সবে ভোরের আলো ফুটেছে। তৃণা জানালার পাশে উঠে এসে দাঁড়ালো। গ্রামের মধ্যে এই ঘরটায় দুটো বড় বড় জানালা। একটা জানালা দিয়ে মাঠ পেরিয়ে পাকা রাস্তাটার এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত বিস্তৃত অনেকটা পথ দেখা যায়। আর এই জানালাটার বাইরে কিছুটা ফাঁকা জায়গা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। তারপর সরু কাঁচা মেঠো পথটি পাকা রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। এই বাড়িটায় তৃণা গত দু'দিন আগেই এসেছে। প্রথমবার, হয়তো বা শেষবার!
গ্রামের এই বাড়িটাই দোতলা। পাঁচটা ঘর আছে মোট। নীচে দু'টো শোবার ঘর আর কিচেন কাম্ ডাইনিং। উপরে তিনটেই শোবার ঘর। একটু ঘিঞ্জি, কিন্তু প্রত্যেকটা ঘরেই ছোট একটা করে বারান্দা আছে। বাড়িটা সিঞ্জনদের। ওর বিয়ের জন্যই গত পরশু সকালে এ বাড়িতে তৃণা এসেছে ছোট্ট তিষানকে নিয়ে।
গতকাল সিঞ্জনের কালরাত্রি ছিল। উপরে সিঞ্জনের ঘরে সিঞ্জন আর ওর কিছু বন্ধুবান্ধব শুয়েছে। বাকি ঘরগুলোতে বিয়ের জন্য দূর থেকে আসা আত্মীয়স্বজনরা আছে। নীচের একটি ঘরে ওর বাবা-মা, আর মামাবাড়ির কয়েকজন। এই ঘরটিতে তৃণা, তিষান এবং সিঞ্জনের বউ মৌমি। অন্য ঘরগুলোর তুলনায় এই ঘরটি বেশ ফাঁকা ও নিরিবিলি। তবুও তৃণার ঘুম আসছে না। অনেকক্ষণ বিছানায় এদিক ওদিক করার পর, ও এই জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো।
বেড়ার গায়ে গায়ে কতকগুলো গাঁদাগাছ, বড়ো বড়ো ফুল ফুটে আছে বেশ। মাঝে কয়েকটা কুমড়ো গাছ সদ্য ছোট ছোট কুমড়ো প্রসব করে, রোদ পোহানোর জন্য উপরের দিকে তাকিয়ে সকালের অপেক্ষা করছে। আর একদিকে পেঁয়াজকলি কয়েক ঝাড়। তৃণা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, মৌমি আর তিষান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তৃণা কিছুক্ষণ বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
গ্রামে ভোর থেকেই মানুষজন যাতায়াত শুরু করে দেয়। এখন ফাল্গুন মাস। তবুও বেশ ঠান্ডা এখানে। গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিল সে। মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসছে চারপাশ থেকে। তৃণার এই গ্রাম্য পরিবেশটা বেশ সুন্দর লাগছে। শহরের দমবন্ধ পরিবেশেই ওর জন্ম। ওর বেড়ে ওঠা। বত্রিশ বছরের জীবনে এই প্রথম ওর গ্রাম দেখা। যদিও বিয়েবাড়িতে এসে গ্রামটা ভালো করে ঘুরে দেখার সুযোগ হলো না ওর। সিঞ্জনও বিয়ে নিয়ে খুব ব্যস্ত। তার মধ্যেও ও সর্বক্ষণ তৃণা আর তিষানের খেয়াল রাখছে। তিষানও ওর পিছনে পিছনে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দুষ্টুমি করে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যেই সকলের মন জয় করে নিয়েছে ও। আজ রাতে ফুলশয্যার অনুষ্ঠানটা মিটে গেলে, আগামীকাল দুপুরে চলে যাবে ওরা।
স্মৃতির পাতায় অনেক পুরানো কথা ফুটে উঠলো তৃণার। বাবা-মা দুই বোনের ছোট সংসার ছিল ওদের। ছোট থেকেই পড়াশোনায় খুব ভালো রেজাল্ট না করলেও, হাতের কাজে তৃণা ছিল পারদর্শী। স্বল্প উপার্জনের সংসারে দুই মেয়ের বিয়ের জন্য চিন্তিত বাবা, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বড় মেয়ে তৃণার বিবাহ সম্পূর্ণ করে ফেলেন।
তৃণার স্বামী রাহুল। পেশায় সরকারি চাকুরিজীবী। বিয়ের পরে তৃণার জীবন আর্থিক স্বচ্ছলতার মধ্যে কাটলেও তার জীবন হয়ে উঠেছিল ভীষণ দুর্বিষহ। প্রত্যেক দিনই রাহুল বেশি রাতে মদ্যপান করে বাড়ি ফিরতো। সাথে বউয়ের জন্য বরাদ্দ একরাশ নোংরা গালি-গালাজ, সন্দেহ আর শারীরিক অত্যাচার, মানে গায়ে হাত তোলা। শরীরের চাহিদা সে বাইরেই পূরণ করে আসতো। রাহুলের বাড়ির লোকজনদের এ ব্যাপারে কোনো ভ্রূক্ষেপই ছিল না। রাহুলের মাকে তৃণা কিছু বলতে গেলেই তিনি বলতেন -
-পুরুষ মানুষ অমনই হয় বাছা, মেয়েদেরকে তাদের মন জুগিয়ে চলতে হয়। তাছাড়া এদ্দিনে একটা বংশপ্রদীপ এনে দিতে পারলে না, কোন মুখে আমার ছেলের নিন্দা করতে আসো?
বেশ কয়েকবার নিজের মায়ের কাছেও দুঃখ প্রকাশ করেছিল সে। মাও তাকে বলেছে-
- একটু মানিয়ে গুছিয়ে নে মা। জামাই বাবাজিকে বুঝিয়ে এবার একটা বাচ্চা নে। দেখবি বাচ্চা-কাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর বাবার অবস্থা তো জানিস। তাছাড়া মীনার বিয়েটাও তো দিতে হবে এরপর। তোর সংসারের ব্যাপার তোকেই মেটাতে হবে, মা।
তৃণা কোনো প্রকার আশার আলো না দেখতে পেয়ে, সংসারের কাজের ফাঁকে যেটুকু সময় পেতো, নিজের এক কালারের শাড়িগুলোতে সুতো দিয়ে নকশা করতো। তাই সময়ও কেটে যেত আর মনটাও একটু ভালো থাকতো। এইরকম জীবন যাপনে ও বেশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
এমনি করে দু'-তিন বছর পার হয়ে গেল। তারপর রাহুলের জন্মদিন উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে তৃণা নিজের কাজ করা একটি শাড়ি পরেছিল। উপস্থিত সকলের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল, তার পরনের শাড়িটা। রাহুলের বন্ধুরা তৃণার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলে রাহুল রাগে, ক্ষোভে মনে মনে লুচির মতো ফুলছিল। সকলে চলে যাবার পর সেদিন রাতে রাহুল প্রথমে প্রচন্ড মারধর শুরু করে এবং সিগারেট জ্বালিয়ে ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতের সৃষ্টি করে। তারপর শরীরের চাহিদা মেটানোর নামে শুরু করে ধর্ষণ। দু'-তিনবার নিজের বিকৃত মানসিকতার পরিতৃপ্তির পর শেষ রাতে পরম সুখে নিদ্রাযাপন করে সে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে জোর করে টেনে নিয়ে, ভোর রাতেই বাড়ি ছেড়েছিল তৃণা।
তিষানের গায়ে লেপটা ভালো করে ঢাকা দিয়ে, তৃণা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলো।সিঞ্জনের ঘরটা সিঁড়ির ঠিক মুখোমুখি। সোফার উপর সিঞ্জন ঘুমাচ্ছে। গায়ের ঢাকাটা নীচে পড়ে আছে। তৃণা একবার ভাবলো, ওর গায়ের ঢাকাটা দিয়ে দেবে। কিন্তু কেউ দেখলে যদি কিছু মনে করে। তাই সে কিছুক্ষণ সিঞ্জনের দিকে অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে থাকার পর, নিজের ঘোর কাটিয়ে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এলো।
ছাদটা বেশ খোলামেলা। ছাদের সামনের দিকে টবের উপর বিভিন্ন ফুলগাছ দিয়ে সাজানো ছোট্ট একটা বাগান। পাশে দুটি বেতের চেয়ার। তৃণা একটি চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। উত্তরের হাওয়া বইছে হু হু করে। সোয়েটারের ওপর চাদর ঢাকা দিয়েও বেশ ঠান্ডা অনুভব করছে ও। কিন্তু চারদিকের মনোরম পরিবেশ ও মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করছে। কিছু সময় বসে থাকার পর তৃণা ছাদের পিছন দিকটায় এসে দাঁড়ালো। এদিকে একটা স্টিলের দোলনা রয়েছে দু'জন বসার মতো। তৃণা ছাদের একেবারে কানায় এসে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলো এটা বাড়ির পিছন দিক। এদিকে অনেকটা বাগানের মতো জায়গায় অনেকগুলো মেহগিনি, দেবদারু আর আকাশবাণী গাছ মাথা উঁচু করে উপরের দিকে উঠে এসেছে। আর বাড়ির গায়ে গায়ে বেশ কয়েকটা সুপারিগাছ। এরকম প্রাণবন্ত পরিবেশ তৃণা কখনও দেখেনি আগে।
ভাড়া বাড়িতেই ওর মেয়েবেলা কেটেছে। একটা শোবার ঘর আর লাগোয়া লম্বা বারান্দার একদিকে রান্না করার জায়গা। অন্যদিকে ছোট একটা চৌকিতেই ওরা দু'বোন ঘুমাতো। বিয়ের পর অবশ্য নিজের একটা বড় ঘর ছিল। কিন্তু ওই ঘরটাকে জেলখানা বলেই মনে হতো তার। সব সময় একটা ভয়ার্ত পরিবেশে ওর দম বন্ধ হয়ে আসতো।
সেদিন রাহুলের দ্বারা চরমভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে, তৃণা স্টেশনে গিয়ে পৌঁছেছিল। তখন সবে সকালের আলো ফুটেছে। চারপাশে লোকজন আছে, কিন্তু ভিড় তেমন একটা নেই। যন্ত্রণায় শরীরটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। ও একটা বসার জায়গায় এসে কোনো রকমে বসলো। ক্ষতস্থানগুলো লাল হয়ে আছে। কোনো কোনো জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে। আশেপাশের লোকজন কৌতূহলী হয়ে দেখছে ওকে। তৃষ্ণায় গলাটা শুকিয়ে গেছে, স্বর বের হচ্ছে না। অস্ফুটে তৃণা একটু জলের সাহায্য চাইলো। নাহ্! কেউ একটু জল দেবার জন্য এগিয়ে এলো না। তৃণা চোখ বন্ধ করলো। সব ঝাপসা হয়ে আসছে। কিছুক্ষণের নীরবতা....
চারপাশ থেকে একটা গুঞ্জন কানে আসছে। ধীরে ধীরে চোখ খুললো ও। আশেপাশের বেডে কয়েকজন পেশেন্ট। কেউ টুকটাক কথা বলছে, কেউ বা ঘুমে মগ্ন। একজন নার্স একটি পেশেন্টকে ইঞ্জেকশন দিচ্ছে। ভালো করে দেখলো একটা বেডে শুয়ে আছে ও। উঠে বসার চেষ্টা করলো। চোখটা ঝিমঝিম করছে। ওকে উঠতে দেখে নার্সটি এগিয়ে এসে, হাত ধরে বসিয়ে দিলো। তৃণা লক্ষ্য করলো ওর ক্ষতস্থানগুলোতে ব্যান্ডেজ লাগানো হয়েছে।কিছুক্ষণ বসার পর ও একটু আরাম বোধ করলো। নার্সটিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো,
-এখানে আমাকে কে নিয়ে এসেছে ?
নার্সটি বললো, একটি ছেলে তিনদিন আগে ভর্তি করেছে আপনাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আপনার খোঁজ নিতে আসে, আজও আসবে।
তৃণা মনে মনে ভাবলো, ওর স্বামী বোধহয় ওকে খুঁজে বের ক'রেছে। তাহলে কি সে তার ভুল বুঝতে পারলো! সন্ধ্যার অপেক্ষা করতে করতে ভাবলো, রাহুল তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে সে কি ফিরে যাবে ? তার কী করা উচিত ?
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সমস্ত পেশেন্টদের বাড়ির লোক একে একে আসছে যাচ্ছে। এমন সময় একটা ছেলে ঢুকে ওর বেডের দিকে এসে, মিষ্টি একটু হেসে, জিজ্ঞাসা করলো, কেমন আছেন ?
ছেলেটি বেশ লম্বা, ছিপছিপে চেহারা। রং শ্যামবর্ণ। পরনে নীল জিন্স আর হালকা কমলা টিশার্ট। ছেলেটি দেখতে খুব একটা সুন্দর নয়; কিন্তু হাসিটা অমলিন, যা মুখমণ্ডলের সৌন্দর্যতা বৃদ্ধি করেছে। তৃণা হাঁ করে তাকিয়েই থাকলো কিছুক্ষণ। নীরবতা ভেঙে ছেলেটি আবার বললো, কীরকম বোধ করছেন এখন ?
তৃণা চোখ নামিয়ে বিস্ময়ের সাথে বললো,ভালো, কিন্তু আপনি?
আমি সিঞ্জন, সিঞ্জন বসু। আমিই আপনাকে এখানে ভর্তি করিয়েছি। এখন আপনাকে বেশ সুস্থ মনে হচ্ছে। আপনি যদি আপনার ঠিকানাটা দেন, তাহলে আপনার বাড়িতে খবর দিতে পারি।
এই পর্যন্ত বলে ছেলেটি তৃণার মুখের দিকে উত্তরের আশায় তাকালো। তৃণা কী বলবে বুঝতে পারছে না। তৃণা একটু ইতস্তত করে বললো, আমার বাড়ি এখানে না, আমি কাজের সন্ধানে এই শহরে এসেছি। আপনি যদি কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেন।
ছেলেটি বিব্রত বোধ করলো। একটু থেমে বললো,আমি দুই বন্ধুর সাথে একটা ওয়ান রুম ফ্ল্যাটে থেকে পড়াশোনা করি। কাছে পার্ট টাইম জব, খুব সামান্য। আমার বন্ধুরা কাজ খুঁজছে। কোনো সোর্স নেই আমাদের।আপনাকে কীভাবে - !
তৃণা অসহায় বোধ করলো ভিতরে ভিতরে, কিন্তু মুখে কিছু বললো না।
ছেলেটি আবার শুরু করলো, দেখুন আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনি বিপদের মধ্যে আছেন। আপনি বিশ্বাস করে সবকিছু খুলে বলতে পারেন, যদি অন্যভাবে কিছু সাহায্য করতে পারি। কাল আপনাকে এখান থেকে ছুটি দিয়ে দেবে। এরপর আপনি কোথায় যেতে চান ? আমি আপনাকে পৌঁছে দিতেও পারি।
তৃণার মাথাটা ভারী হয়ে আসছে। সে কিছু ভাবনা চিন্তা না করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। কোনো টাকা পয়সাও সঙ্গে আনেনি। কী করবে ও ? কোথায় যাবে এখন ? বাপের বাড়ি ফিরে যাবারও কোনো মানে হয় না। সেখানে ঠাঁই হবে না, ভালোমতোই জানে ও।চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল বেরিয়ে এলো। কোনো কথা বলতে পারলো না। ছেলেটি কিছু একটা আন্দাজ করে ওর হাতে রুমালে বাঁধা কিছু জিনিস দিয়ে বললো, এগুলো আপনার সম্পদ।
তৃণা রুমাল খুলে দেখলো, একটা আংটি, একজোড়া কানের দুল আর চারগাছা চুড়ি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় ওগুলোই ও পরে ছিল। ছেলেটি বললো, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে আপনার আত্মীয় ভেবে এগুলো দিয়েছিল। দেখুন, যদি আপনার কিছু কাজে লাগে।
তৃণা ওর সঙ্গে ঘটা সমস্ত ঘটনা ছেলেটাকে খুলে বললো। তারপর গহনাগুলো দেখিয়ে বললো, এগুলো নিয়ে যদি কিছু ব্যবস্থা করে দেন তো !
সবকিছু শোনার পর সিঞ্জন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো, দেখছি, কী করা যায়! কিন্তু আপনার স্বামী যদি আপনার খোঁজ করে ?
তৃণা কাঁদতে লাগলো নীরবে। সিঞ্জন আবার বললো, আজকে ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ, আমি কালকে আপনাকে আনতে আসবো। তার মধ্যে দেখি কী ব্যবস্থা করতে পারি। গহনাগুলো আপনার কাছেই থাক।
-এখন আসি।বলে যেতে উদ্যত হলে, তৃণা হঠাৎ করে ওর হাতটা ধরে বললো, আসবেন তো কালকে ?
সিঞ্জন একটু লজ্জা বোধ করলো। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে তৃণা হাতটা ছেড়ে দিয়ে মাথা নামিয়ে নিল। সিঞ্জন বললো, চিন্তা করবেন না, আমি আসবো।
সিঞ্জন চলে যাবার পর তৃণা মনে মনে ভাবলো, ছেলেটি যদি না আসে কী করবে ও ? আবার পরক্ষণেই ভাবলো - একটা অচেনা, অজানা মানুষকে বিশ্বাস করে কি ও ঠিক করছে ? কিন্তু ছেলেটি ওর অনেক উপকার করেছে। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। ওর গহনাগুলো নিয়ে তো পালিয়ে যেতে পারতো, কিন্তু সেটা ও করেনি। এরকম করে কতক্ষণ কেটে গেল ও খেয়াল করেনি। ঘোর কাটলো নার্সের আওয়াজে।
নার্স বললো, আপনার খাবার পড়ে আছে এখনও, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। আমি একটা ইনজেকশন দেবো।
খাবার পর নার্স ইনজেকশন দিল। আর সাথে সাথে তৃণার দু'চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো। সে মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে সিঞ্জন যথাসময়ে এসে উপস্থিত হলো। তৃণা বেডের উপর বসেছিল।
সিঞ্জন ঢুকে বললো, আপনার ছুটি হয়ে গেছে। আমি সমস্ত রকম ফরম্যালিটি করে নিয়েছি। আপনি রেডি হয়ে যান।
-আমি তৈরি আছি, চলুন।
হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে তৃনা বললো, কোথায় যাবো ?
-আপাতত আমার ফ্ল্যাটে চলুন। আমি রুমমেটদের সাথে কথা বলে রেখেছি, কোন অসুবিধা হবে না।
তৃণা মনে মনে একটু ইতস্তত বোধ করলো, কিন্তু ওর কিচ্ছু করারও নেই।তাই নিঃশব্দে সিঞ্জনের পথ অনুসরণ করলো।
সিঞ্জনের ফ্ল্যাটটা খুব ছোট। একটা বেডরুম সাথে ডাইনিং, কিচেন আর বাথরুম। ভীষণ অগোছালো, চারিদিকে জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তৃণাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, বাথরুমটা দেখিয়ে তৃণার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে সিঞ্জন বললো, এতে দুটো শাড়ি এবং প্রয়োজনীয় কাপড় আছে, আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। রান্না রেডি আছে, খেয়ে আমার সাথে একটু বেরোবেন।
তৃণা সম্মতি জানিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো।
কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে দেখলো, সিঞ্জন আর দুটো ছেলে খাবারের টেবিলে বসে আছে।তৃণাকে দেখে সিঞ্জন বললো, চলে আসুন আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি আমরা।
ছেলে দুটোকে দেখিয়ে বললো, ও ববি আর এ মন্টু, আমার রুমমেট।
তৃণা নমস্কার জানাতে, ওরা হেসে বললো, আমরা বন্ধুর মতো, এসব লাগবে না।
মন্টু বললো, খুব খিদে পেয়েছে, খেতে আসুন।
তৃণা খাবার টেবিলে বসলো। ভাত, ডাল,আলুপোস্ত আর বেগুনভাজা, প্লেটে সাজিয়ে তৃণার দিকে এগিয়ে দিল ববি। সকলে খেতে শুরু করলো। তৃণা খাবার মুখে নিয়ে দেখলো, খুবই বিস্বাদ খাবারগুলো। কিন্তু মুখে কোনো ভাবপ্রকাশ না করে চুপচাপ খেয়ে নিলো।
তারপর সিঞ্জনের কাছে জানতে চাইলো, আমরা কোথায় যাবো ?
-উকিলের বাড়ি। আপনার স্বামী কোনো মিথ্যা অভিযোগ করার আগে সমস্ত আইনি কার্যক্রম সেরে ফেলা উচিত।
তৃণা ধীরে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। উকিলের বাড়ি থেকে ফিরে তৃণা ডাইনিং রুমের একধারে থাকা সোফার উপর নিজের থাকার ব্যবস্থা করলো। তারপর ওরা সকলে টুকটাক গল্প করে, বাইরে থেকে আনা রুটি তরকারি খেয়ে ঘুমাতে গেল। যাবার আগে ববি বললো, কাল রবিবার আমাদের ছুটি, তাই আমরা সকলে একটু দেরিতে উঠি। আপনার কোনো অসুবিধা হলে, ডাকবেন আমাদের।
পরদিন সকালে মন্টু ঘুম থেকে উঠে, মোবাইল নিয়ে দেখলো সাড়ে দশটা বাজে।তড়াক্ করে বিছানা থেকে নেমে সিঞ্জনকে ঠেলতে ঠেলতে বললো,ও সিঞ্জনদা ওঠো। ক'টা বাজে দেখো।
ববি পাশ ফিরে শুতে শুতে বললো, কটা বাজে রে ?
মন্টু বললো, চোখ খুলে দেখ না।
তারপর সিঞ্জনকে বলল, ও সিঞ্জনদা, ওঠো। ফ্রেশ হয়ে বাজারে যেতে হবে। আজ যে তোমার গেস্ট আছে, সেকথা ভুলে গেছো ?
শেষের কথাটা কানে যেতেই সিঞ্জন আর ববি বিছানায় উঠে বসলো। তাই তো, ছুটির দিন বলে এতটা আলস্য সাজে না। তাছাড়া তৃণার কথা মনেই ছিল না প্রায়। ববি বললো, অনেক বেজে গেছে সিঞ্জনদা, তৃণাদি মনে হয় ঘুম থেকে ওঠেনি, চলো ডেকে তুলি।
সিঞ্জন বললো, হ্যাঁ যা। মন্টু! বাথরুমে যা, আর আমি মুখ ধুয়ে চা করতে যাচ্ছি।
কথা বলতে বলতে ওরা তিনজনে রুম থেকে বেরিয়ে হাঁ হয়ে গেল। এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। ওদের অগোছালো রুমটা সুন্দর করে গোছানো। নিজেরাই চিনতে পারছে না, যে ওটা ওদের রুম। ওদের এভাবে দেখে তৃণা ভয় পেয়ে গেল।
তারপর ধীরে ধীরে বললো, আমার ভোরে ওঠার অভ্যাস, কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। তাই সব পরিষ্কার করেছি, আর কিচেনে গিয়ে রান্নাও করেছি। আপনাদের না জানিয়ে করেছি। প্লিজ, ক্ষমা করে দিন, আর কখনও করবো না।
ওরা হো হো করে হেসে উঠলো। ববি বললো, একশো বার করবেন। না, মানে আপনার ইচ্ছা হলে অবশ্যই করবেন। তাহলে এই আধমরা মানুষগুলো বেঁচে যাই আর কি!
মন্টু বললো, বাজার তো ছিল না, কী রান্না করলেন ?
তৃণা এবার খুশি হয়ে বললো, সোয়াবিন ছিল দেখলাম, আর আলু করলা ছিল। তাই দুপুরে ভাত, ডাল, করলা ভাজা আর সোয়াবিন আলুর তরকারি করেছি। জলখাবারের জন্য আলু চচ্চড়ি করেছি। আর ময়দা মেখে রেখেছি, গরম গরম লুচি ভেজে দেব।
মন্টু তৃণার মুখের কথা এক প্রকার কেড়ে নিয়ে বললো, গরম গরম! আহা! কতকাল খাইনি। তৃণাদি তুমি ভাজতে শুরু করো। আমরা একে একে ফ্রেশ হয়ে নিই।
তৃণা হেসে কিচেনে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে ওরা সবাই টেবিলে এলো।ইতিমধ্যে তৃণা গরম গরম লুচি, আলু চচ্চড়ি প্লেটে সাজিয়ে ফেলেছে। ওদের খেতে দিয়ে তৃণা চলে যেতে চাইলে, সিঞ্জন বললো, আপনিও চলে আসুন
তৃণা বললো, আমি সকলের চা নিয়ে আসছি।
তারপর তৃণা সকলকে চা পরিবেশন করলো। সকলে জলখাবার খেতে খেতে তৃপ্তির স্বাদ অনুভব করলো। ওদের ভালোলাগা দেখে তৃণাও মনে মনে খুশি হলো। জলখাবারের পর তৃণার কথায় ওরা সকলে মিলে বেডরুমটা পরিষ্কার করে নিল। তারপর স্নান সেরে দুপুরের খাবার খেতে বসলো। সিঞ্জন বললো, আপনার যা রান্নার হাত, আমরা বহুদিন পর এত সুন্দর রান্না তৃপ্তি করে খেলাম।
মন্টু বললো, বাড়িতে গেলেই, মায়ের হাতে এরকম খাবার জোটে তৃণাদি।
ববি বললো, তৃণাদি রাতে মাংস নিয়ে আসব কিন্তু, গরম গরম মাংসের ঝোল আর ভাত করতে হবে তোমাকে।
তৃণা বললো, ঠিক আছে।
এমনি করেই কয়েকদিন কেটে যাবার পর তৃণা বুঝতে পারল, সিঞ্জন মুখে কিছু না বললেও সমস্ত কিছু জোগাড় করতে ওর বেশ সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু তৃণা কী বা করতে পারে, ওকে সাহায্য করার জন্য। পড়াশোনাও তো বেশিদূর করতে পারেনি। অনেক ভেবে চিন্তে একদিন সিঞ্জনকে তৃণা বললো, আমাকে একটু বাইরে নিয়ে যেতে পারবেন ? আমার প্রয়োজন ছিল।
সিঞ্জন কোনো প্রশ্ন না করে বললো, অবশ্যই নিয়ে যাব, কিন্তু রবিবার।
যথারীতি রবিবার সিঞ্জনের সাথে বেরিয়ে প্রথমে গহনার দোকানে গিয়ে ওর গহনাগুলো বিক্রি করে, যেটুকু টাকা পেল সেটা নিয়ে কয়েকটা সুতির শাড়ি এবং সেলায়ের জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি ফিরলো। ববি আর মন্টুকে কৌতূহলে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিঞ্জন বললো, তৃণা ভালো নকশা সেলাই করেন, উনি এই শাড়িগুলোতে নকশা করতে চান।
তৃণা বললো, কীভাবে জানলেন ?
সিঞ্জন কিছু না বলে শুধু হাসলো একটু।
তৃণা আবার বললো, আমি এই কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। এটা কি সম্ভব ?
-পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছুই নেই।সিঞ্জন বললো।
ববি আর মন্টু উৎসাহিত হয়ে বললো, কোনো চিন্তা নেই তৃণাদি, তুমি শাড়িতে নকশা কর, আর ওই শাড়িগুলো আমরা ইন্টারনেটে বিক্রির ব্যবস্থা করবো।
দেখতে দেখতে কয়েক মাসের মধ্যেই তৃনার শাড়ি প্রচুর বিক্রি হতে লাগলো। ও আর একটি মেয়েকে সঙ্গে করে একটা বুটিক শুরু করলো। মেয়েটিকে সিঞ্জনই ব্যবস্থা করে দেয়। তারপর দু'বছরের মধ্যেই ওর ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠলো।
এই দু'বছরের মধ্যে ওদের সকলের জীবনে বহু পরিবর্তনও ঘটেছে। ববি পাশ করে চাকরি পেয়ে অন্য রাজ্যে চলে গেছে। মন্টুর বাবা মারা যাওয়ায় ও গ্রামের বাড়িতে ওদের পারিবারিক ব্যবসায় ঢুকেছে। সিঞ্জন একটি মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানিতে উচ্চপদে নিযুক্ত হয়েছে। আর তৃণা এর মধ্যে ওর স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছে। বোনের বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাবা-মা'র সাথে তেমন যোগাযোগ রাখেনি, তবে প্রত্যেক মাসে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেয়। একটি বড়ো দোকান নিয়ে অনেককে কাজও দিয়েছে।
এখন সিঞ্জন আর তৃণা দু'জনেই ফ্ল্যাটে থাকে। ওদের কোনো কিছুর অভাব নেই। ছুটির দিনে দু'জনে মুভি দেখে, এদিক ওদিক ঘুরতে যায়। দু'জনে মিলে রান্না করে, হাসি মজায় কেটে যায় ওদের দিন। তৃণা এত আনন্দে কখনও কাটায়নি।
এমনি একদিন ছুটির দিনে শীতের সন্ধ্যায় হঠাৎ করে হালকা বৃষ্টি নামলো। সিঞ্জন বললো, আজকে খিচুড়ি কর তৃণা। আমি ডিম আর পাঁপড় ভাজবো খাবার সময়।
তৃণা জমিয়ে খিচুড়ি রান্না করলো। ডিনারের সময় সিঞ্জন গরম গরম ডিম আর পাঁপড় ভেজে নিয়ে এলো। খাওয়ার পর সিঞ্জন বললো, খুব ঠান্ডা আজকে। তৃণা! শোবার আগে এক কাপ কফি করে খাওয়াবে আমায় ? ঘুম আসছে না, মুভি দেখবো একটু।
কিছুক্ষণ পর তৃণা কফি নিয়ে এসে বসলো। দু'-কাপ কফি দেখে সিঞ্জন বললো, তুমিও খাবে নাকি?
-হ্যাঁ, কালকে তো ছুটি আছে, তাই ভাবলাম তোমার সাথে মুভি দেখি।
সিঞ্জন বললো, বসো।
ওরা কফি খেতে খেতে অনেক পুরনো মুভি 'ববি' দেখছিল। হঠাৎ ঝড় উঠল। বজ্র-বিদ্যুৎ সহ ঝম্ ঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। তৃণা আর সিঞ্জন দু'জনেই ছুটল, জানালা বন্ধ করতে। তাড়াতাড়িতে দু'জনে ধাক্কা খেল এবং জলের ঝাপটায় খানিকটা ভিজেও গেল। শীতের রাতে ঘরের মধ্যে এরকম পরিস্থিতিতে একটা রোমান্টিক আবহাওয়ার সৃষ্টি হলো। কেউই নিজেদের সামলাতে পারলো না তৃণা আর সিঞ্জন। ক্ষণিকের দুর্বলতায় দু'টি মন দু'টি প্রাণ এক করে, তারা পরস্পর নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলল উভয়ের মধ্যে। অদ্ভুত এক মিলন রাতের চির সাক্ষী হয়ে থাকলো সেদিনের বর্ষণমুখর নিসর্গ প্রকৃতি, ঘনঘন অশনির নির্ঘোষ আর বিদ্যুৎ- ঝলকের আলো আঁধারিতে ঘেরা ওই নির্জন রুমটা।
কিছুদিনের মধ্যেই তৃণার শরীরে তিষানের অস্তিত্ব বুঝতে পেরে, তৃণাকে আইনত বিয়ে করলো সিঞ্জন, সবার অলক্ষ্যে। অন্যদিকে সিঞ্জনের বাবা মৌমির সাথে সিঞ্জনের বিয়ের পাকা কথা দিয়ে দেন। কিন্তু হঠাৎ মৌমির বাবা-মা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ায়, অনন্যোপায় সিঞ্জনের বাবা পুত্রবধূর পরিচয়ে মৌমিকে বাড়িতে নিয়ে চলে আসেন, সিঞ্জনকে না বলেই। বাবার মর্যাদা রক্ষা করতে এবং সর্বোপরি অসুস্থ বাবার শরীরের কথা ভেবে, শেষ পর্যন্ত তৃণার কথায় মৌমিকে বিয়ে করতে রাজি হয় সিঞ্জন।
-সারা রাত ঘুমাওনি ?আচমকা এমন প্রশ্নে চমকে উঠে তৃণা। পিছনে তাকাতেই দেখলো, সিঞ্জন এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে মাটির ভাঁড়ে করে গরম চা এনেছে দু'-কাপ।
-চলো, বসা যাক।সিঞ্জন প্রস্তাব দেয়।
তৃণা বললো, তুমি নিচে যাও সিঞ্জন, কেউ দেখলে খারাপ মনে করবে।
সিঞ্জন বললো, সময়ের সাথে সাথে বাবাকে ঠিকই মানিয়ে নিতাম আমি। তুমিই বা কেন ?....
-এসব কথা এখন আর কেন ? থাক না! মৌমি খুব ভালো মেয়ে, ওকে কোনো কষ্ট দিও না তুমি।
মন দিয়ে তৃণার পরামর্শ শোনার পরও সিঞ্জনের প্রতিক্রিয়া, তিষানকে ছেড়ে থাকতে পারবো না আমি।
তৃণা সান্ত্বনা দিয়ে বলে, সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। কলকাতায় ফিরে আমি নতুন বাড়িতে শিফট হয়ে যাবো। কারণ আর একসাথে থাকা ঠিক দেখায় না। বাকি জীবনটা তিষানের মাঝেই তোমার স্মৃতি হৃদয়ে নিয়ে কাটিয়ে দেবো আমি।
-আর আমি কাটাবো কীভাবে ?বলে, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তৃণার মুখের দিকে চেয়ে থাকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত সিঞ্জন।
চোখের জল গোপন করে, উদাসীভাবে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে, তৃণা বললো, কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই সিঞ্জন। দেখ, সকালে কেমন সুন্দর আলো ফুটেছে ! প্রার্থনা করি, সূর্যকিরণের মতো আলোকিত হোক তোমার ও মৌমির নতুন দাম্পত্যজীবন।
সিঞ্জন ম্লান মুখে বসে রইলো। তৃণা নিজেই নীচে নেমে এলো । তারপর সমস্ত ব্যস্ত দিনের শেষে ফুলের গন্ধে ম-ম-করা একটা স্নিগ্ধ মায়াবী রাত, নেমে এলো সিঞ্জন ও নববধূ মৌমির ঘরে। অন্যঘরে বিষন্ন তৃণা তিষানকে বুকে জড়িয়ে, নির্জনে সারারাত স্মৃতির পাতা উল্টে মেখে নিলো, গত তিন বছরের ভালবাসার সোহাগ উত্তাপ।
পরদিন সকালে কলকাতা ফেরার জন্য রেডি হলো তৃণা। তিষানকে সঙ্গে নিয়ে সিঞ্জন গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। তৃণা সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, শেষে মৌমির সাথে দেখা করতে গেল এবং বললো, মৌমি! চললাম বোন। ভালো থেকো। আগামী দিনগুলো মধুময় হোক তোমার।
মৌমি তৃণার হাতে একটা ছোট্ট বাক্স ধরিয়ে দিয়ে বললো, এটা তোমাকে উপহার হিসাবে দিলাম। তুমিও খুব ভালো থেকো তৃণাদি।
সিঞ্জন ওদের গাড়িতে তুলে দিল। বললো, কিছুদিন পর এদিকের সমস্ত কাজ সেরে কলকাতা যাব। তিষানকে নিয়ে সাবধানে থেকো তৃণা।
সিঞ্জনের নাড়ানো হাত ফিকে হতে হতে শান্ত জনপথ কোলাহলমুখর রাজপথে মিশে যাওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ওরা ঠিকানায় এসে দাঁড়ালো। রাতে তিষান ঘুমিয়ে পড়ার পর, মৌমির দেওয়া উপহারটা খুলে দেখলো তৃণা। খুব সুন্দর একটা মিনাকরা রুপোর সিঁদুর কৌটো, সাথে একটা চিরকুট,
তৃণাদি! সিঞ্জন, আমার কাছে কিছুই লুকোয়নি। মানুষ সবকিছু ভাগ করলেও নিজের স্বামীকে ভাগ করতে পারে না। কিন্তু সিঞ্জনের বাবার দেওয়া কথার মর্যাদা রক্ষা করতে তুমি আমাকে সেটাও দিয়ে দিয়েছো। তুমি যদি পারো, তাহলে আমি তা পারবো না কেন ? বিয়েতে উপহার হিসাবে পাওয়া, দুটো সিঁদুর কৌটোর একটা তোমাকে দিলাম। আর একটা আমি রাখলাম। দু'জনে না হয় একটা মানুষকে ভাগ করে সিঁথি ভরালাম।
দিদি! সমাজ সংসারকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা বা দুঃসাহস আমার নেই । তাই সাত পাকের বন্ধনের সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে, স্ত্রী হিসাবে আমি সংসার সামলাবো গ্রামে। আর আইনত স্ত্রী হিসাবে ওর ভবিষ্যৎ বংশধরকে সযত্নে আগলে, কলকাতায় সংসার করো তুমি, সম্পূর্ণভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে।
ইতি
তোমার বোন মৌমি
অজান্তে তৃনার চোখের কোণে জলরাশির বান ডাকলো। এই অশ্রুরাশি আনন্দের না দুঃখের, তৃণা তা জানে না। ও কখনো ভাবতেও পারেনি, শেষ পর্যন্ত জীবনটা এমনও হতে পারে।।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন