–টিকিটটা দেখান।
ক্লান্ত চোখদু'টো বুজে এসেছিল কখন কেজানে। অরিত্রর রুটিন তন্দ্রাটা কেটে গেল। পকেট থেকে মাসিক টিকিটটা বার করতে করতে একবার চেকারকে দেখে নিল। মনে হল, কোথায় যেন দেখেছে! তৎক্ষণাৎ মনে করতে পারলো না। টিকিটটা দেখে চেকার তার হাতে ফেরত দিয়ে এগিয়ে গেল। অরিত্র প্রায় দু'বছর বনগাঁ লাইনে যাতায়াত করছে। চেকিং প্রায়ই হয়। বেশ কিছু টিটি প্রায় পরিচিত হয়ে গেছেন। কিন্তু এইরকম বয়স্ক কোন টিটি সে এতদিন দেখেনি, আর এনাকে তো নয়ই। যাই হোক, প্রৌঢ় ভদ্রলোককে বেশ পরিচিত বলেই মনে হচ্ছে তার। অন্যদিনের মত হলে বনগাঁ থেকে শিয়ালদা পুরোটাই প্রায় ঘুমোতে ঘুমোতে আসে অরিত্র, কিন্তু আজ আর তার ঘুম আসছে না।
ততক্ষণে চেকার ভদ্রলোক পাশের দু'তিনজনকে দেখে একেবারে জানালার ধারে বসা এক কমবয়সী ছেলেকে টিকিট দেখাতে বললেন। ছেলেটা একটুখানি চেকারকে দেখে টিকিট বার করার ভান করতে লাগল। চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল ভয় পেয়েছে। জামার বুকপকেট থেকে একগাদা কাগজপত্র বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে খুঁজতে লাগলো টিকিট। মিনিটখানেক এভাবে কাটার পর একটা টিকিট চেকারের হাতে গুঁজে দিল। চেকার ভদ্রলোক টিকিটটা ভালো করে দেখে বলে উঠলেন,
–আরে এটা তো আট তারিখের টিকিট! আজকে তেরো তারিখ। আপনি আজকের টিকিট দিন! আর না হলে উঠে আসুন।
ছেলেটার সমস্ত মুখ ঘামে ভর্তি হয়ে উঠেছে। গম্ভীর গলায় এবার চেকার বলে ওঠেন,
–তুমি বেরিয়ে এসো!
গলাটা শুনে চমকে উঠলো অরিত্র! খুব চেনা! খুব চেনা এই স্বর। এই গলার সঙ্গে তার পরিচয় আছে এটা ঠিক, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না। এদিকে ছেলেটা বেশ ভীত মুখে চেকারের সঙ্গে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। রাত্রের ট্রেন। বেশি ভিড় নেই, ছেলেটাকে আড়াইশো টাকা বার করতে বলে বিল বই বার করতে ব্যাগ খুললেন চেকার, কিন্তু ছেলেটা এই পকেট সেই পকেট ঘেঁটে কিছু খুচরো টাকা বের করল। এবার চেকার ভদ্রলোকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল বোধ হয়! অরিত্র মনে মনে বললো, আহা রে, ছেলেটার ভাগ্যে আজ লকআপ একেবারে অবধারিত। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই বিস্মিত হয়ে দেখল চেকার ভদ্রলোক ওই ছেলেটার হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে আস্তে আস্তে কিছু একটা বলে সামনে এগিয়ে গেলেন। ছেলেটা যেন একটু স্বস্তি পেয়ে আবার আগের জায়গায় এসে বসলো।
..................................
অটো থেকে নেমে অরিত্রকে আর বেশিক্ষণ খুঁজতে হলো না। মেইন রোডের গায়েই দেখল "স্বস্তি বৃদ্ধাবাস"। সেদিন বাড়ী ফিরতে ফিরতেই মনে পড়েছিল চেকার ভদ্রলোকের পরিচয়, বিনয়কাকু। সায়নের বাবা। সায়ন ওদের সঙ্গে পড়তো, ম্যাথ অনার্স। ওর বাবাকে মনে থাকার আরও একটা কারণ আছে, উনি খুব সুন্দর আবৃত্তি করতেন। বহুবার সায়নদের বাড়ি গেছে অরিত্র। ওর বাবার আবৃত্তি শুনেছে। তাই বোধহয় সেদিন ট্রেনে ওনার গলার স্বরটা অত বেশি পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল। গত রবিবার সায়নদের বাড়ি গেছিল অরিত্র, কারণ ও যতদূর জানতো সায়নের বাবা কোন প্রাইভেট সংস্থার অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন এবং বর্তমানে তার বয়স অন্তত সত্তর হওয়ার কথা। ফলে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে কোন যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছিল না অরিত্র। অস্থির হয়ে উঠছিল মনে মনে। অনেক ভেবে যেটা বুঝতে পারল, কোথাও একটা গন্ডগোল আছে। হয় উনি বিনয়কাকু নন, আর যদি বিনয়কাকু হন, তাহলে উনি কিছুতেই চেকার হতে পারেন না! তাহলে এটা কোন ফ্রড কেস? নকল চেকার? কিছুদিন আগেই এরকম একটা খবর পড়েছিল কাগজে। সম্ভবত হাসনাবাদ লাইনে।
সায়নরা থাকতো সোনারপুরের একটু ভিতরে। অরিত্র সেখানে পৌঁছে দেখল, যেখানে সায়নদের বাড়ি ছিল সেখানে এখন বিরাট একটা কারখানা। কয়েকজন প্রতিবেশীকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো, প্রায় দু'বছর আগে সায়ন কোনভাবে বাবাকে ফাঁকি দিয়ে বাস্তুভিটে বেচে দেয় ওই কারখানার মালিকের কাছে। তারপর বাবাকে নামমাত্র টাকা দিয়ে ওই বৃদ্ধাবাসে রেখে দিয়ে টাকাপয়সা সব আত্মসাৎ করে দিল্লি চলে যায়। শোনা যায় সেখানে বিয়ে করে সেটল হয়েছে। এসব শুনে অরিত্রর মনে হয়েছিল সন্তান কখনো আশীর্বাদ আবার কখনো অভিশাপ! তার নিজেরও একটা ছেলে আছে। সাত বছর বয়স। কেজানে ভবিষ্যৎ কী!
সায়নের বাবাকে খুঁজে পেতে দেরী হলো না অরিত্রর। উনি এই বৃদ্ধবয়সেও বেশ বিখ্যাত ওনার আবৃত্তির জন্য। অরিত্রর মনে হলো এখানকার যাঁরা বৃদ্ধাবাসে থাকেন তাঁরা সবাই ওনাকে বেশ ভালোবাসেন। অরিত্রকে দেখে বেশ চমকে উঠলেন যেন। বললেন,
–তুমি সেদিন ট্রেনে ছিলে। আমি দেখেছি। ভাবলাম কথা বলি, কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে কিছু বলিনি। অথচ দেখো তুমি ঠিক খুঁজে খুঁজে চলে এলে। কেমন আছো? কবিতা লেখাটা ছাড়োনি তো?
অরিত্র বলল,
–না, লিখি এখনও। আপনার জন্য একটা বইও এনেছি। কিন্তু..
ওকে শেষ করতে না দিয়েই সত্তর বছরের পক্ককেশ বৃদ্ধ বিনয় দে বলতে লাগলেন,
–জানি তুমি কি প্রশ্ন করবে। কিন্তু কিছু করার ছিল না অরিত্র! জানি এটা অন্যায়, প্রতারণা। ধরা পড়লে অনেক কিছুই হতে পারে। কিন্তু একরকম বাধ্য হয়েই আমরা এই কাজ করেছি।
চমকে উঠলো অরিত্র!
–আমরা মানে! আরো কেউ ছিল নাকি?
মুখটা মাটির দিকে নামিয়ে উনি বললেন,
–হ্যাঁ আমরা সাতজন ছিলাম। আসলে সুভাষবাবুর নাতির দু'টো কিডনি অচল হয়ে গেছে। অন্তত একটা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার দরকার খুব শিগগির। সেজন্য হাসপাতাল চেয়েছে সাত লাখ টাকা। এখানে যার যা জমানো ছিল সবকিছু দিয়েছি আমরা। সুভাষবাবুর ছেলে বাড়ি-ঘর বেচে কিছুটা জোগাড় করেছে আর এখানকার ডোনেশনে সাড়ে তিন লাখ মত উঠেছে। তাই আমরা চেষ্টা করছিলাম যদি আরো কিছু টাকা জোগাড় করে দেওয়া যায়। তবে এই মুহূর্তে আর খুব বেশি অসুবিধা নেই। দু'টো এনজিও সাহায্য করছে। আশা রাখি বাচ্চাটা বেঁচে যাবে, আমরা তো সেই চলেই যাব। ওরা অন্তত বাঁচুক। আনন্দে উপভোগ করুক জীবনটাকে। আরে, ওইতো সুভাষদা! কোথায় ছিলে? বাগানে? এই দেখো আমার ছেলের বন্ধু অরিত্র। সেদিন ট্রেনে দেখেছে! খুঁজে খুঁজে ঠিক চলে এসেছে।
অরিত্র দেখল অশক্ত একজন বৃদ্ধ, অন্তত বছর আশি বয়স হবেই, হাতে একটা খুরপি নিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে। দু'চোখে জল এসে গেল তার। সারাজীবন তো বাগানই করলেন এঁরা। স্ত্রী পুত্র-কন্যা নিয়ে ভরন্ত সংসারে একসময় এঁরা ছিলেন অপরিহার্য প্রাণবায়ু। আর আজ? অর্থ নেই, ফলে প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়েছে। সেই শিশু গাছগুলো আজ মহীরুহ, কিন্তু শিকড়টা ভুলে গেছে একেবারে। অথচ এঁরা এখনও শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও সেই বাগানটাকেই বাঁচিয়ে, সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন। অদ্ভুত বৈপরীত্য! অদ্ভুত বৈচিত্র!
–কাকাবাবু, আজ আমি আসি। এই প্যাকেটে কিছু খাবার আর বইটা আছে। আমি আবার আসবো।
পিতৃহীন অরিত্র যেন একসঙ্গে তার বাবার অনেকগুলো বিভিন্ন আকার আকৃতি এবং মুখাবয়বের অস্তিত্ব খুঁজে পেল আবার।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন