অসুর - শম্পা সাহা

 


Why Is Sex Work Not Seen As Work? – Part 1 | Feminism in India

বেশ্যা পাড়ার গলিটা অনেক আগেই ফেলে এসেছে কুসুম। আলো অন্ধকারে ঢেকে থাকা রাস্তাটা অনেক বেশী নিস্তব্ধ। বয়ে যাওয়া বাতাস বলে দিচ্ছে শীত আসছে। পঞ্চমীর চাঁদ হেলে আছে পশ্চিম আকাশে। কাল থেকে পুজো শুরু। ঈদ, পুজো, ক্রিসমাস মানেই তো জোয়ারের মত খদ্দেরের আনাগোনা। এই সময় অনেক বকশিশ দেয় বাবুরা। মেয়েরাও দু'হাত ভরে উপার্জন করে। অথচ পুজোর পাঁচ দিন শরীরের এই কেনা বেচা, এই নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে ইচ্ছে করে না কুসুমের। ল্যাম্প পোষ্টের নীচে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে বিশু, হারু, আর ফরিদ। লিটনের হাতে বোতল। 

- তুমি এখানে? ঘরে খদ্দের বসাওনি কুসুমদি? 

- না, রে। এই পাঁচ দিন আমার ছুটি। 

মাসির পাওনা টাকা অগ্রিম বুঝিয়ে দিয়ে তবেই ছুটি পেয়েছে কুসুম। ওরা সবাই এই পাড়ারই ছেলে। থানা, পুলিশ, খদ্দেরদের সাথে ঝামেলা, কোন মেয়ে পালানো কিনা- সব এরাই মীমাংসা করে। গেঞ্জির  নিচে  সব সময় ছুরি লুকানো থাকে। বিশুর কাছ থেকে একটা ধারালো ছুরি নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে কুসুম। মনের মধ্যে জিইয়ে রাখা আগুনকে নিভতে দেয় না সে। যার জন্য এ আগুন, সে-সুলতান। মনের মধ্যে বারে বারে আরো ফিরে ফিরে আসে ঘরের আড়ার সাথে ঝুলতে থাকা মায়ের আলতা মাখা দু'টি পা আর শ্মশানের মরা পোড়ানোর গন্ধ।

 

কার্তিক মাস। বিকালে সূর্য ডোবার আগে ঝিনাই নদীর পাড়ে ধোঁয়ার মত কুয়াশা জমে। ভোরে ঘাসে শিশির জমে। শিউলির গন্ধ ভাসে বাতাসে। গ্রামের মধ্যে একটা আনন্দের রেশ। মেলা হবে। পুজোর পর ঈদ। ঈদ পর্যন্ত মেলা চলবে। নদীর পাড়ে তাঁবু পড়েছে। দিনে দু'বেলা করে মাইকিং চলছে। বাজারের দোকানগুলোতে বড় বড় পোষ্টার। তাতে শহর থেকে আসা “সুজন সখী” অপেরার নায়ক-নায়িকার ছবি। পালা নামবে- “বেহুলা লক্ষীন্দর, সিরাজদৌল্লা"। শুধু যাত্রাপালাই নয়, সাথে আরো আছে ‘পুতুল নাচ’, সার্কাস। ঢাকাই জামদানী, হাতের রেশমী চুড়ি থেকে শুরু করে সংসারের হাতা, খুন্তি সবই বিক্রি হচ্ছে মেলায়। ঝিনাই নদীর আশেপাশের আরো দু'-তিনটে গ্রাম থেকে আসা মানুষের ভিড় উপচে পড়ে। রাত একটু বেশী হতে না হতেই শুরু হয় জুয়ার আসর। শুধু দেশী নয়, চলে বিলেতী মদও। নিমাই জুয়া খেলতে বসে পয়লা দিন জিতেছিল বকনা বাছুর। পরদিন দু'টো হাঁস। আজ প্রথমবার হেরে গিয়ে উত্তরের ফসলী জমি খুইয়েছে সে। শুধু জেতার নেশা নয়, মদের নেশাও পেয়েছে ওকে। আরও এক দান শুরু। এবার বাজি বসত ভিটা। ওদের ঘিরে আছে শত শত মানুষ। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, বসত-বাড়ী চলে গেলে থাকবি কোথায় নিমাই? তার চেয়ে ভাল লতাকে বাজি রাখ। 

উচ্চস্বরে কিছু কন্ঠ একসাথে ধ্বনিত হয়, ঠিক ঠিক। আবার বিয়া করলেই তো বৌ পাওয়া যায়। কিন্তু ভিটা হারালে ভিটা পাওয়া যাবে না। মহা উৎসাহে আবার খেলা শুরু হয়। এক দান, দুই দান, তিন দান – হেরে যায় নিমাই। নেশাচ্ছন্ন সে। বুঝতে পারে না, কি সে বাজি রেখেছিল, আর কি বা সে হারাল!

নেশা কেটে যাবার পর লতার সম্মুখে দাঁড়ানোর সাহস ছিল না নিমাইয়ের। একদিন পর গভীর রাতে বাড়ী ফিরেছিল সে। ঘরে ফিরে আসার পর নিমাইয়ের সাথে ঝগড়া, অশান্তি কোন কিছুই করেনি লতা। তবে সংসারের কোনকিছুতে তার মন নেই। মেঘে ঢাকা অন্ধকার দিনের মত নিরানন্দের মধ্য দিয়ে এবার কুসুমের পুজোর চার দিন কাটে। মায়ের সাথে পাড়ার লক্ষ্মীদি, ঝুনু বৌদি, বকুল জ্যেঠি, রত্না কাকিমা, মিতু, নুপুর, তনু সবার সাথে দল বেঁধে পুজো দেখা, প্রসাদ খাওয়া কোনটাই হয়নি এবার। এই শুক্রবার স্কুল ঘরে সালিশি বসবে। সবার অপেক্ষা এখন সেই সালিশির দিকে। আজ দশমী। ঘরে ঘরে সবাই ব্যস্ত মায়ের বিদায় নিয়ে। বেশ কিছুদিন পর নিমাই আজ তার বর্গা চাষীদের নিয়ে মাঠে গেছে। লতা বলেছে, আজ সে ছোঁবে না। তাই সিঁদুর ছোঁয়াতে কুসুম গেছে ঘোষবাড়িতে। ফাঁকা বাড়িতে লতা একা। 

নিথর দেহটা শোয়ানো আছে উঠোনে। চাপানো দরজাটা হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গিয়েছিল। কুসুমই প্রথম দেখেছিল, শূন্যে ঝুলছে ওর মায়ের আলতা মাখা দু'টি পা। বজ্রাহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে সে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করতে চায়, কিন্তু কোন কন্ঠস্বর বাইরে ধ্বনিও হয় না। একজন, দুইজন করে ধীরে ধীরে জানাজানি হল। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন আসতে শুরু করল। কুসুমের আর্তচিৎকার, কান্না আর বিলাপে ভরে উঠল বাড়ি। মায়ের দেহটাকে জড়িয়ে ধরে আছে কুসুম। কিছুতেই তা ছাড়বে না। সবাই দোষ দিচ্ছে নিমাইয়ের। সমালোচনার ঝড় তাকে ঘিরে। স্থানুর মত বসে আছে সে। এক প্রস্তরমূর্তি। চোখ একদম শুকনো। অনুভূতিগুলো সব কোথায় শেষ হয়ে গেছে । সাজানো হল লতাকে। লাল পেড়ে শাড়ী। কপালে বড় ফোঁটা। সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর। সমস্বরে একটাই উচ্চারন- বল হরি, হরিবোল।


শ্মশানে আসতে আসতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। তবে পশ্চিমের আকাশের গায়ে এখনো লাল আভা। মধ্য আকাশে দশমীর চাঁদ। পূর্ব আকাশে উজ্জ্বল হয়ে আছে সন্ধ্যা তারা। আবছা আলো, কিছু অন্ধকার। দূরে শেয়ালের ডাক। পরিত্যক্ত একটা চালাঘরে শ্মশানকালীর মূর্তি। একটা গাছ চোখে পড়ে। ঝুড়ি নেমেছে। তবে অন্ধকারে বোঝা যায় না বট না পাকুড়। সেখানেই বসে আছে ৭/৮ জন। পরনে সাদা বস্ত্র। গাজা টানছে আর বেসুরো গলায় গান গাইছে। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি।


কিছুদূর এগিয়ে যেতেই মরা পোড়ানোর জায়গা। আরো একটা মরা পুড়ছে। চারিদিকে এক বিশ্রী গন্ধ। সেই মৃত মানুষের ব্যবহার্য জামা কাপড়, কাঁথার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ঝগড়া করছে দু'জন ডোম। চিতা সাজানো হচ্ছে। একটু পড়েই মুখাগ্নি । মায়ের শরীরটাকে আর কোনদিন ছুঁয়ে দেখা যাবে না। হঠাৎ যেন কুসুমের কানে এল মায়ের কন্ঠস্বর,

নিজেকে বাঁচানোর আর কোন উপায় ছিল না আমার। খুব স্বার্থপর আমি তাই না? তোর কি হবে? তোর বাবার কি হবে- একবারও ভাবলাম না।


দৈনিকই কাঠে আগুন জ্বলে। আজও জ্বলছে। একই কুন্ডলীকৃত ধোঁয়া। একই কাঠ পোড়া গন্ধ। ঝিনাই নদীর কোন এক ঘাটে যখন মাকে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে অন্য ঘাটে তখন জ্বলছে আগুন। সর্বগ্রাসী আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ছে রক্তমাংসের শরীর। জ্বলতে থাকা আগুনের আভা ছড়িয়ে পড়েছে সবার মুখে, শরীরে।

- বলো, দুর্গা মা কি-------- জয়। 

- বলো, দুর্গা মা কি-------- জয়।

আসছে বছর, আবার হবে!!

সময় গড়ালো। শেষ হল বিসর্জন।


স্তিমিত হয়ে এল আগুন। জল দিয়ে শান্ত করা হল সবকিছু। পড়ে রইল শুধু দেড় কেজি ছাই। এতক্ষনে অন্ধকার শ্মশান জুড়ে নেমে এসেছে জ্যোৎস্নার আলো। সব কাজ শেষে ফিরে যাবার সময় কিসের টানে কার জন্য জানা নেই, তবুও বার বার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল ওরা দু'জনে- নিমাই আর কুসুম। আবারও যেন মায়ের গলা শুনতে পেল কুসুম, 

- বাবার দিকে খেয়াল রাখিস মা। 

অশৌচের দিনগুলো কেটে গেল একরকমভাবে। কুসুমের জন্য জমানো বিয়ের টাকা ভাঙ্গিয়ে শ্রাদ্ধের খরচ করা হল। যারা এসেছিল, তারা ফিরে গেল। শূন্য ঘর, শূন্য কলতল, শূন্য বারান্দা, শূন্য সংসার। সব শূন্য। সারা দিনে চোখে ভাসে শরীরী আবয়ব, কানে আসে কথা । প্রতিদিন স্নানের পর উঠোনের দড়িতে মার শাড়ী ছড়ানো থাকত। দড়িটা এখন ফাঁকাই থাকে। জানালা দিয়ে ঘরে রোদ আসে। ঘরের মেঝেতে গাছের ছায়া দোলে। শুধু পুজোর ঘর থেকে আর চন্দন, ফুল আর ধূপের গন্ধ আসে না। ন'টা বাজলেই কানে আসে, কুসুম তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। না হলে স্কুলের দেরী হয়ে যাবে।


উচ্চমাধ্যমিকের ফল বের হল। সবাই কলেজে- ভর্তি হল। শুধু কুসুমের ভর্তি হওয়া হয় না। তার বিয়ের সমন্ধ আসে। মা মরা মেয়ে। উঠতি বয়স। সংসারে দেখে রাখার কেউ নেই--- ইত্যাদি, ইত্যাদি। বিয়েই একমাত্র সমাধানের পথ। পাত্রের বিঘা বিঘা জমি। ছোট ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। নির্ঝঞ্জাট পরিবার। শুধু সমস্যা একটাই- এক দুর্ঘটনায় পাত্রের বাঁ দিক অবশ। আত্মগ্লানি আর অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে ভিতর থেকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষের কিছু বলার থাকে না। নিমাইয়ের বলার কিছু ছিল না। বিয়ে হয়ে গেল কুসুমের। সারাদিন স্বামী মানিকের যত্নআত্তি করা, খাওয়ানো, স্নান করানো। ভারী শরীরের ভার বহনে ক্লান্ত কুসুমের চোখ উপচে জল আসে। দুপুরবেলা সবাই যখন ঘুমে তখন ঘরের দাওয়ায় বসে শুন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে কুসুম। পুরানো সব স্মৃতি ভিড় করে মনের মধ্যে। বসন্তে আমের মুকুলের গন্ধ। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া চরাচর, স্কুলের বন্ধু, খেলার সাথী সব হাতছানি দিয়ে ডাকে তাকে। টিফিন বেলা সবাই মিলে রুমাল চোর, বৌচি, কুমীর ডাঙ্গা খেলা। ছুটির ঘন্টা পড়তেই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সবাই মিলে ছুটে চলা। কখনো রেললাইন ধরে, কখনো ক্ষেতের আইল ধরে। কখনো দু'পাশে সবুজ ধান, কখনো হলুদ সর্ষে ক্ষেত। কার্তিকে যখন জল নামতে শুরু করত সন্ধ্যা হলে মা তখন খালে, জল ডোবা ক্ষেতে দোয়ারি পেতে দিয়ে আসত। রাতে ধরা পড়ত টেংরা, স্বরপুঁটি, বেলে, পাবদা। ভোর রাতে দোয়ারিগুলো নিয়ে আসত মা। খুব ইচ্ছে হয় বাড়ি যেতে। যেন বাড়ি ফিরে গেলেই মার দেখা পাবে। ফিরে পাবে সেই চির চেনা ঘর, চেনা গন্ধ, চেনা অনুভূতি, চেনা সুখ। 


দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা। রাত শেষ হলে আবার দিন। সময় গড়ায় কুসুমের সব না পাওয়ার মাঝে হঠাৎই সামনে এসে দাঁড়ায় সুলতান। তার দেবরের বন্ধু। উদাস করা নির্জন দুপুরে পিছনের জানালার কাছে প্রতিদিন অপেক্ষা করে কুসুম। সুলতান আসে, চোখে চোখ রেখে কথা বলে। গোলাপ নিয়ে আসে। লাল গোলাপ। গোলাপ দেওয়ার অছিলায় কুসুমের আঙ্গুল স্পর্শ করে। 

-আমার যে খুব ভয় হয় সুলতান ভাই। 

- ভয় কিসের কুমু? কথা দিয়েছি ত সারা জীবন তোমার পাশে থাকব। 

- ধর্ম যে আলাদা!

-ভালাবাসাই তো ধর্ম। ভালবাসার চাইতে বড় কোন ধর্ম নেই।


কুসুমের বুকের মধ্যে মাদল বাজে। পশ্চিমের সন্ধ্যার আকাশটা বেশী লাল মনে হয়। বাতাসে মাধবীলতার মিষ্টি গন্ধ ভাসে। নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ কানে আসে। গোধূলির অবেলায় কিংবা বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় স্বপ্ন দেখে, কখনো কাশফুলে ঘেরা ঝিনাই নদীর তীরে, কখনো অশ্বত্থ গাছের নীচে সুলতানের বুকে সে মাথা রেখেছে। যদি জানাজানি হয়ে যায় যদি সুলতান হারিয়ে যায়! আর দেরী নয়। সুলতানের কথা মত হাতের শাঁখাপলা নোয়া খুলে, সিঁদুর মুছে ভোর রাতের আঁধারে ঘর ছাড়ে কুসুম। নতুন সূর্য, নতুন আলো, নতুন দিন। ফাঁকা বাস, বাসের হেল্পার বাসের গায়ে বাড়ি মেরে মেরে ড্রাইভারকে সংকেত পাঠায়। ডাইভার বাস থামায়। গন্তব্যের নাম ধরে হেল্পার চিৎকার করে। যাত্রী ওঠে। কন্ডাক্টর নতুন যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া তোলে। অচেনা শহর, অচেনা পথঘাট। যার ভরসায় ঘর ছেড়ে আসে কুসুম, বাসের জানালার পাশে বসে নিঃসঙ্কোচে নির্দ্বিধায় তার কাঁধে মাথা রাখে। সুলতানের গায়ের গন্ধ নেয়। গভীর এক প্রশান্তিতে নির্ভরতায় ঘুম ঘুম চোখে আবছা আবছা স্বপ্ন দেখে সে। 


সকাল শেষ হলেও তখনও ঘুমিয়ে থাকে সবাই। তারপর বেলা আরো বাড়লে মেয়েরা ওঠে। স্নান সারে। চুলায় আগুন দেয়। দু'-একজন যে এইসময় আসে না তা নয়। তবে বিকেল শুরু হতেই ব্যস্ততা বাড়ে। যতই রাত বাড়তে থাকে ততই সরগরম হয়ে উঠে এই পাড়া। কুসুমের ভালবাসা, বিশ্বাসের পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছিল সুলতান। ফ্রেশ মাল হিসাবে বিক্রি করে মাসির কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে গেছে সে। কুসুমও এখন অন্য সবার মত কপালে টিপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে লাল রং আর রঙিন জামা পরে গলির মুখে কিংবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘরে খদ্দের ঢোকানোর জন্য পুরুষদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। কতরকমের আদবকায়দা! সবই শেখা হয়ে গেছে কুসুমের। এ যেন অন্য এক জগৎ, অন্য এক পৃথিবী। পদে, পদে ক্ষুধার জ্বালা, শরীরি শোষন, মিথ্যা ভালবাসা আর প্রবঞ্চনার ইতিহাস। এখানে পুরুষেরা শুধু মেয়েদের শরীরের মাংস চেনে। তাল তাল মাংস। রাত দ্বিপ্রহরের পরে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েরা। শুধু ঘুমায় না কুসুম। মনের বদ্ধ দুয়ারে ফিরে ফিরে আসে তার ভাবনা। মায়ের চিতার আগুন যেন জ্বলতে থাকে তার শরীরে। ঘেন্না হয় নিজের উপর। ইচ্ছে হয় সযত্নে রাখা ঐ ছুরিটা দিয়ে নিজের শরীরটাকে কুপিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে। নাহয় ওবাড়িতে সে কাজের মানুষ হয়ে থাকত আর প্রতিদিন রাতে বিছানার এক কোনে শুয়ে চোখের জল ফেলত, তবুও তো পরিচয় ছিল মন্ডলবাড়ির বড় বৌ। কিন্তু আজ! কি তার পরিচয়! বেশ্যা! পতিতা! এই অসম্মানের হাত থেকে বাঁচার জন্যই তো মা সেদিন মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিল। অথচ সেই ক্লেদাক্ত অন্ধকারময় জীবন আজ সে বয়ে চলেছে! কেন? শুধুমাত্র সুলতানের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, না নিজের জীবনের মায়া, কোনটা?  


সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। নবমীর চাঁদ আকাশে। নক্ষত্রেরা জ্বলছে উজ্জ্বল হয়ে। পচা পুকুরের বিশ্রি গন্ধ মিশে আছে বাতাসে। একটানা ঝিঁ ঝিঁ’র ডাক। জমাট বাঁধা অন্ধকারে মাঝে মাঝে জ্বলে ওঠা জোনাকির সবুজ আলো। পুজো প্যান্ডেলের হলুদ আলোকে ঘিরে আছে হাজারো পতঙ্গ। সন্ধ্যা আরতির কাঁসরঘন্টা আর ঢাকের শব্দ মেথরপট্টী ছাপিয়ে মাইলখানেক দূরের বেশ্যাপল্লীতে এসে পৌঁছেছে। 

কুসুমের ঘরে আজ খদ্দের বসিয়েছে শিউলি। অনেকক্ষণ হল চিৎকার চেঁচামেচি যেন ওদিক থেকেই আসছে। ছেড়া কাঁথার উপর শুয়ে চিৎকার করে কাঁদছে বিউটির মেয়ে। কাঁথা, ন্যাকড়া নিয়ে বিউটি কলতলায়। সাতদিনের শীর্ণ, অপুষ্ট শিশুটিকে কোলে নিতেই কান্না থামে। দুধ মুখে নিতে চায়। ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কুসুম। চিরপ্রশান্তির এক অনুভূতি। এই পাড়ায় সহজে কেউ মা হয় না। হয়ত সেও কোনদিন মা হবে না । স্বামীর সোহাগের লোভ, সংসারের লোভ, সন্তানের লোভ – এইসব লোভেই সে একদিন ঘর ছেড়েছিল সুলতানের সাথে। খবর নিয়ে আসে বিউটি। শেফালির স্বামী পরিমল তার আরো দুই সাগরেদকে নিয়ে একসাথে ঘরে ঢুকছে। 

-মাসি জানে?

- ঐ মরদটা মাসির হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছে। 

কুসুমের অন্তরের প্রতিশোধের ঐ আগুনকে মুহূর্তেই যেন জ্বালিয়ে দেয় বিউটি। দ্রুতগতিতে ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে দাড়ায় কুসুম। 

- আমি তো তোর বিয়ে করা বউ, আর আমারে শেষপর্যন্ত তুই বিক্রি করে দিলি?

-পনের দিন আমি আসি নাই এখানে। টাকা বাইর কর। 

-গতর বিক্রি করে টাকা যদি আমি কামাই করি, তবে সেই টাকার ভাগ আমি তোরে দিমু ক্যান? আর, এরা আইছে ক্যান তোর লগে? কইছি না, আমার শরীরে কেউ হাত দিবি না তোরা----!!


বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে কুসুম। খুলতে দেরী করে না শেফালি। অবিন্যস্ত তার শাড়ি। উপস্থিত সবার উচ্চ হাসি ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়। 

-এ তো মেঘ না চাইতেই জল! আরো একটা বিলেদী মদ নিয়ে আয় পরিমল। 

---- আজ নবমীর রাত। নেশা হবে, ফুর্তি হবে, মজা হবে। 

নেশাচ্ছন্ন একজন এগিয়ে আসে। বুকের আঁচলটা ফেলে দেয় কুসুমের। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠে সে। তোষকের নীচ থেকে বের করে তার সযত্নে রক্ষিত ধারালো ছুরি। এরপর ক্ষিপ্রগতিতে বসিয়ে দিতে চায় পরিমলের পিঠে। চিৎকার করে উঠে শেফালি। পিছন ঘুরে দাঁড়ায় পরিমল। আর মুহূর্তেই ছুরিটা বসে যায় পরিমলের বুকে। ছিটকে ওঠা রক্ত ছড়িয়ে পড়ে কুসুমের মুখে। না হোক এ সুলতান, হোক সে পরিমল, পরিচয় তো সবারই এক – অসুর। আর অসুর তো বধ হতেই হবে।



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন