন বানাতে লাগবে :

  • ২ কাপ বেসন
  • ১০০ গ্রাম খাঁটি দুধের খোয়া
  • কাজুবাদাম
  • কিশমিশ
  • পেস্তা
  • চিনি
  • ১/৪ চামচ ছোট এলাচের গুঁড়ো
  • ১/২ কাপ গাওয়া ঘি

 

প্রণালী : 

চিনির সাথে এক কাপ জল নিয়ে একটি পাত্রে গরম করে ঘন সিরা বানিয়ে নিন। ততক্ষণ গরম করুন যতক্ষণ না একটি চামচে নিয়ে তা পাত্রের উপর ওঠালে একটি সুতোর মত তা বেরিয়ে আসে। তার পরে তাতে ছোট এলাচের গুঁড়ো ভালো করে মিশিয়ে নিন। আলাদা একটি বাটিতে বেসন জলে গুলে নিন(১ কাপ বেসনে ১/৪ কাপ জল লাগবে)। বেসন ও জলের মিশ্রণ ভালো করে ফেটিয়ে নিন যাতে মিশ্রণ মিহি হয় যায়। এর পরে আরও একটি পাত্রে গাওয়া ঘি গরম করে একটি ঝাঁঝড়ি হাতায় করে বেসন-গোলা নিয়ে তা ধীরে ধীরে চক্রাকারে ঘুরিয়ে ঘিয়ের মধ্যে ছেড়ে ঝুরি ভাজার মত লম্বা আকারে ভেজে নিন। ঝুরিগুলো সোনালী রং ধারণ করলে তা আলাদা করে একটি পাত্রে জলের মধ্যে রেখে দিন। এর পর সবটুকু মিশ্রণের ঝুরিভাজা বানানো হয়ে গেলে তা গরম চিনির সিরায় ঢেলে খোয়া ক্ষীর, কাজুবাদাম ও কিশমিশের সাথে ভালো করে নেড়ে নিন। তার পরে হাতে অল্প ঘি মাখিয়ে সেই ঝুরিভাজা-ক্ষীর-কাজু-কিশমিশের-কাজু-কিশমিশের মিশ্রণ দিয়ে গোলাকার নাড়ু পাকিয়ে নিলেই তৈরি হয়ে গেল পকান্ন।

 

ভেটকি মাছের নিরামিষ ঘন্ট :

 


এটি হল চোরবাগান চট্টোপাধ্যায় বাড়ির পারিবারিক রান্না। এই বাড়ির বিশেষত্ব হল - এখানে দেবীকে নানাবিধ আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়, যার মধ্যে আছে লাউ চিংড়ি, চিংড়ির মালাইকারি ও ইলিশ  মাছের অম্বল। সবকটি রান্নাই প্রায় পরিচিত, ব্যতিক্রম একমাত্র এই ভেটকি মাছের নিরামিষ ঘন্ট। তাই তার প্রণালীই এখানে তুলে ধরলাম।


ভেটকি মাছের নিরামিষ ঘন্ট বানাতে লাগবে :

  • ৪ টুকরো ভেটকি মাছ
  • ৩/৪ কাপ আলু, ছোট করে কাটা
  • ৩/৪ কাপ ফুলকপি, ছোট করে কাটা
  • ৩/৪ কাপ মূলো, ছোট করে কাটা
  • ৩/৪ কাপ বেগুন, ছোট করে কাটা
  • ১/২ কাপ টক দই, ফেটানো
  • ১/২ চামচ আদা বাটা
  • ২ চামচ জিরে বাটা
  • ২-৩টে তেজপাতা
  • ১ চামচ হলুদগুঁড়ো
  • ২ চামচ লাল লঙ্কার গুঁড়ো
  • ১/২ চামচ গরম মশলা গুঁড়ো
  • ৩ চামচ সর্ষের তেল
  • ২ চামচ ঘি
  • নুন ও চিনি - স্বাদানুসারে

 

প্রণালী : 


মাছে হলুদ ও নুন মাখিয়ে রেখে দিন। এক চামচ সর্ষের তেল পাত্রে গরম করে মাছ হাল্কা করে ভেজে নিন, তার পরে ঠাণ্ডা করে কাঁটা বেছে মাছ ভেঙে আলাদা করে রেখে দিন। বাকি সর্ষের তেল ও এক চামচ ঘি গরম করুন ও তাতে তেজ পাতা দিয়ে দিন। তার পরে একে একে আলু, ফুলকপি, হলুদ, লাল লঙ্কা গুঁড়ো, নুন দিয়ে নাড়াচাড়া করে নিন ৪-৫ মিনিট। তার পরে যোগ করুন বেগুন, এবং আরও পাঁচ মিনিট নাড়াচাড়া করে নিন। তার পরে ফেটানো ঠক দই ঢেলে দিন, সাথে আদা বাটা ও চিনি এবং নাড়াচাড়া করে নিন, যতক্ষণ না সবজি নরম হয়ে যায়। এর পরে মাছ দিয়ে দিন, এবং রান্না প্রায় শুকনো না হওয়া অবধি নাড়াচাড়া করুন। শেষে গরম মশলা গুঁড়ো ও ঘি ছড়িয়ে দিন।

 

এত সব জাঁকজমকের মাঝে যে বাড়িতে মা দুর্গা খেতে আসেন, সেই চোরবাগান মিত্র বাড়ির পুজোর ভোগই বর্তমানে কালের প্রভাবে খানিক নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছে - কোনোমতে লুচি ও মিষ্টান্ন ভোগ দিয়ে চলছে সেখানে!

 

শুরু করেছিলাম একটা বিতর্ক দিয়ে, শেষও করব একটা বিতর্ক দিয়ে দুর্গাপূজা মানেই উত্তর ভারতের স্বঘোষিত কিছু হিন্দুধর্মের ধ্বজাধারীদের বিশাল মাথাব্যথায়ে বঙ্গালীলোগ নবরাত্রি মেঁ ভি মাঁস-মচ্ছি খানা কিঁউ নহি ছোড়তে'? তা, তাদের হাতে এই আমিষভোগের লিস্টি পড়লে তো কথাই নেই, এই পুজোগণ্ডার দিনে ভদ্দরলোকরা ভিরমি খেয়ে মরবেন তাই শেষ অবধি একটা কথা না লিখে পারলাম নাবাংলা তথা গোটা পূর্ব ভারতে যে পশুবলি ও আমিষ নৈবেদ্য উৎসর্গের মাধ্যমে নারী-রূপে, অর্থাৎ স্ত্রী দেবতার মধ্যে প্রকৃতি আরাধনার ঐতিহ্য আছে, তা আসলে এই ভূখণ্ডের অতি প্রাচীন লোকায়ত উপাসনার ধারা, নাম কৌলমার্গ এই কৌলমার্গের কারণেই আমরা ব্যতিক্রমী ভাবে, বেখাপ্পা ভাবে আমিষাশী রয়ে গিয়েছি, এবং থাকব এই কৌলমার্গের কারণেই আমাদের লক্ষ্মী কৈমাছের ভোগ খান এই কৌলমার্গের কারণেই চিল্কীগড়ের কনকদুর্গার ভোগে ছড়িয়ে দেওয়া হয় গাঁজার পাতা সর্বোপরি, এই কৌলমার্গের বশেই বাংলার বৈষ্ণব অবধি শাক্ত, রাধাভাব এখানে কৃষ্ণভাবের তুলনায় সহস্রগুণ বেশি প্রবল তাই, কেউ আপনাকে এই পুজোর মরসুমে ঠারেঠোরে আমিষ ছাড়ার কথা শোনাতে এলে আপনিকৌলমার্গবলে ফস করে কেটে পড়তেই পারেন!

 

তো এই হল কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজার ভোগের কিছু ইতিহাস। তবে এই বিষয়ে পড়তে গিয়ে আমি যা পেলাম তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট - আত্মবিস্মৃত বাঙালি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করতে ভুলে গিয়েছে। তবে এবার যখন বিলিতি সম্মান পাওয়া গেছে, কেউ কি এই সব নিয়ে গবেষণা করে 'জাতে উঠতে' চাইবে? এক মাত্র মা দুর্গাই হয়তো জানেন সে কথা।

দুর্গাপূজার অনেক শুভেচ্ছা রইল। সকলের পুজো অনেক ভালো কাটুক।

 

কলমে - ডঃ অদ্রিজা বসু


চিত্র সৌজন্য – Gastronomad

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন