"আউট - আউট! বি. রয় বোল্ড! ক্লিন বোল্ড!"
আম্পায়ার মাথার উপরে বিশিষ্ট নির্দেশ-সূচক আঙুল তুলে বি. রয় এর উইকেট পতনের পরোয়ানা জারি করেছেন। 'আম্পায়ার'স কল ইজ কল।' তাই বি. রয় অর্থাৎ বন্ধন রায় কাঁধে ব্যাট ফেলে প্যাভেলিয়ন মুখী হয়েছে। ক্রিজে আসার পর মাত্র তিনটে বল খেলেছে বন্ধন।প্রথম বলটা একটু নীচু হয়ে এসেছিল। সাবধানী ও সতর্ক বন্ধন ওই বলটা খেলবার মত কোন ঝুঁকি নেয়নি। দ্বিতীয় বলটাতে গতি হঠাৎ বেড়ে যায়। বন্ধন ব্যাট চালিয়েছিল শেষ মুহূর্তে। কোন রান সম্ভব হয়নি, বিপদও কিছু ঘটেনি। কিন্তু দিনের তৃতীয় বলটি সোজা এসে উইকেটে ধাক্কা দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বন্ধন রায় বোল্ড।
প্যাভেলিয়নে ফেরবার পথে গাল্যারী থেকে বি. রয় এর উদ্দেশ্যে কিছু খিস্তি বর্ষিত হল।দর্শকদের আসন থেকে কে একজন হেঁড়ে গলায় বলল, "এটা পুরো হাফ কেলানে মাইরি।এমন পয়মাল কে কেন যে মাঠে নামায়!" আবার একজন হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে বলে উঠল, "দাদা কি নেবুর বলে প্যাকটিস করেছেন নাকি? এইচ -ডি পাল কোথাকার!"
বি. রয় অর্থাৎ বন্ধন রয় আজকাল দর্শকদের এইসব বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ভালো খেলতে না পারার জন্য এইসব অভিযোগ গালাগাল শোনাটাই স্বাভাবিক। তবে এসবে খারাপ তো লাগেই। কাঁটার আঘাত তো জ্বালা দেয়ই।
বন্ধন কলকাতার একটি ক্রিকেট দলের একদা নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান। একসময় কলকাতার ক্রিকেট বোদ্ধাদের কাছে মাঠের হিরো। ওর খেলার স্টাইল নিয়ে মিডিয়াতে নানা প্রশংসাসূচক আলোচনা হয়েছে। সবাই বলত, "গুরু, এ শিওর শচীন নইলে সৌরভ।"
নুঙ্গী স্কুলে ছাত্র থাকাকালীন ওর খেলোয়াড় জীবনের শুরু। প্রথমে এন.এস.এ মাঠে ও পরে বাটা স্টেডিয়ামে খেলা প্র্যাকটিস করত বন্ধন। ওর প্রথম কোচ তখন রাধাবল্লভ চৌধুরী। ঘন্টার পর ঘন্টা চড়া রৌদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে নেট প্র্যাকটিস করত বন্ধন। বাড়ির অবস্থা ভালো না হলেও বাবা ধারদেনা করে খেলার সব সরঞ্জামই কিনে দিয়েছিলেন। রাধাবল্লভ স্যার ওকে ভালোবাসতেন খুব। কিভাবে ব্যাট ধরতে হয়, কিভাবে কোন পরিস্থিতিতে আক্রমণ মোকাবিলা করতে হয়, কিভাবে আক্রমণ রচনা করতে হয়, স্যার অনেক যত্ন করে ওকে শিখিয়েছিলেন। বন্ধনের উপর অনেক আশা ছিল সেদিন স্যারের। বলতেন, "তুই পারবি, শুধু আত্মবিশ্বাস আর পরিশ্রম বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে হবে।"
সেই বিশ্বাসের উপরে ভর করেই বন্ধন এতদিন মাঠে দাপটের সঙ্গে খেলে গিয়েছে। দলের তিন নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে চারদিকে ওর নাম ডাক হয়েছে। ওর খেলার মধ্যে একটা অভিনবত্ব আছে যা সহজেই দর্শকদের প্রশংসা আদায়ে সক্ষম হয়েছে। অথচ, ইদানিং মাঠে গিয়ে ক্রিজে বেশিক্ষন দাঁড়াতে পারছে না বন্ধন। ব্যাড প্যাচ যাকে বলে।
সেদিন মা গীতাদেবী তাকে বলছিলেন, "খেলোয়াড় না হয়ে তুই যদি একটু মন দিয়ে পড়াশোনা করতিস, তাহলে একটা চাকরি পেতিস বন্ধন।"
বাবা মা-কে বলছিলেন, "প্লেয়ার হচ্ছে,না গুষ্টির মাথা হচ্ছে!"
বাবা একটা বেসরকারী কারখানায় কেরানীর চাকরি করেন। উপার্জন সামান্য। কোনরকম করে সংসারটা চলে যায়। বন্ধনের ছোট বোন অর্পিতা বি.এ. পাস করে বসে আছে। কয়েকটা টিউশনি করে। ওর বিয়ের ব্যাপারে চেষ্টাচরিত্র চলছে। কিন্তু শ্যামবর্ণা হওয়ায় পাত্রপক্ষ পরে জানাবে বলে আর কখনো ফিরে আসেনি। বন্ধনের বাবার চাকরি আর বেশিদিন নেই। অবসর নেওয়ার পর খুব একটা বেশি অঙ্কের টাকাপয়সা পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। তাই তিনি ভাবছিলেন তাঁর চাকরী থাকতে থাকতে অর্পিতার বিয়েটা দিয়ে যেতে পারলে অনেকটা হালকা লাগতো।
বন্ধন এসব ব্যাপারে যে ভাবনাচিন্তা করে না, তা নয়। বাবার পাশে দাঁড়াতে ওর খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু পড়াশোনায় ও কোনদিনই আহামরি কিছু নয়। বরং খেলার মাঠ ওকে অনেক বেশি কাছে টানে। ক্লাব ক্রিকেট খেলে একসময় যথেষ্ট তারিফ পেয়েছিল একদিন ও। কাগজে খেলার পাতায় ওকে নিয়ে প্রশংসাসূচক আলোচনা ছাপা হয়েছিল। অনেকেই বলছিলেন, ছেলেটার সম্ভাবনা আছে। ওর মধ্যে একটা আক্রমনাত্মক ব্যাটসম্যান যে লুকিয়ে আছে, সেটা ক্রীড়া বিশেষজ্ঞেরা অনেকেই বলেছিলেন।
একদিন এই খেলার সূত্রেই ভাস্বতী সান্যালের সঙ্গে ওর আলাপ। বড় ম্যাচ ছিল ফ্লাড লাইটের আলোয়। বন্ধন সেদিন বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে সংহার মূর্তিতে ব্যাট করেছিল। দর্শকদের অভিনন্দনে সেদিন ভেসে যেতে হয়েছিল ওকে।অপরাজিত থেকে বন্ধন সেদিন দেড়শো রান একাই করে বসে। গ্যালারিতে হইচই পড়ে যায়। ব্যাটিংয়ের দাপটে সেদিন কলকাতা মাঠের হিরো হয়ে যায় বন্ধন। দর্শকরা ওকে কাঁধে তুলে মাঠে চক্কর কাটে। আসলে, বন্ধন লড়াইটা জানতো। ওর মনে হয়েছিল নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে একদিন ভারতীয় ক্রিকেটে নিজের জায়গা করে নিতে পারবে। ভালো খেলতে পারলে আত্মবিশ্বাস জাগা স্বাভাবিক।
ভাস্বতী তখন টেলিফোন ভবনে চাকরি করত।ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে এসে বন্ধনকে বলে, "একটা অটোগ্রাফ প্লিজ!" খুশিমনে বন্ধন ওর ডাইরিতে লিখে দিয়েছিল, "শুভেচ্ছাসহ, বন্ধন রায়।"
সেই প্রথম সাক্ষাৎ। তারপর কতবার পার্কস্ট্রিট, আকাশবানী ভবনের রাস্তায়, কফিখানায়, কিংবা আউটট্রাম ঘাটে দেখা হয়েছে দু'জনের। মিলেনিয়াম পার্কে যেতে যেতে একবার ভাস্বতী বন্ধনকে বলেছিল, "অ্যাই তোমাকে ভালো খেলতে হবে কিন্তু! তোমার জন্য আমার খুব গর্ব হয়।"
বন্ধনের কাছ থেকে জবাব এসেছিল, "চেষ্টা তো করছি।"
ভাস্বতীর কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়েছিল উচ্ছ্বলতা, "যখন সবাই খেলার জন্য তোমার প্রশংসা করে, আমার দারুণ লাগে।"
বন্ধন বলেছিল, "আমার পাশে চিরদিন থাকবে তো?"
ভাস্বতী তখন ওর হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে নেয়। বলে, "আমি তোমার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করে থাকবো।"
বন্ধন জানায়, "খেলার জন্য কয়েকটা সংস্থা থেকে চাকরির অফার আসছে। একটু দাঁড়িয়ে নিই, তারপর তোমার মা বাবার কাছে গিয়ে তোমাকে পাওয়ার জন্য দাবি জানাবো।"
কত স্বপ্ন, কত আশা, কত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল বন্ধনের। অথচ ইদানিং খেলাটা পড়ে গেছে ওর। মাঠে গিয়ে বেশিক্ষন ক্রিজে দাঁড়াতে পারছে না বন্ধন। খেলার জন্য যারা একদিন ওকে মাথায় তুলেছিল, আজ তারাই ওকে আর সহ্য করতে পারছে না। দোষটা দর্শকদের নয়। আসলে, বন্ধনের খেলায় আগেকার সেই ধার আর নেই। হঠাৎ করে খেলার মাঠে এভাবে দুর্যোগের মেঘ নেমে আসবে, বন্ধন কখনো স্বপ্নেও একথা ভাবেনি। বাড়িতে মা-বাবা ওর সমালোচনা করছেন, মাঠে নেমে আউট হয়ে গেলে দর্শকদের দিক থেকে ক্রমাগত ক্ষোভের বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছে। একসময় অনুরাগীরা সবসময় ঘিরে থাকত ওকে। এখন ওর পাশে কেউ নেই। জীবন কখনো কখনো এভাবেই মানুষের পরীক্ষা নেয়। ক্লাব কর্তারা অনেকেই এখন ওকে এড়িয়ে চলেন। বন্ধন বুঝতে পেরেছে, খেলায় ভাল পারফরম্যান্স দেখাতে না পারলে কোনো ক্লাবেই ওর আগামীতে জায়গা হবে না।
ইদানিং বন্ধন নিজেকেও সহ্য করতে পারছে না। বাড়ি ফিরে বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ব্যঙ্গ করে বলছে, আমি একটা যাচ্ছেতাই। আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। খেলা পড়ে যাওয়ায়, সিএবি-র কর্মকর্তারা ইদানীং ওকে পাত্তা দিচ্ছেন না। আবার অনাহুত রবাহুত হয়ে কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে হাত কচলানো, সেটা আবার বন্ধনের স্বভাবে নেই। চারদিকে অন্ধকার দেখছে এখন বন্ধন। ওর স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে খান খান। বাড়িতে শান্তি নেই, খেলার মাঠে শান্তি নেই, ভাস্বতীও এই দুর্দিনে ওকে একলা ফেলে চলে গেছে। সেই থেকে বন্ধন বড় একা। ভালোবাসা ওর কাছে এখন জলাতঙ্ক। ভালবাসতে ভয় করে আজকাল ওর। মনে হয়, ওর জাহাজে দাউদাউ আগুন। মনে হয়, দুরন্ত দুপুরে কতদিন ও একা একা দৌড়চ্ছে। ওর জন্য কোনো ছায়াময় গাছ নেই। এভাবে কি একলা বাঁচা যায়!
এক ক্লাব-কর্তা দেবু দত্ত সেদিন ওকে ডেকে বলেছেন, "এই ক্লাবে আপনাকে রাখা যাবে না।নেক্সট সেশানে আপনি অন্য ক্লাব দেখুন।"
খেলা পড়ে যাওয়ার পর ভাস্বতীও আজকাল ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। অথচ আগে আগে ভাস্বতীর ফোন আসত রাতের দিকে। কোনো কোনো দিন বন্ধনও ভাস্বতীকে ফোন করত।
-হ্যালো
-কে?
-বলতো কে?
-জানি না।
-তবে রেখে দিলাম।
-এই শোনো শোনো। আজ বিকেলে একবার দেখা করো না আমার সঙ্গে।
-কেন, কি ব্যাপার?
-আমার অফিস-কলিগ মোহর আর সোনালী একবার তোমাকে সামনাসামনি দেখে কথা বলতে চায় ।
-কখন যাব ?
-ঠিক বিকাল সাড়ে-পাঁচটায়।
-ঠিক আছে, যাব।
অন্য একদিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে ও আর ভাস্বতী হাঁটতে গিয়েছিল।
ভাস্বতী জিজ্ঞাসা করে, "আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কি ঠিক করলে?"
বন্ধন বলে, "একটু সময় দাও, একটু দাঁড়িয়ে নিই, তারপর.."
ওরা এরপর বোটানিক্যাল গার্ডেনে আসল বটগাছটা খোঁজবার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালায়। সন্ধ্যেবেলায় বাইরে বেরিয়ে আসে। ভাস্বতী সেদিন গেয়েছিল, চাঁদ উঠেছিল গগনে।
সত্যি সত্যি তখন আকাশের থালার মতো চাঁদ। বন্ধন সেসব দিন ভুলতে পারে না। না পারাই স্বাভাবিক।
অথচ, আজকাল বন্ধনের সঙ্গে প্রায় যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে ভাস্বতী। বন্ধন একদিন টেলিফোন-ভবনে ওর সাথে দেখা করতে গেলে ভাস্বতী ওকে বলেছে, "তোমার জন্য মাঠে যাওয়া বন্ধ করতে হবে আমাকে। কি যা-তা খেলছ আজকাল তুমি!"
বন্ধন লোকমুখে জেনেছে, ইদানিং ভাস্বতী অফিস কলিগ সুদীপ্ত মুখার্জি বলে এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে নতুন করে প্রেম শুরু করেছে। বন্ধন ভাস্বতীকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, ও একদিন ঠিক ঘুরে দাঁড়াবেই।ভাস্বতী সেসব কথায় আমল দেয়নি। ফুটো নৌকায় কেউ উঠতে চায় না।
অনেকদিন হলো বন্ধন মাঠমুখো হয় না। খেলা পড়ে যাওয়ায় ওর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছে। ও যে কখনও ভালো ব্যাটিং করত, আজ সেসব কথা ওর গল্প বলে মনে হয়। নিজের অতীত গৌরব ওকে উপহাস করে। আজকাল এইসব কারণে দারুন মানসিক অবসাদে ভুগছে বন্ধন।
সেদিন সকালে বন্ধন নিজের ড্রয়িংরুমে বসে, ওর কোচ সিদ্ধার্থ মিত্তিরের ফোন এল, "মন খারাপ কোরো না। সব পেশাতেই মাঝে মাঝে ব্যাড প্যাচ আসে। তুমি আমার বাড়িতে এসো , কথা আছে।"
বন্ধন পরেরদিন সকালে কোচের লেকটাউনের ফ্ল্যাটে হাজির। কলিংবেল বাজাতে ওনার মেয়ে কঙ্কনা দরজা খুলে দিল।
-বসুন! বাপি বাথরুমে, আপনাকে বসতে বলেছেন।
বন্ধন সোফায় বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিল। কোচ এলেন।
"তোমার সঙ্গে আমার মেয়ে কঙ্কনার পরিচয় নেই বুঝি! ও নাম করা ইন্টিরিয়ার ডেকরেটর।আর মামণি, ও হল বন্ধন রায়। ভালো ব্যাটসম্যান। ইদানিং ওর খেলাটা একটু ডাউন-পজিশনে। শীঘ্র কাটিয়ে উঠবে নিশ্চয়ই।"
কঙ্কনা মুগ্ধ চোখে বন্ধনের দিকে তাকালো।কপাল থেকে উড়ু উড়ু চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল, "আপনার খেলা কখনো দেখিনি, তবে বাপির কাছে আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি।আপনার খেলার স্টাইলটা অনেকটা নাকি মনসুর আলি খান পতৌদির মতো।"
বন্ধন লজ্জায় পড়ে যায় কঙ্কনার কথা শুনে।
কোচ বলেন, "তুমি আজকাল মাঠে আসছ না কেন? কাল থেকে তোমায় মাঠে দেখতে চাই।"
বন্ধন বিদায় নেওয়ার সময় কঙ্কনা বলল, "আবার আসবেন।"
বন্ধন মনে মনে ভাবে, "আমার এই অন্ধকার জীবনে তুমি আলো হবে? আমি তাহলে আরেকবার ঘুরে দাঁড়াবো। ভাস্বতী আমাকে অন্ধকারে একলা ফেলে চলে গেছে, সেই থেকে আমি ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি।"
তারপর নিজেকে বকলো বন্ধন। কী যা তা ভাবছিল এখন ও!
সেদিন প্র্যাকটিস থেকে ফেরার পথে সামনে একটা স্যান্ট্রো গাড়ী এসে বন্ধনের সামনে দাঁড়ালো। স্টিয়ারিংয়ে কঙ্কনা। হাসি হাসি মুখে বলল, "উঠে আসুন। বাড়ী যাবেন তো?"
সামনে উঠে বসল বন্ধন।
-প্র্যাকটিস সেরে ফিরছেন?
-হ্যাঁ।
-বাপি বলছিল মাঠে আপনি খুব ঘাম ঝরাচ্ছেন।
-তাই বুঝি! কিন্তু কনফিডেন্স পাচ্ছি না।
-পাবেন পাবেন। শূণ্য থেকে শুরু করুন।
বন্ধন মনে মনে বলল, তুমি তো জানো না কঙ্কনা, আমি একজন হেরো মানুষ। ভাস্বতী আমায় একলা ফেলে গেছে, সেই থেকে আমার ইচ্ছাশক্তিটাও তলানিতে। ততক্ষণে বন্ধনের বাড়ি এসে গেছে। গাড়ী থেকে নেমে পড়ল সে।কঙ্কনাকে বলল, "আসুন না, মায়ের সঙ্গে আলাপ করবেন।"
কঙ্কনা বলে, "আজ নয়, অন্যদিন এসে মাসিমার হাতে চা খেয়ে যাব।"
"আপনি এলে ভালো লাগবে।" বলে বন্ধন।
"আসব তো। আমি একজন যোগ্য মানুষের হেরে যাওয়া দেখতে রাজী নই।" কঙ্কনা বলে
গলির মোড়ে এরপর ওর গাড়ী মিলিয়ে গেল।
দিন সাতেক বাদে কঙ্কনা একদিন বন্ধনের বাড়িতে এসে হাজির। বন্ধন ওর মাকে ডাকলো, "মা, দ্যাখো কে এসেছে!"
গীতাদেবী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বন্ধন পরিচয় করিয়ে দিল, "মা, এ কঙ্কনা, বড় ইন্টেরিয়ার ডেকোরেটর। ওর বাবা আমার কোচ। বলতে গেলে আমি মাঠের বাইরে ছিলাম, উনি আমাকে আবার মাঠের ভিতরে আনতে পেরেছেন।"
কঙ্কনা বন্ধনের মাকে প্রণাম করল। গীতাদেবী বলেন, "তোমরা বসে কথা বলো, আমি তোমাদের জন্যে জলখাবার আনছি।"
"না মাসিমা, আপনি বসুন। আমি চা করে আনছি।" শাড়ি পেঁচিয়ে কঙ্কনা রান্নাঘরে ঢুকে যায়।
চা খেয়ে বলে, "মাসিমা, আজ চলি।"
গীতাদেবী বলেন, "আবার এসো।" তারপর বন্ধনের দিকে চেয়ে বললেন, "যা তুই ওকে একটু এগিয়ে দিয়ে আয়।"
পথে নামতেই কঙ্কনা বলল, "আপনার মাকে কী ভালো লাগলো! শ্রদ্ধায় মাথা আপনিই নুইয়ে আসে।"
বন্ধন বলে, "আপনি এলেন, আমাদের ভালো লাগলো।"
"আমি আবার আসবো, আপনাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। আমি জানি, আপনি খেলার মাঠে নিজেকে ঠিক একদিন প্রমাণ করতে পারবেন। সেদিন আবারও আসবো।"
কঙ্কনার কথার জাদু আচ্ছন্ন করে ফেললো বন্ধনকে। পূর্ণ উদ্যমে আবার মাঠে ঘুরে দাঁড়াবার জন্য উঠে-পড়ে লাগলো। মনে মনে বলল, এ লড়াই অন্য কারোর সঙ্গে নয়, এ লড়াই আমার নিজের সঙ্গে। আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে হবে সৌরভ গাঙ্গুলীর মতো। খেলার মাঠ আজ থেকে আমার কাছে যুদ্ধক্ষেত্র।
সেদিন মাঠে প্র্যাকটিস সেরে বাড়ি ফেরার পথে আবার কঙ্গনার সঙ্গে দেখা।
"প্র্যাকটিস থেকে ফিরছেন?"
"হ্যাঁ।"
"কাগজে আপনার খেলা নিয়ে প্রশংসা বেরিয়েছে।"
"শুনেছি।"
"বলেছিলাম না আপনি পারবেন!'
"চেষ্টা তো করছি।"
"আপনি আমাকে ফোন করেন না কেন?"
"আপনি যদি কিছু মনে করেন।"
"ফোন না করলে মনে তো করবোই।"
"তাই নাকি! তাহলে তো আপনাকে ফোন করতেই হবে!"
"হ্যাঁ, মনে থাকে যেন!"
"তাই হবে। চলি তাহলে।"
ইতিমধ্যে ক্লাব-পর্যায়ের খেলায় বন্ধন ভালো রান পেতে শুরু করেছে। ইদানিং খেলায় যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে ওর। ঘন্টার পর ঘন্টা খুব মনোযোগ দিয়ে নেট প্র্যাকটিস করেছে ও। প্রবল রোদে ঘাম ঝরিয়েছে। কোচের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছে। দলের তিন-নম্বর ব্যাটসম্যান হিসাবে ওর জায়গা প্রায় পাকা। ইন্ডিয়া-টীমে বন্ধনকে নেওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে শলা-পরামর্শ চলছে। মিডিয়ায় বি. রয়-কে নিয়ে জোরদার জল্পনা শুরু হয়েছে। পত্রপত্রিকায় ওকে নিয়ে আজকাল লেখালিখি চলছে।
বন্ধন বরাবর সৌরভ ভক্ত। মনে মনে বলছে --দাদা যদি ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তাহলে আমি পারব না কেন! আমাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে।
বন্ধন ভালো খেলতেই দেবু দত্ত তাকে ফোন করে বলছেন, "তোমার মত ডিপেন্ডেবল ব্যাটসম্যানকে ক্লাব কখনো হাতছাড়া করতে পারে! আমরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি?"
বন্ধন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে। কঙ্কনা আজ ওর অফিসে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে বলেছে। একটা হলুদ ট্যাক্সি ভাড়া করে বন্ধন আজ কঙ্কনার সাথে দেখা করতে এল। কঙ্কনা তখন অফিসের ফাইলে চোখ রেখে ভারী ব্যস্ত।
-আসতে পারি?
-অবশ্যই। বসুন, কি সৌভাগ্য আমার!
-কেন?
-আমি একজন ভালো মানুষকে হারতে দিইনি।
-তুমি আমায় ভালবাস, কঙ্কনা?
কঙ্কনা মাথা নীচু করল। এভাবে ভালবাসায় সম্মতি একমাত্র মেয়েরাই জানাতে পারে।
বন্ধনের মনে হল কোন দূরের পাহাড়তলীতে ওরা দু'জন অঝোর ধারায় ঝর্নার নীচে দাঁড়িয়ে ভালবাসায় ভিজে যাচ্ছে।
পরদিন কোচ সিদ্ধার্থ মিত্র বন্ধনকে ডেকে বললেন, "বলেছিলাম না, তুমি পারবে! বাই দ্য ওয়ে, কঙ্কনা আমায় বলেছে যে ও তোমাকে ভালবাসে, তোমাকে বিয়ে করতে চায়। আরেকটা গুড নিউজ দিই, তুমি ইন্ডিয়া টীমে চান্স পেয়েছ।"
স্বপ্নের গাড়ীটা এভাবে সামনে এসে পড়বে, বন্ধন কখনো ভাবেনি। বিকেলে কঙ্কনার সঙ্গে পার্কস্ট্রিটে দেখা।
কঙ্কনা বলল, "এইযে মশাই, কেমন লাগছে?"
স্মিত হাসে বন্ধন, "কঙ্কনা,আমি আর হারবো না। আমি পারব।"
দূরে কোথাও জনপ্রিয় শিল্পীর গান বাজছিল,
"চলে যেও না, আর দেরী নেই, আমি আসছি.."
বন্ধন বলে, "তুমি সাথে থাকলে, আমি সব পারব।"
"সকালে গাছে গাছে ফুল ফোটে, কিন্তু কুঁড়ির উপর রাতের কুয়াশা আর ভোরের শিশিরের অনুষঙ্গ থাকা চাই।" বলে কঙ্কনা।
"আমি প্রায় অন্ধকারে চাপা পড়ে গিয়েছিলাম, তোমার বাবা আমাকে মাঠের বাইরে থেকে তুলে এনেছিলেন। সেইসঙ্গে তুমি আমার সঙ্গে ছিলে, তা না হলে আমি তো প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিলাম।"
কঙ্কণা মৃদু হাসে, "একজন ভালো মানুষের কখনো হেরে যাওয়া চলে না।"
বন্ধন বলে, "তখন হাড়কাঁপানো শীত বর্ষার দিনে আমার সঙ্গে কেউ ছিল না। সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।"
"জানি তো, আমি তোমার খেলা আগে দেখিনি। কিন্তু বাবার কাছে শুনেছিলাম তুমি খুব সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় ছিলে একসময়। মাঝে মাঝে সব পেশাতেই খারাপ সময় আসে। আমার ভালো লাগছে, তুমি নিজের চেষ্টায় সেই মন্দ সময় বেরিয়ে এসেছো।"
"দ্যাখো, এখন বসন্তকাল। গাছে গাছে লাল কৃষ্ণচূড়া ছেয়ে আছে। শীত বর্ষার দিন দূরে চলে গেছে।" বলে বন্ধন।
"হ্যাঁ, বসন্ত দিনের ডাক এসেছে। একে সাদরে বরণ করে নিতে হবে।"
"তুমি সঙ্গে থাকো কঙ্কনা। আর দেরী নেই,আমি আসছি।"
কঙ্কনা বলে, "বলেছিলাম না, তুমি পারবে!"
"চলো, একবার মাঠের কাছ থেকে ঘুরে আসি।"
বিস্মিত হয় কঙ্কনা, "কেন?"
বন্ধন বলে, "এই মাঠ আমাকে একদিন রাজমুকুট পরিয়েছিল। এই মাঠ একদিন আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে, আর আজ এই মাঠ আমাকে দু'হাত ভরে সব হারানোটুকু আবার ফিরিয়ে দিল।"
কঙ্কনা বন্ধনের দু'চোখে চোখ রাখল। বলল, "এই বসন্তদিন সাক্ষী থাকুক। চলো, আমরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করি।"
বাইরে কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া মহাদেবচূড়া গাছে তখন বসন্তের হিল্লোলিত বাতাস উদাস বয়ে যাচ্ছে। বন্ধনের চোখে তখন ওর প্রিয় খেলার মাঠটা স্বপ্নের স্বর্গের বাগান বলে মনে হচ্ছিল। একটা প্রবল যুদ্ধ শেষে জয়ের আনন্দটা বন্ধন আজ পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছিল। ওর বারবার মনে হচ্ছিল, কঙ্কনা পাশে না থাকলে এমন কঠিন যুদ্ধটা ওর পক্ষে জয় করা হয়তো সম্ভব হতো না। মনে মনে কঙ্কনার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল ওর।
"কী ভাবছো?" কঙ্কনা জিজ্ঞাসা করে।
বন্ধন বলে, "তোমার কথা।"
"ধ্যাৎ!"
বন্ধনের মনে হল, এই প্রথম ওরা ভালোবাসার বৃষ্টিতে কোনো পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে দু'জনেই ভিজছে, কেবলই ভিজে যাচ্ছে। হাইওয়ের ওপর পথের নিয়ন আলোগুলো ওদের ভালোবাসার দিকে যেন মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন