অরুণাং করুণা-তরঙ্গিতাক্ষীং ধৃত-পাশাঙ্কুশ-পুষ্পবাণ-চাপম্।
অণিমাদিভিরাবৃতাং ময়ূখৈ-রহম-ইত্যেব বিভাবয়ে ভবানীম্।।
-শ্রীললিতাসহস্রনামস্তোত্রম
[তাঁর গায়ের রঙ ঊষা-সূর্যের আভাযুক্ত। তাঁর নয়নযুগে করুণার
তরঙ্গ বয়ে চলেছে। তিনি চার হাতে
- পাশ,
অঙ্কুশ, পুষ্পবাণ এবং ধনুক ধারণ করে আছেন। তাঁর চারিপার্শ্বে
অণিমাদি অষ্টসিদ্ধি আবৃত হয়ে রয়েছে। আমি এহেন ভবানীর ভাবনায় ভেসে রই।]
তন্ত্রের নানা পরম্পরার মধ্যে প্রকট দুটি ধারা হলো—কালীকুল ও শ্রীকুল। কালীকুল
উভয় বঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ইত্যাদি স্থানে ব্যাপ্ত আর শ্রীকুল দাক্ষিণাত্যে প্রসারিত। কালীকুলের
মূল আরাধ্যা হলেন কালী। কালীকেই আদ্যাশক্তিরূপে স্বীকার করা হয়,
তিনিই দশমহাবিদ্যার আদিবিদ্যা বা প্রথম বিদ্যা। যে মূল
শক্তি থেকে ভগবতীর অনেক রূপ প্রকাশিত হয়, তিনিই আদ্যাশক্তি। আবার শ্রীকুলে এবং নানা তন্ত্রগ্রন্থ
অনুসারে ভগবতী ললিতা বা ষোড়শী বা ত্রিপুরাসুন্দরী হলেন আদ্যাশক্তি। ইনি দশমহাবিদ্যার তৃতীয় বিদ্যা, যদিও শ্রীকুলে ইনি শিবশক্তির সম্মিলিত
প্রকাশ। বামকেশ্বর তন্ত্রেও এঁকে
আদ্যা, পরমা ও ত্রিলোকের উৎপত্তিকারিণী বলা হয়েছে। আচার্য ভাস্কররায় তাঁর
‘সৌভাগ্যভাস্কর’ গ্রন্থেও বলেছেন, ললিতা ত্রিপুরাসুন্দরী পরশিব থেকে অভিন্ন,
শুদ্ধসত্ত্বগুণের ঘনীভূত মূর্তি। সেজন্য শ্রীকুলের অন্তর্গত
ত্রিপুরার পূজায় তাঁর পুরুষমূর্তি বা ভৈরবের আলাদা পূজা হয় না। ললিতার ভৈরব কামেশ্বর, ললিতার অপর নাম কামেশ্বরী। শিব যদি শক্তিযুক্ত না হন,
তবে শিবের স্পন্দনেও সামর্থ্য থাকে না। ই-কার শক্তিস্বরূপা,
শিব শব্দে ই-কার যুক্ত না হলে তিনি ‘শব’ হন,
শবের স্পন্দন ঘটে না। শিব-শক্তির সম্মিলনেই জগতের
সৃষ্টি-স্থিতি-লয় ঘটে। এই শক্তি প্রণবস্বরূপা,
আবার ইচ্ছা-জ্ঞান-ক্রিয়াশক্তির সম্মিলনে ভদ্রা-শান্তাশক্তির
বিকাশ এই ললিতা ত্রিপুরাসুন্দরী। অগস্ত্য,
দুর্বাসা, দত্তাত্রেয়, পরশুরাম, লোপামুদ্রা, প্রমুখ প্রাচীন শ্রীবিদ্যা-উপাসকদের নাম,
ঋষি-পরম্পরা এবং রচনায় পাওয়া যায়। আচার্য শংকরের প্রবর্তিত
চার মঠে এবং কাঞ্চীপীঠে শ্রীযন্ত্র ও শ্রীবিদ্যা উপাসনার অনবিচ্ছিন্ন পরম্পরা দেখা
যায়। কিন্তু, কে এই ললিতা ত্রিপুরাসুন্দরী? কীভাবে আর কেনই বা তাঁর এই রূপ?
কিভাবে বা তাঁর উৎপত্তি?
দেবী ললিতার আবির্ভাব,
দিব্য অবতারত্ব ও মুখ্যলীলার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের একাদশ অধ্যায়ের 'ললিতোপাখ্যাণ' অংশে যা ঋষি অগস্ত্য ও নারায়ণের হয়গ্রীব অবতারের কথোপকথনের
মধ্য দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
ভগবান হয়গ্রীব বর্ণিত 'ললিতোপাখ্যাণ'-এ ত্রয়োদশ
কল্পের কথা বর্ণিত আছে। কামদেব মহেশ্বরকে মদনশরে আক্রান্ত করলে,
কুপিত মহেশ্বর তার তৃতীয় নেত্র দ্বারা কামদেবকে ভস্ম করেন।
সেই ভস্ম রক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় গণেশ্বর চিত্রকর্মাকে। একদিন চিত্রকর্মা সেই
ভস্ম রক্ষা করার সময় কি একটা খেয়ালে সেই ভস্ম দিয়ে একটি পুতুল নির্মাণ করেন। পুতুলটিকে
মহেশ্বরের কাছে নিয়ে যেতেই ঘটলো এক আশ্চর্য ঘটনা। মহাদেবের দৃষ্টি পুতুলের উপর
পরতেই, সেই পুতুলে প্রাণের সঞ্চার ঘটলো ও সেই পুতুল মহাবলবান ও সুর্যসমতেজস্বী এক
কন্দর্পকান্তি বালকে পরিণত হল। একদৃষ্টিতে মহাদেব কামকে ভস্মীভূত করেছিলেন,
আবার অপর দৃষ্টিতেই সেই ভস্মে তিনি প্রাণদানও করলেন।
চিত্রকর্মার যেন আনন্দের সীমা-পরিসীমা রইলোনা। স্বয়ং দেবাদিদেব তাঁকে পুত্র প্রদান
করেছেন, একি কম কথা! সেই সদ্যোজাত অথচ তেজোময় বালকটির প্রতি তাঁর মনে যেন অপত্যস্নেহের
উদ্ভব ঘটলো। পরম স্নেহে সেই বালককে আলিঙ্গন
করলেন চিত্রকর্মা, তারপর বললেন, “বৎস্য, তোমাকে লাভ করে আমি প্রীত হয়েছি। তুমি আমার সন্তানসম,
অতএব তোমার মঙ্গলই আমার একান্ত প্রার্থনা। আমি মহাদেবের
ভক্ত। তোমাকেও উপদেশ দিই, তাঁর শরণ নাও, তিনি সর্বকারণকারণম,
সর্বকর্মের আধারস্বরূপ,
তিনি প্রসন্ন হলে জগৎ সংসারে এমন কিছু নেই যা তোমার আয়ত্তে
আসবে না।” চিত্রকর্মা এইবলে তাকে শতরুদ্রীয় মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। বালকটি তখন সেই
বিশেষ মন্ত্র অবলম্বন করে মহেশ্বরের ঘোর তপস্যা শুরু করে।
তপস্যার ফলে মহাদেব অবশেষে প্রসন্ন হন। তাঁর সম্মুখে আবির্ভুত হয়ে মহাদেব তাকে
বর প্রার্থনা করতে বলেন। তখন বালকটি বলে, “হে প্রভু, হে জগৎ-এর নাথ, আপনার দর্শনপ্রাপ্তিতে আমার ইহকাল-পরকাল ধন্য হলো। আপনি যদি
আমার উপর প্রসন্ন হয়ে থাকেন, তাহলে আমায় এমন বর দিন যাতে যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো
প্রতিদ্বন্দ্বী যদি আমার মুখোমুখি হয় তাহলে তাঁর অর্ধবাহুবল যেন লোপ পায়;
আমাকে এমন বর দিন যাতে আমার শত্রুর সেই লুপ্ত অর্ধশক্তি
আমার শক্তির সাথে সংযোজিত হয়ে আমার বলবৃদ্ধি করে;
আমাকে এমন বর দিন যাতে আমার বিরুদ্ধে ও অমঙ্গলার্থে ব্যবহৃত
সকল প্রকার অস্ত্রশস্ত্র ব্যর্থ হয়।”
ব্রহ্মা কিন্তু যোগবলে সব প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এইরকম আত্মদম্ভী ও হিংসাত্মক বর,
বরপ্রার্থী কেন প্রার্থনা করে থাকেন তা তাঁর অজানা নয়,
কারণ তিনি নিজেও তাঁর ভুক্তভোগী হয়েছেন আদিতে। আসন্ন বিপদের
আশংকায় ব্রহ্মার কপালে চিন্তার ভাঁজ পরল। কিন্তু মহাদেব?
তিনি তো আশুতোষ, অতি অল্পে ও শীঘ্রই তাঁকে তুষ্ট করা সম্ভব আর একবার তুষ্ট
হলে তাঁর অদেয় কিছুই নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হলো,
আশুতোষ তাঁর বর মঞ্জুর করলেন। কিন্তু এতেই মহাদেব ক্ষান্ত
হলেন না। “তুমি অতঃপর ষাট সহস্র বৎসর নিষ্কন্টক রাজ্য শাসন করবে”- এইবলে মহাদেব
অন্তর্হিত হলেন। কিন্তু ব্রহ্মার সহ্যের সীমা ছাড়ালো। বালকের উগ্রতা,
কুটিলতা ও ক্ষমতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রত্যক্ষ করে আশঙ্কিত
ব্রহ্মা তাঁকে, “ভণ্ড...তুই ভণ্ড,”
বলে ভর্ৎসনা করেন।
বালক স্বয়ং রুদ্রের কোপানলজাত হওয়ায় সে তো মহাপরাক্রমশালী ছিলই,
সেই সঙ্গে তার স্বভাবেও আসুরিকভাব প্রবল ছিল। ব্রহ্মার
দ্বারা 'ভণ্ড' হিসেবে অভিহিত হয়ে ও আসুরিকস্বভাব হওয়ায় সেই বালক পরিচিত পেল 'ভণ্ডাসুর' নামে, আর সেই সঙ্গে জন্ম নিল সেই কল্পের সর্বশক্তিমান,
বুদ্ধিমান, কুটিল ও হিংস্র অসুর,
ভণ্ডাসুর।
এমতাবস্থায় রঙ্গমঞ্চে আবির্ভুত হলেন ভার্গব শুক্রাচার্য্য। শুক্রাচার্য্য
ছিলেন প্রচণ্ড দেববিদ্বেষী। নারায়ণ তাঁর মাতা ভৃগুপত্নী কাব্যাকে বধ করেছিলেন,
শুক্রাচার্য্য তা কখনই মেনে নিতে পারেননি। ফলে তিনি হয়ে
ওঠেন বিষ্ণুবিরোধী ও পক্ষান্তরে দেবতাদের বিরোধী। স্বভাবতই,
শুক্রাচার্য্য যেনতেনপ্রকারেন দেবতাদের অনিষ্ট চাইতেন,
দেবলোক অধিকার করতে চাইতেন,
চাইতেন দৈত্য-দানব তথা অসুরদের ঋতগৌরব ফিরিয়ে আনতে। তাই
তিনি সুরাসুর সংগ্রামে দৈত্যদের মুখ্য উপদেষ্টা ও গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
ভণ্ডের খবর শুক্রাচার্য্য জানতেন, রাজনীতি ও কুটনীতি সম্পর্কে শুক্রাচার্য্যের ছিল প্রভুত
জ্ঞান। শুক্রাচার্য্য এর আগেও দৈত্যদের দেবতাদের বিরুদ্ধে নানা ভাবে সাহায্য
করেছিলেন, কিন্তু নারায়ণের জন্য তাঁর সব পরিকল্পনাই ব্যর্থ হত। তাই নিজের বিদ্বেষ ও
প্রতিশোধের বাসনা চরিতার্থ করতে শুক্রাচার্য্য এইবার ভণ্ডকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার
করতে চাইলেন।
আগেই বলা হয়েছে, শুক্রাচার্য্য ভণ্ডের বৃত্তান্ত সম্পর্কে ভালোই অবগত ছিলেন।
অতঃপর নিজের অসংখ্য দৈত্য-দানবশিষ্যদের নিয়ে তিনি ভণ্ডের সাক্ষাৎপ্রার্থী হন।
ভণ্ডও অমিতশক্তিধর শুক্রাচার্য্যকে নিজের গুরু হিসেবে নিযুক্ত করেন। দেবতাদের
রাজ্যচ্যুত করা ও মহেশ্বরের 'নিষ্কণ্টক রাজত্ব'-এর বরকে বাস্তবায়িত করার লক্ষের দিকে এটাই ছিল ভণ্ডের প্রথম
ধাপ। শুক্রাচার্য্যও বেদ, বেদাঙ্গ, রাজনীতি, কুটনীতি, অস্ত্রশিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে ভণ্ডকে দেবতাদের সমতুল্য,
যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তুলতে লাগলেন।
শুক্রাচার্য্যের সহায়তায় ভণ্ডেরও প্রভাবপ্রতিপত্তি ও দৌরাত্ম,
দুটোই সমান তালে বাড়তে থাকে। শুক্রাচার্য্য যেন তাঁর আগের
করা ভুলত্রুটিগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সাবধানে ভণ্ডকে তৈরী করতে থাকেন।
কিছু সময় পর, শুক্রাচার্য্যের কাছে ভণ্ডাসুরের শিক্ষা সম্পুর্ণ হলো। তিনি
বললেন, “দৈত্যেন্দ্র, তুমি নিজগুণে সর্বশিক্ষাপারঙ্গম হয়েছ,
তোমার ব্রহ্মচর্য সম্পুর্ণ হলো। এবার তোমার রাজধর্ম পালনের
সময় আগত। রাজ্য ও প্রজাই রাজার ভূষণ, রাজ্যহীন রাজা যেন মণিহীন ফণী। অতএব,
হে ভণ্ড, তুমি নিজের রাজ্য ও প্রজানির্মানে মনোনিবেশ করো। মহাবল ময়
দৈত্যশিল্পী, কারীগরি বিদ্যায় তাঁর দক্ষতা বিশ্বকর্মার সমান। তুমি এই ময়কে নিজের রাজ্য আর
রাজধানী নির্মাণের কাজে নিযুক্ত করো। প্রথম দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর কথা স্মরণে আছে
নিশ্চয়, বিষ্ণু তাঁকে ছলনা করে বধ করেছিল, সেই মহাবল হিরণ্যকশিপুর নগরী,
যেখান থেকে তিনি ত্রিলোক শাষন করতেন,
সেই পুন্যভুমিতেই তুমি স্থাপন করবে তোমার রাজ্য।”
শুক্রাচার্যের কথামত ভণ্ড ময়কে নিযুক্ত করেন ও তাকে এক রাজকীয় পুরী নির্মাণের
আদেশ দেন। মহেন্দ্র পর্বতে ময় যে পুরী
নির্মাণ করলেন তা ছিল অভুতপুর্ব, খোদ ইন্দ্রের অমরাবতীর ন্যায় মনোহর সেই পুরী,
বিস্তারে সেই পুরী ছিল শত যোজন বিস্তৃত। ভণ্ড সেই পুরীর নাম
দেন শোণিতপুর। এই অদ্ভুত মনোমুগ্ধকরো পুরেই দৈত্যাধিপতি হিসেবে শুক্রাচার্য্যের
পৌরহিত্যে রাজ্যাভিষেক ঘটে ভণ্ডের ও ভণ্ডাসুর নিজেকে 'ইন্দ্র' ঘোষনা করেন। শুক্রাচার্য্য স্বয়ং সুর্যের তেজোপম সিংহাসনে
অধিষ্ঠিত, সর্বআভরণে ভুষিত ভণ্ডের মাথায় পড়িয়ে দেন রাজমুকুট,
যা ইতিপুর্বে স্বয়ং হিরণ্যকশিপু ও প্রহ্লাদ পৌত্র বলীর
শিরোভুষণ হিসেবে শোভা পেত। শুক্রাচার্য্য নবাভিষিক্ত দৈতেন্দ্রকে ব্রহ্মা নির্মিত
চন্দ্রকলাসম দুটি চামর ও ছত্র উপঢৌকন প্রদান করেন। রাজ্যাভিষেক হলে
শুক্রাচার্য্যের অনুগমনকারী অসংখ্য দৈত্য-দানবও তাঁর ছত্রছায়ায় আসে।
রাজ্যনির্মান তো হলো, এবার আসে সৈন্যনির্মানের পালা। শুক্রাচার্য্যের সাথে আগত
বিপুল পরিমান অসুরদের নিয়ে তিনি নিজের চতুরঙ্গ সেনা নির্মান করলেন। তাঁর সেনার
সংখ্যা দাঁড়ালো প্রায় ৩০০ অক্ষৌহিণী, এর আগে কেউ কখনই এতো বিপুল পরিমান সেনা নির্মাণ করতে
পারেনি। তাঁদেরই মধ্যে থেকে ইন্দ্রশত্রু, অমিত্রাঘ্ন, বিদ্যুন্মালী, বিভীষণ, উগ্রকর্মা, উগ্রধন্বা, বিজয় ও শ্রুতিপারণ- এই ৮জন প্রবলপ্রতাশালী দৈত্যকে নিজের
সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন ভণ্ডাসুর। কামদেবের অবশিষ্ট ভস্ম থেকে
শুক্রাচার্য্যের মন্ত্রবলে তিনি নিজের দুই ভ্রাতা তথা দুই পারিষদকে ও এক ভগিনীকেও
সৃষ্টি করলেন - বিষঙ্গ, বিশুক্র ও ধৃমিনী। বিষঙ্গ ছিল দুষ্ট শিরোমণি আর
বিশুক্র শুক্রাচার্য্যের ন্যায় বুদ্ধিমান
আর বিচক্ষন। অতঃপর ভণ্ড চার পত্নীও লাভ করলেন- সুমোহিনী,
কুমুদিনী, চিত্রাঙ্গী ও সুন্দরী। মহাদেবের বরে বলিয়ান ভণ্ডাসুর নিজেই;
তারই সাথে বিচক্ষণ গুরু,
কুটিল পারিষদ, সু্যোগ্য সেনাপতি ও অতুলনীয় সেনাবল লাভ করে এমনিতেই সে
প্রায় অপরাজেয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাহুবল ছাড়াও এবার তাঁর দৃষ্টি পড়ল দেবতাদের
শক্তি অর্থাৎ তপোবলের ওপর। আর এখানেই ভণ্ডাসুর আর শুক্রাচার্য্য এক মোক্ষম
বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন।
ভণ্ডাসুরের রাজ্যের সমস্ত প্রজা ছিল পরম শৈব। মহেশ্বরের কৃপায় তাদের কিছুর
অভাব ছিলনা, সন্তানসন্ততি ও ধনসম্পদে সুখী ও
সমৃদ্ধশালী ছিল সবাই। সাধারণত, দৈত্য দানবরা বেদবিরোধী,
যজ্ঞাদিকর্মকাণ্ডের বিরোধী হত,
কারণ, যজ্ঞে দেবতাদের নামে আহুতি প্রদান করা হত। যজ্ঞের
হব্যগ্রহণও দেবতারাই করতেন, যার ফলে দেবতারা বাহুবল ও তপোবলে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতেন। ভণ্ড
কিন্তু সেই সব কিছুই করলেন না, যজ্ঞের
উপর তিনি কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি। বরং তিনি এতে উৎসাহ প্রদান করতেন। প্রজাদের
ঘরে ঘরে যাগযজ্ঞ লেগেই থাকতো, প্রত্যেকটি গৃহে
ঋক-সামাদি বেদ এবং ন্যায়-স্মৃতি-মীমাংসা ইত্যাদির শিক্ষায় ছিল সবাই
শিক্ষিত। মুনি ঋষিদের আশ্রমেও প্রতিনিয়তই যজ্ঞ চলত,
কিন্তু সেই যজ্ঞের আহুতি প্রদান করা হত ভণ্ডাসুর তথা
অসুরদের নামে, দৈত্যরাই পেতেন যজ্ঞভাগ ও হব্যের উপরও অধিকার ছিল দৈত্যদেরই। বাহুবলে সে তো
অজেয় ছিলই, আর এভাবেই চতুর ভণ্ড তপোবলেও ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে থাকল। শুধু নিজে
অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল তাই নয়, দেবতাদের যজ্ঞভাগ ও হব্য থেকে বঞ্চিত করে তাঁদের ক্রমশ
শক্তিক্ষয় করতে লাগল। শেষে এমন হলো, নিজের প্রজা ও ঋষিদের যজ্ঞের সম্মিলিত ফলের আতিশয্যে সে
তপোবলে দেবতাদের পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়। এদিকে ভণ্ডের রাজত্বে যজ্ঞে কেউ দেবতাদের
নামে আহুতি না দেওয়ায় দেবতাদের ও ইন্দ্রের শক্তি হয়ে পরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর।
এইবার এল সেই বহুপ্রতীক্ষিত ক্ষণ। সর্বশক্তিমান হয়ে ভণ্ডাসুর সসৈন্য দেবলোক
আক্রমণ করে বসলেন। ফল যা হওয়ার তাই হলো, দেবতারা যেন ভণ্ড ও তাঁর সেনার সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে
গেলেন। এমন কোনো দেব-দৈত্য-দানব ছিলেন না যাকে ভণ্ডাসুর পরাস্ত করেনি। নিজেদের শৌর্য আর বীর্য বলে
দৈত্যরা সারা বিশ্বব্রহ্মান্ডে এক অভুতপুর্ব বিশৃঙখলা আর ত্রাসের সঞ্চার করল।
অমৃতের প্রভাবে দেবতারা হয়তো অমর হয়েছিলেন কিন্তু তাঁর প্রতাপে দেবতারা স্বর্গ
থেকে পালিয়ে কেউ পাতালে, কেউ মহাসাগরের তলদেশে কেউ বা দুর্গম পর্বতের উপত্যকায় আশ্রয়
নিলেন। রক্ষঃ, যক্ষ, সর্প, সিদ্ধ্য- সমস্ত লোককে পরাস্ত করে ভণ্ডাসুর একাই সসাগরা ধরিত্রী সহ সমগ্র
স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল অধিকার করে ফেলেন। এইভাবেই দেবতাদের পলায়ণ ও ভণ্ড কর্তৃক
বিতাড়নের পর শুক্রাচার্য্যের সহায়তায় ভণ্ডাসুর ত্রিলোকে নিজের একাধিপত্য কায়েম করতে
সক্ষম হলেন। বাহুবল, তপোবল, বুদ্ধি, কুটিলতাতে অন্য সমস্ত অসুরদের মধ্যে তিনি হয়ে উঠলেন শ্রেষ্ঠ,
তারমতো পরাক্রমশালী অতীতেও কেউ হয়নি,
আর ভবিষ্যতেও হবেনা। দেবতাদের জন্য এক পরম সঙ্কটের কাল
উপস্থিত হলো। শেষে এমন পরিস্থিতি হলো যে, ব্রহ্মা- ইন্দ্রাদি দেবতাগণ তাঁকে নানান মুল্যবান উপঢৌকন
প্রদান করে তাঁকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলেন,
এমনই ছিল ভণ্ডের প্রতাপ।
কিন্তু, এমনটা তো চলতে দেওয়া যায় না। দেবতারাও এমন পরিস্থিতিতে নেই যে,
তাঁরা সবলে নিজরাজ্য পুনরুদ্ধার করবেন। অতএব,
এক্ষেত্রে দেবতারা সাধারণত যা করে থাকেন,
সেই চিরাচরিত উপায়ই তাঁরা অবলম্বন করলেন। দেবতারা এবার
কমলাপতি নারায়ণের শরণাপন্ন হলেন। দেবতাদের এমন চরম দুরবস্থায় তিনিই ত্রাতার ভুমিকা
পালন করলেন। নারায়ণ দেবতাদের বললেন, “ভণ্ড স্বয়ং মহাদেবের আশীর্বাদধন্য,
তাছাড়া শুক্রাচার্য্য স্বয়ং তাঁর উপদেষ্টা ও গুরু,
এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁকে সমূলে নিধন করা
অসাধ্য। তাই, রণনীতি নয়, অসাধ্যসাধন করতে কুটনীতি প্রয়োগই সর্বোত্তম। কিন্তু সময় প্রতিকুল,
কারণ মহাদেব তাঁকে ষাট সহস্র বৎসর রাজত্বের বর দিয়েছেন। তাই
সঠিক মুহুর্তের অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।”
অপেক্ষা শুরু হলো। সমগ্র ত্রিলোকের একাধিপতি হয়ে ভণ্ডাসুর প্রবল প্রতাপে
রাজ্যশাষণ করতে লাগলেন। কিন্তু সুখ চিরস্থায়ী নয়,
আর সুখভোগে মত্ত থাকলে সময়জ্ঞানও থাকেনা। ভণ্ডাসুরের
রাজত্বে ষাট সহস্র বৎসর যেন এক লহমায় কেটে গেল,
মহেশ্বরের বরের সময়সীমাও অতিক্রান্ত হলো। ভণ্ড তা টেরও
পেলেন না।
দৈত্যদানব তথা অসুররা বেদ-বেদাঙ্গের শিক্ষায় শিক্ষিত হলে কি হবে,
তাঁরা কিন্তু যোগী নয়,
চরম ভোগী। ষড়রিপুকে দমন করতে তাঁরা জানত না। আসুরিক স্বভাব
হওয়ায়, তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে কাম ও লোভ, দুইই পুর্ণমাত্রায় বিরাজমান ছিল। তাছাড়া,
ভণ্ডাসুর নিজেই কামদেবের ভস্মজাত,
রিপুগুলির মধ্যে কামই যে তাঁর মধ্যে প্রবল ছিল,
সেটা বলা বাহুল্য। নারায়ণ কামের মাধ্যমেই ভণ্ডকে পরাস্ত
করার সিদ্ধান্ত নিলেন। দেবতারাও বুঝলেন, ষাট সহস্র বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে,
অতএব এখনই সেই সুযোগ উপস্থিত হয়েছে। মায়াপতি তখন নিমেষেই
মায়ার দ্বারা এক ত্রিলোকবিমোহক নারীকে সৃষ্টি করলেন। বিষ্ণূ তখন সেই মায়াকে আদেশ
দিলেন, “হে মৃগেক্ষণা সর্বাঙ্গসুন্দরী, তুমি নিজের মায়ার প্রভাবে ত্রিলোককে মোহিত করতে পার। তুমি
এই মুহুর্তেই মানস সরোবরের দিকে প্রস্থান করো,
তুমি তোমার ইচ্ছানুসার বিচরণ করলেও কেউ তোমার স্বরূপ জানতে
সক্ষম হবে না। দৈত্যদের প্রভু ভণ্ডাসুর সরোবরের পাশে এক প্রমোদ উদ্যান নির্মাণ করে
সুখে বসন্ত যাপন করছে। তুমি যাও, তাঁকে নিজের সৌন্দর্য দিয়ে বিমোহিত করো,
তোমার প্রেমের দ্বারা তাকে এই জগৎসংসার থেকে বিস্মৃত করো,
তাঁকে নারীদোষে দুষ্ট করো।”
সেইমত মায়া, আরও কয়েকজন অনিন্দ্যসুন্দরী অপ্সরা সমভিব্যাহারে মানস সরোবরে উপস্থিত হলেন।
ভণ্ড তখন উদ্যানে সপারিষদ বসন্ত উপভোগ করছিলেন।
মায়া তখন একটি চম্পক বৃক্ষের নীচে উপবিষ্ট হয়ে মধুবিনিন্দিত কণ্ঠে সংগীতের আলাপ
শুরু করলেন, অন্যান্য অপ্সরারাও বীণা-আদি যন্ত্রে তাঁকে সঙ্গত করতে লাগলেন। গান শুনে
অদূরেই উপস্থিত ভণ্ডের দৃষ্টি পরল মায়ার উপর। মায়া তথা অপ্সরাদের চারুতা,
কমনীয়তা ও বিদ্যুৎবল্লরীর মতো দেহসৌষ্ঠব অবলোকন করে ভণ্ড
এবং তাঁর পারিষদবর্গ যেন মুহুর্তেই মদনবাণে জর্জরিত হলেন। দেবতাদের প্রাথমিক
উদ্দেশ্য সাধিত হলো।
কামতপ্ত ভণ্ড তখন মায়াকে অনুরোধ করলেন,
“অয়ি ভুবনমোহিনী,
আমি দৈতেন্দ্র ভণ্ডাসুর,
ত্রিলোকের একাধিপতি,
আপন বাহুবলে দেবলোক অধিকার করে ইন্দ্রকে জয় করেছি,
দেবতাদেরও বিতাড়ন করেছি,
স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মাও আমার প্রতাপে সন্ত্রস্ত,
পরম শিবভক্ত আমি, আমার মতো পরাক্রমশালী কেউ নেই,
তোমার যোগ্য পুরুষ হিসেবে নিজেকেই বিবেচনা করি। অতএব আমাকে
বরণ করো।” মায়া তখন ভণ্ডের বাহুলগ্না হলেন। স্বর্গসুন্দরীদের সান্নিধ্যে সপারিষদ
ভণ্ড সুখযাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নারীসংসর্গে লিপ্ত দৈত্যরা যেন সময়ভেদ ভুলে
গেলেন। কামপীড়িত দৈত্যরা ভাবল, “রাজসূয়, বাজপেয়-আদি মহাযজ্ঞ অনুশীলন করেও যেই সুখ লাভ হয় না,
আমরা অনায়াসে সে সুখেই পরিতৃপ্ত হচ্ছি। অতএব,
ইহজগতে আমাদের অপ্রাপ্ত বলে কিছুই রইলো না।” কামের তাড়নায়
তাঁরা যেন মহেশ্বরকেও বিস্মৃত হলো। তাঁরা বেদজ্ঞানকে উপেক্ষা করল,
যজ্ঞাদি কর্মকাণ্ডকেও অবহেলা করা শুরু করল,
পুরোহিতগণ যজ্ঞাদির কথা মনে করাতে গেলে তিরষ্কৃত হয়ে ফিরে
গেলেন। এইভাবেই, একসময় ভণ্ডের রাজ্যে বেদাধ্যয়ণ বন্ধ হলো,
যজ্ঞও বন্ধ হলো। যজ্ঞ বন্ধ,
অর্থাৎ, দৈত্যদের যজ্ঞফল লাভও সাঙ্গ হলো। তাও,
তাঁদের বোধোদয় হলোনা। ভণ্ডাসুরের অন্তের আরম্ভ হলো এইভাবেই।
আরও দশ সহস্র বছর এইভাবেই অতিক্রান্ত হলো,
ভণ্ডের রাজ্যে এর মধ্যে একটিও যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়নি। দেবতারা
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বসে ছিলেন না, তাঁরা ভণ্ডকে আক্রমণের পন্থা অনুসন্ধান করতে লাগলেন। এইরকমই
একদিন ইন্দ্র নিজের সভায় বসে আলোচনায় মগ্ন ছিলেন,
রাজ্যচ্যুতির বেদনার তুলনায় অপ্সরাদের নৃত্য-গীত-বাদ্যের
আনন্দ বোধ হয় ইন্দ্রের কাছে প্রগৌণ হয়ে পড়েছিল। যাইহোক,
সভায় তখন আগমন হলো দেবর্ষি নারদের। ইন্দ্র তাঁর পাদবন্দনা
করে বললেন, “হে মুনিশার্দুল, আপনি সর্বজ্ঞ, পরাপরজ্ঞাতাদের মধ্যে আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ,
আপনার বাক্য শ্রুতিমধুর এবং আপনার আগমনে সভা সমৃদ্ধ ও
মঙ্গলময় হলো। আপনি আসন গ্রহণ করুন ও আপনার আগমনের হেতু শ্রবণ করিয়ে এই সভা কে
কৃতার্থ করুন।” নারদ বললেন, “দেবেন্দ্র বাসব, আপনার জয় হোক। আপনার এবং সুরেদের বর্তমান সঙ্কটকালীন
পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি সম্পুর্ণ অবগত। আপনার হয়তো স্মরণে আছে,
দেবতাদের অনুরোধে স্বয়ং ভগবান মায়ার দ্বারা দৈতেন্দ্র
ভণ্ডকে বশ করেছেন। যজ্ঞবিমুখ দৈত্যগণদের শক্তিও ক্রমশ কমে আসছে। এটাই সু্যোগ,
শত্রু যখন দুর্বল তখনই উত্তম সময় তাকে সমূলে নাশ করার। অধিক
বিলম্ব করলে যদি ভণ্ড মায়ামুক্ত হয় তাহলে শুক্রাচার্য্যের মাধ্যমে সে সহজেই
নারায়ণের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারবে। আর তা হলেই অনর্থ ঘটবে। তখন ভণ্ডের কোপানল থেকে
দেবতাদের রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে উঠবে, ভণ্ড দাবাগ্নির মতো ত্রিলোকদগ্ধ করবে। কিন্তু এখনও,
ভণ্ডাসুর শিবের বরে আপনাদের থেকে বাহুবলে শ্রেষ্ঠতর।
বর্তমান পরিস্থিতিতে কোটিকল্প যুদ্ধ করেও ভণ্ডকে পরাস্ত করতে আপনারা পারবেন না।”
ইন্দ্র শুনে আশংকিত হলেন। নারদ বলে চললেন,
“আপনার জানা আছে বোধহয়,
আদিতে রম্ভপুত্র মহিষ দেবগণের অবধ্য হলে রম্ভকল্পে দেবী
পরাশক্তি তাঁকে অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডা রূপে,
নীললোহিত কল্পে ষোড়শভুজা ভদ্রকালী ও শ্বেতবরাহ কল্পে দশভুজা
মহিষমর্দ্দিনী রূপে সংহার করেন। এই পরিস্থিতিতেও একমাত্র দেবী পরাশক্তিই দেবতাদের
ত্রাতা হতে পারেন। অতএব, হে শক্র, শত্রুর পুনরুত্থানের আগেই তাঁর বিনাশ করুন। অধিক কালক্ষেপণ
না করে ভগবতীর শরণ নিন। তপস্যা করে তাঁকে তুষ্ট করুন। তিনি তুষ্ট হলেই ভণ্ডের পতন
অবশ্যম্ভাবী।”
দেবর্ষির উপদেশ ইন্দ্রের মনঃপুত হলো। ইন্দ্রও অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিলেন,
নিজের রাজ্য পুনরুদ্ধারের আশায় এবার তিনি বদ্ধপরিকর হয়ে
উঠলেন। আর দেরী করা ঠিক হবেনা, এই বিচার করে তিনি সমস্ত দেবতাদের সঙ্গে হিমালয়ের উপত্যকায়
উপস্থিত হলেন। ভাগীরথীর মনোরম তটে সুরগণের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি ভগবতীর
ধ্যান শুরু করলেন। ইন্দ্র এখানে তপস্যা করেছিলেন,
তাই অখিলসিদ্ধিপ্রদায়ী সেই স্থানের নাম হলো 'ইন্দ্রপ্রস্থ'। দেবর্ষি নারদ পূর্বেই পরাশক্তির তপস্যার বিধি বিস্তারিত
ভাবে বর্ণনা করেছিলেন, সেই বিধি মেনেই ইন্দ্র ও দেবতাগণ শুরু করলেন কঠিন তপস্যা।
একাগ্রতার সাথে নিশ্চল চিত্তে সুরগণ তপ করলেও, ভগবতী কিন্তু
দর্শন দিলেন না। এদিকে কালচক্র তো থেমে নেই,
সময় অতিবাহিত হয়ে চলল,
তাও দেবী পরাশক্তি সুরগণের
সম্মুখে আবির্ভুতা হলেন না। এই ভাবে দশ সহস্র বৎসর অতিক্রান্ত হলো। তাহলে,
দেবতাদের তপস্যায় কি কোনো ত্রুটি হলো?
ওদিকে দৈত্যরা তখনও মায়ার বশবর্তী, বেদবিদ্যা-যজ্ঞ-তপস্যা সমস্ত কিছুই তাঁরা যেন জলাঞ্জলি
দিয়ে নারীভোগেই তাঁদের দিন কাটছিল। কিন্তু
দেবর্ষি নারদ যে আশঙ্কা করেছিলেন, তাই সত্যি হলো। দশদিন পর অবশেষে শুক্রাচার্য্য অসুররাজ্যে
প্রত্যাগমণ করলেন। অসুরদের এই অবস্থা দেখে তিনি আশ্চর্য হলেন। মুহুর্তেই তিনি সব
বুঝতে পারলেন। ক্রুদ্ধ দৈত্যগুরু তখন ভণ্ডাসুরের সমীপে গিয়ে বললেন,
“ত্রিলোকেশ্বর,
তুমি মূঢ়,
কামের বশে তুমি অনাচার আরম্ভ করেছ। হায় অদৃষ্ট! কামই সকল
অনিষ্টের মূল। দৈতেন্দ্র, তোমার ধ্বজাধারী হয়ে অসুররা ত্রিলোক বিজয় করেছিল,
তোমার ছত্রছায়ায় অসুররা স্বর্গ থেকে পাতাল নির্ভয়ে বিচরণ করতে
পারত, তোমার কল্যাণেই দৈত্যদের এমন অভূতপূর্ব প্রতাপ। তোমার ত্রাসে ইন্দ্র সাগরতলে লুকিয়ে থাকত,
আর সেই তুমিই কিনা সামান্য মায়ার ছলে পরাস্ত হলে?
নারায়ণ তোমাকে অপসারণ করার জন্য এই ছলের আশ্রয় নিয়েছে,
তা কি তোমার বোধগম্য হচ্ছে না?
পূর্বেও বিষ্ণু ছলের মাধ্যমে তোমার জ্ঞাতিগণকে বধ করেছে,
এবারও সে তাই করছে।” এতক্ষণ পর,
ভণ্ড এবং দৈত্যরা বুঝতে পারল তাঁদের কামাগ্নী
দাবাগ্নীস্বরূপ হয়ে নিজেদেরই দগ্ধ করছে। শুক্রাচার্য্য থামলেন না,
“দৈত্যগণ,
শুনে রাখ, তোমাদের পরমশত্রু বাসব ভাগীরথীকুলে এক ঘোরতর তপস্যা শুরু
করেছে, তাঁর লক্ষ্য ভগবতী জগদ্ধাত্রীকে তুষ্ট করা। দেবগণ যদি লক্ষ্যভেদ করে ফেলে,
তাহলে অসুররাজ্যের পতন ও ভণ্ডের নিধণ আমি নিজেও আটকাতে
পারবনা। অতএব, ওই ছলনাময়ীকে এইমুহুর্তেই পরিত্যাগ করো,
তপস্যায় বিঘ্ন ঘটিয়ে ইন্দ্রকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করো। তোমাদের
মঙ্গল হোক।” এই বলে শুক্রাচার্য্য ভণ্ড ও তাঁর দৈত্যদের সান্নিধ্য ত্যাগ করে তীর্থে
প্রস্থান করলেন। কিন্তু গুরুর কথায় মন্ত্রীরা সম্মত হলো। চিন্তিত ভণ্ড তাই
সৈন্যসমাহারে ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে যাত্রা করলেন।
জগদাম্বিকার অগোচরে কিছুই নেই। তিনি দেবগণকে আক্রমণে উদ্যত দৈত্যসেনাদের দেখে,
তপস্থলের চারিদিকে এক সুবৃহৎ প্রাচীরের নির্মাণ করলেন।
ক্রুদ্ধ ভণ্ড তখন শস্ত্র দ্বারা প্রাচীরে আঘাত করল। প্রাচীর ভাঙ্গলো বটে,
কিন্তু ভগবতীর মায়ায় সেই স্থলে আরও একটি প্রাচীরের উদ্ভব ঘটলো।
দৈত্যরা বিস্মিত হলো। ভণ্ড তখন বায়ব্য অস্ত্র নিক্ষেপ করল,
প্রাচীর ভাঙলো ও আবার নতুন একটি প্রাচীরের উদ্গম ঘটলো। এবার
মরিয়া ভণ্ড তাঁর সমস্ত সেনাকে প্রাচীর ভাঙ্গতে নির্দেশ দিল। কিন্তু ফল যা হওয়ার
তাই হলো। একটা প্রাচীর ভূপতিত হলে তাঁর স্থলে অন্য একটি প্রাচীর নির্মিত হতে লাগল।
এমন ঘটনায় সেনাগণ হতোদ্যম হয়ে পড়ল। ভণ্ড এই প্রথমবারের মত পরাজয়ের স্বাদ পেল। কি একটা চিন্তা
করে ভণ্ড সসৈন্য নিজের নগরে ফিরে গেল।
সুরগণের
মধ্যে এবার ত্রাস সৃষ্টি হলো। ভগবতী সেই মুহুর্তে তাঁদের রক্ষা করলেন বটে,
কিন্তু ভণ্ডের প্রতাপ আর তাঁর সৈন্যের আকার দেখে তাঁরা ভয়
পেয়ে তপস্যা বন্ধ করে দিলেন। ইন্দ্র কিন্তু হাল ছাড়লেন না। দেবগণকে উদ্দেশ্য করে
তিনি বললেন, “ভণ্ড, নারায়ণের মায়া ও আমাদের তপস্যার কথা জ্ঞাত হয়েছে,
তাই আমাদের আক্রমণ করতে এখানে আগমন করেছিল। আমাদের সম্মিলিত
শক্তিও ভণ্ডকে বধ করতে অক্ষম। প্রাণ বাঁচাতে পলায়ণেরও উপায় দেখছিনা,
কারণ আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো স্থানই ভণ্ড আমাদের জন্য
রাখেনি। একমাত্র উপায়- মহাযাগ অনুষ্ঠান।” দেবগণ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন,
কি বলছেন ইন্দ্র! মহাযাগ?
সে তো খুবই জটিল যজ্ঞ,
তাঁর নিয়ম অন্যান্য যজ্ঞ থেকে কঠিন,
উপাচারও অধিকতর। এই অল্প সময়ে তা কি আদৌ সম্ভব?
তাছাড়া, সেই যজ্ঞে মহামাংস(যজ্ঞহোতার নিজ মাংস)-এর আহুতি প্রদানই
বিধি। কিন্তু উপায় নেই। ইন্দ্র এবার দেবগণকে আদেশ করলেন,
“যোজনময় বিস্তৃত,
নিখুঁত ও যথাযথ যজ্ঞকুণ্ডের খনন করো। কুণ্ডে সমস্ত আচারবিধি
অবলম্বণ করে অগ্নি প্রণিধান করো। ভগবতী যদি মহামাংসে তুষ্ট হতে চান,
তাহলে তাই হোক। হয় আমরা নিজেরা ব্রহ্মভূত হব
নতুবা অখণ্ড স্বর্গলোক ভোগ করব।” সমস্ত আদেশের পালন করা হলো। কুণ্ডে অগ্নী
প্রজ্জ্বলন করে যজ্ঞের হোতা হিসেবে ইন্দ্র মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন। মন্ত্রপাঠ ও
অন্যান্য আচার শেষ হলে এবার সময় এল আহুতি প্রদানের। ইন্দ্র ও সকল দেবগণ তখন নিজ
শরীর থেকে ক্রমান্বয়ে মাংস কর্তণ করে হোমাগ্নিতে অর্পণ করতে লাগলেন। একে একে
বিভিন্ন অঙ্গ যজ্ঞে আহুতি দিয়েও যখন কিছু হলোনা,
তখন দেবগণ মরিয়া হয়ে নিজেদেরকেই আহুতি প্রদানে উদ্যত হলেন।
এইবার এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দেবতাদের ভক্তিতে প্রীত হয়ে দেবী স্বয়ং আবির্ভূতা
হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। যজ্ঞকুণ্ড থেকে তখন মণ্ডলাকার তেজপুঞ্জের প্রাদুর্ভাব ঘটলো।
সেই তেজপুঞ্জের মধ্যে আলোকচক্রের উৎপত্তি ঘটলো। সেই চক্রের মধ্য থেকেই উদীয়মান সূর্যসম
মহাদেবী আবির্ভূতা হলেন। যজ্ঞোত্থিতা দেবী জগতের
উজ্জীবনকারী, ত্রিদেব তাঁরই স্বরূপ। তিনিই সমস্ত সৌন্দর্যের সার,
জবাকুসুমের মতো রক্তবর্ণা,
পরনে দাড়িম্ববর্ণের বস্ত্র। পদ্মফুলের মতো দেবী ললিতা
প্রভাতসূর্যের সমান উজ্জ্বলা ও কোমল। সর্বাভরণভুষিতা হয়ে দেবী যেন শৃঙ্গাররসের মূর্তরূপ
ও সাক্ষাৎ পারমার্থিক শক্তির অধিকারিণী। দেবীর কৃপাদৃষ্টি চন্দ্রপ্রভার মত
স্নিগ্ধ। দেবীর এলোকেশ যেন কোটি কোটি কালো ভ্রমরের একত্র বিচরণ। তাঁর দেহে কস্তুরী-কুঙ্কুমের সুবাস,
মুখে কর্পূরজড়িত তাম্বুল। তাঁর শিরে চন্দ্রকলার ভুষণ,
উন্নত বক্ষস্থল ও চতুর্ভুজা- পাশ,
অঙ্কুশ, ইক্ষু কোদণ্ড ও পঞ্চবাণ শোভিতা। দেবীর গ্রীবা শঙ্খের মতো,
চিবুক অতিসুন্দর, তাঁর সুন্দর হাসির মাধুর্য সাগরের সমান। তাঁর বাহু
মৃণালদলের মতো লালিত্যময়, নখের দ্যুতি যেন উজ্জ্বল নক্ষত্রমণ্ডল। তাঁর উন্নত বক্ষে
লতার মতো মুক্তাহার দুলছে। উদরে বলয়াকার তিনটি বিভাজিকা রচিত হয়েছে,
আর এই লাবণ্যসাগরের আবর্তবিন্দু হচ্ছে তাঁর নাভিদেশ। তাঁর
জানু আর জংঘাদেশ যেন কুসুম আর কদলীর মতো লাবণ্যময়। তিনিই স্বয়ং আদিপরাশক্তি,
পরমব্রহ্মের দুই স্বরূপ অর্থাৎ পুরুষ এবং প্রকৃতির থেকে
সম্পুর্ণ ভিন্ন এক তৃতীয় স্বরূপ। দেবীর ভক্তবাৎসল রূপ অবলোকন করে
দেবগণের মনে ভীতিনাশ হয়ে পরম প্রশান্তির উদ্রেক হলো,
তাঁরা যেন এখন থেকেই নিজেদের শক্তিশালী অনুভব করলেন।
নিশ্চিন্ত দেবগণ ভক্তিভরে দেবী অম্বিকাকে সাষ্টাঙ্গপ্রণাম করে তাঁর স্তুতি করলেন-
“হে দেবি, হে পরাতপরে, আপনিই জগত্মাতা, আপনার জয় হোক। আপনিই বামাক্ষী ও আপনিই কামাক্ষী। হে
ব্রহ্মময়ী, আপনিই কলা-কাষ্ঠা-মুহুর্ত-দিন-মাস-ঋতু-বর্ষস্বরূপা,
আপনার জয় হোক।”
“হে ললিতাম্বিকে, অতল যেন আপনার চরণ,
বিতল আপনার জানু, রসাতল আপনার কটিদেশ,
ধরিত্রী আপনার কুক্ষি। স্বর্গলোক আপনার শ্রীমুখ,
ভুবর্লোক আপনার হৃদয়। চন্দ্র-সুর্য্য-অগ্নি আপনার ত্রিনেত্র,
বায়ু আপনার নিশ্বাস,
বেদ আপনার বাণী, লোকরোচনা আপনারই ক্রীড়া। সৎ আপনার আবাস,
চিৎ আপনার সখা ও আনন্দ আপনার আহার। আপনাকে প্রণাম।”
“ত্রিভুবন আপনার দেহ,
মেঘমণ্ডল আপনার কেশ,
নক্ষত্র আপনার কেশপুষ্প। ধর্ম আপনার বাহু,
অধর্ম আপনার অস্ত্র। যম ও নিযম আপনার হস্তপদ,
স্বাহা-স্বধা আপনার স্তনদ্বয়। প্রাণায়াম আপনার নাসিকা ও
সরস্বতী আপনার রসনা। আপনাকে প্রণাম।”
“বৃক্ষরাজি আপনার রোম,
প্রত্যাহার আপনার ইন্দ্রিয়,
ধ্যান আপনার বুদ্ধি। পর্বত আপনার অঙ্গরূহ ,
প্রভাতই আপনার বসন। ভুত-ভব্য-ভবিষ্য-নিত্য আপনারই বিগ্রহ,
আপনি যজ্ঞরূপা ও বিশ্বরূপা,
ত্রিগুণাত্মিকা হয়েও নির্গুণ। আপনি অনাদিমধ্যন্ত,
অপাঞ্চভৌতিক। হে দেবী ললিতাত্রিপুরাসুন্দরি, আপনি তুষ্ট হোন।”
দেবী প্রসন্ন হলেন। ইন্দ্র প্রার্থনা করলেন,
“হে কল্যাণময়ী,
আমরা দৈতেন্দ্র ভণ্ডের দ্বারা পীড়িত ও লাঞ্চিত। যদি আপনি
আমাদের দ্বারা প্রসন্ন হয়ে থাকেন,
তাহলে কৃপা করুন, এই অবস্থা থেকে আমাদের ত্রাণ করুন।” স্মিত হেসে শ্রীদেবী
বললেন, “তোমাদের ভক্তিতে আমি তুষ্ট। যারা আমার স্তুতি করে আমার চরণে শরনাপন্ন হন,
তাঁদের আমি যশ, শ্রী ও ধর্ম দ্বারা অশেষ কৃপাবর্ষণ করে থাকি,
আমার অনুগ্রহেই তাঁরা পুত্রমিত্রকলত্র প্রাপ্ত হয়ে সুখে
কালযাপন করে থাকে। আমি স্বয়ং দৈত্যকুলাধিপতিকে বিনির্জিত করে চরাচরসহ ত্রিলোক বিজয়
করব। হে দেবগণ, আপনারা শঙ্কামুক্ত হোন।” দেবী ললিতার কৃপা ও আশ্বাসে দেবগণ যেন দ্বিতীয়
জন্মলাভ করলেন।
দেবীর আবির্ভাবে দেবলোক যেন খুশিতে মুখরিত হয়ে উঠল। যে যেখানে ছিলেন,
ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরীর দর্শন প্রার্থী হয়ে যজ্ঞস্থলে আগমন করতে
লাগলেন। ব্রহ্মা এলেন, গরুড় সমারূঢ় হয়ে এলেন বিষ্ণু। ঋষিদের সঙ্গে করে এলেন নারদ।
অপ্সরা, গন্ধর্ব, যক্ষ সবাই এলেন দেবী অম্বিকাকে একবারের জন্য হলেও চাক্ষুষ করতে।
সর্বমন্ত্রাধিষ্ঠাত্রী দুর্গা, সর্ববিদ্যাধিষ্ঠাত্রী শ্যামা প্রমুখ দেবীরাও অম্বিকার
সাক্ষাৎপ্রার্থী হলেন। মাতৃগণ, যোগিনীগণ, বেতালগণ, কার্তিকেয়, বীরভদ্র- ত্রিলোক যেন ভেঙ্গে পরল দেবী ললিতাকে দেখার জন্য।
এতো দর্শনার্থীদের আগমন হলো যে, স্থান সঙ্কুলান কঠিন হয়ে পরল। শেষে ব্রহ্মা বিশ্বকর্মাকে
আজ্ঞা করলেন দেবী আদিপরাশক্তির জন্য অমরাবতীর ন্যায় এক দিব্য নগর নির্মান করতে।
নগর তৈরী হলো, বিশ্বকর্মা তৈরী করলেন বড়োবড়ো অট্টালিকা,
বিশাল প্রাকার এবং সুবিশাল তোরণ। সেই নগরের নাম হলো
শ্রীনগর। নগরের ঠিক মধ্যে তৈরী হলো বহু সভা ও গোপুরমণ্ডিত এক সুরম্য রাজগৃহ। সেই
রাজগৃহের মনোরম সভাকক্ষে নবরত্নমণ্ডিত সিংহাসন-সভায় দেবীর অধিষ্ঠানের জন্য তৈরী হলো
চিন্তামণি নির্মিত এক দিব্য সিংহাসন।
কিন্তু, যেমন স্ত্রী ব্যতিরেকে একা পুরুষ রাজসিংহাসনের অধিকারী নন,
তেমনই পুরুষ ব্যতিরেকে একা স্ত্রীও রাজসিংহাসনের অধিকারী
হননা। দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী অনুঢ়া, তাই তাঁর জন্য পাত্র অম্বেষণ শুরু হলো। দেবী স্বয়ং
ত্রিগুণাতিত আদিপরাশক্তি, তাঁর সমকক্ষ পাত্র কে হতে পারে- ব্রহ্মা তা চিন্তা করতে
লাগলেন। এমন সময়, দেবীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে বৃষারুঢ় দেবাদিদেব শঙ্কর সভাগৃহে
প্রবেশ করলেন। ব্রহ্মা ভাবলেন, যে দেবী নিজেই আদি
পরাশক্তি, তাঁর জন্য স্বয়ং শক্তিমান ব্যতিত সুযোগ্য পাত্র সমগ্র ত্রিলোকে অমিল। কিন্তু,
এ কেমন বেশ মহাদেবের?
শিরে জটা, গলায় মুণ্ডমালা, বিরূপ ত্রিনেত্র, হাতে নরকপাল, কন্ঠ নীল, ভস্ম-চর্চিত দেহ! স্বয়ং শৃঙ্গাররসের প্রতিরূপ,
সর্বমঙ্গলা, সর্বালঙ্কারশোভিতা দেবী অম্বিকা কি অমঙ্গল লক্ষণধারী
শ্মশানচারীকে স্বামীত্বে বরণ করবেন?
মহাদেব ব্রহ্মার চিন্তা বুঝতে পারলেন ও নিমেষেই এক অদৃষ্টপুর্ব দিব্যরূপ ধারন করলেন।
তাঁর সেই রূপ যেন সমগ্র নগরকে আলোকিত করে ফেলল। সেই রূপের তুলনায় যেন কোটি
কন্দর্পের রূপও তুচ্ছ। দেবীর মতো তিনিও দিব্যমাল্য,
কিরীট, কোঙ্কণ, কেয়ুরাদি সর্বালঙ্কারভুষিত হলেন। তিনি অঙ্গে দিব্যচন্দন
বিলেপন করেছেন ও দিব্যমালা ধারণ করেছেন। রাজ-বসন,
রাজ-ভূষণে সজ্জিত মহেশ্বর রূপেগুণে যেন কামদেবকেও অতিক্রম করলেন,
সেই জন্য মহাদেবের এই নবসুকুমার রূপের নাম হলো কামেশ্বর।
ব্রহ্মা মহাদেবের নতুন রূপ দেখে প্রীত হয়ে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন ও তাঁকে দেবীর
সমীপে নিয়ে গেলেন ও দেবীর স্তব করলেন। দেবী অম্বিকাকে অবলোকন করে কামেশ্বর যেমন
মুহুর্তেই তাঁর প্রতি অনুরক্ত হলেন, তেমনই দেবী নিজেও শঙ্করে মোহিত হলেন। এক মুহুর্তের জন্য যেন
তাঁরা দুজনেই প্রেমতপ্ত হয়ে চেতনালুপ্ত হয়ে পড়েছিলেন।
শক্তি ও শক্তিমান- দুজনেই দুজনের মধ্যে যেন বিভোর হয়ে গেলেন।
ব্রহ্মা আবার দেবীর স্তুতি করে তাঁকে অনুরোধ করলেন ,
“হে ত্রিলোকনায়িকা,
এখানে উপস্থিত সবাই আপনাকে আপনার প্রিয়তমের সহিত সমন্বিত
হয়ে যুদ্ধযাত্রা দেখতে যাঞ্চা করেন। হে দেবি,
কৃপা করে বলুন কে আপনার যোগ্য পুরুষ?
আপনি লোকসংরক্ষণার্থে পরমপুরুষের ভজনা করুন। আপনি মহারাজ্ঞী
হয়ে আপনার স্বামীর সাথে সিংহাসনারোহন করুন,
ঋষিদের দ্বারা আপনার রাজ্যাভিষেক হবে।”
লোকপিতামহের আবেদন শুনে দেবী স্মিত হাসলেন। তারপর বললেন,
“হে সুরগণ,
আমি পরম স্বতন্ত্র এবং সর্বদা নিজ ইচ্ছা অনুসারে বিহার করে
থাকি। আমার সমমনস্ক ও অনুরূপ চরিত্রবিশিষ্ট পুরুষই আমার স্বামী হবেন।” ব্রহ্মা
সম্মত হলেন। দেবী অম্বিকা তখন নিজের কণ্ঠস্থিত দিব্যমাল্য ত্যাগ করে উর্ধ্বে
নিক্ষেপ করলেন। এক মুহুর্তকালের জন্য সেই নিক্ষিপ্ত মালা নভোমণ্ডলকে সুশোভিত করে
কামেশ্বর মহাদেবের কণ্ঠে পতিত হলো। ব্রহ্মা, বিষ্ণূ
সহ উপস্থিত সবারই আনন্দের সীমা পরিসীমা রইলো না। প্রসন্ন ব্রহ্মা তখন প্রভু
ত্রিবিক্রমকে অনুরোধ করলেন, “হে হরি, হে জনার্দন, মঙ্গললগ্ন আরম্ভ হয়েছে,
শিব ও শিবানীর বিবাহ বৈদিক মতে এখনই সম্পন্ন হোক। এবং আমার
ইচ্ছা লোকহিতার্থে আপনি স্বয়ং এই শুভকর্মের পৌরোহিত্য করুন। তাছাড়া,
আপনি ও আদিপরাশক্তি অভিন্ন এবং যোগমায়া রূপে দেবী আপনার
ভগিনীও বটে। অতএব, আপনিই ভ্রাতার কর্তব্য পালনার্থে দেবীকে সম্প্রদান করবেন।”
বহুদিন পর দেবতারা আনন্দে মেতে উঠলেন। কেশব স্বয়ং পৌরহিত্য করলেন ও সমস্ত দেব-গন্ধর্ব-যক্ষ-ঋষিদের উপস্থিতিতে কন্যাদান সুসম্পন্ন করলেন। কল্যাণান্তে দেবগণ নবদম্পতিকে নানাবিধ যৌতুক প্রদান করে সমৃদ্ধ করলেন। কামেশ্বরের পত্নী, সেই জন্য দেবী অম্বিকার নাম হলো কামেশ্বরী। বিবাহপর্ব মিটে যাওয়ার পর দেবীর রাজ্যাভিষেকের আয়োজন শুরু হলো। ব্রহ্মা ইতিমধ্যে “কুসুমাকরো” নামক এক দিব্যবিমান নির্মাণ করিয়েছেন। নবদম্পতি সেই বিমানে আরোহন করে নগর পরিভ্রমণে বেরোলেন। অপ্সরা ও গন্ধর্বগণ নৃত্য-গীত-বাদ্য দ্বারা নগর মুখরিত করে তুললেন। অপ্সরা, ঋষিকা ও অন্যান্য দেবীগণ তাঁদের উপর পুষ্পবর্ষণ করতে লাগলেন। বিমান এবার রাজপ্রাসাদে এলে মহাদেব ও মহাদেবীর নীরাজন করা হলো। তারপর, শূলপাণির সাথে দেবী ত্রিপুরাম্বিকা রাজরাজেশ্বরী রূপে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন ও ব্রহ্মা তাঁর শিরে অগ্নিদেব নির্মিত রাজমুকুট পরিয়ে দিলেন।
মহাদেব ও দেবী ললিতার রাজত্বে রাজ্যে আনন্দের সীমা রইলো না। তাঁদের রাজ্যে
দেব-দানব-রক্ষঃ-যক্ষ নির্বিশেষে সবাই সুখে শান্তিতে দিন অতিবাহিত করতে লাগল।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহাদেব, বাসব, অষ্টদিকপাল সবাই রাজ্যের প্রজাদের উপর অফুরন্ত কৃপাবর্ষণ করে চললেন। প্রত্যেক
গৃহে দেবী লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান হলো ও প্রত্যেকের বাক্যে দেবী সরস্বতীর অধিষ্ঠান হলো।
এইভাবেই সুখে স্বাচ্ছন্দে আরও দশ সহস্র বৎসর অতিবাহিত হলো। এইভাবেই দিন কাটছিল।
ত্রিলোকে তখনও কিন্তু ভণ্ডের প্রতাপ কমেনি। ভণ্ড-সংহারে বিলম্ব হচ্ছে দেখে,
দেবর্ষি নারদ দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হলেন।
নারদ অনুরোধ করলেন, “হে পরমমাতা, জগৎকে ত্রাণের লক্ষ্যেই আপনার আবির্ভাব,
আপনিই দুর্জনের বিনাশক ও সজ্জনের পালক। আপনি অবগত আছেন
নিশ্চয় ভণ্ডাসুরের অত্যাচার সম্পর্কে। সে দেবতাদের অবধ্য,
একমাত্র আপনিই তাঁকে নিধণ করতে পারেন। সাধুগণের রক্ষণই
আপনার প্রবৃত্তি। অতএব, আপনি আপনার ধর্ম পালন করুন।”
নারদের কথায় দেবী ত্রিপুরেশ্বরী সতেজে ভণ্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি
শুরু করলেন। কিন্তু সেনা কোথায়? দেবী সেই অভাবও পুরণ করলেন। দেবীর ইচ্ছায় নিজ থেকেই তিনি
লক্ষকোটি যোগিণীদের সৃষ্টি করলেন ও তাঁদের সমন্বয়ে দিব্যসেনা নির্মাণ করলেন।
দিগন্ত অবধি পরিব্যপ্ত সেই সেনাসমুদ্র দেবীর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে ত্রিলোক মুখরিত করল।
যোগিনীসেনাদের জন্য দেবী উপযুক্ত রথ-গজ-অশ্বাদি ও অসংখ্য মারণাস্ত্রেরও নির্মাণ করলেন।
বনায়ুজ-কাম্বোজ-পারদ-পার্বত্য-পারসিক-যাবনোদ্ভুব ইত্যাদি সর্বোৎকৃষ্ট ও
সর্বলক্ষণসমন্বিত, শান্ত অথচ বিদ্যুৎগামী অশ্বপ্রজাতির সমন্বয়ে তিনি এক অজেয়
অশ্বারোহীবাহিনীর সৃজন করলেন।
এরপর দেবী অম্বিকা গজবাহিনীর সৃজন করবেন বলে স্থির করলেন। উৎকৃষ্ট ও যুদ্ধের
জন্য প্রস্তুত কোটিকোটি হস্তির নির্মান হল তিনি নিমেষেই। তারপর তিনি নিজের
অঙ্কুশ হতে ভয়ঙ্করী ও তরুণসুর্যের ন্যায় রক্তাভা দেবী সম্পদেশ্বরীকে উৎপন্ন করলেন।
দেবী অম্বিকা সম্পদেশ্বরীকে কালনাথের কুটিল ভ্রুকুটির ন্যায় শোভাযুক্ত খড়্গ প্রদান
করে গজবাহিনীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করলেন। দেবী সম্পদেশ্বরী
নিজের বাহন হিসেবে স্থির করলেন চলমানপর্বতসম,
শেলসদৃশশুণ্ডযুক্ত,
সংগ্রামমরসিক এক হস্তিকে যার নাম ছিল “রণকোলাহল”। দেবীর অধীনস্ত
হস্তিবাহিনীর কোথায় আদি, কোথায়ই বা অন্ত, তা অক্ষিগোচর হলনা। কোটিহস্তির সম্মিলিত পদচারণায় পৃথিবী
মুহুর্মুহু কম্পিত হতে লাগল। নিজের বাহিনী অবলোকন করে দেবী
রোমাঞ্চিত হয়ে হুঙ্কার ছেড়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। সেনাগণ উত্তেজিত হয়ে
মর্দল-মৃদঙ্গ-ঢক্কা-ভেড়ি ইত্যাদি রণবাদ্য বাজাতে লাগল,
তাঁদের শব্দ সপ্তসমুদ্রের গর্জনকেও হার মানাল।
অতঃপর, দেবী ললিতা নিজের পাশায়ুধ থেকে অশ্বারুঢ়া দেবী শ্রীদণ্ডনাথাকে সৃষ্টি করে তাঁকে অশ্বারোহীসেনার সৈনাপত্যে প্রতিষ্ঠিত করলেন। চতুর্ভুজা দেবী ভীষণদর্শনা, তাঁর শ্রীমুখ বরাহের ন্যায়; এক হাতে অঙ্কুশ, এক হাতে পাশ, একহাতে বেত্র ও একহাতে অশ্বের বল্গারজ্জু। তাঁর অধীনস্ত কোটিকোটি অশ্বের হ্রেসাধ্বনি হুঙ্কারের ন্যায় জগতে অনুরণিত হতে লাগল, তাঁদের ক্ষুরাঘাতে ধরা বিদীর্ণ হতে লাগল। যোগিনীগণও 'এবার জয় নিশ্চিত' মনে করে প্রবল উত্তেজনায় হুঙ্কার দিতে থাকলেন। দশদিকে সমান ভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালনে সক্ষম বহু যোগিনী বজ্রসম ধনুর্বাণ সজ্জিত হয়ে দেবী দণ্ডস্বামিণীর অগ্রে অবস্থান করলেন। খড়্গ ও ঢালে সজ্জিত বহু সেনা দেবীর পশ্চাৎবর্তী হলেন। সহস্র যোগিনী বৃষ, মৃগ ও সিংহ চিহ্ন যুক্ত সুউচ্চ ধ্বজা ধারণ করে সেনা মধ্যে অবস্থান করলেন। চণ্ডদণ্ড প্রভৃতি ত্রিশুলধারী ভৈরবগণও যুদ্ধে অগ্রবর্তী হলেন। অশ্বারুঢ়া দেবী দণ্ডনাথা এবার শৃঙ্গাররূপ ত্যাগ করে রণরঙ্গিণী বেশ ধারণ করলেন ও বজ্রঘোষ নামক মহাসিংহে সমারূঢ় হলেন। সিংহের গর্জনে ধরাতে যেন প্রলয়ের উপক্রম হলো। দেবী ও তাঁর বাহন দুজনেই ভীমগর্জন করে সমুদ্রসম সেনাদল নিয়ে অবশেষে ভণ্ডাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করলেন। ললিতাম্বিকা দেবী দণ্ডদাত্রীকে নিজের যোগিনীসেনার সর্বাধিনায়িকা হিসেবে অভিষিক্ত করলেন। দেবগণ 'ধন্য, ধন্য' করে উঠলেন। দেবীর বিক্রমে সন্ত্রস্ত ও মুগ্ধ হয়ে দেবতারা দেবীর দ্বাদশনাম কীর্তন করলেন।
সেনানির্মাণ হলো, সেনাপতি নির্বাচনও সম্পন্ন হলো। কিন্তু দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীকে
মন্ত্রণা দেবেন কে? অতএব দেবী ললিতা আবার নিজ শরীর থেকে অপর এক দেবীকে উৎপন্ন করলেন।
দেবী রথারুঢ়া, ঘোর শ্যামবর্ণা, দ্বিভুজা; এক হাঁতে বীণা ও অপর হস্তে একটি শুকপক্ষী। উদিয়মান সুর্যের
মতো উজ্জ্বল বর্ম পরিহিতা নবোত্থিতা দেবীকে, আদিপরাশক্তি
নিজের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত করলেন,
তাই দেবীর নাম হলো মন্ত্রনায়িকা। দেবী মন্ত্রনায়িকার আগমনে
যোগিনী সেনা আনন্দে নৃত্য করে উঠলেন। ভক্তিভরে দেবী দণ্ডনায়িকা তাঁর চরণবন্দনা করলেন।
রণোন্মত যোগিণীগণ হুঙ্কার ও গর্জনের মাধ্যমে নিজেদের শক্তির জানান দিতে থাকল। তাঁদের
কেউ ময়ুরবাহনা, কেউ হংসবাহনা, কেউ ভীষণদর্শন নকুলের পিঠে সমারূঢ়া,
কেউ কুক্কুট আবার কেউ ঘোটকের পিঠে আসীনা। তমালবর্ণা এই
সমস্ত যোগিণীগণ দেবী মন্ত্রনায়িকার নেতৃত্বে এগিয়ে চললেন। ভীষণ সেনাবাহিণী ও তাঁর
যোগ্য নেতৃত্বপ্রদানকারীকে দেখে দেবগণের বিস্ময়ের অবধি থাকল না,
তাঁরা সসম্ভ্রমে দেবী মন্ত্রনাথার অষ্টাদশ নাম জপ করতে
লাগলেন। এমনসময় দেবী শ্যামলা মন্ত্রনাথার সম্মুখে চতুর্ভুজ ধনুর্বেদের আবির্ভাব হলো।
ভক্তিভরে প্রণাম করে তিনি দেবীকে চিত্রজীব নামক এক ভীষণকায় ধনুক ও দুটি অক্ষয় তূণীর
অর্পণ করলেন। ধনুকের ক্ষমতা পরীক্ষণের জন্য দেবী জ্যা-রোপণ করে তাতে
প্রবল আকর্ষণ করলেন। ধনুকের গুরুগম্ভীর টঙ্কার জগতে
আদিশব্দের মতো মুখরিত হতে লাগল। দেবী প্রীত হলেন। এই ভাবেই দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী
নিজের সেনা ও পারিষদ নির্মান সম্পুর্ণ করলেন,
যা সংখ্যায় ছিল ১০০০ অক্ষৌহিণী।
দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী অবশেষে নিজে এবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। চতুর্ভুজে
তিনি অঙ্কুশ, পাশ, ইক্ষু নির্মিত ধনুক ও পঞ্চবাণ- এই চতুর্বিধ অস্ত্র ধারণ করলেন।
বর্ম-চর্ম-অস্ত্র সজ্জিত দেবীর শরীর থেকে সহস্র সুর্যের সমপ্রভ এক দিব্য মঙ্গলময়
আভা যেন চতুর্দিক বিকীর্ণ করল। তিনি এবার নিজের দিব্যরথ শ্রীচক্ররাজে আরোহন করলেন।
দেবীকে যুদ্ধে সঙ্গদানের জন্য রহস্যযোগিণী,
নিগর্ভযোগিণী, অজ্ঞশক্তি, গুপ্ততারা, মুদ্রাদেবী, মাতৃকা, নিত্যা প্রমুখও দেবীরাও রথে অবস্থান করলেন। সপার্ষদ দেবীর
এমন ভীষণ মূর্তি অবলোকন করে সমগ্র দেবলোক রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। তাঁরা দেবীকে প্রণাম
করে দেবীর পঞ্চবিংশতি নাম কীর্তন করে দেবীকে প্রীত করলেন। যুদ্ধের জন্য দেবী ললিতা
মন্ত্রনায়িকা ও দণ্ডনায়িকাকেও যথাক্রমে গীতিচক্র ও কিরীচক্র নামক দুটি স্বর্গীয় রথ
প্রদান করলেন। তাঁদের রথেও রতি, প্রীতি, বামা, জ্যেষ্ঠা, ভৈরবী, মোহিনী, স্তম্ভিণী, ধাত্রী, সিদ্ধি প্রভৃতি দেবীরা নানান পদে অধিষ্ঠিত হলেন। এবার সেই
অতিপ্রতীক্ষিত মুহুর্ত এল। দেবী তাঁর ১০০০ অক্ষৌহিণী যোগিনী সৈন্যের সাথে ভণ্ডের
নগরী শোণিতপুরে যাত্রা করলেন। দেবীর সৈন্য সজ্জার নৈপুন্যে দেবগণ অভিভূত হয়ে
পড়লেন। গোটা ত্রিলোক দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে আকাশ-পাতাল মুখরিত করতে
লাগল।
ভণ্ডাসুর তখন রাজসভায় মন্ত্রীদের সাথে আলোচনায় মগ্ন ছিলেন। দৈত্যগুরু
শুক্রাচার্য্য ভণ্ডকে ত্যাগ করায় কিছুটা চিন্তিত ছিলেন তিনি। এদিকে দেবতাদের
তপস্যাও ভণ্ডুল করতে ব্যর্থ তাঁর সৈন্যদল। পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে,
তাই নিয়ে শলাপরামর্শ করছিলেন তাঁরা। এমন সময় ঘটলো অঘটন!
তাঁর নগরীতে নানান দুর্লক্ষণ দেখা দিল। নগরীর সীমান্তপ্রাকারে অকালেই ফাটল দেখা
দিল, নগরে
উল্কাপাত হতে লাগল। ভুমিকম্প গোটা নগরীর সাথে নগরবাসীদের হৃদয়কেও কম্পিত করে তুলল।
অগ্নিসংযোগের মতো ভয়ংকরো দুর্ঘটনাও ঘটতে হতে থাকল। গৃধ্র,
বায়স, শ্যেন ইত্যাদি মৃতভোজী পক্ষীদল অট্টালিকার চূড়ায় অবস্থান
করে বিকট স্বরে ক্রন্দন করতে করতে যেন আসন্ন বিপদের সংকেত দিতে লাগল।
দৈত্যগৃহিণীদের মুল্যবান অলঙ্কার ভূমিতে পতিত হলো, দর্পণে ফাটল দেখা দিল। স্বজনদের অমঙ্গল আশংকা করে তাঁরা
উচ্চস্বরে বিলাপ করতে লাগলেন। আর ভণ্ডাসুর?
তিনি অবলোকন করলেন এক অপার্থিব দৃশ্য;
তিনি দেখলেন তাঁর রাজপ্রাসাদের চূড়ায় সুউচ্চ ধ্বজদণ্ডে
প্রোথিত দৈত্য সাম্রাজ্যের ধ্বজা, কিছুক্ষণ আগেও যা সগর্বে বাতাসে হিল্লোলিত হয়ে তাঁর
সাম্রাজ্যের জয়জয়কার করছিল, কোনো এক অজ্ঞাতকারণে তা ভীষণভাবে অগ্নিতে দগ্ধ হচ্ছে,
আর তার ঠিক পশ্চাৎপটেই মধ্যগগনে সুর্যদেব গ্রহণগ্রস্ত
হচ্ছেন।
নগরে এতো অশুভ সংকেতের ঘনঘটাতেও ভণ্ড বিচলিত হল না;
বা বলা ভালো সর্বসমক্ষে নিজের বিচলিত ভাব প্রকাশ করল
না। চক্রবর্তী সম্রাট,
ত্রিভুবনাধিপতি; সাধারণের ন্যায় সেও যদি স্নায়ুনিয়ন্ত্রণে
ব্যর্থ হয়,
তাহলে এমন সঙ্কটকালে রাজ্যের হাল ধরবে কে! তখনই সে এক
গোপন সভার আয়োজন করল ও সমস্ত পারিষদকেও সভায় উপস্থিত থাকতে আদেশ করল। সভাস্থ সকলে
দেখল, তাঁদের আজ সম্রাট যেন কিছুটা ম্রিয়মাণ। গুপ্তচরগণ ভণ্ডের অনুজ মহাপ্রতাপ
বিশুক্রকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে আগেই অবহিত করেছিল। সে সভায়
অগ্রজের পাদবন্দনা করে বলল, “হে দৈত্যেন্দ্র, আপনি নিজবলে ইন্দ্রাদি দেবগণকে বিধ্বস্ত করেছেন,
তাঁদের আশ্রয়ের জন্য তিলার্ধপরিমাণ ভুমিও রাখেননি। দেবগণ
আপনার সমকক্ষ নয়, আপনাকে আক্রমণ করার মতো সাহসও নেই ওই ভীরু বাসবের। তাই
তাঁরা নাকি তপস্যা করে এক দিব্য নারীকে সৃষ্টি করেছেন আপনাকে পরাস্ত করার জন্য।
সেই ছলনাময়ীও নাকি নিজের অস্ত্রশস্ত্র ও নারীসেনা নিয়ে আপনাকে সম্মুখসমরে আহ্বান করতে
চাইছে। ভ্রাতা, নিয়তির কি অপুর্ব পরিহাস দেখুন! এই অবলাগণ নাকি দৈত্যসেনাকে জয় করতে চায়!
হাস্যকর! লতার আঘাতে কি কখনও পাষাণ বিদীর্ণ হয়?
ওই দুর্মতি নারীগণের আমাদের ভৃত্যদের সাথে সংগ্রামেরও
যোগ্যতা নেই। দেবগণ কাপুরুষ আর ইন্দ্র নারীসেনা যুদ্ধে প্রেরণ করে নিজেও ভীরুতার
পরিচয় দিয়েছে। কোথায় তাঁদের ব্রহ্মা, বিষ্ণূ, মহেশ্বর- দেবতাদের হয়ে তাঁরা যুদ্ধ করছেন না কেন?
তাঁরাও কি নিজেদের কাপুরুষত্বের আড়ালে লুকিয়ে আছেন?
হে ত্রিলোকবিজয়ী, সেনা নয়, তাঁদের পরাজিত করতে আমাদের ভৃত্যদলই যথেষ্ট। আপনি এখনই
তাঁদের আদেশ করুন, তাঁরা যেন নারীসেনা ছত্রভঙ্গ করে এবং তাঁদের দলনায়িকাকে যেন
তাঁর কেশদাম আকর্ষণ করে আপনার চরণতলে নিপতিত করে। মহারাজ,
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন,
ওই সুন্দরী মৃগনয়না নারী অচিরেই আপনার দাসী হয়ে
গৃহশোভাবর্ধন করবে। দৈত্যাধিপতি, আপনি আজ্ঞা করুন।”
এই উপদেশ বিষঙ্গের মনঃপুত হলনা একেবারেই। অহঙ্কারবশত প্রতিপক্ষকে দুর্বল ও
নিকৃষ্ট মনে করা অনুচিত। তাই চিন্তিত বিষঙ্গ নিজের অগ্রজকে বলল,
“অসুরাধিপতি,
যে কোনো কার্য যথাযথভাবে বিবেচনার পরই করা উচিত। যথেষ্ট
সতর্কতা অবলম্বন না করে, অগ্রপশ্চাৎ ভাবনা না করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়,
কারণ তাতে উক্ত কার্যের সমূলে বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ভ্রাতা, বর্তমান পরিস্থিতিতে গুপ্তচরের দৃষ্টিতে শত্রুকে পরিমাপ করাটাই প্রথম ও প্রধান
কর্তব্য। অতএব, আপনি কিছু অভিজ্ঞ ও সুদক্ষ গুপ্তচরকে শত্রুশিবিরে প্রেরণ করে শত্রুর বলাবল
সম্পর্কে সম্পুর্ন ভাবে অবগত হোন। অবিবেচক ও দুঃসাহসী নৃপতি মাত্রই নিজের ও
স্বজাতির বিনাশের কারণ হয়। আপনার স্মরণে আছে নিশ্চয়ই,
স্তম্ভ থেকে উৎপন্ন অর্ধনর-অর্ধপশু এক বিচিত্র জীব
বরাহকল্পে মহামহিম হিরণ্যকশিপুর নিধনের হেতু হয়েছিল। আদিতে চণ্ডিকা নামক এক দুষ্টা
মায়াময়ী শুম্ভ, নিশুম্ভ ও মহাবল মহিষকে নিপাতিত করেছিল। অর্থাৎ,
হে অগ্রজ, শত্রু নারীই হোক, পশুই হোক বা শুদ্রই হোক- তাঁকে দুর্বল প্রতিপন্ন করে তাঁর
বৈরীতা অবজ্ঞা করাটা দুঃসাহস মাত্র। অতএব,
মহারাজ, আমার নিবেদন এই যে,
নারী বলে তাঁর প্রতি কোনোরূপ দাক্ষিণ্য না দেখিয়ে,
সবলে ও চতুরঙ্গসৈন্য সমাহারে তাঁকে আক্রমণ করা হোক।”
নিজ ভ্রাতার এই 'কাপুরুষোচিত' কথায় ভণ্ড যার-পর-নাই লজ্জিত ও অসন্তুষ্ট হল। বিষঙ্গকে
ভর্তসনা করে সে বলল, “নারীদের ক্ষেত্রে পৃথক করে কোনরূপ বিচার-বিবেচনার আবশ্যকতা
দেখিনা। মূঢ় তুমি! তুমি দৈত্যাধিপতি ভণ্ডের অনুজ,
সামান্য এক অবলার আস্ফালনে অকারণে ভীত হওয়া তোমার তথা
অসুরকুলের শোভা পায়না। ইতিমধ্যে আমি চর দ্বারা সন্দেশ পেয়েছি। ওই মায়াময়ী নাকি
অগ্নিসম্ভুতা, নাম ললিতা। সার্থক সেই নাম, পুষ্পের ন্যায় ললিত তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ,
সেই অঙ্গ কেবল শৃঙ্গারের উপযুক্ত,
যুদ্ধ নয়। মায়াপ্রাজ্ঞ্য হলেও তাঁর বাহুবল শূন্য,
তাঁর এই বিশাল নারীসেনাও সেই মায়াবিদ্যারই ফসল। আমি
ত্রিলোকবিজয়ী, আমার প্রতাপে দেবগণ পর্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়ে ছদ্মুবেশ ধারণ করে লুকিয়ে আছে। আমার
সেনা অপরাজেয়, আমার সেনাপতিগণ সাগর শোষণ ও স্বর্গ দহনেও সক্ষম। কুটিলাক্ষ,
কুরণ্ড, করোঙ্ক প্রমুখ আমার শতাধিক মহাবল পুত্র ও তাঁদেরও শতশত পুত্র বর্তমান। সাহসিকতায় তাঁরা হিরণ্যকশিপু ও
বাহুবলে হিরণ্যাক্ষের সমান। ওই পাপমতি নারী ক্ষীণবুদ্ধি,
তাই যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর না আছে পুর্বজ্ঞান না সে জানে আমার
প্রতাপ। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যেকোনো মহাযোদ্ধা তাঁর শত সহস্র অক্ষৌহিণী সেনা সমৃদ্ধ
হয়ে আমাদের আক্রমণ করুক, আসলে তাঁর নিয়তিই তাঁকে ধ্বংসের পথে আকর্ষণ করছে। আর এত
সামান্য এক নারী! তাঁদের অহঙ্কার অন্তঃপুরে শোভা পায়,
যুদ্ধক্ষেত্রে নয়। ওহে বিষঙ্গ,
তোমার শঙ্কা অমুলক,
হয় সেই পাপিষ্ঠা আমার দাসী হবে,
নতুবা সমূলে সে আমার প্রতাপে ভস্মীভূত
হবে।”
এমন সময় নগরের বাইরে ঢোল-মৃদঙ্গের ভীষণ শব্দ ও সমবেত নারীকণ্ঠের প্রবল
রণহুঙ্কারে গোটা শোণিতপুর যেন কেঁপে উঠল। আদি পরাশক্তি শ্রীদেবী তাঁর সেনা সমেত
নগর আক্রমণে উদ্যত হয়েছেন। নিজের রাজপ্রাসাদ থেকে এইবার ভণ্ডাসুর সচক্ষে দেবীর
বিক্রম প্রত্যক্ষ করলেন। দিগন্তবিস্মৃত সেই সেনা কোনো অশান্ত সাগরের তুলনায় কম নয়,
যার বিধ্বংসী ঢেউ অনতিবিলম্বেই দৈত্যরাজ্যে আছড়ে পড়তে চলেছে। সেনার
পদচারণায় উত্থিত ধূলীময়
বাতাস যেন অশুভ কুজ্ঝটিকার ন্যায় গোটা নগরকে গ্রাস করছে। সামান্য নারীর এমন
স্পর্ধা, সে কিনা নিজেকে ত্রিলোকাধিপতি ভণ্ডের সমকক্ষ ভাবে! ভণ্ড তাই ওই পাপিষ্ঠাকে
উচিত শিক্ষা দিতে চাইল। সিংহাসন থেকে গাত্রোত্থান করে ভণ্ড হুঙ্কার দিয়ে ঘোষণা করল, “দৈত্যগণ, অস্ত্রধারণ করো, সেনা প্রস্তুত করে তৈরী থাক। পুত্র কুটিলাক্ষ,
যুদ্ধ আগতপ্রায়। নগরের প্রত্যেক প্রবেশদ্বারে ভীমদর্শন
শুলধারী দ্বারপাল নিযুক্ত করো। তালজঙ্ঘ, তালভুজ, তালগ্রীব ও তালকেতু- এই চারজন মহাবল সেনাপতির প্রত্যেকে ১০
অক্ষৌহিণী করে সেনা প্রদান করে নগরের চতুর্দিকের চতুর্দ্বারে অবস্থান করতে বল।
নগরের প্রত্যেকটি দুর্গে ক্ষেপণিকাধারী সেনা সংস্থান করো। পুরোহিতদের আদেশ করো,
তাঁরা যেন অবিলম্বে দুষ্ট কর্মানুষ্ঠান আরম্ভ করেন। নগরের
মধ্যস্থিত শালবলয়ে অবস্থান করার জন্য আরও ১০ অক্ষৌহিণী সেনা নিযুক্ত করো। । পুত্র,
তুমি সেনাপতি দুর্মদকে প্রস্তুত হতে আদেশ দাও,
তাঁকে আমি ১০ অক্ষৌহিণী দৈত্যসেনার দলনায়ক হিসেবে স্থাপন করলাম,
অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত হয়ে তাঁকে এখনই সেনা সহ প্রস্থান করতে
আদেশ করো। ওই নির্লজ্জা পাপিনীকে সে যেন এই মুহুর্তে কেশাকর্ষণ করে আমার সম্মুখে
উপস্থিত করে। মহাবল দুর্মদ, আশীর্বাদ করি তুমি যেন দৈত্যগণের নাম উজ্জ্বল করে বিজয়ী
রূপে নগরে প্রত্যাবর্তন করো।”
ভণ্ডের আদেশে ভণ্ডপুত্র কুটিলাক্ষ সমস্ত ব্যবস্থা করল। সেনাপতি দুর্মদও সেনা
সমাহারে দেবী ললিতাত্রিপুরাসুন্দরীকে পরাজিত করতে যাত্রা করল। দেবীসেনার রণভেরীর
নির্ঘোষের উত্তরে দৈত্যসেনাও সজোরে দুন্দুভি বাদন করা শুরু করল। দৈত্যসেনাও
ক্রমাগত হুঙ্কার দিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে থাকল। এমন যুগপৎ শব্দযুদ্ধে
ত্রিভুবন বধির হওয়ার উপক্রম হলো। অসি, পট্টিশ, মুদ্গর, ভিন্দিপাল, কুঠার, গদা, শতাঘ্নী, ত্রিশিখা, বিশিখা, মহাচক্র সজ্জিত অসুরসেনাগণ ত্রিলোক বিনাশের ক্ষমতাধারী।
অশ্ব, গজ, উষ্ট্রক, সিংহ, শরভ, ভেরুণ্ড ইত্যাদি বাহনে সমারুঢ় হয়ে অসুরগণ দেবীসেনাসংহারের জন্য অগ্রবর্তী হলে,
তাদের ক্রোধাগ্নি যেন স্বয়ং ইন্দ্রকেও দগ্ধ করতে সক্ষম।
এছাড়াও, শঠচুড়ামণি কুটিলাক্ষ কতিপয় সেনা সমন্বিত এক গুপ্তচরকেও যুদ্ধের সন্দেশ
সংগ্রহের জন্য নিযুক্ত করল। অতঃপর, চতুর্দশ ভুবনকে যেন ভেদন করতে করতে ১০ অক্ষৌহিণী ভয়ঙ্কর
সেনা নিয়ে সেনাপতি দুর্মদ দেবীসেনাকে আক্রমণ করল।
দেবীসেনা ও দৈত্যসেনার ভীষণ যুদ্ধ শুরু হলো। নিজেদের ভয়ঙ্কর অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে
রণনিপুণ দৈত্যসেনা শত্রুপক্ষকে নিপাত করতে লাগল। অসি ঝনঝনিয়ে উঠল। অসির সাথে অসি,
ভল্লের সাথে ভল্ল, শরের সাথে শরের আঘাতে যে স্ফুলিঙ্গ উৎপন্ন হলো তা দেখে যেন
বজ্র বলে ভ্রম হয়। দৈত্যসেনা হিংস্র হলে কি হবে,
মহাদেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর সেনা ছিল হিংস্রতর। রণকৌশলে তাঁরা
ছিল দৈত্যসেনা থেকেও নিপুণ। অতএব, যুদ্ধে প্রবল সংখ্যায় দৈত্যসেনার নিধন হতে লাগল।
যুদ্ধক্ষেত্রের ভুমি রক্তের আতিশয্যে কর্দমাক্ত হয়ে উঠল। মনে হতে লাগল,
দেবী যেন নিজেই যুপকাষ্ঠে একে একে অসুরদের বলি দিচ্ছেন এবং
নিজেই সেই বলি গ্রহণ করছেন।
এমন ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ দেখে অসুররা দিশেহারা হয়ে পড়তেই সুযোগ বুঝে দেবী
সম্পদেশ্বরী তাঁর সেনা নিয়ে দৈত্যব্যুহের দক্ষিণ পার্শ্ব আক্রমণ করলেন। হঠাৎ
আক্রমনে হতচকিত দৈত্যসেনা সাধ্যমত শক্তিসেনার আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করতে
লাগল। কালক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রে যেন অসুররক্তের নদী উৎপন্ন হলো। কল্পান্তের অগ্নি
যেমন ভীষণ সমুদ্রকে গ্রাস করে, শক্তিসেনা সেইভাবেই অসুরদের গ্রাস করতে লাগলো। দেবী
সম্পদেশ্বরীর আক্রমণে সিংহভাগ অসুরসেনার পতন হলো,
যুদ্ধক্ষেত্রে ছিন্নমুণ্ড স্তুপাকারে এখানে সেখানে পতিত হতে
লাগল। শেষবারের মতো আঘাত হানার ইচ্ছা নিয়ে সেনাপতি দুর্মদ উষ্ট্রকপীষ্ঠে সমারুঢ়
হয়ে দেবী সম্পদেশ্বরীকে বধ করতে ধাবিত হল। অবশিষ্ট সেনা নিয়ে সেনাপতি দুর্মদ এমন
বিধ্বংসী যুদ্ধ আরম্ভ করল যে তাঁকে দেখে দেবীসেনাও কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে
গেলেন।
বর্ষাকালে মেঘ অরণ্যের উপর যেভাবে জলবর্ষণ করে,
দুর্মদের নেতৃত্বে দৈত্যসেনাও শত্রুপক্ষের উপর শরবর্ষণ করতে
লাগলো। ক্রুদ্ধ দেবী সম্পদেশ্বরী এবার তাঁর বাহন রণকোলাহল হস্তীর পীষ্ঠে আরুঢ়া হয়ে
দুর্মদের সাথে সম্মুখসমরে রত হলেন। দেবীর নিক্ষেপিত শরে সূর্য
আচ্ছাদিত হলো। এমন সময় সেনাপতি দুর্মদ এক ভয়ঙ্কর বাণে দেবীর কিরীটস্থিত দিব্যমণি
কিরীটচ্যুত করলে দেবী নৃসিংহসম হুঙ্কার করে দুর্মদের দিকে শরনিক্ষেপ করলেন। সেই
কালদণ্ডস্বরূপ বাণ সেনাপতি দুর্মদের বর্ম ভেদ করে বক্ষ বিদীর্ণ করে ভূমিতে
প্রবেশ করল। দুর্মদ নিহত হল। “সেনাপতি হত হয়েছেন”- উচ্চৈঃস্বরে এমন বিলাপ করতে করতে
ভীত দৈত্যসেনা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পলায়ণ করল। দুর্মদের পতন ও পলায়নরত
দৈত্যসেনাদের দেখে শক্তিসেনা আনন্দে কোলাহলো করে উঠলেন। “জয় দেবী সম্পদাম্বিকের জয়,
জয় দেবী ত্রিপুরাম্বিকের জয়”- এইরকম জয়ধ্বনিতে ত্রিলোক
মুখরিত হলো।
“মহারাজ, সেনাপতি দুর্মদের পতন ঘটেছে,
যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন।”- কুটিলাক্ষের
কাছ থেকে এমন অশুভ সংবাদ পেয়ে ভণ্ডাসুর স্তম্ভিত হয়ে গেল। “কিভাবে
তা সম্ভব? যে দুর্মদ ক্রীড়াচ্ছলে সুরলোক অধিকার করতে পারে,
এক সামান্য পাপিষ্ঠার হাতে তাঁর মৃত্যু কিভাবে হলো?
হা অদৃষ্ট! দৈবই দেখছি প্রবল! না হলে রক্ষঃ,
যক্ষ, উরগ এমনকি ইন্দ্রের পক্ষেও যে অজেয়,
এক অবলার হাতে নাকি সে নিহত হয়!” পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল
ভণ্ড। কোষস্থিত খড়্গে হাত বুলিয়ে ভণ্ড আদেশ করল,
“পুত্র,
তুমি অবিলম্বে ২০ অক্ষৌহিণী সেনা প্রদান করে দুর্মদাগ্রজ
কুরণ্ডকে যুদ্ধে প্রেরণ করো। সে যেন এই মুহুর্তেই সেই দুষ্টা পাপিয়সীর কেশাকর্ষণ
করে আমার সামনে উপস্থিত করে।” কুটিলাক্ষ আদেশ পালন করল ও সেইসঙ্গে কুরণ্ডকে সতর্ক
করে বলল, “সেনাপতি, ওই অহঙ্কারিণী সম্পদেশ্বরী তোমার অগ্রজকে নিহত করেছে। পাপীয়সী মায়া যুদ্ধে
নিপুণা, তাঁকে মায়া প্রয়োগ করেই পরাজিত করো।”
অতঃপর চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে সেনাপতি কুরণ্ড দেবীশিবিরে আক্রমণ করল। নিজ ভ্রাতার
মৃত্যুতে দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ হলেও যুদ্ধ নৈপুণ্যে তার প্রভাব পরল না। অশ্বে আসীন
হয়েও সেনাপতি কুরণ্ড তাঁর শার্ঙ্গ ধনুকের সাহায্যে দেবীসেনার উপর প্রবল শরবর্ষণ করতে
থাকল। কুরণ্ড হুঙ্কার দিয়ে দেবীকে বলল, ''রে কুলঘাতিনী, আমার ভ্রাতা মহাবল দুর্মদকে বধ করে তুই বৃথাই গর্ব করছিস,
সাধ্য থাকে তো আমাকে পরাজিত করে দেখা। হয় আমি নিজে যমালয়ে
গমন করব, নতুবা এই ক্ষুরধার নারাচের আঘাতে তোকেই যমালয়ে প্রেরণ করব। নগরের রণপুতানাগণ
বহুকাল ধরে তৃষ্ণার্ত, তোর রমণীয় দেহনিঃসৃত সুস্বাদু রুধীরের মাধ্যমেই আজ তাদের
তৃষ্ণা নিবারণ হবে। দুষ্টে, আমার ভ্রাতাকে হত্যা করে তুই ঘোর অনর্থ করেছিস,
নিজের বাহুবল দ্বারা এখনই তোকে সেই পাপের উচিত দণ্ড প্রদান করব।”
কুরণ্ডের এইরকম আস্ফালনে দেবী সম্পদেশ্বরী মোটেই শঙ্কিত হলেন না,
বরঞ্চ কৌতুক বোধ করলেন। অট্টহাস্য করে দেবী সম্পদেশ্বরী
দ্বিতীয় বারের জন্য দৈত্যদের আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন,
এমন সময় দেবী দণ্ডনায়িকা তাঁকে বাধা দিলেন।
অশ্বারোহী দেবী দণ্ডনায়িকা স্মিত হেসে সম্পদেশ্বরীকে বললেন,
“সখী,
তুমি ক্ষণিকের জন্য শান্ত হও,
নিজ সেনার সাথে বিশ্রাম করো। এই অহঙ্কারী দৈত্যকে আমার সাথে
যুদ্ধ করতে দাও। অবিলম্বে আমি তাঁকে আক্রমণ করো ও তাঁর যমালয়ে গমনের প্রার্থনা
নিমেষেই পুর্ণ করব। দেবি, তুমি শঙ্কিত হয়োনা।” দেবীর কথা সম্পদেশ্বরীর মনঃপুত হলো,
তিনি তাঁর সেনাকে সরিয়ে নিলেন। নিমেষেই দেবী দণ্ডনায়িকার
সৈন্য হুঙ্কার দিয়ে উঠল। বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন অসংখ্য অশ্বারোহী সেনা অসুরদের আক্রমণ করল।
অশ্বক্ষুরের আঘাতে ভূমি বিদীর্ণ হলো, তা থেকে উৎপন্ন ধূলিঝড় চারিদিক ব্যপ্ত করল।
কালান্তকের যমের ন্যায় অশ্বারোহী বাহিনী অসুরসেনাকে ধ্বংস করতে লাগল। দেবী
দণ্ডনায়িকা নিজে সেনাপতি কুরণ্ডের সাথে সম্মুখসমরে লিপ্ত হলেন। নিজের ধনুক থেকে
নিক্ষিপ্ত সুবর্ণপঙ্খ শর দিয়ে তিনি যেন দশদিক বিদ্ধ করতে লাগলেন। এমনকি দেবী বাহন
অপরাজিত অশ্বও তাঁর ক্ষুরাঘাতে পার্শ্ববর্তী সৈন্যমর্দন করতে লাগল। দেবীসেনার
অশ্ববাহিনীর সম্মিলিত হ্রেষাধ্বনি শুনে কিছু দৈত্য মুর্ছিত হলো,
কিছু স্তম্ভিত হয়ে নিশ্চল হয়ে পরল আবার কিছু ভীত হয়ে পলায়নও
করল। এদিকে কুরণ্ডও কম যান না, তিনিও তাঁর শার্ঙ্গ ধনুর সাহায্যে যোগ্য প্রতিআক্রমণ করতে
থাকলেন। বাণের জ্বাল রণভুমি এমনভাবে অন্ধকার করে দিল যে প্রভাত না রাত্রি তা আর
বোধগম্য হলনা।
এমনসময়, দেবী সৈত্যসেনার দিকে তাঁর ভয়ঙ্কর পাশায়ুধ নিক্ষেপ করলেন। সেই পাশায়ুধ থেকে
আরও কোটিকোটি ভুজঙ্গতুল্য পাশ নির্গত হয়ে দৈত্যসেনাকে বন্ধন করে তাদের গতিরুদ্ধ করল।
কুরণ্ড নিজেও পাশে আবদ্ধ হয়েছিলেন, অতঃপর অসির সাহায্যে নিজেকে বন্ধনমুক্ত করলেন এবং এক ভীষণ
শরাঘাতে দেবী দণ্ডনায়িকার মণির্ধনুর জ্যা ছিন্ন করলেন। ছিন্নধনু ত্যাগ করে দেবী
দণ্ডনায়িকা তাঁর বজ্রমুষ্ঠি থেকে নিজের অঙ্কুশ নিক্ষেপ করলেন। দ্বিপ্রহরের সুর্যের
ন্যায় সেই অঙ্কুশ নভোমণ্ডল প্রজ্জ্বলিত করে উল্কার ন্যায় কুরণ্ডের বক্ষে পতিত হলো।
ভীষণ যুদ্ধ করে অবশেষে কুরণ্ডের ভবলীলা সাঙ্গ হলো। বজ্রাঘাতে ছিন্ন বৃক্ষের মতো
সেনাপতি কুরণ্ডের নিষ্প্রাণ, রক্তাক্ত দেহ ভুমিতে পতিত হলো। দেবীর অঙ্কুশ থেকে অতঃপর
ভীষণদর্শণ পুতনাদের উদ্ভব ঘটলো। জীবিত-মৃত বিচার না করে সেই পুতনাগণ মহানন্দে
দৈত্যদের ভক্ষণ করে অবশিষ্ট সেনারও বিনাশ করল।
কুরণ্ডের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ভণ্ড প্রচণ্ড ক্রোধে ক্ষণিক নিশ্চুপ হয়ে রইলেন,
তারপর নিজ পুত্র কুটিলাক্ষকে বললেন,
“স্বপ্নেও যার সম্ভাবনা ছিলনা,
এমন অভুতপুর্ব দুর্ঘটনা ঘটছে আমাদের সাথে। ওই মায়াবিনী
দুষ্টাকে অক্ষম প্রতিপন্ন করা একদমই উচিত হয়নি,
তাঁর শক্তি আমাদের ধারণাতীত। পুত্র কুটিলাক্ষ,
তুমি অবিলম্বে মহাবল
করোঙ্ক, বজ্রদন্ত, বজ্রমুখ, বজ্রলোমা ও কালবাশিত - এই পাঁচ সেনাপতিকে প্রস্তুত হতে বল,
তাদেরকে শত অক্ষৌহিণী সেনা প্রদান করে রণভুমিতে প্রেরণ করো।
এঁরা যুদ্ধে অজেয়, বিজয়ের জন্য নিজশরীর ত্যাগ করতেও প্রস্তুত। ওই দুর্বিদগ্ধ বিলাসিনীকে
এঁরা অবশ্যই বিজিত করতে পারবে।”
প্রবল সৈন্যবল নিয়ে দৈত্যগণ দেবী ললিতার সেনা আক্রমণে প্রস্তুত হলো।
দৈত্যরাজ্যের ধ্বজা উড্ডয়ন করতে করতে তাঁরা সগর্বে যুদ্ধক্ষেত্রে আগমণ করল। পদাতিক,
অশ্বারোহী, গজারোহী- প্রভৃতির পদাঘাতে ধরিত্রী কম্পিত হতে লাগল,
সবৃহৎ রথচক্রের চাপে ভুমি যেন কর্ষিত হতে লাগল। শত
অক্ষৌহিণী সেনাদের হুঙ্কার ও কোলাহলের শব্দে,
অদৃশ্যলোকে আত্মগোপনকারী সুরগণও ভয় পেলেন। তাঁরা শঙ্কিত
হলেন এই ভেবে যে, এমন প্রভাবশালী সৈন্যকে আদিপরাশক্তি জয় করতে পারবেন কি?
এইবার দৈত্যসেনা দেবীকে পরাজিত করার জন্য এক সুচতুর পন্থা
অবলম্বন করল। করোঙ্ক প্রমুখ পঞ্চ সেনাপতি ছিলেন মায়াবিদ্যায় নিপুণ। তাই তাঁরা মায়া
অবলম্বণ করেই মহামায়ার সেনাকে বিনাশ করোবে স্থির করল। পঞ্চসেনাপতি তাদের সম্মিলিত
শক্তি প্রয়োগ করে যুদ্ধক্ষেত্রেই রণশাম্বরী নামক এক ধুম্রবর্ণা সর্পিণী মায়াকে সৃষ্টি
করল। এই সর্পিণী নাগমাতা কদ্রুর ন্যায় অসংখ্য মহাবল সর্প উৎপন্ন করার ক্ষমতাধারিণী,
সর্পই তাঁর আয়ুধ, সর্পই তাঁর ভূষণ। রণশাম্বরী প্রকটিত হলে দৈত্যগণ তখনই
বিজয়ানন্দে উল্লাস করে উঠলো। সর্পিণীকে অগ্রবর্তী করে বিশাল দৈত্যসেনা অতঃপর
দেবীসেনাকে আক্রমণে করল।
দেবীপক্ষ ও দেবদ্রোহীদের মধ্যে এক ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আরম্ভ হলো। যুদ্ধে
সেনাদের পদচারণায় উৎপন্ন ধুলিময় বাতাস সুর্যালোককেও আচ্ছাদিত করল। দৃষ্টি অগোচর
হওয়ায় সেনাদের মধ্যে এমন ভ্রান্তির উদ্রেক হলো যে,
কে কাকে প্রহার করছে সেই জ্ঞানও কারও রইলো না। সমান
বীরত্বের সাথে দৈত্যসেনা ও দেবীসেনা একে অপরকে আঘাত করতে থাকল। তাদের শরজালে দশদিক
ব্যপ্ত হলো, সেনাদের রুধিরস্রাবের স্রোত গজ-অশ্বাদিকেও নিমজ্জিত করল। রক্ত,
মাংস, মৃতদেহের কর্দমময় স্তুপে রথচক্র নিমগ্ন হলে রথসমুহ নিশ্চল
হয়ে পড়ল। রক্তের স্রোত কেশময় ছিন্নমুণ্ড সমুহকে শৈবাল ও জলজ উদ্ভিদের ন্যায় ভাসিয়ে
নিয়ে যাচ্ছিল।
সুযোগ বুঝে এইবার করোঙ্ক সর্পিণীকে দেবীসেনা আক্রমণ করতে আহবান জানাল।
যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ত, মাংস, চারিদিকে স্তুপাকারে পতিত কর্তিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ,
ছিন্নমুণ্ড- এমন বীভৎসতা সূরগণের হৃদয়কেও বিচলিত করতে পারে।
কিন্তু সেই ভীষণদর্শণা রণশাম্বরী যেন এতে আরও আনন্দিত ও উত্তেজিত বোধ করল। নিজের
শরীর থেকে সে লক্ষলক্ষ সর্প সৃষ্টি করে তাদের শক্তিসেনা পরাস্ত করার আদেশ দিল। এই
সর্পগণ ছিল নানান বর্ণের, নানান আকারে, ভিন্নভিন্ন বিষবিদ্যায় পারদর্শী,
নিজেদের বিষময় নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ত্রিলোক দগ্ধ করতে দক্ষ।
প্রতাপে এঁরা তক্ষক, কর্কোটক এমনকি বাসুকিরও সমকক্ষ ছিল। পারদ,
বৎসনাভ, কালকুট, হলাহলো, সৌরাষ্ট্র, শৌক্লিকেয়- ইত্যাদি মহাবিষ প্রয়োগে তাঁরা শক্তিসেনা বিনষ্ট করতে
লাগল। পাশের ন্যায় তাঁরা নিজেদের শরীর দিয়ে শক্তিসেনাকে আবদ্ধ করে ভীষণ ভাবে দংশন করতে
থাকল। যোগিণীসেনার শস্ত্রাঘাতে সর্পগণের মৃত্যু হচ্ছিল ঠিকই,
কিন্তু পরক্ষণেই সর্পিণী ততোধিক সর্প উৎপন্ন করে তাদের
আক্রমণ করছিল। এমন অভুতপুর্ব আক্রমণে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দেবীসেনার পতন হতে লাগল।
শত্রুপক্ষের এমন দুর্বলতার সুযোগ নিল পঞ্চসেনাপতিগণ। চক্র,
ভল্ল, শরাঘাতে তাঁরা প্রায় বিনা বাধায় শক্তিসেনাকে নিশ্চিহ্ন করতে
লাগল। সুরগণ আশঙ্কিত হলেন। নিজের সেনার এমন পতন দেখে দেবী ললিতা ত্রিপুরাসন্দরী
স্থির থাকতে পারলেন না। ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি প্রবল হুঙ্কার করলেন। এইসময় তাঁর তালু
থেকে প্রকট হলেন হেমবর্ণা দেবী নকুলী। তপ্তহেমবর্ণা দেবী নকুলীর আকার বাঙময় এবং
তাঁর দন্ত ছিল বজ্রসমকঠিন। দেবী যোগবলে বিষ্ণূবাহন গরুড়কে আবাহন করে,
তাঁর পৃষ্ঠে আসীনা হয়ে সর্পসেনা আক্রমণ করলেন ।
যুদ্ধরত রণশাম্বরীকে দেখে তিনি ক্রোধে
মুখব্যদান করলে তাঁর বত্রিশ দন্ত হতে বত্রিশ কোটি সুবর্ণপ্রভ ভীষণকায় নকুলের
উৎপত্তি হলো। এই নকুলসেনা সর্পদের আক্রমণ করতে লাগল,
নিজেদের ক্ষুরধার দন্তাঘাতে তাদের বধ করতে লাগল পাশাপাশি
সর্পবিষে জর্জরিত দেবীসেনাকেও বিষ থেকে সুস্থ করতে লাগল। ছিন্নরজ্জুর মতো মৃত
সর্পদেহ এখানে ওখানে পতিত হতে লাগল, তাদের ফণাস্থিত মণিরত্নের প্রভায় সমরাঙ্গণ আলোকিত হয়ে উঠল।
নিজ সন্তানদের মৃত্যু অবলোকন করে ক্রুদ্ধ সর্পিণী দেবী নকুলেশ্বরীকে বধ করতে উদ্যত
হতেই, দেবী গরুড়াস্ত্র নিক্ষেপ করলেন । সেই ভয়ঙ্কর মহাস্ত্র আকাশ-পাতাল আলোকিত করে
সর্পিণীর বক্ষে নিপাতিত হলো।
সর্পিণীকে বধ্য হতে দেখে ক্রুদ্ধ পঞ্চসেনাপতি সবলে ও একযোগে দেবী নকুলীকে আক্রমণ করল । গরুড়াসনা দেবী বীরত্ব সহকারে সেই আক্রমণ প্রতিহত করলেন ও নকুলসেনাকে নির্দেশ দিলেন পঞ্চসেনাপতিগণকে লাঞ্ছন করতে। নির্দেশ পেয়ে সমস্ত নকুল তাদের তীক্ষ্ণ দন্তের সাহায্যে করোঙ্ক প্রমুখকে দংশন করতে শুরু করল। কেউ দৈত্যদের কানে, কেউ নাকে, কেউ মাথায় দংশন করল। কেউ কেউ আবার দৈত্যদের বর্ম দংশন করে তা দুর্বল করতে লাগল। এমন অতর্কীত আক্রমণে দিশাহারা করোঙ্ক মহাক্রোধে নকুলবাহিনী সংহার করা শুরু করল। এরই মধ্যে দেবী নকুলী অক্ষীণনকুল মহাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন । সেই মহাস্ত্র থেকে কোটিকোটি মহানকুল উৎপন্ন হয়ে দৈত্যসেনা ছত্রভঙ্গ করতে লাগল। দন্তাঘাতে মহানকুলগণ দৈত্যসেনাদের নৃশংস ভাবে ছিন্নভিন্ন করতে লাগল। বিষজ্বালা থেকে সুস্থ দেবীসেনাও নকুলদের সাথে মহাবলে দৈত্যনিধন করতে থাকল। ইতিমধ্যে দেবী নকুলীও খড়্গের আঘাতে চারজন সেনাপতির শিরোশ্ছেদন করলেন ।
শত অক্ষৌহিণীর প্রায় সমস্ত অসুরসেনার পতন হলে,
একা সেনাপতি করোঙ্ক অবশিষ্ট রইল। করোঙ্ক তখন দেবীর সাথে
শরযুদ্ধ শুরু করল । মহাবল দেবী নকুলী একেএকে করোঙ্কের ধনুকের জ্যা ছিন্ন করলেন ,
রথের চুড়াস্থিত দৈত্যদের ধ্বজা কর্তন করলেন ,
রথবিনষ্ট করলেন ও রথ বহনকারী গর্দভও বিনষ্ট করলেন । অবশেষে
উপায়ান্তর না দেখে করোঙ্ক দেবীর সাথে ভয়ঙ্কর অসিযুদ্ধ শুরু করলে দেবী নকুলী
পট্টিশের আঘাতে করোঙ্ককে সংহার করলেন । করোঙ্কের পতনে দেবীসেনা আনন্দে দেবী নকুলীর
নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগলেন। দেবীর বীরত্বে অভিভুত হয়ে মন্ত্রনায়িকা তাঁকে আশীর্বাদ করলেন
নিজ অঙ্গের পরমদেবতত্ত্ব দেবী নকুলীকে অর্পণ করলেন । অবশিষ্ট দৈত্যসেনাগণও দেবীর
বাহুবল অবলোকন করে সন্ত্রস্ত ও মুগ্ধ হয়ে,
তাঁরাও দেবীর শরণাপন্ন হলেন। স্মিত হেসে দেবী তাদের অভয়
প্রদান করলে দৈত্যগণ দেবীকে প্রণাম করলেন ,
তারপর শোণিতপুরে পলায়ণ করলেন ।
বারংবার শক্তিসেনার কাছে পরাজিত হয়েও ভণ্ডের শিক্ষা তো হলোই না,
বরঞ্চ সে এবার ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেল। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে আবার
দেবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেই মনস্থির করল। এবার বলাহক,
সূচিমুখ, ফলমুখ, বিকর্ণ, বিকটানন, করালাক্ষ ও করোটক- এই সাতজন সেনাপতি ৩০ অক্ষৌহিণী সৈন্য
নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করল । আগের যোদ্ধাদের তুলনায় এঁরা বিশেষ কারণে অধিক শক্তিশালী
ছিল। আদিতে কিকসা দানবের এই সপ্তপুত্র সূর্যদেবের তপস্যা করে এই বর পেয়েছিল যে,
সুর্যের সমস্ত তেজ তাদের নেত্রে অবস্থান করবে ও তারা যার
উপরই দৃষ্টিপাত করুক না কেন, সে অস্ত্রচালনা বিস্মৃত হয়ে নিশ্চল স্থাণুবৎ হয়ে পড়বে। তাছাড়া,
এই সাত ভাই প্রত্যেকেই ছিল নভোযুদ্ধে পারদর্শী,
অর্থাৎ প্রয়োজনে আকাশপথে বিচরণ করতে করতে যুদ্ধ করতে পারত।
দৈত্যদের রণভেরীর শব্দ সমস্ত বিশ্বকে শঙ্কিত করল। তাদের মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ,
তাদের অস্ত্র যেন সুর্যের মতো তেজ বিচ্ছুরণ করছে। তাদের
পদাঘাত ভুতল বিমর্দিত করে তুলছে। অসুরসেনার দলপতি বলাহক দেবীসেনাকে প্রথমে
বাক্যবাণে জর্জরিত করল , “রে দুষ্টা তোরা নারীগণেরও অধম। যারা দুর্বল,
যারা জড় বিষয়ে আসক্ত,
কেবল তাদেরই তোরা মায়াবলে পরাস্ত করার ক্ষমতা রাখিস। যদি
পরাক্রম দেখাতেই হয়, তাহলে মায়া পরিহার করে যুদ্ধ করে দেখা। এখনও সময় আছে,
তোরা সকলে ত্রিলোকাধিপতির শরণাপন্ন হয়ে তাঁকে ভজনা করো।
নতুবা এই ভয়ঙ্কর শস্ত্রের আঘাতে তোদের সপার্ষদ যমালয়ে প্রেরণ করবো।”
অতঃপর প্রচণ্ড হুঙ্কার করে দৈত্যসেনা শক্তিসেনাকে আক্রমণ করল। দেবী ললিতার সেনা
প্রস্তুতই ছিল। তাঁরাও পাশ, মুষল, চক্র, মুদ্গর ইত্যাদি শস্ত্রের দ্বারা সবলে দৈত্যদের প্রহার করা
শুরু করল। শস্ত্রের সাথে শস্ত্রের আঘাতে উৎপন্ন শব্দ দশদিক মুখরিত করতে থাকল।
দাশরথি রাম যেমন সমুদ্রশোষণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন,
সেইভাবে যোগিণীগণও যেন দৈত্যসেনা শোষণ করতে লাগল। কেউ পট্টিশের
আঘাতে নির্বিচারে দৈত্যসেনার শিরোচ্ছেদ করতে লাগলো,
কেউ শরাঘাতে তাদের বিদ্ধ করতে লাগল। হস্তির দ্বারা পদদলিত
হয়ে কিছু দৈত্যের প্রাণ গেল। কেউকেউ আবার মুদ্গরের প্রহারে দৈত্যদের রথ বিনষ্ট করল।
শেষে শক্তিসেনা এমন বীরত্বে যুদ্ধ করা শুরু করল যে,
কাতর মনুষ্যগণ তা বর্ণনে অপারগ।
ভুমিযুদ্ধে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, এই বিচার করে সপ্তসেনাপতি আকাশে উড্ডিয়মান হয়ে যুদ্ধ করাটাই
শ্রেয় স্থির করল । অতএব, বলাহক এক ভীষণকায় গৃধ্র পৃষ্ঠে আসীন হয়ে দেবীসেনার উপর
শরবর্ষণ করতে লাগল। সূচিমুখ, ফলমুখ ও বিকর্ণ যথাক্রমে কাক,
সারস ও ভেরুণ্ডে আরুঢ় হয়ে যুদ্ধ করতে লাগল। বিকটানন
নির্বাচন করল কুক্কূট ও করালক্ষ গুহ্যমন্ত্রের দ্বারা এক প্রেতকে নিজের বাহন
নির্বাচন করল । করোটক বেতাল পৃষ্ঠে উড্ডয়ণ করল। সুর্যের বরে বলীয়ান এই সপ্তসেনাপতি
তাদের দৃষ্টির মাধ্যমে দেবীসেনাকে মূর্তিবত নিশ্চল ও নিরায়ুধ করে শুল,
শর, হলের আঘাতে তাদের নিপাত করা শুরু করল। নিজেদের অসহায়তায়
যোগিনীগণ দেবী ললিতার শরণাপন্ন হলে, দেবীর আজ্ঞায় দণ্ডনায়িকা তাঁর প্রত্যঙ্গরক্ষিণী
তিরষ্কারণিকাকে দৈত্যনিধনের আদেশ দিলেন। দেবী তাঁর সর্বমঙ্গলময় দৃষ্টির দ্বারা
যোগিণীগণকে ভয়মুক্ত করলেন । তারপর তমোলিপ্ত নামক সর্বতোমুখ দিব্যবিমানে আসীনা হয়ে
চতুর সপ্তসেনাপতিকে নিহত করতে উড্ডয়ণ করলেন । ভীষণ সিংহনাদ করে দেবী এরপর তাঁর
বাসন্তীমোহন কোদণ্ডের সাহায্যে তাদের শরজালে বিদ্ধ করা শুরু করলেন ।
দেবীর বিক্রমে তাঁরা অবাক হয়ে গেলেন। দৈত্যসেনাপতিদের শরীরে এমন একটিও স্থান
রইল না যা শরবিদ্ধ হয়নি। দেবী দণ্ডনায়িকার আদেশে তখন তিনি সপ্তসেনাপতির দিকে
অন্ধাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন । অন্ধাস্ত্র চিরবস্ত্রের ন্যায় দৈত্যসেনাপতিদের চক্ষু
আচ্ছাদিত করল। দৃষ্টি অচল হওয়ায় দেবীসেনার উপর তাঁর প্রভাবও লুপ্ত হলো।
শস্ত্রস্তম্ভিত দেবীসেনা বন্ধন মুক্ত হলেন,
তাঁরা যেন দেহে নতুন করে বল পেলেন। দেবীর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে
প্রবল পরাক্রমে দেবীসেনা একের পর এক দৈত্যকে মোক্ষ প্রদান করতে লাগল।
যুদ্ধেক্ষেত্রে যেন অসুররক্তের রক্তগঙ্গা বইতে লাগল। কিন্তু সপ্তসেনাপতি তখনও আকাশ
পথে বিচরণ করছে, তাই যোগিণীগণ দেবী তিরষ্কারিণীকেই তাদের বধ করতে অনুরোধ করলেন ।
নিজসেনার প্রার্থনায় দেবী প্রীত হয়ে বিমানে আরোহণ করলেন । বিমান ক্রমশ
উর্দ্ধমুখী হয়ে সেনাপতিদের বাহনের সমউচ্চতা প্রাপ্ত হলো। দেবী তখন প্রচণ্ড হুঙ্কার
করে সপ্তসেনাপতিকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন । কিন্তু তাঁদের অন্ধত্ব প্রাপ্তি ঘটেছে,
ফলে সুর্য প্রদত্ত বর তাঁরা দেবীর উপর প্রয়োগ করতে পারলেন
না। মহাবলে দেবী অসিদ্বারা বলাহক,সূচিমুখাদি
সাত ভাইয়ের শিরোচ্ছেদ করলেন । সপ্তসেনাপতির ছিন্নমুণ্ড দিয়ে তিনি এক মুণ্ডমালা
নির্মাণ করে তিনি সেটি নিজের কণ্ঠে ধারণ করলেন । মহামুল্যবাণ অলঙ্কারের মতোই সেই
মুণ্ডমালা দেবীর শ্রীকণ্ঠ ভুষিত করতে লাগলো। দেবীর এই ভয়ঙ্কর রূপদর্শন করে অবশিষ্ট ভীত অসুরসেনা
শোণিতপুরে পলায়ণ করল। দেবী তিরষ্করণিকার বীরত্বে আবার শক্তিসেনার জয় হলো।
পরাজয়ের খবরে ভণ্ড এবার ভেঙ্গে পড়ল। নিজের অদৃষ্টকে দোষারোপ করে সে
বিলাপ করতে শুরু করল , “হা হতোস্মি, অসুরগণের পতন এবার অবশ্যম্ভাবী। বিধি আমাদের উপেক্ষা করছে।
আদিতে আমরা দেবগণকে পরাজিত করে বিতাড়িত করেছিলাম,
এখন আমাদেরই পরাজয়ের আশঙ্কা উপস্থিত হয়েছে। এই ভীষণ বিপদ
থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় অবশিষ্ট রইল না?
হা অদৃষ্ট, দৈবই দেখছি প্রবল, দৈবের প্রভাবেই বলবান বলহীনে পরিণত হয়,
ধনবাণ ধনহীনে পরিণত হয়,
দীর্ঘায়ু পরিণত হয় আয়ুহীনে। ধিক আমাদের বাহুবল যা সামান্য
এক অবলাকে পরাজিত করতে অক্ষম! ধিক আমাদের পরাক্রম! ধিক্কার জানাই আমাদের
ত্রিলোকবিজয়ের অহঙ্কারকে! এর থেকে দেবগণের হাতে বীরগতি প্রাপ্ত হওয়াটাই শ্রেয় ছিল।
এক দুর্ললিতা নারী তাঁর নারী সেনা নিয়ে আমাদের পদদলিত করছে,
এই কথা উচ্চারণ করতেও আমার জিহ্বা লজ্জায় আড়ষ্ট হচ্ছে।”
ভণ্ড এবার নিজেকে সামলে নিল। কুটিল দৃষ্টিতে বলে উঠলো, “সরোজিনীর কন্দ ছেদন করলেই জলের উপরে তাঁর দলমণ্ডলের বিনাশ
ঘটে। তেমনই এই ভীষণ বিপদকে মূলে আঘাত করে বিনষ্ট করা ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।
গুপ্তচর সংবাদ দিয়েছে, ওই পাপিষ্ঠা মায়াময়ী নাকি নিজে যুদ্ধ করেনা। সে তাঁর
চতুরঙ্গ সেনাকে অগ্রবর্তী করে নিজে অন্তরালে থেকে যুদ্ধপরিচালনা করে। অতএব,
আমরা পার্ষ্ণিগ্রাহ(সম্মুখসমরের বদলে শত্রুসেনার পশ্চাৎভাগে
সহসা আক্রমণ) পন্থা অবলম্বন করবো। শত্রুসেনার পশ্চাৎভাগ আক্রমণ করে ওই কুলটা
ললিতাকে বধ অথবা বন্দি করো, সে পরাস্ত হলে তাঁর সেনাও পরাস্ত হবে। বিষঙ্গ,
তুমি পার্ষ্ণিগ্রাহ পন্থায় বিশেষ পারঙ্গম,
তাছাড়া ঝটিকা আক্রমণেও তুমি অতুলনীয়। পুত্র কুটিলাক্ষ,
তুমি ১৫ জন মহাবল সেনাপতিকে ১৫ অক্ষৌহিণী সেনাপ্রদান করো,
তাদের সঙ্গে বিষঙ্গ পেছনদিক থেকে গুপ্ত আক্রমণ করে ললিতাকে
বন্দিনী করবে।”
সমস্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন হলো। বিষঙ্গ কয়েকজন বিশ্বস্ত সেনা নিয়ে গুপ্ত আক্রমণের
প্রস্তুতি নিল। মদনক, দীর্ঘজ্বিহা, হুম্বক প্রভৃতি পঞ্চদশ সেনাপতির প্রত্যেকে এক অক্ষৌহিণী করে
সেনার দলপতি হল। রাত্রিবেলাতেই অসুরদের মায়াশক্তির বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া,
দেবীসেনা নিশ্চয়ই শিবিরে রাত্রিকালীন বিশ্রামগ্রহণ করবেন, ফলে তখন তাঁরা
অসতর্ক থাকবেন। এইরকম বিবেচনা করে বিষঙ্গ রাত্রেই আক্রমণ করবেন স্থির করলেন ।
সেদিনের মতো সুর্য অস্তাচলে গমন করলেন । পৃথিবীর শতসহস্র গভীর বিবর থেকে
নির্গত হয়ে সেই গাঢ় অন্ধকার যেন চরাচর গ্রাস করল। দিনান্তের সেই নিশ্চিদ্র
অন্ধকারে মনে হচ্ছিল ধরিত্রী যেন পর্বতের কোনো গভীর গুহাভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন।
মলয়বায়ুতে দীপশিখা বোধ করি কোনো এক অজানা ভয়ে কম্পমান। যুদ্ধান্তের প্রসাধনের পর
যোগিণীগণকে যেন যোদ্ধা নয়, অপ্সরা বলে ভ্রম হয়। দীপশিখার স্নিগ্ধ প্রভা তাদের শ্রীমুখ
আলোকিত করছে, তাঁরা যেন চন্দ্রমার মতো জ্যোৎস্না বিকিরণ করছেন;
তাদের কনককুন্তল, নাসিকাস্থিত স্বর্ণময় নথ যেন নক্ষত্রের ন্যায় সেই মঙ্গলময়
চন্দ্রমার যোগ্য সঙ্গত প্রদান করছে। যেই বজ্রকঠিন হস্ত একসময় শস্ত্রচালনায় প্রভুত
দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল, সেই হস্তই কমনীয় ভঙ্গিতে বীণাতে সুরের ঝঙ্কার তুলছিল। যে
কন্ঠ হুঙ্কারে বিশ্বকম্পিত করেছিল, সেই কণ্ঠেরই রাগরাগিণীর আলাপ আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলল।
রাত্রির সেই মনোরমরূপে মনে হয় পৃথিবীতে যেন হিংসা নেই,
ক্রোধ নেই, যুদ্ধ নেই।
ওদিকে দৈত্যগণ কিন্তু কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে ছিলনা। তাঁরা নতুন উদ্যমে
রাত্রিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করল। অন্ধকারে যাতে তাঁরা সহজে দৃশ্যমান না হয়,
তাইজন্য তাঁরা এক চতুর পন্থা অবলম্বন করল। অন্ধকারে অদৃশ্য
হওয়ার জন্য তাঁরা গাঢ় শ্যামবর্ণের কবচ, কঞ্চুক, শিরস্ত্রাণ ধারণ করল। তাদের সমস্ত আয়ুধও শ্যামবর্ণে রঞ্জিত
করে দৈত্যসেনা ভণ্ডানুজ বিষঙ্গের নেতৃত্বে নিঃশব্দে দেবীশিবিরে গমন করল। কোনোরকম
হুঙ্কার, কোনোরকম গর্বিত যুদ্ধপ্রার্থনা করলেন না তারা,
পাছে যোগিণীগণ সতর্কিত হয়ে যায়। দুন্দুভি,
মর্দল, রণভেরীর বিকট শব্দ দৈত্যসেনাদের যুদ্ধযাত্রার সংকেতও দিলনা।
এমন নিঃশব্দে তাঁরা বিচরণ করতে লাগল যে মনে হলো,
তাঁরা যেন নিজেদের নিঃশ্বাস পর্যন্ত অবরুদ্ধ করে রেখেছে।
বিষঙ্গের সেনা প্রথমে দেবীশিবিরের উত্তরভাগে তারপর পুর্বভাগে দেবী ললিতার খোঁজ করতে
লাগল। অবশেষে একজন দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর মেরুকান্তি দিব্যরথ চিহ্নিত করতে পারল।
সেই দিব্যরথেই সহস্রসুর্যের সমপ্রভ স্বয়ং দেবী ললিতা বিরাজ করছেন,
তাঁর সাথে কয়েকজন মহাশক্তিশালী নিত্যাগণও প্রহরী হিসেবে
রথের আশেপাশে বিদ্যমান ছিলেন।
পাছে যোগিণীগণ তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে টের পেয়ে হয়ে তাদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল
করে, তাই
বিষঙ্গ আর বিলম্ব করতে চাইল না। এইরূপ বিবেচনা করে ধুরন্ধর দৈত্যগণ সর্বশক্তি
প্রয়োগ করে দেবীসেনাকে পশ্চাৎভাগ থেকে
অকস্মাৎ আক্রমণ করে বসল।
হতচকিত শক্তিগণ প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ না পেয়ে হাতের সামনে যা পেলেন তাই দিয়ে দৈত্যদের
আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। দেবীশিবিরে প্রচণ্ড হট্টগোল শুরু হলো।
পট্টিশ, ভিন্দিপাল, ভুশুণ্ডী, অসি, খড়্গ সম্বলিত দৈত্যগনের ভয়ঙ্কর অথচ দ্রুত আক্রমণে শক্তিসেনা পিছু হটতে থাকলেন।
আঘাত-প্রত্যাঘাতে দুপক্ষেরই প্রচুর সৈন্যের পতন হলো। দেবীসেনার উপর ভীষণ প্রহার করতে
করতেই তাঁরা দেবীর চক্ররাজ রথের দিকে অগ্রসর হতে থাকলেন। দৈত্যগণ বিপাট নামক এক
অদৃশ্য অস্ত্রের সাহায্যে একে একে দেবীসেনার ৯টি পঙক্তি ছেদন করল। দেবী ললিতার
রথের নিকটবর্তী হতে তাদের বেশি সময় লাগল না। বিষঙ্গ তখন রথে প্রবল শরবর্ষণ শুরু করল।
বর্ষাকালে মেঘপুঞ্জ যেমন সুর্যকে আবৃত করে,
তেমনই বিষঙ্গের শরজাল দেবীর রথকে আচ্ছাদিত করতে শুরু করল।
“সম্রাটের জয় হোক। প্রভু,
গুপ্তচর সংবাদ দিয়েছে,
ভাগ্য এই বার আমাদের সহায়। সেনাপতি বিষঙ্গের আক্রমণে
অবলাদের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। অবিলম্বেই বীরগণ ওই পাপিষ্ঠাকে বন্দিনী করবেন,
নতুবা বধ করবেন। পিতা,
বজ্রকঠিন শুল যেমন বক্ষভেদ করে হৃদয়কে বিদ্ধ করে,
তেমনই দৈত্যসেনা শত্রুদের ভেদ করে ললিতাকে অচিরেই বিদ্ধ করবেন।”,
কুটিলাক্ষের সুসংবাদের চতুর ভণ্ড প্রসন্ন হল,
কিন্তু সর্বসমক্ষে তা প্রকাশ করল না। চিন্তিত স্বরে
কুটিলাক্ষকে বলল, “পুত্র, বিষঙ্গের সেনা তাদের লক্ষ্যে অবিচল সন্দেহ নেই। কিন্তু,
ললিতাকে বন্দি করলে নগরে তাঁর অবশিষ্ট সেনানিদের প্রকোপ
পরবেই, তারও কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া, শত্রুর ছায়াকেও নিশ্চিহ্ন না করাটা মুঢ়তার লক্ষণ। বর্তমানে
নারীসেনা দুর্বল। পুত্র, তুমি বিলম্ব করোনা,
এখনই ১০ অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে সম্মুখ সমরে দেবীসেনাকে
সবান্ধবে নিহত করো।”
কুটিলাক্ষ তখনই দেবীসেনাকে আক্রমণ করল । সন্দংশিকার মতো দৈত্যসেনার দুটি দল
যোগিণীগণকে পিষ্ট করতে লাগল। সম্মুখে কুটিলাক্ষ ও পশ্চাদে বিষঙ্গ- দুই দলের এহেন
যুগপৎ আক্রমণে দেবীসেনা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। এমন অভুতপুর্ব
আক্রমণে গোটা দেবীশিবিরে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরী হলো। অসুরসেনার হুঙ্কার,
তাদের শস্ত্রাঘাতের শব্দ,
দেবীসেনার আর্তনাদ ও হাহাকারে ত্রিলোক শঙ্কিত হলো। দৈত্যগণ
যেন আগের সমস্ত পরাজয়েরই প্রতিশোধ এইবার দেবীসেনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। শস্ত্রাঘাতে
ছিন্নভীন্ন দেবীসেনাদের পতন হতে লাগল। মহাসুর রাহু যেমন গ্রহণকালে সুর্যকে গ্রাস
করে, দৈত্যসেনাও
যেন তেমনভাবে দেবীসেনাকে গ্রাস করছে।
প্রবল রণসংগ্রামের মাঝেই বিষঙ্গ দেবীর কিরীট লক্ষ্য করে শরযোজনা করল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সেই শর চক্ররাজের তালবৃন্ত নির্মিত সুবিশাল দিব্যপঙ্খকে ছিন্ন করল। নিত্যাদেবীরা রথস্থিত হয়েই দৈত্যদের সাথে বীরত্বপুর্ণ প্রত্যাঘাত চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন অশুভ ঘটনায় তাঁরা শঙ্কিত হলেন। দেবী ললিতারও কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। প্রধানা নিত্যা কামেশ্বরী তখন ক্রুদ্ধ হয়ে রথাবরোহণ করলেন এবং সিংহনাদ করে বিষঙ্গের দিকে ধাবমান হলেন। দেবী ললিতা তখন বহ্নিবাসিনী ও জ্বালামালিনী- এই দুই নিত্যাদেবীকে আদেশ করলেন , “দেবীগণ, কোনো উপায় না পেয়ে চতুর দৈত্যরা কাপুরুষের ন্যায় আমাদের পৃষ্ঠে আক্রমণ করছে। মায়া অবলম্বন করে অদৃশ্য হয়ে অসতর্ক সেনানীদের আঘাত করতেও তাদের কুন্ঠা হচ্ছেনা। অতএব, তোমরা আপন শক্তিতে সমগ্র যুদ্ধক্ষেত্রে একযোগে অবস্থান করে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করো। সেই অগ্নির আলোকে কাপুরুষগণ পুর্বের ন্যায় দৃশ্যমান হবে, অতঃপর এই শৃগালবৃত্তি অবলম্বণ করার জন্য তাদের উচিত দণ্ডদান করা হবে।” ক্রোধান্বিত দেবী কামেশ্বরী তখন দৈত্যদের উদ্দেশ্যে হুঙ্কার দিলেন, “রে পাপী দুরাত্মাগণ, মায়া অবলম্বন করে তোরা ক্রুর যুদ্ধ করিস, এই তীক্ষ্ণ শরের আঘাতে এখনই তোদের নিধন করবো।” দেবীর নির্ঘোষে ভগমালিনী প্রমুখ অন্যান্য নিত্যাগণও দেবী ললিতার রথ থেকে নেমে কামেশ্বরীকে উচিত সঙ্গদান করতে শুরু করলেন ।
জ্বালামালিনী ও বহ্নিবাসিনী দেবী সমগ্র যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে নৃত্য করতে লাগলেন।
নৃত্যের তালে তালে যুদ্ধক্ষেত্রের ভুমিতে তাঁরা পদাঘাত করছিলেন,
সেই আঘাতের আতিশয্যে নিমেষেই যুদ্ধক্ষেত্রে চারিদিকে
মহাযজ্ঞকুণ্ডের মতো মঙ্গলময় অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল। সেই অগ্নির আলোকে
ক্রুরযুদ্ধকারী অসুরসেনা মুহূর্তেই সুস্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠল। এইবার দেবীগণ দনুজসেনার
উপর হিংস্র প্রত্যাঘাত শুরু করলেন । কামেশ্বরী,
অনিমা, ভগমালিনী ইত্যাদি পঞ্চদশ নিত্যাদের মিলিত প্রচেষ্টায়
অসুরসেনা ক্রমশই কোণঠাসা হতে শুরু করলেন । মন্দারাচল যেমন বিশাল সমুদ্রমন্থন
করেছিলেন, নিত্যাগণ সেইভাবেই দনুজমন্থন করতে লাগলেন। নিত্যাদেবীগণের অবিরত শরবর্ষণে
তাদের প্রাণকোদণ্ড ধনুতে মুহুর্মুহু টঙ্কার উৎপন্ন হচ্ছিল। তাঁদের উদ্ধত
যুদ্ধকৌশলে একেএকে দনুজসেনাপতিদের পতন হতে লাগল। প্রথমে কামেশ্বরীর আক্রমণে মদনক,
ভগমালার প্রহারে দীর্ঘজ্বিহা ও নিত্যক্লিন্নার শরে হুম্বকের
পতন হলো। তারপর দেবীগণের সম্মিলিত শস্ত্রাঘাতে কাকলাশ,
কল্কিবাহন, পুল্কশ, চন্দ্রবাহু ইত্যাদি অবশিষ্ট সেনাপতিদেরও পতন হলো। রাত্রি
তিনপ্রহরের মধ্যেই দনুজসেনার পার্ষ্ণিগ্রাহ সম্পুর্ণ ব্যর্থ হলো।
নিজ সৈন্যের নিধন প্রত্যক্ষ করে অবশেষে কুটিলাক্ষ ও বিষঙ্গ স্বয়ং
নিত্যাদেবীদের আক্রমণ করলেন । কিন্তু নবোদ্যম নিত্যাশক্তিদের কাছে তাঁরা যেন
দাঁড়াতেই পারলেন না। দেবী কামেশ্বরী তাঁদের শরাঘাতে জর্জরিত করে তুললেন। দেবীর
বাণে তাদের কবচ ছিন্ন হলো ও রথও বিনষ্ট হলো। মৃত্যু নিশ্চিত মনে করে বিষঙ্গ বিহ্বল
হয়ে যুদ্ধে বিরত হল ও যেনতেনপ্রকারেণ নিজের প্রাণরক্ষায় সচেষ্ট হল। কিন্তু,
উপায়ান্তর না দেখে পলায়ণই শ্রেয় মনে করল। অতএব,
কুটিলাক্ষকে নিয়ে আহত বিষঙ্গ যে পথে আক্রমণ করেছিল,
সেই একই পথে নিষ্ক্রমণ করল কাপুরুষোচিত উপায়ে। “পলায়ণরত
শত্রুকে প্রহার অনুচিত”, এইরূপ বিচার করে দেবী দণ্ডনায়িকা নিত্যাদের আক্রমণে বিরত
রাখলেন। রাত্রিকালীন এই মহাযুদ্ধের পর নিত্যাগণ আহত,
রক্তাক্ত কিন্তু জয়ী হয়ে দেবী ললিতাকে প্রণাম করলেন । দেবীর
স্নেহময় কৃপাদৃষ্টিতে রণক্লান্ত নিত্যাগণের সমস্ত ক্লান্তি ও যন্ত্রণা নিমেষেই নির্মূল
হলো। দেবীর কৃপায় তাঁরা সমস্ত আঘাত থেকে মুহুর্তেই সম্পুর্ণ
সুস্থ হয়ে উঠলেন। রাত্রিতে সংঘটিত এই ক্রুরযুদ্ধ দেবীগণের জয়ের মাধ্যমে রাত্রিতেই
শেষ হলো।
দেবী ললিতা ত্রিপুরাসুন্দরীর প্রথম দিনের জয়যাত্রা এভাবেই শেষ হলো। কিন্তু
দেবীগণের মধ্যে তা নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাস দেখা গেল না। দনুজগণের এহেন অতর্কীত
কপটসংগ্রামে দেবীগণ ক্ষণিকের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন,
দৈত্যগণও দেবী ললিতার রথ প্রায় অধিকার করে নিতে বসেছিল। এমন
বিফলতার কথা মাথায় রেখে দেবী দণ্ডনায়িকা ও দেবী মন্ত্রিণী কিছুটা বিমর্ষ ছিলেন।
শ্রীচক্ররাজ রথের কথা শত্রুরা জানল কি করে, রথোপবিষ্ট
অন্যান্য দেবীগণ দৈত্যদের প্রাথমিক আক্রমণ প্রতিহত করতে পারলেন না কেন,
তবে কি রথের রক্ষণ ব্যবস্থাতে কোনো খামতি ছিল,
বর্তমানে কি করোণীয়-এইসব চিন্তাতেই তাঁরা নিমগ্ন ছিলেন।
দেবীগণ তখন দেবী মন্ত্রিণীকে অগ্রবর্তী করে ললিতাম্বিকাকে নিজেদের শঙ্কার কথা
নিবেদন করলেন । ললিতা তখন বললেন, “ভণ্ডের নগরীর সম্মুখেই শতযোজন বিস্তৃত শিবির প্রস্তুত করুন।
শিবিরের প্রবেশদ্বারে নিশ্ছিদ্র প্রহরা নিযুক্ত করুন,
শস্ত্রধারী প্রহরীগণ যেন শিবিরে প্রবেশ ও প্রস্থানকারী সবার
দিকে লক্ষ্য রাখে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা-নিদ্রাজয়ী মহাবল শক্তিগণকে ভয়ঙ্কর অস্ত্র প্রদান
করে শিবিরে অবস্থানের আদেশ দিন। দেবীগণ, আপনারাও সদাসতর্ক থাকুন।”। অতঃপর তিনি দেবী জ্বালামালিনীকে
নির্দেশ দিলেন, “বৎসে, তুমি স্বয়ং বহ্নিরূপা, নিজ বলে দৈত্যদের পার্ষ্ণিগ্রাহ ব্যর্থ করেছ। যুদ্ধের সময়
তুমি যুদ্ধক্ষেত্রের চারিদিকে ভয়ঙ্কর অগ্নি প্রজ্জ্বলন করেছিলে। তেমনই,
শক্তিশিবিরের চারিদিকে ত্রিশ যোজন উচ্চতাবিশিষ্ট কালান্তক
অগ্নির এক অভেদ্য প্রাকার নির্মাণ করো। সেই অগ্নিতে অবস্থান করে তুমি শিবির রক্ষা করবে।” দেবীর নির্দেশে শিবিরের চারিদিকে নরককূন্ডের
বহ্নিশিখার সমান দীপ্ত অগ্নিপ্রাকার নির্মিত হলো।
পুর্বের পরাজয়ের কথা মাথায় রেখে দেবী দণ্ডনাথা নতুন করে চমুনির্মাণ করলেন
। দেবীর নির্দেশে শক্তিব্যুহের মধ্যিখানে দেবী ললিতার শ্রীচক্ররথ অবস্থান করল।
শ্রীচক্ররথের সুরক্ষার জন্য তার বামদিকে দেবী দণ্ডিনী স্বয়ং ও ডানদিকে দেবী
শ্যামলা নিজ নিজ রথে আরোহন করলেন । শ্রীচক্ররথের অগ্রভাগ রক্ষার জন্য গজারুঢ়া দেবী
সম্পদেশ্বরী ও পশ্চাদভাগ রক্ষার জন্য দেবী হয়াসনা নিযুক্ত হলেন। দেবী শ্রীচক্রের
প্রবেশদ্বার কালান্তক যমের ন্যায় নিত্যাদেবী স্তম্ভিনী নিজের দণ্ডায়ুধ নিয়ে অবরোধ করলেন
। আরও ২০ অক্ষৌহিণী শক্তিসেনা রথের চারিদিকে নানা সজ্জায় অবস্থান করল। নবরূপে
সজ্জিত ও নব উদ্যমে শক্তিগণ হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর নামে
জয়ধ্বনীতে আকাশ-বাতাশ মুখরিত হলো। প্রচণ্ড কোলাহল করতে করতে দেবীগণ শিবিরের
অগ্নিপ্রাচীরের মধ্যে অবস্থান করে যুদ্ধের উদ্যোগ নিলেন।
পরমমাতা দেবী ললিতার মনে এবার যেন একটু কৌতুক রসের উদয় হলো। স্মিতহাস্য করে
তিনি দেবী দণ্ডনায়িকাকে মধুর কণ্ঠে নির্দেশ দিলেন,
“সখি,
দেবগণের মুখে অসুরদের অতিথিবাৎসল্যের খুবই গুণগান শুনেছি।
অতএব, তুমি ভণ্ডাসুরকে সংবাদ প্রেরণ করো, তার নগরীতে অতিথির আগমন ঘটেছে,
নগরবাসী যেন যথাবিধি অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা করে। তাঁকে
সন্দেশ পাঠাও, স্বয়ং দেবী পরমাপ্রকৃতি তার আতিথ্যগ্রহণে ইচ্ছুক।” দণ্ডনায়িকা দেবীর কৌতুক
বুঝতে পারলেন। তিনি তাঁর রথ চালনা করে দেবীসেনা ও ভণ্ডের নগরীর মাঝামাঝি এলেন।
এরপর নিজের ধনুকের জ্যা আকর্ষণ করে তাতে প্রবল টঙ্কার ধ্বনি উৎপন্ন করলেন । সেই
গুরুগম্ভীর ও ভয়ঙ্কর টঙ্কার ধ্বনিতে গোটা শোণিতপুর যেন কেঁপে উঠল। ইন্দ্রের বজ্র
যেন মহীতল বিদীর্ণ করছে, এইরূপ ধারণা করে গোটা নগরীতে হাহাকার শুরু হলো। ভণ্ড এতে
যেন ক্রোধে ফেটে পড়ল। একে তো বারংবার পরাজয়ের গ্লানী,
তার ওপর এমন অশালীন ব্যঙ্গ- ভণ্ড নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না। তখনই
কুটিলাক্ষ, বিশুক্র ও বিষঙ্গের সাথে পরামর্শ করে নিজের ৩০ পুত্রকে যুদ্ধে প্রেরণ করবে
স্থির করল । নিজের পুত্রদের আদেশ করল যে, ললিতা কে জীবিত বা মৃত;
যে কোনো অবস্থাতেই সত্বর বন্দি করে আনা হোক।
চতুর্বাহু, চকোরাক্ষ, চতুঃশিরা, বজ্রঘোষ ইত্যাদি ভণ্ডের ৩০ পুত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করল। সর্বঅস্ত্রে
সজ্জিত, সর্ববর্মে ভুষিত হয়ে তারা যুদ্ধযাত্রা করল। ভণ্ডাসুর
নিজে তাদের কপালে মঙ্গলময় জয়তিলক এঁকে দিল। তাদের অধীনে রইল
প্রবল প্রতাপ ২০০ অক্ষৌহিণী দৈত্যসেনা, যারা ইতিপুর্বে দেবগণকে যুদ্ধে লাঞ্ছিত ও পরাজিত করেছিল।
আত্মদম্ভে দম্ভী পুত্রগণ ভণ্ডকে আশ্বাস দিল,
“পিতা,
শক্তিসেনাকে ভক্ষণ করতে আমাদের মুহুর্তকালও ব্যয় হবে না। আজ
আমাদের জ্ঞাত সমস্ত অস্ত্রবিদ্যা, শস্ত্রবিদ্যা, গুহ্যবিদ্যা প্রয়োগ করে শত্রুবিনাশ করবো ও পাপিষ্ঠা ললিতাকে
নিমেষেই বন্দিনী করবো। মহারাজ, হয় আমরা বিজয়ী হয়ে নগরে ফিরব,
নতুবা রণক্ষেত্রেই বীরগতি গ্রহণ করবো।” সর্ব প্রকার
অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ভণ্ডপুত্রগণ তাদের বিশাল সৈন্য নিয়ে দেবীশিবিরে
যুদ্ধযাত্রা করল । তাদের প্রতাপ দেখে অদৃশ্য দেবগণ সন্ত্রস্ত হলেন,
তাদের চতুরঙ্গ সেনার পদাঘাতে ত্রিলোক মুহুর্মুহু কম্পিত হতে
লাগল। দৈত্য নগরীর অধিবাসীগণ তাদের জয়জয়কার করতে লাগল,
দৈত্যকবিরা মধুর ভাষায় তাদের স্তুতি করতে লাগল। দৈত্যসেনা
প্রবল স্বরে হুঙ্কার দিয়ে দেবীসেনাকে যুদ্ধে আহ্বান জানাল। ২০০ অক্ষৌহিণী সেনার
মিলিত সিংহনাদে ব্রহ্মাণ্ড বিদীর্ণ হওয়ার উপক্রম হলো।
দৈত্যগণের রণ হুঙ্কারে দেবী ললিতা এবার স্বয়ং আক্রমণ করবেন বলে স্থির করলেন । বর্মচর্মে সজ্জিত হয়ে দেবী নিজের যুদ্ধাভিযান শুরু করতে যাবেন, এমন সময় ললিতাত্মজা বালা দেবীকে বাধা দিলেন। মহেশ্বর কামেশ্বরের ঔরসে দেবী ললিতাম্বিকার গর্ভে সর্বাঙ্গসুন্দরী সর্বসুলক্ষণা বালাম্বার জন্ম হয়। নবমবর্ষীয়া দেবী বালা সুর্যতপ্তা, রূপে-গুনে-বীরত্বে স্বয়ং দেবী ললিতার সমকক্ষা। দেবী ললিতা নিজে তাঁর কন্যাকে সর্ববিদ্যা ও সর্বশাস্ত্রের শিক্ষা প্রদান করেছিলেন। রাজরাজেশ্বরীর পাদপীঠেই ছিল তাঁর নিত্য সন্নিধান। দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর চতুর্থ নেত্রস্বরূপ বালা নবমবর্ষীয়া হলেও দেবীর কৃপায় তিনি এরই মধ্যে সর্বাস্ত্রপারঙ্গম হয়ে উঠেছিলেন। দেবী ললিতার মতোই, তাঁর তনয়া বালাকুমারিকা সকল যোগিণীগণের পুজ্যা ছিলেন। মুলত দেবী বালা ও তাঁর মাতা দেবী ললিতার মধ্যে কোনো প্রভেদই ছিল না, দেবী ললিতার প্রাণস্বরূপা ছিলেন এই দেবী বালা।
“দৈত্যেন্দ্র বোধহয় এখনও নিজের পরাজয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ
করেননি। তাঁর ক্রোধ, অহঙ্কার এবং জীঘাংসাই তাঁকে সবংশে নিহত করবে,
সন্দেহ নেই। এক্ষণে তিনি নিজের পুত্রদের যুদ্ধে প্রেরণ
করেছেন। এদের পরাক্রম যদি এদের হুঙ্কারের ন্যায় শক্তিশালী হতো,
তাহলে বারংবার এদের পরাজয় ঘটতো না। মাতা,
এঁরা আপনার যোগ্য প্রতিপক্ষ নন,
আপনার বদলে আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক। আমি বালিকা,
ক্রীড়ানুরাগী। অতএব,
এই যুদ্ধ নামক ক্রীড়ায় জয়লাভের প্রীতি থেকে আমাকে নিবারণ করবেন
না। হে পরাৎপরে, আপনি আমাকে যুদ্ধযাত্রার অনুমতি দিন।” বালার এই সোৎসাহ আবেদনে দেবী ললিতা একই
সাথে আনন্দিত ও শঙ্কিতও হলেন। তিনি স্বয়ং আদিপরাশক্তি,
তাঁর কন্যা বালাও তাঁরই অংশোদ্ভুত। তা সত্ত্বেও,
তিনি তো মা, সন্তানের চিন্তায় তিনি সদাচিন্তিত। যুদ্ধে বালার বিজয় নিয়ে
দণ্ডনায়িকা প্রমুখ যোগিণীগণ নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু সন্তানের চিন্তা কি মায়ের মন
থেকে কখনো দুরীভুত হয়? শঙ্কিত স্বরে দেবী ললিতা বললেন,
“বৎসে,
তুমি নবক্রমা, তোমার শস্ত্রবিদ্যা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
কিন্তু, যুদ্ধের তোমার পুর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তাছাড়া,
তুমি মাত্র নবম বর্ষীয়া ও কোমলাঙ্গী,
অদ্যাবধি তুমি পৌগণ্ডে উপনীত হওনি। তুমি আমার
প্রাণবায়ুস্বরূপা, তোমা বিনা আমার শ্বাস-প্রশ্বাস নিশ্চিন্তে এক মুহূর্তের
জন্যও চলে না। আমি আজ্ঞা করি, তুমি এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে অস্ত্রধারণের প্রমাদ করোনা। দণ্ডিণী,
মন্ত্রিণী এঁরা উপস্থিত থাকতে তুমি যুদ্ধ করবে কেন?”
বালা কিন্তু তা মানলেন না। দেবী ললিতার অনুরোধ,
উপরোধ সত্ত্বেও তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। কিশোরীচিত
কৌতুহলে সমাবিষ্ট হয়ে তিনি দেবীর কাছে পুনঃপুনঃ আজ্ঞাপ্রার্থনা করতে লাগলেন।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত শক্তি একযোগে ব্যবহার করেও যাকে পরাস্ত করা অসম্ভব,
সেই দেবী ললিতা ত্রিপুরাসুন্দরী অবশেষে নিজের আত্নজার জেদের
কাছে পরাভূত হলেন। নিজ কন্যার দৃঢ় মানসিকতায় মুগ্ধ হয়ে দেবী তাঁকে
আলিঙ্গন করলেন । তারপর তিনি নিজের হাতে কুমারিকাকে রণসজ্জায় সজ্জিত করে তুললেন।
একেএকে তিনি নিজের অঙ্গ থেকে বর্ম, চর্ম, কবচ, কঞ্চুক, শিরোস্ত্রাণ খুলে নিয়ে পরম মমতায় নিজ কন্যাকে পরিয়ে দিলেন।
নিজের চতুর্বিধ আয়ুধ তিনি দেবী বালাকে প্রদান করলেন । রণসজ্জা সমাপ্ত হলে হংসচালিত
এক দিব্যরথে অধিষ্ঠিত হয়ে অবশেষে দেবী বালাকুমারিকা তাঁর অভিযান শুরু করার অনুমতি
চাইলেন দেবীর কাছে। দেবী ললিতা তার কপালে চুম্বন করে তাঁকে আশীর্বাদ করলেন ।
যোগিণীগণ তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগলেন। নিত্যাগণ তাঁকে প্রণাম করলেন । দেবী
দণ্ডনায়িকা ও মন্ত্রনায়িকা বালার বীরোচিত মুর্তি দেখে বিস্ময়াবিষ্ট ও মুগ্ধ হলেন।
বালার অঙ্গরক্ষার জন্য তাঁরা দুইদিকে অবস্থান করলেন । শক্তিসেনা এক বিশাল ব্যূহ
রচনা করে বালার অনুগত হলো।
অগ্নিপ্রাকারের দ্বার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে,
দুরন্ত বেগে শক্তিসেনা দৈত্যদের উপর আক্রমণ করল।
বালাকুমারিকা ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আরম্ভ করলেন । শস্ত্রচালনা ও সৈন্যচালনা- দুটোতেই তিনি
সমান দক্ষ। কুমারিকার শস্ত্রাঘাতে কর্তিত কদলীবৃক্ষের ন্যায় ছিন্নভিন্ন দৈত্যদের
পতন হতে লাগল। ভণ্ডাসুরের পুত্রগণ এমন কল্পনাতিত আক্রমণে যেন বিহ্বল হয়ে পড়ল। এক
নবমবর্ষীয়া কন্যার এহেন বীরবিক্রম দেখে তারা হতবাক। এই ভণ্ডপুত্রেরা পুর্বে
অবলীলায় দেবগণকে জয় করেছিল। সেই প্রবলপরাক্রমী দৈত্যদের কাছেও এমন নৃশংস
অস্ত্রবিদ্যার নমুনা ছিল নতুন। কিন্তু সবথেকে বেশী অবাক হলেন বোধ
হয় শক্তিসেনাগণ নিজেরাই। এমন অভুতপুর্ব বীরত্বে তাঁরা অভিভুত হয়ে পড়লেন। “যোগ্য
মাতার যোগ্য কন্যা”- এই ভেবে তাঁরা দ্বিগুণ উৎসাহে দৈত্যগণকে নিপাত করতে লাগলেন।
গুপ্তচর মারফত নিজ কন্যার এমন পরাক্রমের সংবাদে দেবী ললিতা গর্ববোধ করলেন । দেবী
মন্ত্রিণী আর দণ্ডনায়িকা বালাম্বাকে রক্ষা করছিলেন নামমাত্রই। এই দুই দেবীর মনে
হতে লাগল, তাদের প্রহারের পুর্বেই কুমারিকা যেন ইতিমধ্যেই দৈত্যদের নিহত করে রেখেছেন।
দেবী কালিকা যেমন রক্তবীজকে শোষণ করেছিলেন,
বালিকাও তেমনই দৈত্যগণকে শোষণ করছে মনে হলো। “ধন্য দেবী
ললিতাম্বিকে”, “ধন্য দেবী বালাকুমারিকা”, এইরূপ প্রতিপন্ন করে দেবীদ্বয় এই অপুর্ব দৈত্যসংহারযজ্ঞের
নীরব দর্শকে পরিণত হলেন।
সম্মুখযুদ্ধে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী মনে করে অবশিষ্ট দৈত্যসেনা সম্মিলিত হয়ে কেবল
বালাম্বাকেই আক্রমণ করা শুরু করল। নবমবর্ষীয়া সেই দেবী নানাবিধ অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে
তা প্রতিহত করতে থাকলেন। অবশেষে দেবী দ্বিশত অক্ষৌহিণী সেনাকে একেবারে নিধন করার
জন্য মোক্ষম নারায়ণাস্ত্র মোচন করলেন । কল্পান্তের অগ্নির ন্যায় সেই নারায়ণাস্ত্র
এক মুহুর্তেই সমস্ত দৈত্যসেনাকে নিশ্চিহ্ন করে দিল। অবশেষে ভণ্ডের ত্রিশ পুত্রও
বালাকুমারিকাকে আক্রমণ করতে এলে, ত্রিশটি ক্ষুরধার অর্ধচন্দ্র বাণের আঘাতে শিরোচ্ছেদ করে
তাদের ভবলীলা সাঙ্গ করলেন । দেবীগণের জয়ের মাধ্যমেই দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধ শেষ হলো।
বালার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে আকাশস্থিত দেবগণ পুষ্পবৃষ্টি করলেন । দেবী মন্ত্রিণী ও
দণ্ডনায়িকা বালাকে আলিঙ্গন করলেন , অন্যান্য যোগিণীগণও উল্লাসে নৃত্যগীত শুরু করলেন । তাঁরা
মহানন্দে দেবী ললিতার কাছে তাঁর দুহিতার পরাক্রমের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন ।
গতকালের ব্যর্থতা ভুলে দেবীশিবির যেন আরও একবার আনন্দের জোয়ারে ভেসে গেল।
ওদিকে দৈত্যপুরীকে যেন ভয়ঙ্কর শোকানলে গ্রাস করল। বারবার পরাজয়,
সৈন্যনিধন ও সর্বোপরি পুত্রবিয়োগ যেন ভণ্ড আর সহ্য করতে
পারল না। যুগপৎ ক্রোধ ও দুঃখে বিলাপ করে উঠল,
“হা পুত্র! তোমরা কি তোমাদের পিতার
ক্রন্দন শুনতে পারছ না? পিতা কে ত্যাগ করে তোমরা কি সুখী হয়েছ?
আজ আমার রাজ্যের সমস্ত যশ,
সমস্ত শোভা বুঝি লুপ্ত হলো। আমার মহাবল পুত্ররা দেবগণেরও
অবধ্য ছিল, এক দুষ্টা নারী তাদের মায়াবলে হত্যা করল। হায় অদৃষ্ট! আমার রাজ্য,
আমার কুল, আমার সেনা আজ ধ্বংসের অভিমুখে। এই পরিস্থিতিতে এমন অমোঘ
পুত্রশোকও কি আমার প্রাপ্য ছিল? হা পুত্র, তোমরা কি তোমাদের মাতা এবং কুলস্ত্রীদের বিলাপও শুনতে
পাচ্ছনা? রে পাপিষ্ঠা ললিতা, আমার ক্রোড়শুন্য করে তুই আজ আনন্দে মেতেছিস,
আজই সসৈন্য তোকে খণ্ডবিখণ্ড করবো।” ক্রোধে দিগ্বিদিক
জ্ঞানশুন্য হয়ে ভণ্ড তখনই কোষ থেকে খড়্গ নির্গত করল ও দেবী ললিতাকে হত্যা করতে
ধাবমান হলো। বিশুক্র, বিষঙ্গ প্রভৃতি দানবগণ দৈত্যস্বামীর এমন অভুতপুর্ব মুর্তি
দেখে যার-পর-নাই অবাক হয়ে গেল। তারা তখনই ভণ্ডকে আটকালো।
কুটিলাক্ষ বলল, “হে স্বামিন, আপনি সামান্য মনুষ্যগণের ন্যায় কেন শোক করছেন?
আপনার পুত্রগণ কাপুরুষের মতো নয়,
যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মৃত্যু প্রাপ্ত হয়েছেন। বীরশয্যা
প্রাপ্ত হওয়ায় ক্ষত্রিয়গণের কাছে ধার্মিক পন্থা,
ক্ষত্রবীরগণের কাছে এটাই অভীষ্ট। এমন মৃত্যুতে শোক করা উচিত
নয়। মহারাজ, আপনার আজ্ঞায় আমরা ত্রিভুবন মর্দন করতে পারি,
সপ্তসমুদ্রকে শোষণ করতে পারি এমনকি বিশাল মেরু পর্বতকেও
চূর্ণ করতে পারি। অতএব, আপনি শোকত্যাগ করে আমাদের আদেশ দিন,
আপনার আশীর্বাদে আমরা শুধু ললিতা কেন,
গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেই অধিকার করতে পারব।” কুটিলাক্ষের
কথায় ভণ্ড একটু শান্ত হলো। বারবার সম্মুখ যুদ্ধে ব্যর্থ হয়েও আবার
ক্রুড়যুদ্ধের পরিকল্পনা করল । ভণ্ড বিশুক্রকে আদেশ দিল,
“মায়া দ্বারা নিজেদের অদৃশ্য করে
শত্রুশিবিরে গমন করো। অতঃপর জয়বিঘ্ন নামক মহাযন্ত্রের রচনা করে গুহ্যবিদ্যার
দ্বারা তাদের পরাজিত করো। এই যন্ত্র অব্যর্থ,
ইতিপুর্বে এই বিদ্যা কদাপি অসফল হয়নি,
এবারও হবেনা।”
ইতিমধ্যে সুর্য অস্তাচলে অদৃশ্য হলেন। গোধুলি সমাগতা। ভানুকে অনুসরণ করে
অনুরাগবতী সন্ধ্যাও যেন পাতালের কোনো এক গহীন কুঞ্জে তাঁর সাথে মিলিত হলেন। অনন্তর
কজ্জলসমা গভীর অন্ধকার জগৎকে গ্রাস করল। মায়ায় অদৃশ্য বিশুক্র অতি সংগোপনে,
নিঃশব্দে দেবীশিবির পৌছল। কিন্তু,
শিবিরের বাইরের সেই বিশাল অগ্নিপ্রাকারকে পার করার কোনো উপায়
তার জানা ছিল না। তাছাড়া, প্রাকারের প্রবেশদ্বারেও সশস্ত্র প্রহরী বর্তমান। এমন
নিশ্চিদ্র প্রহারার ব্যবস্থা দেখে বিশুক্র
শঙ্কিত। গতকালের পার্ষ্ণীগ্রাহের ফলেই কি এমন দুর্ভেদ্য সতর্কতা?
যাই হোক। এমতাবস্থায় শিবিরে প্রবেশ করাটা তার যুক্তিযুত মনে
হলোনা। অতএব, শিবিরের বাইরেই যন্ত্ররচনা করা স্থির করল । শিবিরের বাইরে সকলের অলক্ষে এক বৃহৎ শিলাপট্টে
তিনি কুটিল জয়বিঘ্ন যন্ত্র অঙ্কন করল , দৈর্ঘ্য-প্রস্থে যার ব্যপ্তি এক গব্যুতি(যতদুর অবধি গরুর
হাম্বারব পৌঁছায়, ২ ক্রোশ) সমান। যন্ত্রের আটদিকে সে
আটটি শুল অঙ্কন করলেন সংহারাক্ষরের মাধ্যমে। মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা শুলাষ্টক পুটে
অলসা, কৃপণা, নিতন্দ্রা প্রমুখ আটজন ভয়ঙ্কর দেবীর আবাহন করা হলো। অতঃপর গুঢ় মন্ত্রের
মাধ্যমে যন্ত্রের পূজা করা হলো। অবশেষে, ছাগাদি বলি প্রদান করে যন্ত্রকে জাগরিত করে বিশুক্র
কুটযন্ত্র অঙ্কিত শিলাপট্টটিকে সজোরে দেবীশিবিরে নিক্ষেপ করল।
সেই ভয়ঙ্কর যন্ত্র শক্তিশিবিরের ভুমিস্পর্শ করতেই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো।
যন্ত্রের আবেশে শক্তিসেনাকে এক আশ্চর্য বিষণ্ণতায় গ্রাস করল। যে শক্তিসেনা
ইতিপুর্বে তুমুল উৎসাহে দৈত্যনিধন করেছে, শস্ত্রাঘাতেও যাদের উদ্যম বিন্দুমাত্র নষ্ট হয়নি, বারংবার আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের ক্লান্তিকর চক্রেও যারা
বিন্দুমাত্র অবসন্ন হয়না- যন্ত্রের প্রভাবে তারাই হতোদ্যম ও বিকারগ্রস্ত হয়ে
অস্ত্রত্যাগ করলেন । নিজেদের লক্ষ্য, কর্তব্য বিষয়ে তাঁরা সন্দিহান হয়ে পড়লেন। এক
সঙ্কীর্ণ দীনতার বশবর্তী হলো তাদের মন। সঙ্কীর্ণতার বশবর্তী হয়ে তাদের মনে প্রশ্ন
উঠল- “অসুর নিধন করে কি লাভ হচ্ছে? অনেক অস্ত্রচালনা, অনেক রক্তপাত হলো- তাতে কোন কার্যসিদ্ধি হচ্ছে?
দেবাসুরের এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে আমাদেরই বা কি ফল?
কে ওই মহারাজ্ঞী ললিতাসুন্দরী?
কে এই দণ্ডনায়িকা ও মন্ত্রনায়িকা?
আমরা কেন তাদের আজ্ঞাপালন করছি?
এতে কোন পরম মোক্ষ প্রাপ্ত হব আমরা?”
এইরূপ বিষাদগ্রস্ত হয়ে দেবীসেনা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া
ত্যাগ করলেন । আলস্যের আতিশয্যে দেবীসেনাগণ যে যেখানে ছিলেন,
সেখানেই নিদ্রামগ্ন হলেন। গোটা শিবিরে মন্দতা ও মদালস্য
ছেয়ে গেল।
জয়বিঘ্ন মহাযন্ত্র সফল হলো। মধ্যরাত্রীর মধ্যেই শক্তিসেনার মনকে এই যন্ত্র এমন
ভাবে আবিষ্ট করল যে তাঁরা আর যুদ্ধ করার মতো পরিস্থিতিতে রইলেন না। বিশুক্র এই
সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাইলেন। তিনি অবিলম্বে নগরে সংকেত পাঠালেন। দৈত্যদের
রণদামামা বিকট স্বরে বেজে ঊঠলো। কর্মবিমুখ শক্তিসেনাগণ তা শুনতেও পেলেন,
কিন্তু কেউই শিবির রক্ষা করতে কোনো উদ্যোগ নিলেন না। তবে,
দেবী মন্ত্রিণী ও দণ্ডনায়িকা কিন্তু সজাগ ছিলেন। জয়বিঘ্ন
যন্ত্র তাদের প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। শত্রু যে কোনো মুহুর্তে আক্রমণ করতে
পারে, তাঁর উপর নিজসেনার এমন অভুতপুর্ব কর্মবিমুখতা- দেবীদ্বয় শঙ্কিত হলেন। ওদিকে
বিশুক্রের সংকেতে ত্রিশ অক্ষৌহিণী দৈত্যসেনা অগ্নিপ্রাকারের প্রধান ফটকের সামনে
অবস্থান করল। তাদের হুংকার ও কোলাহলেও শক্তিসেনারা তাদের কালনিদ্রা ত্যাগ করলেন না।
দণ্ডনায়িকা প্রমাদ গুনলেন। মন্ত্রিনীর সাথে পরামর্শ করে তিনি তখনই দেবী ললিতাকে সব
জানাবেন স্থির করলেন ।
সময় নষ্ট না করে দেবীদ্বয় তখনই চক্ররাজ রথে দেবী ললিতার দর্শনপ্রার্থী হলেন।
মন্ত্রিণী তখনো দেবী ললিতাকে বললেন, “হে দেবি, শক্তিসেনাগণের এমন মতিভ্রমের কারণ কি?
কার দ্বারা তাঁরা বিকারগ্রস্ত হলেন?
হে মহারাজ্ঞী, আপনি স্বয়ং বিশ্বপালিকা। শক্তিগণ আপনার আদেশ অমান্য করার
প্রতিষ্পর্ধা করছে। কর্মবিমুখতা তাদের এমন ভাবে আবিষ্ট করেছে যে,
নিজেদের রক্ষা করতেও তাঁরা সচেষ্ট হচ্ছে না। ওই যে,
অসুরগণের হুংকার শোনা যাচ্ছে। হে পরমমাতা,
আজ্ঞা করুন।” দেবী ললিতাত্রিপুরাসুন্দরী মুহুর্তকালের জন্য
কামেশ্বর মহেশ্বরকে স্মরণ করলেন । তারপর উচ্চৈঃস্বরে অট্টহাস্য করে ঊঠলেন।
রণহুংকার স্বরূপ তাঁর সেই অট্টহাস্য শুনে দৈত্যগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ঊঠলেন।
দণ্ডিনী ও মন্ত্রিণী অভিভুত হয়ে দেখলেন, দেবী ললিতার অট্টহাস্যকারী অথচ স্মিতপ্রভ মুখবিবর হতে এক
ভীষণদর্শন দেবতার উদ্ভব হলো।
এই দেবতা দশভুজা ও গজাননযুক্ত। তাঁর ললাটের মধ্যস্থলে এক গহবর - যেখান থেকে মদ
নিঃসৃত হচ্ছে। জবা পুষ্পের
ন্যায় পাটল তাঁর গাত্রবর্ণ, তুন্দিল উদর বিশিষ্ট,
শিরপরে তিনি বালচন্দ্রকে ধারণ করেছেন। বীজময় জাম্বীর ফল,
গদা, ইক্ষুচাপ, শুল, সুদর্শন চক্র, অব্জ-পাশ, নীলোৎপল, ধান্যমঞ্জরী, বরদাঙ্কুশ ও রত্নকুম্ভ- ইত্যাদি দশবিধ আয়ুধে তিনি সুসজ্জিত।
তাঁর স্বর মন্দ্র ও বৃংহিত ধ্বনিপুর্ণ। তাঁর বাম ক্রোড়ে শ্বেতবর্ণা দেবী
সিদ্ধিলক্ষ্মী বিরাজমানা, দেবী বামহস্ত দ্বারা তাঁকে আলিঙ্গন করে আছেন। ইনি মহাগণপতি,
বিঘ্নহর্তা গনেশেরই একটি বিশেষ রূপ ইনি। মহাগণপতি দেবী
ললিতাকে প্রণাম করলে, দেবী তাঁকে জয়বিঘ্ন যন্ত্র ভেদন করার আদেশ দেন। শিবিরের
মধ্যেই এক নিভৃত স্থানে ভ্রমহন্তা মহাগণপতি যন্ত্র অঙ্কিত শিলাপট্টটির খোঁজ পেলেন
তিনি। কালক্ষেপ না করে, মহাগণপতি দুঃসহ দন্তের এক ভীষণ নির্ঘাতে সেই শিলাপট্টটিকে
খণ্ডবিখণ্ড করলেন । যন্ত্র বিনষ্ট হতেই শক্তিসেনা তাঁর প্রভাব থেকে মুক্ত হলো।
আলস্য রহিত যোগিনীগণ তৎক্ষণাৎ অস্ত্রসজ্জিত হয়ে হুঙ্কার দিয়ে যুদ্ধে উদ্যত হলেন।
চর মারফর বিশুক্র সেই সংবাদ পেয়ে চিন্তিত হলেন। বিজয়ের প্রত্যেকটা সম্ভাবনার দ্বার
যেন এঁকেএঁকে তাঁর সামনে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মহাগণপতি ও যোগিণীগণদের মত্ত উল্লাসের
কোলাহল শুনে বিশুক্র এবার ভীত হল। কিন্তু দৈত্যসেনাদের নিজের ভীতির কথা বুঝতে না
দিয়ে সে যোগিণীসেনাকে আক্রমণের আদেশ দিল।
শিবিরের অগ্নিপ্রাকার ক্ষণকালের জন্য নির্বাপিত হলো। এই সুযোগে দৈত্যগণ ও
যোগিণীগণ এঁকে অপরকে ভয়ঙ্কর ভাবে আক্রমণ করল। মহাগণপতি স্বয়ং সংহার মুর্তি ধারণ
করে অসুর নিধন করা শুরু করলেন । নিজের মতই তিনি সপ্তকোটি হেরম্বযোদ্ধা সৃজন করলেন ।
তাদের সম্মিলিত বৃংহতি ধ্বনিই শত্রুকে ভীত করতে যথেষ্ট ছিল। আমোদ,
প্রমোদ, সুমুখ, দুর্মুখ, অরিঘ্ন ও বিঘ্নকর্তা- এর ছয়জন বিঘ্ননায়ককে তিনি বিশাল
হেরম্বসেনার অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করলেন । অসুরসেনা নবোদ্যম যোগিনীগণের আক্রমণে
বিপর্যস্ত হয়ে ছিলই, উপরন্তু মহাগণপতির সপ্তকোটি হেরম্বসৈন্যও সবলে তাদের আক্রমণ
করল। মুহুর্তেই অসুরগণের অবস্থা হয়ে পড়ল শোচনীয়।
কোন দিকের প্রহার প্রতিহত করবে বুঝতে না পেরে,
তাঁরা অন্ধের মতো অস্ত্রচালনা করা শুরু করল। ফলে দেখা গেল,
অনেক দৈত্যই ভ্রান্তিবশত নিজপক্ষকেই আঘাত করে বসছে।
মহাগণপতি স্বয়ং বিশুক্রর সাথে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হলেন। যুদ্ধক্ষেত্র তাদের
হুঙ্কার, ফুৎকার, ধনুর টঙ্কার এবং শস্ত্রের ঝঙ্কারে মুখরিত হয়ে উঠল। ঘোড়ার হ্রেসারব,
হস্তির বৃংহতি, দৈত্যগণের ভীত ক্রন্দন ও হেরম্বসেনার উল্লাসের সম্মিলিত হয়ে
এক বিচিত্র অনুনাদ সৃষ্টি করল।
হেরম্বসৈন্যদের কেউ কেউ নিজের শুণ্ডে আবৃত করে দৈত্যগণকে দূরে নিক্ষেপ করতে
লাগলেন, কেউ কেউ পর্বততুল্য উরঃস্থলের চাপে দৈত্যদের মর্দন করলেন ,
কেউ আবার পদাঘাতে তাদের ভুমিতে পিষ্ট করলেন । অনেকে আবার
শুলসমান দন্তের আঘাতে তাদের বক্ষ ভেদন করলেন । দৈত্যসেনা এবার পিছু হটতে শুরু করল।
হেরম্বসেনারা যেন কোনো শস্ত্রের আহত হচ্ছিল না। চক্র,
ভল্ল, শর, খড়্গের আঘাতে দৈত্যগণ কর্তিত হতে থাকল। সন্ত্রস্ত বিশুক্র
এমন ভয়ঙ্কর ভাবে নিজসেনার পতন লক্ষ্য করে মনে করলেন ,
স্বয়ং কালদণ্ডধারী যম হয়তো তাদের সংহার করছেন।
বিশুক্র বিজয়ের জন্য একবার শেষচেষ্টা করোবে স্থির করলেন । মহাগণপতিকে বধ করার
জন্য সে মায়া দ্বারা এক অতিকায় গজাসুরকে সৃষ্টি করলেন । সিংহের ন্যায় হুঙ্কার করে
গজদৈত্য মহাগণপতিকে বধ করতে উদ্যত হলো। অট্টহাস্য করে মহাগণপতি এক চপেটাঘাতেই
তাঁকে বধ করলেন । নিজের ত্রিশ অক্ষৌহিণী সৈন্যকে মর্দিত হতে দেখে ভীত সন্ত্রস্ত
বিশুক্র যুদ্ধ না করে পলায়ণই শ্রেয় মনে করলেন । সুযোগ বুঝে বিশুক্র সকলের অলক্ষে
শোণিতপুরে ফিরে গেলেন। শক্তিগণ উল্লাসে দেবী ললিতা ও মহাগণপতির নামে জয়ধ্বনি দিতে
লাগলেন। তবে শক্তিগণ তাদের আলস্য নিয়ে লজ্জিত ছিলেন। তাঁরা সমবেত হয়ে দেবী ললিতার
কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করোলে, সদাহাস্যা দেবী ললিতা তাদের অভয় দেন। গণপতি দেবী ললিতার
পাদবন্দনা করোলে দেবী তাঁর ভুয়শী প্রশংসা করেন। গণপতির পরাক্রমে তিনি দেবী প্রসন্ন
হয়েছিলেন। গণপতিকে আশীর্বাদ করে মহারাজ্ঞী তিনি তাঁকে বর দিলেন যে,
সমস্ত দেবতার পুর্বে প্রথমে গণপতিকে অর্চনা করে তাঁকে
পুজ্যত্ব প্রদান করা হবে। আরও একবার দেবীগণের জয় ও অসুরগণের পরাজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধ
সমাপ্ত হলো।
এতোকিছুর পরেও ভণ্ড কিন্তু দেবীর বশ্যতা স্বীকার করলেন না। বল,
যশ ও খ্যাতির অহঙ্কারে মত্ত ভণ্ড আবার দেবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ
ঘোষণা করলেন । এতো পরাজয়, এতো অপমান, বারংবার পুত্রশোকের প্রবল আঘাত- সবকিছুই আবারও ভণ্ডের ক্রোধ
আর অহঙ্কারকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলো। এবার তিনি বিশুক্রের সাথে নিজ ভ্রাতা
বিষঙ্গকেও যুদ্ধের আদেশ দিলেন। তাদের সঙ্গ দিল ভণ্ডের ভগিনী ধৃমিনীর ১০ পুত্র ও
চতুঃশত অক্ষৌহিণী দনুজসেনা। উলুকজিৎ প্রমুখ ভণ্ডের দশ ভাগিনেয় তাঁর বিশেষ স্নেহের
পাত্র ছিল, ভণ্ড নিজপুত্রদের সাথে তাঁদেরকেও স্বহস্তে অস্ত্রশিক্ষা প্রদান করেছিলেন।
মাতুলদের সাথে তাঁরাও নানা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কোলাহলো করতে করতে দেবী শিবিরের
দিকে যাত্রা করল।
এবার কিন্তু যোগিণীসেনাগণ দৈত্যদের কোনোরূপ সুযোগ দিলেন না। দৈত্যসেনা শিবিরের
কাছে আসতে না আসতেই যোগিণীগণ সবলে তাদের উপর আক্রমণ করল। মন্ত্রিনী ও দণ্ডনায়িকা
দুজনেই নিজনিজ দিব্যরথে আরুঢ়া হয়ে দৈত্যসেনার দুই পার্শ্বে অস্ত্রবর্ষণ শুরু করলেন
। নিজের কীরিচক্র রথে দেবী দণ্ডনায়িকা ভল্লের মতো দৈত্যচমুর বাম পার্শ্ব ভেদ করতে
লাগলেন। একহস্তে মহাকায় হলায়ুধ ও অন্য হস্তে মুদ্গর ধারণ করে তিনি সব্যসাচীস্বরূপা
হয়ে অসুরদের যমালয়ে প্রেরণ করছিলেন। অন্যদিকে দেবী মন্ত্রনায়িকার গীতিচক্র রথ
দৈত্যচমুর দক্ষিণ পার্শ্ব বিদ্ধ করছিল। মন্ত্রিণীর মদোদ্যত ধনুকের মুহুর্মুহু
টঙ্কার দনুজসেনাকে সন্ত্রস্ত ও ভয়ভীত করে তুলল। ঘোটক,
হস্তি, রথ ও সেনাগণের উন্মত্ত পদচারণায় ধরা কম্পিত হতে লাগল। বিপুল
হারে সেনাক্ষয় হতে থাকল দু'পক্ষেই। এমন সময় বিশুক্র লক্ষ্য করল ,
তাঁর নিজ সেনাবল ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়ছে। উপয়ান্তর না
দেখে, বিশুক্র প্রবল তৃষাস্ত্র নিক্ষেপ করল । মুহূর্তেই সেই তৃষাস্ত্রের প্রভাবে
দাবাগ্নি সমদীপ্ত যোগিণী সেনা ব্যাকুল হয়ে পড়ল।
তৃষাস্ত্রের প্রভাবে বিষম তৃষ্ণায় দেবীসেনা বিপর্যস্ত হলো। তৃষ্ণায় তাদের তালুমূল
শুষ্ক হলো, কর্ণকুহর রুক্ষ হলো, দেহে অঙ্গদৌর্বল্য দেখা দিল। তৃষ্ণার নিদারুণ জ্বালায়
মুর্ছিত হয়ে একের পর এক যোগিণীর পতন হতে লাগল। একবিন্দু জলের অন্বেষণে বাকি
যোগিনীরাও অস্ত্রত্যাগ করে নিষ্ক্রান্ত হলেন। ক্রুঢ় দৈত্যগণ নিরস্ত্র দেবীসেনাকে
নির্বিচারে সংহার করা শুরু করল।
দৈত্যসেনার এহেন নিচ আচরণ দেখে ক্রুদ্ধ দেবী দণ্ডিণী সুরাসিন্ধুকে আবাহন করলেন
। দেবীর আবাহনে মদালস্যা, রক্তচক্ষু, তপ্ত হেমবর্ণা সুরাসিন্ধু স্বয়ং দেবীর সম্মুখে উপস্থিত
হলেন। দণ্ডিণী সুরাসিন্ধুকে দেবীসেনার তৃষ্ণানিবারণের আদেশ দিলেন। সুরাসিন্ধু
দেবীকে প্রণাম করে তখনই নিজের থেকে আরও অনেক সুরা দেবীকে সৃষ্টি করলেন । তাদের কেউ
তরুণাদিত্যের মতো পাটলবর্ণা, কেউ আবার তাপিচ্ছের ন্যায় শ্যামবর্ণা,
কেউ কেউ আবার শ্বেতশুভ্রধবলকান্তি। তাঁরা আকাশে বলাহকের
ন্যায় সুবিশাল মেঘ নির্মাণ করে তৃষ্ণার্ত শক্তিসেনার উপর সুরা বর্ষণ শুরু করলেন ।
অচিরেই গৌড়ী, পৈষ্টী, মাধ্বী, মৈরেয়, কাদম্বরী, হৈতালী, লাঙ্গলেয়া ইত্যাদি নানাবিধ সুগন্ধি সুরার বর্ষণ হতে লাগল। যার গন্ধমাত্রেই
মৃতে প্রাণের সঞ্চার হয়, তেমন মধুবর্ষণে শক্তিগণ তৃপ্ত হলেন। দেবী ললিতার আদেশে
সুরাদেবীগণ এমন ভাবে সুরা বর্ষণ করছিলেন, যাতে সুরা বৃষ্টি শুধু দেবীসেনার উপরেই সীমাবদ্ধ থাকে।
যোগিণীগণ প্রাণভরে সুরাপান করতে থাকলেন। যারা মুর্ছিত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁরাও ক্লান্তি ও তৃষ্ণা নিবারণ করে নবোদ্যমে যুদ্ধে উদ্যত
হলেন। সুরাদেবীর প্রচেষ্টায় দেবী সেনা তৃষ্ণা মুক্ত হলেন। প্রসন্ন দেবী দণ্ডিণী
তখন সুরাসিন্ধুকে বর দিলেন, “হে মদ্যাব্ধে, আপনার সহায়তায় আমরা তুষ্ট,
এই পবিত্র দেবকার্য আপনার প্রভাবেই নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন
হবে। অতঃপর, দ্বাপর যুগে আমারই প্রসাদে যজ্ঞকারীগণ তোমাকে পানের অধিকারী হবে। যজ্ঞে সমস্ত
দেবতা, পুরোহিত, ভক্তজন সকলে তোমাকে পানের মাধ্যমে ঋদ্ধি,
সিদ্ধি, স্বর্গ, অপবর্গ প্রাপ্ত হবে। মহেশ্বর,
মাহেশ্বরী, বলদেব, ভার্গব, দত্তাত্রেয় , বিধি, বিষ্ণূ- প্রমুখ সিদ্ধজনও তোমাকে পান করে পরম তৃপ্তি লাভ করোবে।”
তৃষ্ণামুক্ত শক্তিসেনার সাথে আবার দৈত্যসেনার তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হলো। দেবীগণের
অট্টহাস্য ও রণহুংকারে যুদ্ধক্ষেত্র মুখরিত হয়ে উঠল। নবীন মদিরামত্ত শক্তিগণ ভল্ল,
অসি, খড়্গ, চক্রের আধাতে দৈত্যনিধন শুরু করলেন।
মদোন্মত্ততায় তাঁদের চক্ষু ও দৈত্যরুধীরে তাঁদের
অস্ত্রশস্ত্র- দুইই ঘোর রক্তবর্ণ ধারণ করল। দণ্ডনায়িকা ও মন্ত্রিণীও যেন দেবীর
চরণে একের পর এক দৈত্যদের বলি দিতে শুরু করলেন।
সুর্যাস্ত আসন্ন। এমন সময়, বিশুক্র দেবী মন্ত্রিণীকে শরজ্বালে আবদ্ধ করলে, মন্ত্রিণী
ক্রোধে বিশুক্রকে প্রতিআক্রমণ করলেন । মন্ত্রিণীর প্রতিআক্রমণে বিধ্বস্ত বিশুক্র
পিছু হটতে লাগল। মন্ত্রিণী তাঁর তীক্ষ্ণ শরাঘাতে এক এক করে বিশুক্রর রথের ধ্বজদণ্ড
বিনষ্ট করলেন , সারথি বিনষ্ট করলেন । অসির আঘাতে বিশুক্রের ধনুকের প্রত্যঞ্চা ছিন্ন হলো।
অবশেষে দেবী মন্ত্রিণী অগ্নিকান্তি যুক্ত ব্রহ্মশির অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন ।
প্রচণ্ড বেগে সেই অস্ত্র বিশুক্রের বক্ষে নিপাতিত হয়ে তাঁর প্রাণহরণ করল।
সম্পদেশ্বরী, ভগমালিনী, হয়াসনা প্রমুখ নিত্যাগণও প্রচণ্ড প্রহারে ভণ্ডের ১০ ভাগিনেয় সহ সিংভাগ সেনাকেও
কালসমীপে প্রেরণ করলেন ।
বিশুক্রের পতন দেখে বিষঙ্গ নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। প্রচণ্ড ক্রোধে
হুঙ্কার করে সে গদা হস্তে দেবী মন্ত্রিনীর দিকে ধাবিত হল। কিন্তু
দণ্ডনায়িকা তাঁকে বাধা দিলেন। নিজের লৌহমুসলের এক আঘাতে তিনি বিষঙ্গকে ভুপতিত করলেন
। অতঃপর, বিষঙ্গ নিজের কালদন্ডসম গদা দিয়ে দণ্ডিণীর সাথে ভীষণ যুদ্ধ শুরু করল। যুদ্ধ
নৈপুণ্যে দুজনই সমান, দুজনই সমান ক্ষিপ্রতায় গদাযুদ্ধে লীন ছিলেন। বিষঙ্গ এমন
ভয়ানক যুদ্ধ শুরু করল যে দেবী দণ্ডিনীর মনে হলো,
তিনি যেন নিজের ছায়ার সাথেই যুদ্ধ করছেন। মধ্যরাত পর্যন্ত
তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলল। এমন সময় বিষঙ্গ তাঁর গদা দিয়ে দেবী দণ্ডনায়িকার
মস্তকে প্রচণ্ড আঘাত করল । আঘাতের আতিশয্যে দেবীর মুকুট শতধা বিভক্ত হয়ে দূরে
নিক্ষেপিত হলো। দেবী তখন নিজের হলায়ুধ দিয়ে সজোরে বিষঙ্গের মস্তকে প্রহার করলেন ।
দেবীর হলের ফলা বিষঙ্গের মস্তক ভেদ করে তাঁর দেহকে দ্বিখণ্ডিত করে দিল। ভীষণ যুদ্ধ
করে বিষঙ্গও তাঁর ভ্রাতার অনুগামী হয়ে যমালয়ে গমন করল । অবশিষ্ট অসুরসেনাগণ তাতে
ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ণ করল।
নিজ ভ্রাতাদের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ভণ্ড এবার ভীত হল। বিলাপ করতে করতে সে
বারংবার মুর্ছিত হয়ে পড়তে লাগল। একে একে নিজের পরিজনদের মৃত্যুতে ভণ্ড এবার ভেঙে পড়ল।
কুটিলাক্ষ নিজের পিতাকে আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। সে
নিজেও জানত এমন ঘোরসংকটে কোনোরকম আশ্বাসন বা সান্তনার কোনো মুল্য নেই। শত্রুসেনা
দ্বারপ্রান্তে, অসুরগণের পতন এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। অদৃষ্টকে কেই বা লঙ্ঘণ করতে পারে! ভণ্ড
ঠিকই বলেছিল, অদৃষ্ট যেন এবার সত্যিই অসুরগণকে উপেক্ষা করেছে।
ভৃত্য ও পারিষদগণের শুশ্রূষায় ভণ্ড কিছুটা সুস্থ হল। ভণ্ড এমন চরম
পরিস্থিতিতেও কুটিলাক্ষকে আদেশ দিল, “যে দুষ্টা মায়াময়ী যুদ্ধে আমার প্রাণাধিকপ্রিয় ভ্রাতা ও
ততোধিকপ্রিয় পুত্রগণের মৃত্যুর কারণ, সেই পাপিষ্ঠা ললিতার ছিন্নকণ্ঠ নিঃসৃত রুধিরের মাধ্যমেই আজ
আমার শোকাগ্নি নির্বাপিত হবে। কুটিলাক্ষ, নগরের সমস্ত সক্ষম পুরুষদের নিয়ে সেনা নির্মাণ করো। তালজঙ্ঘ,
তালগ্রীব প্রভৃতি চতুঃসেনাপতিকে অবিলম্বে সংবাদ প্রেরণ করো।
তাদের অধীনস্ত অবশিষ্ট সমস্ত দৈত্যসেনাকে নিয়ে দুর্ভেদ্য ব্যুহ নির্মাণ করো।
হয় আজ দেবীগণ বিনষ্ট হবে, নতুবা অসুরগণ নিশ্চিহ্ন হবে।” ভণ্ডের
পারিষদগণ হতবাক হয়ে গেল। এ কি? যুদ্ধোন্মত্ত ক্ষত্রিয়ের হুঙ্কার?
নাকি জীবের অন্তিমকালের প্রলাপ?
কুটিলাক্ষ কিছু ভাববার পরিস্থিতিতে ছিল না।
ভণ্ডের নির্দেশে সে নীরবে সম্মতি প্রদান করল । ভণ্ড তার শেষ যুদ্ধের প্রস্তুতি
নেওয়া শুরু করল । বজ্ররোধী কবচ পরিধান করে পৃষ্ঠে দুটি তূণীর ধারণ করল। মৌর্বী
নামক এক মহাকায় ধনুকে প্রত্যঞ্চা পরাল, সঙ্গে নিল নিজের ঘাতক খড়্গ। তারপর সহস্র সিংহবাহিত আভিল
নামক রথে উপবিষ্ট হয়ে ভণ্ড যুদ্ধযাত্রা করল। কুটিলাক্ষের প্রচেষ্টায় দৈত্যেন্দ্র
এক বিরাট সেনা নির্মাণ করল । ২০০০ অক্ষৌহিণী অসুরসেনার কোলাহলে আকাশ বাতাস মুখরিত হলো।
দিগন্তপরিব্যপ্ত সেই বিশাল সেনার জন্য তালজঙ্ঘের মতো ৩৫ জন মহাবল সেনাপতি নিযুক্ত
হল। এদের সর্বাধিনায়ক হল কুটিলাক্ষ ও ভণ্ড স্বয়ং। বিশাল দৈত্যসেনা ভণ্ডাসুরকে
অগ্রবর্তী করে তাঁরই অধিনায়কত্বে দেবীশিবিরের উদ্দেশ্য যাত্রা করল। দৈত্যপুরী
পুরুষ শূন্য হলো।
সৈন্যসমভিব্যাহারে ভণ্ড দেবী শিবিরের দিকে এগিয়ে চলল। না ভুমিতে,
না নভঃতে- কোথাও যেন সেই বিশাল সেনার স্থান সঙ্কুলান হচ্ছিল
না। তাদের পরচারণায় পৃথিবী কম্পিত হতে লাগল,
দিকপালগণ ভয়ভীত হয়ে পলায়ণ করলেন ,
দেবগণ প্রবল ত্রাসে মুর্ছিত হয়ে পড়লেন।
পতঙ্গ যেমন দীপশিখায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁরই অগ্নীতে প্রবেশ করে,
অসুরগণও তেমন ভাবেই নিজেদের ধ্বংসে প্রবেশ করছিল। শক্তিগণ
এতো বিশাল সেনাসমুদ্র থেকে সন্ত্রস্ত হলেন ও নিজনিজ অস্ত্রধারণ করে প্রস্তুত
রইলেন। শিবিরের বহ্নিপ্রাকার কালক্ষেপে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল, দনুজগণের আগমনে পুনরায় তা সমহিমায় প্রজ্জ্বলিত হলো। ভণ্ড
তাঁর ধনুকে প্রচণ্ড এক টঙ্কারধ্বনি উৎপন্ন করে যোগিনীগণকে যুদ্ধে আহ্বান জানাল ।
এইবার এল সেই অতি প্রতিক্ষিত মুহুর্ত। মহাবল দৈত্যেন্দ্র ভণ্ডের সাথে সংগ্রাম
শক্তিগণের পক্ষে সম্ভব নয়, এই বিবেচনা করে দেবী ললিতাত্রিপুরাসুন্দরী স্বয়ং ভণ্ড
সংহারের উদ্যোগ নিলেন। শক্তিগণ দেবীর নামে জয়ধ্বনি দেওয়া শুরু করলেন।
দণ্ডিনী ও মন্ত্রিণী দেবীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন । ঋষিরা যথাবিধ মঙ্গলাচরণ
সম্পন্ন করে দেবীর পাদবন্দনা করলেন । কবচ,
মুকুট, অঙ্কুশ, পাশ, ইক্ষুকোদণ্ড, পঞ্চশর শোভিত হয়ে দেবী তাঁর চক্ররাজ রথে উপবিষ্টা হলেন।
দেবীর রথচক্রে ঋক, সামাদি চতুঃবেদের অধিষ্ঠান হলো;
ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ- এই চতুঃবর্গ ফল রথের অশ্ব হিসেবে নিযুক্ত হলো।
মন্ত্রিনী ও দণ্ডনায়িকাও নিজ নিজ দিব্যরথারুঢ়া হয়ে দেবীর চক্ররাজকে সঙ্গ দেওয়ার
জন্য প্রস্তুত হলেন। সিংহ, উষ্ট্র, মৃগ, অশ্ব, হস্তি, ভেরুণ্ড, ব্যাঘ্র, শরভ, বাতমৃগ ইত্যাদি বাহনযুক্ত পরার্ধপরিমান শক্তিসেনা দেবীকে
রক্ষা করার জন্য রথের চতুর্দিকে অবস্থান করলেন । অন্তরীক্ষ থেকে দেবগণ মুগ্ধ হয়ে
শক্তিসেনার উপর পুষ্পবৃষ্টি করলেন । এইরূপে সুসজ্জিত হয়ে দেবী ললিতা
জ্বালামালিনিকে অগ্নিপ্রাকারের দ্বার উন্মুক্ত করার আদেশ দিলেন।
দ্বার উন্মুক্ত হতে না হতেই দেবী ললিতার রথ তীরবেগে অসুরসেনার দিকে ধাবিত হলো।
সেই রথের গতি রোধ করে কার সাধ্য! দেবী ললিতা,
মন্ত্রিণী ও দণ্ডনায়িকা- দৈত্যসেনার মাঝে এই তিন দেবী এক
প্রবল ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করলেন । শরে শরে আকাশ আবৃত্ত হলো। অশ্বের ক্ষুর,
রথের চাকা, হস্তির পদাদির আঘাতে ভুমিতে সুদীর্ঘ ফাটল উৎপন্ন হলো।
দৈত্যদের ছিন্নমুণ্ড, কর্তিত হস্তপদ স্তূপাকারে যুদ্ধক্ষেত্রের এখানে ওখানে পতিত
হতে থাকল, ভুমি হয়ে উঠল রক্তরঞ্জিত। রুধীরস্রাবের ধারায় ধরিত্রী কর্দমাক্ত হয়ে উঠল,
সেই পঙ্কিল ভুমিতে রথ গজাদির গতি রোধ হওয়ার উপক্রম হলো।
দৈত্যদের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রক্তের স্রোতে শৈবালদামের ন্যায় ভাসতে
লাগল, সেই প্রবলস্রোতে বিচরণত রথ-অশ্ব-গজাদিকে জলাশয়ে ক্রীড়ারত মৎস্যে ভ্রম হয়।
দেবীগণের উল্লাস ও দৈত্যগণের মুহুর্মুহু আর্তনাদে যুদ্ধ ক্ষেত্র মুখরিত হয়ে উঠল।
ললিতা-ভণ্ড সংগ্রামের চতুর্থদিনের দ্বিপ্রহরের এই যুদ্ধ এমন বীভৎস হত্যালীলায়
পরিণত হলো, যে স্বয়ং কালদণ্ডধারী যমের মনেও যেন ভীতির উদ্রেক হলো।
দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী দৈত্যচমু ভেদ করতে করতেই ভণ্ডকে আক্রমণ করলেন । দেবী
মন্ত্রিণী ও দণ্ডনায়িকাও ঘোরযুদ্ধে দেবীর পৃষ্ঠরক্ষা করতে লাগলেন। এই অবকাশে ভণ্ড
আর দেবী ললিতার মধ্যে অভুতপুর্ব অস্ত্র-প্রত্যস্ত্রের ভীষণ দ্বন্দ্বযুদ্ধ শুরু হলো।
দেবী ললিতা এমন দ্রুতবেগে নিজের ধনুষে শরসন্ধান করছিলেন যে,
ভণ্ডাসুর প্রত্যাঘাতের সুযোগই পাচ্ছিলেন না। মনে হচ্ছিল,
দেবী নিজের তুণীর থেকে একটি শর গ্রহণ করছেন,
সেই একটি শরই চাপ থেকে নিক্ষেপণের সময় সংখ্যায় দশটিতে পরিণত
হচ্ছে, শুন্যমার্গে তীব্রবেগে গমনের সময় তা একশোটিতে,
লক্ষ্যভেদের পুর্বে তা সহস্র শরে ও দৈত্যগণের মর্মভেদের সময়
কোটিকোটি শরে পরিণত হচ্ছে। ক্রুদ্ধ ভণ্ড দেবীকে ছত্রভঙ্গ করতে মহাবল অন্ধতামিস্র
অস্ত্র মোচন করলেন । মহাদেবী তখন মহাতরণি বাণ নিক্ষেপ করে তা প্রতিহত করলেন ।
মহাবীর ভণ্ড তখন পাখণ্ডাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন । দেবী গায়ত্র্যস্ত্র দিয়ে তাঁর
প্রত্যাঘাত করলেন । কুটিল ভণ্ড তখন একে একে অন্ধাস্ত্র,
অন্তকাস্ত্র, সর্বস্মৃতিনাশাস্ত্র ইত্যাদি মহাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন ।
জগদাম্বিকা মহামৃত্যুঞ্জয় অস্ত্র দিয়ে সবকটিকে একযোগে নিবারণ করলেন ।
সমস্ত অস্ত্রকে ব্যর্থ হতে দেখে ভণ্ড মহারোগাস্ত্রের নিক্ষেপ করল । ক্রুঢ় অস্ত্রের প্রভাবে
শক্তিগণ রাজযক্ষ্মাদি ভয়ানক রোগাক্রান্তা হলেন। রোগপীড়িত দুর্বল শক্তিসেনাকে
দৈত্যগণ মহানন্দে প্রহার করতে লাগল। যোগিণীগণ তখন কাতরস্বরে দেবী ললিতার কাছে
প্রার্থনা করলেন । শক্তিগণের এমন দুরবস্থা দেখে মন্ত্রিণী ও দণ্ডনায়িকা দ্রুত
পীড়িতদের সুশ্রুষা করতে লাগলেন। এই সুযোগে কুটিলাক্ষ দণ্ডনায়িকাকে মুশল দ্বারা প্রহার
করলে, দণ্ডনায়িকা খড়্গাঘাতে তাঁর শিরচ্ছেদ
করলেন। সমস্ত ব্যাধির নাশ করার জন্য মহেশ্বরী ললিতা নামত্রয়
মহামন্ত্র স্মরণ করে বৈষ্ণবাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। তখন সেই অস্ত্র থেকে নারায়ণ
অচ্যুত, অনন্ত ও গোবিন্দ- এই ত্রিরূপে নিজেকে প্রকাশ করলেন । এই ত্রিমুর্তির সম্মিলিত
হুঙ্কারমাত্রেই সমস্ত ব্যাধি দগ্ধ হয়ে শক্তিগণকে মুক্ত করল।
মরিয়া হয়ে ভণ্ড তখন আয়ুর্নাশ অস্ত্র প্রয়োগ করল। দেবী তা কালসঙ্কর্ষণী অস্ত্র
দ্বারা প্রতিহত করলেন । এইবার ভণ্ড এক অতীব ভয়ঙ্কর গুহ্য অস্ত্র প্রয়োগের
সিদ্ধান্ত নিল। শুক্রাচার্য্যের শিষ্য থাকাকালীন দৈত্যগুরু ভণ্ডকে এই বিশেষ
অস্ত্রের শিক্ষা দিয়েছিলেন। শুক্রাচার্য্য মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্রের প্রয়োগ জানতেন ও
ভণ্ডকে তাঁর শিক্ষাও দিয়েছিলেন। মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্রকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার
করার বিশেষ কৌশলও তিনি একমাত্র ভণ্ডকে শিখিয়ে ছিলেন। আজ দেবী ললিতার প্রকোপে তাঁর
সম্মুখে মহাভয় উপস্থিত। তাই কোনো উপায়ান্তর না দেখে সে মৃত
সঞ্জীবনী মন্ত্রসিদ্ধ সেই ভীষণ মহাসুরাস্ত্র নিক্ষেপ করল ।
মহাসুরাস্ত্র প্রয়োগ করতেই তাঁর থেকে কোটিকোটি দেবশত্রুদের উত্থান হতে থাকল।
অতীতে যারা দেবগণের হাতে বধ্য হয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও যারা বধ্য হবেন,
এমন সব দুরন্ত দৈত্য,
দানব, রাক্ষস, মনুষ্যদের উদ্গম হতে লাগল নিমেষেই। কে নেই তাদের মধ্যে!
সৃষ্টির প্রারম্ভে নিহত মধু, কৈটভ, মহাবল মহিষাশুর, ধুম্রলোচন, চণ্ড, মুণ্ড, চিক্ষুর, চামর, ভীমকায় রক্তবীজ, শুম্ভ, নিশুম্ভ, কালকেয়- স্বীয় অস্ত্রধারণ করে তাদের প্রাদুর্ভাব হতে লাগল।
এইসব দুর্বধ্য দানবগণ কঠোর শস্ত্রের প্রহারে শক্তিসেনাকে ভুপতিত করতে লাগল।
যোগিণীগণের আর্তনাদে দেবী ললিতা শঙ্কিত হলেন। ক্রুদ্ধ দেবী ললিতা ত্রিপুরাসুন্দরী
তখন দৈত্যগণের প্রতি এক প্রবল হুংকার দিলেন। তখন দেবীর হুংকার থেকে আবির্ভুতা হলেন
মহা যশস্বীণী দশভুজা এক দেবী। ইনিই দেবী দুর্গা তথা নারায়ণী। শুলী প্রদত্ত শুল,
নারায়ণের সুদর্শন চক্র,
বরুণের শঙ্খ ইত্যাদি দশবিধ অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দেবী
সিংহবাহিনী প্রকট হলেন। সহস্র সুর্যের কিরণের ন্যায় দীপ্তমানা দেবী চণ্ডিকা
মহিষাদি অসুরগণের সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। একাকিনী দেবী দুর্গার
মহাসংগ্রামে একে একে অসুরদের পতন হতে লাগল। একে একে তিনি মধু, কৈটভ,
শুম্ভ, নিশুম্ভ, রক্তবীজকে নিধন করে শুলাঘাতে মহিষকেও মর্দন করলেন ।
ভণ্ড এবার অর্ণবাস্ত্র মোচন করল । অর্ণবাস্ত্র থেকে প্রবল বেগে জলরাশি নির্গত
হয়ে সমুদায় শক্তিসেনাকে নিমজ্জিত করল। দেবী জগদম্বা নিজের দক্ষিণ হস্তের তর্জনীর
নখর থেকে আদিকুর্মকে প্রকট করলেন । আদিকুর্ম তাঁর যোজন বিস্তৃত খোলস পৃষ্ঠে
যোগিণীগণকে ধারণ করে তাদের রক্ষা করলেন । অতঃপর,
ভগবান কুর্ম জলরাশি শোষণ করে অর্ণবাস্ত্রকে বিফল করলেন ।
নিজের সমস্ত মহাস্ত্র ব্যর্থ হচ্ছে দেখে মহাবল ভণ্ড শঙ্কিত হল। শেষ সম্বল
হিসেবে আবার মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র প্রয়োগ করা
স্থির করল । মন্ত্রের মাধ্যমে ভণ্ড দৈত্যসম্রাট হিরণ্যাক্ষ ও মহামহিম হিরণ্যকশিপুকে আহ্বান করল।
পুর্ববর্তী শত সহস্র চতুর্যুগে নিহত হওয়া কোটিকোটি হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপুর
প্রাদুর্ভাব ঘটতে শুরু করল যুদ্ধক্ষেত্রে। হিরণ্যাক্ষগণ গদা ও হিরণ্যকশিপুগণ
মহাশুলের আঘাতে যোগিণীসেনাকে ছত্রভঙ্গ করতে শুরু করল। কুটিল দৈত্যদের দ্বারা
হন্যমান শক্তিসেনা বিহ্বল হয়ে পলায়ণ করতে থাকল। দাবাগ্নীর মতো দৈত্যসেনাগন
যোগিণীদের বিনষ্ট করতে থাকল। দেবী ললিতা তখন নিজের মধ্যমার নখ হতে স্বয়ং নারায়ণ
বরাহরূপে অবতীর্ণ হলেন। বরাহ তাঁর বজ্র কঠিন দন্ত দ্বারা হিরণ্যাক্ষদের মর্মভেদ
করে বধ করতে থাকলেন। হিরণ্যকশিপু তখন ক্রুদ্ধ হয়ে ভগবান বরাহকেই আক্রমণ করে বসলেন।
দেবীর অনামিকা থেকে তখন জ্বলন্ত আদিত্যের ন্যায় তেজোদীপ্ত সিংহের আনন যুক্ত
জনার্দন নৃসিংহের আগমণ ঘটলো। সহস্রবাহু নৃসিংহরূপী জনার্দন ভীষণ গর্জন করে
কালরুদ্রময় নখরের আঘাতে হিরণ্যকশিপুদের ছিন্নভিন্ন করতে লাগলেন।
অতঃপর ভণ্ড দৈত্যরাজ বলি ও হৈহয়রাজ সহস্রার্জুনকে আহ্বান করল । নিমেষেই তাঁরা
প্রবল প্রতাপে যোগিণীগণদের সাথে সংগ্রাম করতে শুরু করল। তখনো দেবী ললিতার
কনিষ্ঠাঙ্গুষ্ট থেকে উপেন্দ্র বামন ও বাম হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ থেকে ভার্গবরামের
উদ্ভব ঘটলো। বামন পাশের সাহায্যে বলিগণকে আবদ্ধ করে পদাঘাতে মর্দন করতে
লাগলেন। ভার্গবরাম এই মুহুর্তেই তাঁর ক্ষুরধার পরশুর আঘাতে অর্জুনদের বিনষ্ট করলেন
।
উপায়ান্তর না দেখে, ভণ্ড এবার পৌলস্ত্যদের উজ্জীবিত করে তুলল ।
তখনই যুদ্ধক্ষেত্রে আবির্ভুত হলেন লঙ্কেশ্বর রাবণ,
রাবণানুজ কুম্ভকর্ণ ও রাবণপুত্র মেঘনাদের। রাবণের সাথেই
তাঁর দশ সহস্র অক্ষৌহিণী রাক্ষসেনারও প্রাদুর্ভাব ঘটলো। চন্দ্রহাস খড়্গধারী রাবণ ও
তাঁর সেনা ভয়ঙ্করভাবে শত্রুভেদ করা শুরু করল। শক্তিসেনার ত্রাহি রবে
ত্রিপুরাসুন্দরী বাম হস্তের তর্জণী থেকে সৃষ্টি করলেন দাশরথি রাম ও লক্ষ্মণকে।
লক্ষ্মণ মেঘনাদকে ও রাম রাবণ ও কুম্ভকর্ণকে দিব্যাস্ত্র প্রয়োগে নিধণ করলেন । শেষে
নীলপদ্মের ন্যায় সুশ্রী শ্রীরাম নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগে রাক্ষসগণকে নিশ্চিহ্ন করলেন ।
ভণ্ড এবার দ্বাপর যুগের মহাবল অসুর ও দেবশত্রুদের আহ্বান করলেন । তাঁর
মন্ত্রের প্রভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে ছত্রাকের ন্যায় উদ্গম হতে লাগল সেইসব নিচ
দানবগণদের। শিশুপাল, দন্তবক্র, শাল্ব, কাশিরাজ, পৌণ্ড্রক, রুক্মী, ডিম্ভক, শম্বর, বাণ, কংস, চাণুর মল্ল, মুষ্টিক, অরিষ্ট, ধেনুক, কেশি, কালিয়, পুতনা, শকট, তৃণাবর্ত, নরক, মুরা
-
ইত্যাদি মহাক্রুঢ় নরপতি ও দানবগণের সম্মিলিত হুংকারে
ত্রিলোক বিদীর্ণ হওয়ার পরিস্থিতি এল। এই ভীষণ ভু-ভার হরণের জন্য দেবী জগদম্বার বাম
হস্তের অনামিকা থেকে আবির্ভুত হলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ থেকে ক্রমে বলভদ্র,
প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধের আবির্ভাব ঘটলো। তাঁরা চারজন মিলে
চতুর্ব্যুহ গঠন করলেন । দুষ্ট নরপতি ও দানবগণকে চতুর্ব্যুহ বাসুদেব ভীষণ যুদ্ধে
কালসমীপে প্রেরণ করলেন ।
ভণ্ডকে আর মন্ত্র ব্যবহারের সুযোগ না দিয়ে শক্তিশেনা ও নারায়ণের অবতারগণ
সম্মিলিত হয়ে ভণ্ডকে আক্রমণ করলেন । এমন যুগপৎ আক্রমণে বিহ্বল ভণ্ড কোনোরকমে তাদের
প্রহার প্রতিহত করতে থাকল। যুদ্ধবিধ্বস্ত,
ক্লান্ত ভণ্ড শেষবারের মতো জ্বলে উঠে প্রাণপণ সংগ্রামে রত
হল। এমন সময় দেবী ললিতাম্বা প্রচণ্ড নারায়ণাস্ত্র বিমোচন করলেন । শীতল জলস্পর্শে
ভীষণ অগ্নি যেমন পরাভুত হয়, নারায়ণাস্ত্রের সাহায্যে দেবী তেমনই অবশিষ্ট দৈত্যচমুকে
বিনষ্ট করলেন । পাশুপতাস্ত্রের মাধ্যমে দেবী দৈত্যসেনার ৩৫ জন সেনাপতির শিরোশ্ছেদ করলেন
। দেবী আদিপরাশক্তি তখন তাঁর ইক্ষুধনু হতে মহাকামেশ্বরাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন । উজ্জ্বল
নক্ষত্রের মতো চতুর্দিক দীপ্তমান করে সেই ভীষণ অস্ত্র ভণ্ডের তীব্রবেগে ভণ্ডের
বক্ষে পতিত হলো। দিনান্তে সুর্যদেব যেমন অস্তাচলে গমন করেন,
ভণ্ডের প্রাণবায়ুও তেমনই পরলোকে গমন করল। চতুর্থ দিনের সেই
ভীষণ সংগ্রামে ভণ্ডাসুর ও তাঁর দোর্দণ্ডপ্রতাপের থেকে সুরগণ অবশেষে মুক্তি পেলেন।
ত্রিলোক হর্ষিত হয়ে দেবীর নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। নারায়ণের অবতারগণ যুদ্ধান্তে
দেবীকে প্রণাম করে দেবীর স্তুতি করলেন । দেবী তখন তাদের বর দিলেন,
প্রত্যেক কল্পে যখনই ধর্মের অবক্ষয় ঘটবে,
তখন তাঁরা অবতীর্ণ হয়ে অধর্মের বিনাশ করে ধর্মস্থাপন করবেন।
বরলাভের পর দেবীর আজ্ঞায় তাঁরা বৈকুণ্ঠে গমন করলেন ।
কিন্তু কাজ তখনও সম্পুর্ণ হয়নি। দেবীর আদেশে উন্মত্ত শক্তিসেনা অবশেষে
শোণিতপুরে প্রবেশ করলেন। মত্ত যোগিণীগণ বিনাবাধায় শোণিতপুর ধ্বংস করতে লাগল।
প্রকাণ্ড অট্টালিকাসমুহ, গোশালা, অশ্বশালা, ভণ্ডের রাজপ্রাসাদে ভীষণ ভাবে অগ্নিসংযোগ করা হলো। অগ্নির
করাল গ্রাসে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সহ অবশিষ্ট সমস্ত দৈত্য দগ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করল।
গোটা শোণিতপুর একসময় ভস্মীভুত হলো। দেবগণ শোণিতপুরের শেষচিহ্নটুকুও মাটিতে মিশিয়ে
দিলেন। শোণিতপুর তথা দৈত্যসাম্রাজ্যের পতনে দেবগণ সহর্ষ উল্লাস করে উঠলেন।
ব্রহ্মাণ্ডপুরাণান্তর্গত ললিতোপাখ্যানের প্রারম্ভে মহাদেবীর স্তুতি প্রসঙ্গে
বলা হয়েছে, জগন্মাতার করুণাতেই মানবলোক তৃতীয় পুরুষার্থ অর্থাৎ কাম লাভ করে। অতি
গুরুত্বপূর্ণ কথা। ধর্মপালনের উদ্দেশ্য অর্থলাভ,
অর্থলাভের উদ্দেশ্য কামোপভোগ। অর্থাৎ স্ব-ইন্দ্রিয়তৃপ্তি।
এককথায় 'ভুক্তি'। পরাম্বিকা অখিলমানবের ভুক্তিপ্রদায়িনী। আবার,
তিনি মুক্তিপ্রদায়িনীও বটে। পরমাত্মা সর্বব্যাপী সৎ-চিৎ
স্বরূপ। পরমাত্মার বোধ এবং সর্বব্যাপকতার বিশ্বাস থেকেই সাধক সকল সিদ্ধি অর্জন
করে। এই নিত্য ক্রিয়াশীল পরমাত্মাই পরাশক্তি ললিতা ত্রিপুরাসুন্দরীর
স্বরূপ, যিনি স্থূল, সূক্ষ্ম ও কার্যকারণরূপে অবস্থিত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জীব আপন
আত্মশক্তির স্বরূপ এই দিব্যচৈতন্য, চিদ্রূপিণী ললিতা রাজরাজেশ্বরী মহাত্রিপুরাসুন্দরীর
সাধন করতে সমর্থ। বিধিবিধানে পূজা না করেও পুরুষোত্তমের পরাশক্তি রূপ নিঃসংশয় এবং
অভিন্নভাবনায় কেবলমাত্র ধ্যান করলেই পবিত্রতা,
সমৃদ্ধি এবং অন্তিমে মুক্তি লাভ হয়। জীব জন্ম-মৃত্যুর চক্র
হতে মুক্ত হয়। ভোগ ও মোক্ষ উভয় প্রাপ্তির একমাত্র উপায় ত্রিপুরাসুন্দরীর সাধন।
ত্রিলোকের আদি জননী, যিনি কেবল ধ্যান ও মননের দ্বারা প্রতিভাত হন,
তিনি ললিতা। যাঁর পরাসত্তা,
কেবলমাত্র জ্ঞানের দ্বারা প্রতিপাদিতা হন,
তিনিই ললিতা। যিনি সকল হৃদয়ে ‘আত্মা’ রূপে বিরাজমানা,
সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মরূপে যিনি নিয়ত ক্রিয়াশীল,
সেই সর্বভূতান্তরাত্মা,
দেদীপ্যমান পরমাত্মাই,
মাতা ললিতা। এই কৃপাময়ী ললিতাই দেবগণের চিদাগ্নিকুণ্ড থেকে
আবির্ভূত হয়েছেন, কামেশ্বরীরূপে, দেবগণের অনন্যশরণাগতি,
আত্মনিবেদনের জন্য,
দেবকার্য উদ্ধারের নিমিত্ত। তিনিই আপন অভিন্ন-রূপ কামেশ্বর
শিবের সঙ্গে মিলিত হয়ে অসুর বিনাশ করেছেন,
দেবগণকে পুনরায় উজ্জীবিত করেছেন,
তাঁদের বিপন্মুক্ত করে সকল বাঞ্ছা পূর্ণ করেছেন।
পরাম্বা ললিতাসুন্দরী আমাদের রক্ষা করুন।
অলমিতি।
তথ্যসূত্রঃ-
১. ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, দ্বিতীয় খণ্ড- গীতা প্রেস, গোরক্ষপুর
২. THE
BRAHMANDA PURANA, PART IV-Translated and Annotated by Dr. G.V. TAGARE, MOTILAL
BANARSIDASS PUBLISHERS
বিশেষ ঋণস্বীকারঃ-
সৌগত সিকদার
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন