তিস্তা হত্যা রহস্য - সমীরণ সরকার

 



বেলপাহাড়ি পৌঁছে আমার বন্ধু ফরেস্ট অফিসার অসীম ঘোষ আর তার স্ত্রী সীমার মুখোমুখি যখন হলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা ।অসীম আমার  হাত জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে বাঁচা ভাই কৌশিক।

সীমা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এমনটা যে কখনো হতে পারে তা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি  কৌশিকদা।

- ঠিক আছে ,এত দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই ।আমি তো এসে গেছি। আমাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বল ।

- সেদিন সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা ছিল। দুপুরের পরে আকাশ পরিষ্কার হওয়ায় সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। ঘন্টা দেড়েক  ঘোরাঘুরি করার পর ফিরে আসছিলাম। হঠাৎ কানে এলো একটা অদ্ভুত শব্দ। চিৎকার করলাম, কে, কে ওখানে? সাড়া পেলাম না। হঠাৎ কানে এলো বাইকের গর্জন। জোরে সাইকেল চালিয়ে শব্দটার উৎস লক্ষ্য করে  গেলাম।  দূর থেকে দেখলাম, একটা ঝাঁকড়া মহুয়া গাছের গোড়ায় কে যেন পড়ে আছে। আরেকটু এগোতেই চমকে উঠলাম। একটা মেয়ে। শাড়ি ফালা ফালা। গায়ের জামা ছেঁড়া। দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে টাটকা রক্ত। কানের পাশ দিয়েও রক্ত পড়ছে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। আরে, এ তো আমাদের তিস্তা!

Assam: Dead Body Of Schoolgirl Found Floating In Mayang

- মেয়েটাকে তুই চিনতিস?

- হ্যাঁ, ওর বাবা আগে ফরেস্ট গার্ড ছিল। মেয়েটার নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখলাম তখনো শ্বাস পড়ছে। তাড়াতাড়ি সাইকেলটা একপাশে ফেলে রেখে মেয়েটাকে দু'হাতে তুলে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। পরদিন ভোরের দিকে মারা গেল মেয়েটা ।সেই থেকে পুলিশি ঝামেলা চলছে।

- হুম। পুলিশি ঝামেলা আর হবে না, ব্যবস্থা করে এসেছি। আর কোনো ইনফরমেশন?

- তিস্তার দাদু ছিলেন খাস বিলিতি সাহেব, ডাক্তার মাইকেল জনসন। উনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন আদিবাসী যুবতী ফুলকিকে ।তাদের ভালোবাসার সন্তান মহুয়ার মেয়ে তিস্তা। দাদুর মত পাকা গমের বর্ণ আর মায়ের মতো নিটোল স্বাস্থ্য পেয়েছিল তিস্তা। খুব অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল তিস্তার বাবা। কিন্তু তিন মাসের মধ্যেই তিস্তার স্বামী সাপের কামড়ে মারা গেছিল। বেলপাহাড়ি ফিরে এসেছিল সে। নতুন করে শুরু হয়েছিল আর এক প্রেম কাহিনী।

- মানে?

- ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি তোকে। যজমানদের কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায় করতে গয়া থেকে বেলপাহাড়ি এসেছিলেন অমল ত্রিবেদীর পূর্বপুরুষ নারায়ন ত্রিবেদী। এখানে এসে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। সুস্থ হওয়ার পরে যজমানদের অনুরোধে তিনি এখানেই থেকে যান। স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে আসেন।ভাগ্যদেবীর সহায়তায় ধীরে ধীরে ত্রিবেদীরা  এই এলাকায় ধনী পরিবার রূপে চিহ্নিত হন । 

                অমল ত্রিবেদী ওই পরিবারের ষষ্ঠ পুরুষ। ছোটবেলা থেকেই গান-বাজনা আর ছবি আঁকার দিকে ঝোঁক ছিল তার। বেলপাহাড়ির চতুর্দিকে জঙ্গল, পাহাড়, টিলা, নদী, ঝোরা ইত্যাদি মিলিয়ে অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যের সমাহার। রঙ তুলি ক্যানভাস নিয়ে জঙ্গলের গভীরে চলে যেত যুবক অমল। তন্ময় হয়ে আঁকত প্রকৃতির ছবি। একদিন ফাল্গুনে সৌন্দর্য পিপাসু চিত্রশিল্পী অমল আদিবাসী তরুণী তিস্তার মধ্যে খুঁজে পেল অনন্য সৌন্দর্য। জঙ্গলের মধ্যে ছবি আঁকিয়ে এই বাবুটির প্রতি আগে থেকেই আকৃষ্ট ছিল তিস্তা। দুই ভিন্ন মেরুর যুবক যুবতীর মধ্যে গড়ে উঠলো প্রণয়। ব্যাপারটা কানে পৌঁছালো হরেকৃষ্ণ ত্রিবেদীর। তিনি তিস্তার বাবাকে ডেকে শাসালেন আর ছেলে অমলের বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করলেন। অমলের বিয়ে হল ঝাড়গ্রামে।নববধূ মালা শিক্ষিত, শ্রীময়ী, স্বাস্থ্যবতী। মালার বাবা হরেন মিশ্র ছিলেন মধ্যবিত্ত, চাকুরীজীবী।

    বিয়ে হলো, কিন্তু নববধূ মালাকে কিছুতেই যেন মন থেকে মেনে নিতে পারলো না অমল। ইতোমধ্যে স্বামী হারিয়ে পিত্রালয়ে ফিরে এলো তিস্তা। আবার নতুন করে অমলের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠলো। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন হরেকৃষ্ণ ত্রিবেদী। পারিবারিক উকিলকে ডেকে সমস্ত সম্পত্তির উইল করলেন তিনি। 

- আচ্ছা তোর কি সন্দেহ হয় যে তিস্তার মৃত্যুর সঙ্গে মালা দেবীর কোন যোগাযোগ আছে?

- না ,আমার সেটা মনে হয় না।

- কেন?

- মালা দেবী অত্যন্ত ভদ্র, রুচিশীল, স্বল্পভাষী নরম স্বভাবের মহিলা। উনি এরকম ছোট কাজ করবেন বলে মনে হয় না।


                          [ দুই   ‌‌]


পরদিন সকালে অসীমকে নিয়ে স্পটে গেলাম ।সেই মহুয়া গাছটার থেকে একটু দূরে একটা মস্ত বড় পাথরের চাঁই। ওটা ভালো করে দেখতে গিয়ে নজরে এলো ধুলোমাখা একটা গোলাপী রুমাল। অসীমের অজান্তে পকেটস্থ করলাম সেটা।এরপর অসীমকে সঙ্গে নিয়ে বেলপাহাড়ি থানায় গেলাম।

পরিচয় দিতেই ও.সি. চন্দন সরকার শশব্যস্ত হয়ে বললেন, এস.পি. সাহেবের কাছ থেকে ফোন পেয়েছি একটু আগে। আপনাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার নির্দেশ দিয়েছেন উনি।

- পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা পেয়েছেন?

- আজকেই পেলাম ।

- একটু দেখতে পারি?

- অবশ্যই ।

চন্দন বাবু তাঁর ড্রয়ার থেকে রিপোর্টটা বের করে আমার হাতে দিলেন। রিপোর্টে দ্রুত চোখ বুলিয়ে বললাম, রিপোর্টে লিখেছে "মৃত্যুর কারণ মাথায় আঘাত, গণধর্ষণ এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে হার্ট ফেল"।

- হ্যাঁ ,ওর বাঁ পাশের কপাল ও কানের উপরে একটা লম্বা ক্ষতচিহ্ন ছিল। বেশ রক্তপাত হচ্ছিল সেখান থেকে। অসীম বলল।

- যে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল তিস্তাকে সেটা কি পাওয়া গেছে চন্দন বাবু?

- দু'টো অস্ত্র পেয়েছি অকুস্থলে। একটা কাটারি জাতীয় ভারী অস্ত্র, অন্যটা হাত দুয়েক লম্বা ভারী একটা গাছের ডাল। কাটারিটার গায়ে শুকনো রক্ত লেগেছিল। ওই রক্তের নমুনা পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছিলাম। আমার মনে হয় বাইরে থেকে এখানে কাঠের ব্যবসা করার সূত্রে যারা এখানে আসে, তাদেরই কেউ এই দুষ্কর্মের সঙ্গে যুক্ত।

- আর কাউকে সন্দেহ হয়  আপনার?

- হয়।

- কাকে ?

- অমল ত্রিবেদীর স্ত্রী মালা ত্রিবেদীকে। দুর্ঘটনা যেদিন ঘটে, অমলবাবু সেদিন ব্যবসার কাজে কলকাতায় ছিলেন। এই সুযোগে মালা দেবী যদি কোন ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে......

- মালা ত্রিবেদীর স্টেটমেন্ট নিয়েছেন ?

- আমি ওই বাড়ির সব সদস্য, ঝি-চাকর-ড্রাইভার, এমনকি ওদের ব্যবসার ম্যানেজার প্রশান্ত মন্ডলের স্টেটমেন্টও নিয়েছি।

- আমি একবার ওগুলো দেখতে পারি?

- অবশ্যই, দিচ্ছি ।

- ধন্যবাদ। আচ্ছা চন্দন বাবু, অকুস্থলে অস্ত্র ছাড়া আর কিছু পাননি?

 - একটা ছেঁড়া দোমড়ানো মোচড়ানো কাগজের টুকরো পেয়েছিলাম। তবে ওটা কোন চ্যাংড়া ছেলের কাজ বলে মনে হয়।


টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা ময়লা হলদেটে কাগজ বের করে আমার হাতে দিলেন চন্দন বাবু। খুলে দেখি মাত্র দু'টো লাইন লেখা আছে, "আজ দুপুরেই ফিরব। বিকেলে এস ওখানে।"

ওটা পকেটে রাখতে রাখতে জিজ্ঞাসা করলাম, হরেকৃষ্ণ বাবুর উইল সম্পর্কে কিছু জানা আছে আপনার ?

- না, তেমন কিছু না। শুধু জানি যে, ওইটা ওনাদের পারিবারিক উকিল শ্যামসুন্দর মুখার্জী করেছেন।

- উনি কোথায় থাকেন?

- ঝাড়গ্রামে।

- ওনার সঙ্গে দেখা করা যেতে পারে?

- অবশ্যই। উনি আমার বিশেষ পরিচিত।


                         [তিন]


চার দিন কেটে গেছে। আজ পঞ্চম দিনে জড়ো হয়েছি ত্রিবেদী বাড়ির মস্ত হলঘরে। গত চারদিনে আমি তিস্তার বাবা বোধন টুডু, স্থানীয় ডাক্তার বিনয় বর্মন, হাসপাতালের ডাক্তার চন্দ্রকান্ত সাহা, ত্রিবেদী টিম্বার ওয়ার্কসের ম্যানেজার প্রশান্ত মন্ডল, অমল ত্রিবেদী ও তাঁর স্ত্রী মালা ত্রিবেদী, অমলবাবুর পিসতুতো দাদা অর্থাৎ স্বর্গীয় হরেকৃষ্ণ ত্রিবেদীর একমাত্র ভাগনে চন্দ্রকান্ত তেওয়ারি, সবসময়ের কাজের লোক যদু, মালা ত্রিবেদীর খাস দাসী ময়না, ত্রিবেদী বাড়ির অন্যান্য দাস-দাসী, দু'জন ড্রাইভার এদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।একাধিকবার ঝাড়গ্রাম গিয়ে দেখা করেছি ত্রিবেদী পরিবারের পারিবারিক উকিল শ্যামসুন্দর বাবু, মালা ত্রিবেদীর বাবা হরেন বাবুর সঙ্গে।

যাদের কথা বললাম তারা ছাড়াও উপস্থিত আছেন বিনপুরের বি.ডি.ও. সাহেব, ঝাড়গ্রামের   এস.পি. সুদর্শন সিং এবং বেশ কয়েকজন সশস্ত্র পুরুষ ও মহিলা কনস্টেবল। আমার বন্ধু অসীমও আছে। এস.পি সুদর্শন সিং সাহেবের অনুরোধে শুরু করলাম আমি।

- অন্যান্য যে কোন অপরাধের মতই এই 'তিস্তা হত্যা রহস্যের' পিছনে প্রথম ও তৃতীয় রিপুর ভূমিকাই সক্রিয়। তিস্তা হত্যার ঘটনাটি আকস্মিক হলেও তিস্তা-ধর্ষণ পূর্বপরিকল্পিত ব্যাপার। ঠান্ডা মাথায় তিস্তাকে ধর্ষণের পরিকল্পনা যিনি করেছিলেন, ধরা যাক তাঁর নাম 'ক'বাবু। তাঁর সহকারীর নাম 'খ' বাবু। 'খ' বাবুর সহায়তায় 'ক' বাবু ইতিপূর্বেই এই ত্রিবেদী পরিবারে একটি খুন করেছেন এবং আরো একটি খুন করার পরিকল্পনা করেছিলেন। 

       হরেকৃষ্ণ বাবু মারা যাওয়ার আগে যে উইল করেছিলেন, সেটা আলোচনা করা যাক। উইলে বলা আছে, ভূ-সম্পত্তি কাঠের ব্যবসা ও করাতকল থেকে যা আয় হবে তার এক চতুর্থাংশ ব্যয় করা হবে পারিবারিক দেবতা রাধাগোবিন্দজীউয়ের নিত্য পূজা ও বার্ষিক উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য। বাকি টাকা থেকে একটা নির্দিষ্ট মাসোহারা পাবেন ভাগ্নে চন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ মালা ও ত্রিবেদী বাড়ির পুরাতন সরকার মশাই। বাকি টাকার সমান মালিক হবেন স্ত্রী রাজলক্ষী ও পুত্র অমল। বাকি যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হবেন ওই দু'জনেই। নগদ এককালীন মোটা অর্থের ব্যবস্থা করে গেছেন মালা, ভাগ্নে ও বাড়ির ঝি চাকরদের জন্য। ওদের মধ্যে টাকা ভাগ করে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন পারিবারিক উকিল মশাই শ্যামসুন্দর বাবুকে। হরেকৃষ্ণ ত্রিবেদী উইলে আরও নির্দেশ দিয়ে গেছেন যে, তাঁর মৃত্যুর দিন থেকে পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে পুত্রবধূ মালা সন্তানের মা হতে না পারলে তাঁর অনুমতি নিয়ে অমল পুনর্বিবাহ করতে পারে।আর যদি তিন বছরের মধ্যে পুত্রবধূ মালা সন্তানবতী হন, তবে সেই সন্তানের জন্য উইলে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ও সম্পত্তির বরাদ্দ করেছেন তিনি। 

কিন্তু পুত্রবধূ মালা সন্তানবতী না হলে ওই অর্থ ও সম্পত্তি রাজলক্ষ্মী ও অমলের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে। যদি কোন কারণে অমল বাবু পুনর্বিবাহ না করেন কিংবা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীও নিঃসন্তান হয় তাহলে স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী ও পুত্র অমলের মৃত্যু হলে সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হবেন ভাগ্নে চন্দ্রনাথ বাবু। হরেকৃষ্ণ বাবু মারা যাওয়ার পরে তিন বছর সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। মালা দেবী মা হতে পারেননি। কিন্তু রাজলক্ষ্মী দেবী হঠাৎ ডায়েরিয়াতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। চিকিৎসা করেছিলেন স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তার চন্দ্রকান্ত সাহা।

- হ্যাঁ, আমি ওনার চিকিৎসা করেছিলাম। উনি ডায়রিয়াতে ভুগে মারা গেছেন। চন্দ্রকান্ত বাবু উত্তর দেন।

- আবার ফিরে আসি মূল কাহিনীতে। 'খ' বাবু সাইন্সে জেনারেল ডিগ্রী নেওয়ার পর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজশ করে প্রিন্সিপালের সই জাল করে কলেজ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে গিয়ে ধরা পড়েন। কলেজ থেকে শুধু বিতাড়িত হন তাই নয়, তিন বছরের কারাবাস হয় তার। জেল থেকে বেরিয়ে  জীবিকার সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে একদিন আসেন এই বেলপাহাড়িতে। 'খ'বাবুর বদ নেশা ছিল জুয়া খেলা, মদ্যপান ও নারী লোলুপতা। 'ক' বাবুরও ছিল এক নেশা। ঝাড়গ্রামের এক পতিতালয়ে দু'জনের দেখা হয়, পরিচয় হয়, ঘনিষ্ঠতা হয়। 'খ'বাবুর তখন আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। বাজারে প্রচুর ধারদেনা। 'খ' বাবু 'ক'বাবুকে অনুরোধ করেন তাঁকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে। 'ক' বাবু তাঁদের পারিবারিক ব্যবসায় চাকরি পাইয়ে দেন 'খ'বাবুকে। তার বিনিময়ে 'খ' বাবু এক মারাত্মক খেলায় সাহায্য করেন 'ক 'বাবুকে।

       'ক' বাবুর পথের কাঁটা ছিল দু'জন। তাদের দু'জনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারলে প্রভূত অর্থ ও সম্পত্তির মালিক হবেন তিনি। 'খ' বাবু উপায় বাতলে দেন। তাঁদের সহায়তা করলেন জনৈক ডাক্তারবাবু, মোটা অর্থের বিনিময়ে। খাদ্যে বিষাক্ত দ্রব্য মিশিয়ে 'ক' বাবু তাঁর প্রথম পথের কাঁটাকে হত্যা করলেন ।দ্বিতীয় পথের কাঁটার উপরে সেই বিষ প্রয়োগ করাকালীন পূর্বোক্ত ডাক্তারবাবু জরুরি কারণে কিছুদিনের জন্য বাইরে যান। এবার অন্য একজন ডাক্তারবাবু দ্বিতীয় পথের কাঁটার চিকিৎসা শুরু করেন। সৌভাগ্যক্রমে সুস্থ হয়ে যান তিনি। কিছুদিন পরে আবার সেই প্রথম ডাক্তারবাবু এসে স্লো পয়জনিং শুরু করেন।  'ক' বাবুকে এই সমস্ত কাজে সহায়তা করতেন ওই ধনী পরিবারের এক দাসী। সবই ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু সব বানচাল হলো 'ক' বাবুর প্রথম রিপুর তাড়নায়। 'ক' বাবুর দ্বিতীয় পথের কাঁটার একজন প্রেমিকা ছিল।

      হঠাৎ তাকেই প্রেম নিবেদন করে বসলেন 'ক' বাবু। প্রত্যাখ্যাত হয়ে অপমানিত হলেন। বদলা নিতে তিনি ঝাড়গ্রামে গেলেন, তাঁর এক দুষ্কৃতী মাতাল বন্ধুর সাহায্য নিতে। সেই মাতাল বন্ধুটির আবার এক প্রেমিকা ছিল। তার নাম লতা মাইতি। সে তার প্রেমিককে একটি সুতোর কাজ করা রুমাল উপহার দিয়েছিল। রুমালের কোনায় ছোট করে লেখা ছিল 'ল' অক্ষরটি। এই সে রুমাল। পকেট থেকে সেদিনের কুড়িয়ে পাওয়া গোলাপী রঙের রুমাল বের করে টেবিলের উপর রাখলাম ।

অসীম বলল, এই রুমালটা কোথায় পেলি তুই?

- সেদিন তোর সঙ্গে স্পটে ঘুরতে গিয়ে পেয়েছিলাম। ওই রুমালের সূত্র ধরে ঝাড়গ্রামে একটা হোটেলে আমি লতা মাইতির দেখা পাই ।আর তারপর পৌঁছে যাই সেই আততায়ী কালু সরদারের ডেরায়। 'ক' বাবু টাকা দিয়ে কালু সরদারকে ডেকে পাঠিয়েছিল তিস্তাকে রেপ করতে। উদ্দেশ্য ছিল যে, ধর্ষিতা তিস্তা তার প্রেমিকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হবে। আর তাহলেই সে 'ক' বাবুর করায়ত্ত হবে। তিস্তার কোমরে সবসময় একটা ধারালো কাটারি থাকতো। কালু সরদার ও তার দুই সঙ্গী তিস্তাকে আক্রমণ করতেই তিস্তা কাটারি চালিয়েছিল কালু সরদারের মাথা লক্ষ্য করে। কালু সরদার হাত দিয়ে সেটা ঠেকাতেই মারাত্মক আহত হয়। তিস্তা দ্বিতীয় বার কাটারি চালাতে যেতেই জঙ্গলে পড়ে থাকা একটা শুকনো গাছের ডাল   দিয়ে তিস্তার মাথায় সজোরে আঘাত করে কালু সরদারের সঙ্গী ভীমা। মাটিতে পড়ে যায় তিস্তা। আর তারপরই তাকে রেপ করে গুন্ডাগুলো।

পকেট থেকে চন্দন বাবুর দেওয়া কাগজের টুকরোটা বের করে বললাম, এই সেই কাগজের টুকরো যাতে 'খ' বাবু অমলবাবুর হাতের লেখা নকল করে তিস্তাকে দেখে পাঠিয়েছিল জঙ্গলে।

              আমার কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ ত্রিবেদী টিম্বার ওয়ার্কসের ম্যানেজার প্রশান্ত মন্ডল প্যান্টের পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে আমার মাথা লক্ষ্য করে ট্রিগার টেপে। 

       আমি সশব্দে হেসে বলি, এবারেও আপনি ব্যর্থ প্রশান্ত বাবু। ওতে গুলি নেই। আমার নির্দেশে আপনার ঘনিষ্ঠ ত্রিবেদী বাড়ির দাসী ময়না সব গুলি সরিয়ে রেখেছে। আমার কথা শেষ হতে না হতেই প্রশান্ত মন্ডল ময়নার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার গলা সজোরে টিপে ধরে। ময়না ছটফট করতে থাকে ।

      আমি ছুটে যাই, ছুটে আসে অসীম। কিন্তু কিছুতেই প্রশান্ত বাবুর হাত আলগা করতে পারছিলাম না। ময়নার জিভ বেরিয়ে আসছিল। 

হঠাৎ যদু ঘরের কোণ থেকে একটা ধাতব ফুলদানি তুলে নিয়ে সজোরে আঘাত করে প্রশান্ত বাবুর মাথায়। রক্তাক্ত প্রশান্ত বাবু চিৎকার করে মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে প্রশান্ত বাবুর হাতের কঠিন পেষণে ময়নার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে।

- পাপ, পাপ, এ আমার পাপ! অনেক পাপ করেছি আমি। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে যদু।

এস.পি. সুদর্শন সিং বলেন, কী মর্মান্তিক!

চন্দন বাবু বলেন, আমার তো মনে হচ্ছে হরেকৃষ্ণবাবুর ভাগ্নে চন্দ্রনাথ বাবুই 'ক' বাবু আর প্রশান্ত মন্ডল 'খ' বাবু ।

এস.পি. সাহেব বলেন, এ ব্যাপারে কি তোমার কোন সন্দেহ আছে চন্দন ?

- না স্যার, আমি তো তাই বলছি। তবে একটা কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। চন্দ্রনাথ বাবু কীভাবে তার মামিমা রাজলক্ষ্মী দেবীকে হত্যা করলেন?

 - বলছি। তার আগে দয়া করে গ্রেফতার করুন হাসপাতালের ডাক্তার চন্দ্রকান্ত বাবুকে। উনি ডাক্তার নামের কলঙ্ক। ওনার দেওয়া আর্সেনিক বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয় রাজলক্ষ্মী ত্রিবেদীকে।

"আমি কিছু জানি না" বলে উঠতে যাচ্ছিলেন ডাক্তার চন্দ্রকান্ত সাহা। ও.সি.র নির্দেশে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। 

আমি আবার বলতে শুরু করি, অমলবাবু সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় আমার প্রথমে সন্দেহ হয়। তারপর ডাক্তার বিনয় বর্মনের সঙ্গে কথা বলে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় আমার কাছে। বিনয় বাবু এবারে আপনি বলুন পুরোটা।

বিনয় বাবু বলেন, প্রশান্ত বাবুর অনুপস্থিতিতে একবার আমাকে ডাকা হয়েছিল ত্রিবেদী বাড়িতে, অমল বাবুর চিকিৎসার জন্য।

তখনই আমার মনে হয়েছিল যে ওনার উপরে সূক্ষ্মভাবে আর্সেনিক বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমি চিকিৎসা করে ওনাকে সুস্থ করি।

চন্দন বাবু বললেন, কিন্তু অমল বাবু যে অসুস্থ সেটা আপনি কি করে বুঝলেন কৌশিক বাবু?

বললাম, অমল বাবুর সঙ্গে কথা বলার সময় ওনার নিচের পার্টির দাঁতের উপরে নীল দাগ দেখে, নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ পেয়ে এবং ওনার অসুখের লক্ষণ শুনে। Chronic Mercurial Poisoning Symptom ওগুলো। পরে ডাক্তার বর্মনের সঙ্গে কনসাল্ট করি। তিনি আমার ধারণা সমর্থন করেন। জানতে পারি, ইতোপূর্বে রাজলক্ষ্মী দেবী ডায়রিয়াতে ভুগে মারা গেছেন। আমার সন্দেহ হয়। আর্সেনিক বিষ কারুর উপর প্রয়োগ করলে সে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়বে। রোগের লক্ষণ কলেরা, ডায়রিয়া বা গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের মত হবে। চেপে ধরলাম ত্রিবেদী বাড়ির পুরোনো চাকর যদুকে। যদু স্বীকার করে সে তার প্রেমিকা ময়নার নির্দেশ অনুযায়ী অমলবাবুর শরবতে প্রতিদিন সাদা গুঁড়ো মতো একটা ওষুধ একটু একটু করে মিশিয়ে দেয়। ময়না নাকি তাকে বলেছিল কোন এক সাধুবাবা এই ওষুধ দিয়েছে বৌদিমণিকে, মানে মালা দেবীকে। এই ওষুধ খাওয়ালে দাদাবাবু বৌদিকে ভালবাসবে।

- হ্যাঁ বাবু, ময়না আমাকে সেইরকমই বলেছিল। - ময়নাকে ঝাড়গ্রামের একটা পতিতালয় থেকে তুলে এনে ভাগ্নে বাবুর সহায়তায় এই বাড়িতে কাজে লাগিয়েছিলেন প্রশান্ত বাবু। তাই তাঁর নির্দেশ অনুসারে কাজ করছিল ময়না।

- বুঝলাম। কিন্তু প্রশান্ত বাবু তো দিব্যি চাকরি করেছিলেন। উনি এতকিছু করতে গেলেন কেন ? 

- চন্দন বাবু, ওটা এই কাহিনীর আরেকটা অংশ। ওটা বলার আগে আমি মালা দেবীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

- কেন ?

- ময়নার সহায়তায় মালা দেবীর ডায়েরি চুরি করে পড়ার পর ব্যাপারটা জানতে পেরেছি। প্রশান্ত বাবুর মামারবাড়ি ঝাড়গ্রামে। সেই সুবাদে ঝাড়গ্রাম কলেজে পড়ার সময় প্রশান্ত ও মালা পরস্পর পরিচিত হয়। কলেজে দুষ্কর্ম করার পর প্রশান্ত বাবুর দীর্ঘ কারাবাস হয়। সেই সময়ে মালা দেবীর বিয়ে হয় অমলবাবু সঙ্গে। কিন্তু প্রথম থেকেই স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় তাঁর। প্রশান্ত বাবু এই পরিবারের চাকরী নিয়ে আসার পরে মালা দেবীকে দেখে নতুন পরিকল্পনা তৈরি করেন। চন্দ্রনাথ তেওয়ারি মামিমা রাজলক্ষ্মী দেবী ও মামাতো দাদা অমলকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে সমস্ত সম্পত্তির মালিক হতে চাইলে তাকে সাহায্য করার বিনিময়ে সম্পত্তির মোটা অংশ দাবি করলেন প্রশান্ত। এমনকি অমলবাবুর মৃত্যুর পরে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। নিজের পরিকল্পনার কথা মালা দেবীকে জানালে মালা দেবী প্রশান্তর প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। তখন প্রশান্তকে লেখা মালা দেবীর পুরনো চিঠিপত্র দিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করলেন প্রশান্ত। তখন মালা দেবী স্বামীকে বাঁচাতে তার প্রাক্তন প্রেমিককে পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য গোপনে একটা পিস্তল জোগাড় করলেন। আমি এখানে না এলে এবং হঠাৎ করে তিস্তা-হত্যা হওয়ার পর ঘটনার মোড় অন্যদিকে না নিলে হয়তো এতদিনে মালা দেবীর হাতে নিহত হতেন প্রশান্ত মন্ডল ।

আমার কাহিনী শেষ হয়ে গেল। অদূরে মাথা নিচু করে বসে আছেন মালা ত্রিবেদী। চোখ থেকে ঝরে পড়ছে বুকের সাগর ছেঁচা মুক্তোকণা। অমল বাবু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছেন তাঁর স্ত্রীকে। স্বামী অমলের মনে স্ত্রী মালার কি নতুন কোন রূপ ধরা পড়লো?

জানিনা। হয়তো বা!



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন