চল্ ভানুমতী চল্....
মোহনা পেরিয়ে নিয়ে যাবি পারে
তুই যে মোদের ভরসা ও বল
চল্ ভানুমতী চল্....
ছোট্ট সে পানসি। আদর করে নাম রাখা হয়েছে 'ভানুমতী'। তাকে ঘিরে হতদরিদ্র তিন মৎস্যজীবী বন্ধুর নতুন আশা ও ভরসা। কঠিন জীবন সংগ্রামে স্বপ্ন দেখছে তারা লড়াই করে বাঁচার। কারণ বাঁচার আর এক নাম তো লড়াই। সৃষ্টির সমস্ত জীবই টিকে থাকার জন্য অহরহ লড়াই করছে। লড়াই ছাড়া বর্তমান দুনিয়ায় নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করা একপ্রকার কঠিন ও অর্থহীন। কিন্তু আচমকা ঘটে গেল এক দুর্নিবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়। আর সেই অনিবার্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ভেঙে খান্ খান্ হয়ে গেল তিন বন্ধুর সোনালী রঙিন মধুর স্বপ্ন।
বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এক অজ পাড়াগাঁ---গোবর্দ্ধনপুর। নদীবেষ্টিত চিরসবুজ বাদাবন-ঘেরা ব-দ্বীপ ভূমি জি-প্লট অঞ্চল। এই অঞ্চলের অন্তর্গত গোবর্দ্ধনপুর গ্রাম। এটি একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের শেষ জনপদ।
জি-প্লট অঞ্চল এবং গোবর্দ্ধনপুর গ্রামের দক্ষিণে কেবল দিগন্ত প্রসারিত লবণাক্ত সুনীল অনন্ত জলরাশি। আর সফেন ঊর্মিমালা বিরাজিত উদ্বেল অশান্ত সাগর ও মহাসাগর---বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগর। পুবে ও পশ্চিমে যথাক্রমে জগদ্দল ও কার্জনক্রিক নদীর দুরন্ত মোহনা। উত্তরে খরস্রোতা বহতা নদী চালতাদুনিয়া।
শতাব্দী প্রাচীন এই গন্ডগ্রাম জন্মলগ্ন থেকে রাক্ষুসে সাগরের করাল গ্রাসে। ক্রমশঃ এর কলেবর ছোট হতে হতে প্রায় গোষ্পদে পরিণত এখন। ফি-বছর বর্ষার মরসুমে আসে লবণ জলের প্লাবন। গবাদি পশু-পাখিসহ সাময়িকভাবে অনেকে হয় ঘরছাড়া; কিন্তু গ্রাম ছাড়া হয় না। ভাটায় জল নেমে গেলে, মা-মাটি-মানুষের টানে সবাই ফিরে আসে আবার ভিটেমাটির উঠানে।
না, সে অর্থে ধনী জমিদার, বড়লোক বা শিক্ষিত চাকুরিজীবীর বাস এখানে নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ মানুষ অর্ধশিক্ষিত নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিরক্ষর আর গরিব। এক সময় চাষবাস ছিল এদের পেশা, আর মাছ ধরা ছিল নেশা। বিগত প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল বছর বছর বন্যার ফলে ধীরে ধীরে মাটি লবণাক্ত হতে হতে ক্রমে চাষাবাদের অনুপোযুক্ত হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে চাষাদির পরিবর্তে মাছ ধরার নেশা হয়ে উঠেছে এখন এদের মূল পেশা। তবে পেশার বদল ঘটলেও ভাগ্য কিন্তু এদের বদলায়নি একটুও। দুর্বল অর্থনীতি এবং নিম্নমানের জীবনযাত্রার বিচারে এরা যেই তিমিরে সেই তিমিরে। অথচ উন্নত জীবন জীবিকার প্রয়োজনে, নতুন দেশের সন্ধানে এ-মাটি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা এরা ভাবেনি কখনও স্বপ্নে। দুঃখ আছে, কষ্ট আছে, আছে শত অভাব---তবুও একটা অভিনব অনাবিল সার্বভৌম সার্বজনীন সুখ এরা অনুভব করে এই লবণাক্ত সোঁদা মাটির টানে ও আঘ্রাণে।
এখন এদের একটাই নতুন পরিচয়---চাষী নয়, এরা সবাই গরিব মৎস্যজীবী। কেউ বা মাঝি। কেউ বা ভাগী। মৎস্য শিকারের রণকৌশলও এদের বিচিত্র রকমের। কেউ কেউ পানসি ভাসায় নদী মোহনায়। খাঁড়িতে পাতে বারান্দা জাল। বড় বড় ভেটকি ভোলা ধরার আশায়। এদের মধ্যে অনেকে বড় বড় ট্রলারে করে জীবনকে বাজি ধরে, গভীর সমুদ্রে ইলিশ ধরতে যায় ভরা বর্ষায়। হায় ! মাঝে মাঝে এদের অনেকেরও আবার নাম লেখা হয় নিরুদ্দেশের খাতায়। এখানে "জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন"। জীবন জীবিকার এ-লড়াই এভাবেই চলছে নিত্যদিন।
হ্যাঁ, এলো সেই ভয়ংকর সর্বনাশা দিন। ২৯ শে নভেম্বর, ১৯৮৪। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হয়েছে গভীর নিম্নচাপ। ক্রমশঃ তা পরিণত হচ্ছে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে। আকাশবাণী বেতার দু'-তিন দিন আগে থেকে তার পূর্বাভাস সম্প্রচার করে চলেছে। কয়েকদিন ধরে তাই মেঘলা আকাশ। মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টি। বাতাসের গতিবেগও ঘন্টায় ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার- এর মধ্যে।
কিন্তু ২৯ শে নভেম্বর সকাল থেকেই ঝড়ের গতিবেগ উত্তরোত্তর বাড়তে শুরু করল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে গেল ঝড়ের গতিবেগ। বেতারে ঘনঘন সতর্কবার্তার ঘোষণা। ঘন্টায় ১৫০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার গতিবেগে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড়।সাবধান ! সাবধান ! সাবধান ! চতুর্দিকে প্রশাসনিক তৎপরতা। জারি করা হয়েছে ভীষণ সতর্কবার্তা। নদী বন্দরে এক, দুই, তিন করে শেষ পর্যন্ত দশ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। মৎস্যজীবীদেরও গভীর সমুদ্রে যাওয়া ভীষণভাবে বারণ।
কিন্তু কোন উপায় নেই---কোনও উপায় নেই অজয়, বিজয় ও সুবাসের। কারণ তাদের বারান্দা জাল পাতা আছে যে ঢঞ্চি জঙ্গলের খাঁড়িতে। জগদ্দলের মোহনা পেরিয়ে ওপারে। সুবাস, অজয় ও বিজয়ের ভয় ও আশঙ্কা ঝড়ে জাল ভেসে হারিয়ে গেলে ধনে- প্রাণে মারা পড়বে যে তারা। কেননা এ বছরই আনকোরা নতুন বারান্দা জাল-সেট তৈরি করেছে তারা। গ্রামের একমাত্র বড় মহাজন ধনপতি মালের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা কর্জ করে। কর্জ দেওয়ার সময় প্রৌঢ় মালবাবু দেঁতো হাসি হেসে বলেছিলেন....
----দেখ বাপু ! এক কথার লোক আমি। তাছাড়া আমার আবার দয়ার শরীর। মানুষের বিপদে আমি চুপ থাকতে পারি না। তাই চাওয়া মাত্র অতগুলো টাকা কর্জ দিলাম। আগামী বোশাখের মধ্যে কিন্তু দেনাটা শোধ করে দিও।কেমন ?
তখন সুবাস আশ্বস্ত করে বলে....
----মালবাবু! ভাববেন না। আয় ইনকাম যদি ভাল হয়, আপনাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু আমাদের সব চেষ্টা ও শ্রম যদি কোন কারণে বিফলে যায়---
সুবাসের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মালবাবুর সহর্ষ মন্তব্য....
----সময় পেরিয়ে গেলে, সুদসহ পুরো টাকাটা তখন কিন্তু পরিণত হবে আসলে। কারণ আমার টাকাটা তো আর বছর বছর বাঁজা থাকতে পারে না।
সঙ্গে সঙ্গে করজোড়ে অজয় ও বিজয় এক সুরে মিনতি করে বলে....
----না--না--মালবাবু, দোহাই আপনার ! ওভাবে টাকার সুদকে আসলে ধরবেন না। তাহলে আমাদের মত গরিবেরা একেবারে জানে বধ হব।
----তা---বললে কী আর হয় বাছারা ! সেই জন্য তো বলি দেনাটা সময়ে শোধ করে দিও। তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।
এ-কথা বলে মালবাবু বাম হাত দিয়ে চাঁদির চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে আনে। তারপর মাথাটা কিছুটা ঝুঁকিয়ে চশমার ওপর দিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে রসালো মন্তব্য করে....
----যদি সরকারি জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতিকে মান্যতা দিয়ে আমার টাকাটা বছর বছর বংশবৃদ্ধি না ঘটায়, তাহলে তোমাদের মত আর পাঁচজন গরিবের বিপদে আমি কেমন করে সাহায্য করবো---তোমরাই বল ?
মুখে কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়েছিল তারা। একপ্রকার হাড়ি কাঠে মাথা গলিয়ে মহাজনের বাড়ি থেকে কর্জ নিয়ে নীরবে সেদিন ঘরে ফিরেছিল তারা তিনজন।
আজ এই মুহূর্তে ঝড়ের সতর্কবার্তার চেয়ে মহাজন মালবাবুর সেদিনের কথাগুলো সুবাসদের কাছে অশনি সংকেত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে প্রবল গতিবেগে ঘন ঘন যেন আছড়ে পড়ছে তাদের মাথায়।
সুবাসরা তিন বন্ধু। নিকট প্রতিবেশী। বাড়ি পাশাপাশি। অজয় ও বিজয় সদ্য যুবক।
অবিবাহিত। ওদের থেকে বয়সে বছর পাঁচেকের বড় সুবাস। বিবাহিত। গত বৈশাখে তার বিয়ে হয়েছে অষ্টাদশী অহল্যার সঙ্গে। অহল্যা অসামান্যা অপরূপা সুন্দরী না হলেও, সে কিন্তু তন্বী শ্যামা শিখরিণী। যেন কাজলনয়না হরিণী। অহল্যার সুমধুর মিষ্টি কথায় বড় যাদু আছে। যে কোনো পুরুষকে সহজেই ঘায়েল করতে বিশেষ একটা সম্মোহিনী ক্ষমতা রয়েছে তার দেহ লাবণ্যে ও চলনে-বলনে। মনের মত পতিব্রতা জীবনসঙ্গিনী পেয়ে সুবাসও স্বভাবতই খুব খুশি।
কিন্তু ফুলেও কাঁটা থাকে। তাই সংসারে সকলে সব সুখ পায় না। আবাল্য মাতৃহীনা স্নেহ-কাঙ্গালিনী অহল্যা শাশুড়িকে নিজের মায়ের আসনে বসিয়ে একটা সুখী একান্নবর্তী সংসার নীড় রচনার স্বপ্ন দেখেছিল শ্বশুরবাড়িতে এসে। ভালোবেসে আপন করে নিতে চেয়েছিল সংসারের সব্বাইকে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন যে এত তাড়াতাড়ি নষ্টনীড়ে পরিণত হবে, কখনো তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
কথায় আছে জগতে অন্ধ ছাড়া কানা ব্যক্তিও সাধারণত রূপ ও সৌন্দর্যের পূজারী। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও ঘটে। প্রায় দেখা যায় অরূপা নারী রূপশ্রীকে হিংসা করে মনে মনে। শ্বশুরবাড়িতে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন অঙ্কনের প্রথম দিন থেকেই অহল্যার ভুবন ভুলানো হাসি যে একসময় তার স্বপ্ন সুখের গলার ফাঁসি হবে, তার রূপলাবণ্য ও সৌন্দর্য যে মধ্যবয়স্কা বিগত যৌবনাবস্থা শাশুড়িকে ঈর্ষান্বিত করে হীনমন্যতায় ভোগাবে, এ-কথা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি সে।
তার উপর গোল বাধলো বিয়ের সময়কার প্রতিশ্রুতিমত দানসামগ্রী ও বকেয়া পণের টাকা নিয়ে। বিয়ের এক-দু'মাস যেতে না যেতেই অনাদায়ী পণের টাকা ও দানসামগ্রীকে কেন্দ্র করে দজ্জাল শাশুড়ি শুরু করল মানসিক ও শারীরিক নিত্য নতুন গালমন্দ ও অত্যাচার। সহ্যের সীমা ছাড়াল অভাগিনী অহল্যার। প্রথম প্রথম নানান লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা সহ্য করেও যৌথ সংসারে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু পারেনি। সহ্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে, সে হলো বিদ্রোহিনী।
আসলে সংসারে অনেক ক্ষেত্রে শাশুড়ি-বৌমার সম্পর্কটা অনেকটা সাপে-নেউলের মতো। সাপ ও নেউল কখনো একত্রে এক বিবরে বাস করতে পারে না। তাই এক সংসারে থাকা অহল্যা আর তার শাশুড়ির পক্ষে শুধু দুর্বিষহ নয়, ভীষণ বিপজ্জনকও হয়ে উঠলো। শাশুড়ির সেই এক কথা---'এ সংসারে হয় বৌমা থাকবে, নয় আমি। কিন্তু আমাকে যদি বৌমার সঙ্গে একই বাড়িতে একই অন্নে থাকতে বাধ্য করা হয়, তাহলে আজ থেকে এই ভিটেয় জলস্পর্শ করবো না---এই আমি বলে রাখছি।' অসহায় শ্বশুরমশায়। পড়লেন গভীর দুশ্চিন্তায়। মুখে শুধু বললেন,-'দেখছি, দেখছি, ভাবছি কী করা যায় !'
শেষ পর্যন্ত পাড়ায় নিরপেক্ষ ভালো মানুষ বলে পরিচিত শ্বশুরমশায় দয়ালবাবুর সুবিচারে শাশুড়ি-বৌমার চিরন্তন কাজিয়া পরিণতি পেল পৃথগন্নে। যে কারণে মন না চাইলেও বাবা-মা, ভাইদের থেকে আলাদা হয়ে থাকতে বাধ্য হল সুবাস তার স্ত্রী অহলাকে নিয়ে।
এদিকে আলোচনা বৈঠকের রায় অনুযায়ী আলাদা ঘরবাড়ি করার জন্য সুবাস পেল পৈত্রিক দশ শতক জমি। আর পেল জীবিকা নির্বাহের জন্য যৌথ সংসারের টাকায় তৈরি করা পানসি ভানুমতী-র মালিকানা। দীর্ঘ সাংসারিক ঠান্ডা লড়ায়ের পর এতদিনে সবাই খুঁজে পেল শান্তির ঠিকানা।
দেনা, আর এক প্রস্থ দেনা। গত বৈশাখে দেনা করে পৈত্রিক জমির উপর ছিটেবেড়া ও কিছুটা দর্মার চাঁচ দিয়ে তার স্বপ্নের ঘর বানিয়েছে সুবাস। এদিকে বছর ঘুরে এলেও, মা ষষ্ঠীর কৃপা এখনো বর্ষিত হয়নি এই দম্পতি যুগলের ওপর। ফলে রাত-দিন শত অভাব অনটনের মধ্যে থেকেও কপোত কপোতীর মতো হেসে খেলে পরস্পর খুনসুটি করে উপভোগ করছে তাদের সুখী দাম্পত্য জীবন। অবশ্য মাঝে মধ্যে খানিকটা চিন্তার কারণ মাথার ওপর ভারী ঋণ ও ঋণদাতা মাল-মহাজন।
মহাজনের দেনার কথা মনে পড়লে সুবাস ভীষণ গম্ভীর হয়ে যায়। চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে থাকে তার প্রিয় সাধের সিংহাসনে---গত দুর্গাপূজায় কেনা ফাইবারের চেয়ারটায়। ডুবে যায় কী এক গভীর ভাবনায়! কিন্তু সুগৃহিনী অহল্যা সুবাসকে সব সময় হাসিখুশি দেখতে চায়। অনবরত চিন্তামুক্ত রাখতে চায়। আজও সুবাসকে ভীষণ চিন্তিত দেখে---অহল্যা দ্রুত কাছে আসে, তার ভুবন ভুলানো হাসির তুফান তুলে। আর আদর দিয়ে সুবাসের মন ভালো করার জন্য, বারবার তার প্রিয় অংকে আশ্রয় নেয় সংসারের সব কাজকর্ম ভুলে। বাম হাত দিয়ে সুবাসের গলাটা জড়িয়ে ধরে ঠিক বামদেবের গলায় বেড়িয়ে থাকা সাপের মত। তারপর সুবাসের স্বল্প-স্বেদ-সিক্ত কপোলে অহল্যা তার হালকা আবির রাঙা অধরপল্লবের শিশির শীতল আলতো ছোঁয়া দিয়ে বারবার তাকে রোমাঞ্চিত করার চেষ্টা করে। ডান হাত দিয়ে সুবাসের ঘন কালো লম্বা মসৃণ চুলে বিনুনি কাটতে কাটতে বলে....
----অতশত ভেবো না তো! সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখবে, মা গঙ্গা দেবীর কৃপা হলে দু'বছরের মধ্যে ঠিক শোধ হয়ে যাবে তোমার ঘরের ও জালের সব দেনা।
সুবাস তবুও কথা বলে না। শুধু খুশিতে উচ্ছল অহল্যার কাজলকালো চঞ্চল নয়নযুগলের বাঁকা চাহনির দিকে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। বাধ্য হয়ে অহল্যা আবার মুখ খুলে। তপ্ত কড়াইয়ে সদ্য ভাজা উছলে পড়া শুভ্র লাজরাশির মতো এক ঝলক মিষ্টি হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে বলে....
----সংসারে তো আমরা মাত্র দুটি প্রাণী। আমাদের আর কতটুকুই বা খরচ! আমার মন বলছে এবার সুসময় নিশ্চয়ই ফিরবে।
অহল্যার তুলতুলে শরীরের উষ্ণ পরশ আর ফুলের মতন কোমল হাতের মিষ্টি আদর ও আশ্বাস সুবাসের মনে কিছুটা বিশ্বাস ও ভরসা জাগিয়ে তুলে।
এমন সময় উঠানে দাঁড়িয়ে অজয় ও বিজয় হাঁক ছাড়ে....
----সুবাসদা---সুবাসদা! রামভক্ত ভরত ও লক্ষ্মণকে কি ভিতরে আসার অনুমতি দিচ্ছ ?
তাদের ডাকে চমকে ওঠে অহল্যা। চকিতে চলচপলার মত সুবাসের অঙ্ক থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় সে জ্যা-মুক্ত তিরের মত। ক্ষিপ্র গতিতে হারিয়ে যায় সেখান থেকে। চলে যায় রান্নাঘরে।
হালকা রসিকতা করে হাসতে হাসতে অনুমতির অপেক্ষা না করে অজয় ও বিজয় ঘরে প্রবেশ করে। সুবাস উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে। চাটাইটা ঝেড়ে পেতে দেয় মাটির মেজেতে। তারপর অজয় ও বিজয়কে ডেকে বলে....
----আয় আয়, বোস। তোরা দু'জনে এসে ভালো করেছিস। না এলে, আমিই ডেকে পাঠাতাম। খাঁড়ি থেকে জাল তোলার ব্যাপারে অনেক আলোচনার আছে তোদের সাথে।
অজয় বলে....
----জানি দাদা, তুমি যে ভীষণ দুর্ভাবনায় আছো সে কথা আমিও বিজয় আসতে আসতে বলাবলি করছিলাম।
অজয়ের কথার রেশ টেনে এবার বিজয় কথা শুরু করে....
----সুবাসদা, তুমি তো মাঝি। আবার মালিকও বটে। তুমিই ঠিক কর, কী আমাদের কর্তব্য ? যেভাবে বলবে আমরা সেভাবে প্রস্তুত।
হ্যাঁ,তিন বন্ধুর এই যৌথ কারবারে সুবাস একাধারে মাঝি ও মালিক এবং প্রধান পরামর্শদাতা। কিন্তু জাল-সেটের সমান অংশীদার তিনজনই। তাই খরচাপাতি বাদ দিয়ে যে অর্থ আয় হয়, তার সমান চার ভাগের এক ভাগ অজয়ের আর এক ভাগ বিজয়ের। বাকি দু'ভাগ পায় সুবাস। এক ভাগ জালের এবং আর এক ভাগ নৌকার মালিক হিসাবে। অবশ্য মাঝি বলে আলাদা করে কোন কমিশন কখনো সে দাবি করে না। আসলে মাঝি কমিশন 'কী'---এ-তল্লাটে তখনও কেউ জানে না। এদিকে তখনও চালু হয়নি পারস্পরিক ঘৃণিত, বিদ্বেষমূলক, বিমাতৃসুলভ, একতরফা, একচোখা এই অন্যায় ব্যবসায়িক শোষক প্রথা।
মাথাব্যথা---অজয়, বিজয় ও সুবাসদের যথেষ্ট মাথাব্যথা। কী করে এই ভয়ানক দুর্যোগে মোহনা পেরিয়ে নিরাপদে খাঁড়ি থেকে জাল তুলে আনতে পারবে তাই নিয়ে। সুতরাং আর দেরি না করে তড়িঘড়ি তিন বন্ধু বসলো আলোচনায়। সুবাসদের ছোট্ট ঘরে সদর-অন্দর মিলেমিশে একাকার। তবুও দর্মার চাঁচের আড়ালে রান্নাঘর থেকে খিচুড়ি ও আলুর দম রান্নার প্রস্তুতি নিতে নিতে কান পেতে সুবাসদের আলোচনা শুনতে থাকে অহল্যা।
অনেক চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ হল। শেষে তিন বন্ধু ঐকমত্যে একটা স্থির সিদ্ধান্তে এল। বিকেল তিনটে নাগাদ শেষ ভাটা। ভরা কোটালের শেষ ভাটায় জল বেশ নিচে নেমে যাবে। মোহনার পরিসরও অনেকটা ছোট হয়ে আসবে। তাছাড়া শেষ ভাটা ও প্রথম জোয়ারের মাঝখানে কিছু সময়ের জন্য তুলনামূলকভাবে নদী মোহনা থাকবে অনেকটা শান্ত। সেই সুযোগে পানসি ভানুমতীর সাহায্যে ওপারে পেরিয়ে যাবে তারা। আর তখন তাদের কাজও হাসিল হবে খুব সহজেই। এদিকে বিকেল তিনটের আগে নদীর চরে পানসির ধারে তাদের সবাইকে পৌঁছে যেতে হবে সময়ে। সুতরাং আর দেরি নয়। অজয় ও বিজয় একসঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত যে যার বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
বেলা প্রায় দশটা। কৃষ্ণা প্রতিপদ তিথিতে নদী মোহনা তখন ভরা কোটালের পূর্ণ জোয়ারে টইটম্বুর। পুবালি বাতাসের গতিবেগ জলস্ফীতির মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। চিরাচরিত স্বাভাবিক প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে গোটা গ্রাম। অবশ্য এই ধরণের পরিস্থিতি তাদের কাছে নতুন নয়। চির পরিচিত। অনেক অনেক বার এরকম ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের সাক্ষী থেকেছে তারা। ছান্দসিক সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ' আমরা'- কবিতার যেন পুনরাবৃত্তির ছবি ফুটে উঠেছে এই শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত অসহায় বাঙালী মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ভুক্ত লোকজনদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়, সুদৃঢ় মানসিকতায় ও ভয়ডরহীন কর্ম চঞ্চলতায়---
বছর বছর বার বার....
ঘূর্ণিঝড়ে পড়ি যে আবার
তবু ঝড় নিয়ে ঘর করি।
সকল ভয়কে জয় করে....
মরণ জেনেও লড়াইকে মোরা
কখনও নাহি যে ডরি !!
দেয়াল ঘড়িটা ঢং-ঢং-ঢং করে বেজে জানিয়ে দিল দুপুর বারোটা। সঙ্গে সঙ্গে আকাশবাণী বেতার আবহাওয়া সংক্রান্ত বিশেষ নিউজ বলেটিন ঘোষণা করল---'সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবনের সাগরদ্বীপ উপকূল বরাবর আছড়ে পড়বে। সে সময় ঝড়ের গতিবেগ থাকবে ঘন্টায় ১৫০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার। উপকূলবর্তী বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য সতর্ক করা হচ্ছে।' আবহাওয়ার খবর শেষ হলে সুবাস রেডিওর সুইচটা বন্ধ করে দেয়।
এই সময় রান্নাঘর থেকে অহল্যা তার সুরেলা গলায় ডাক দিয়ে বলে....
----ওগো, শুনছো! আমার রান্না শেষ হয়ে গেছে। তুমি তাড়াতাড়ি স্নানে যাও। খেয়ে দেয়ে বিকেলে বের হওয়ার আগে কিছুটা বিশ্রাম নেবে তো, না কি ?
সুবাসও আর দেরি না করে পুকুরে এক ডুব দিয়ে উঠে আসে। রান্না ঘরের দাওয়ায় অহল্যা ঝাড়ু দিয়ে ঝাঁট দেবার পর তালপাতার আসনটা সুন্দর করে পেতে দেয়। গরম গরম খিচুড়ি থালায় খানিকটা ঢেলে দিয়ে সুবাসের আসার অপেক্ষায় থাকে অহল্যা।
দ্রুতপদে সুবাস রান্নাঘরে এসে আসনে বসে। বরাবর অহল্যাকে আদর করে যে নামে ডাকে সুবাস সেই নাম ধরে বলে....
----অলি! আজ কী রান্না করেছ ? খুব খিদে পেয়েছে। দাও, খেতে দাও।
অহল্যা খিচুড়ির থালাটা সুবাসের সামনে এগিয়ে দেয়। পাশে বসিয়ে দেয় বাটি ভর্তি আলুর দম। ঝড়-বাদলার দিনে খিচুড়ি ও আলুর দম সুবাসের ভীষণ পছন্দের খাবার। এটা অজানা নয় সুগৃহিনী অহল্যার। তাই আজ সুভাসের অনুমতি না নিয়েই খাবারের এই মেনু।
তাছাড়া সুবাসরা আলোচনায় ব্যস্ত থাকায় অহল্যা স্বামীর অনুমতি নেওয়ার অবকাশ পায়নি। অহল্যা গরম খিচুড়ি ঠান্ডা করার জন্য হাত-পাখাটা ঘন ঘন নাড়তে থাকে। কিন্তু নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সুবাসের মুখের দিকে। অহল্যা বরাবর খিচুড়িটা বানায় ভালো। কিন্তু স্বাদে গন্ধে আজকেরটা স্পেশাল। তাই আয়েসভরে মাথা নিচু করে চুপচাপ গোগ্রাসে গিলছিল সুবাস।
কিন্তু অহল্যা কোন কথা বলছে না কেন ! খানিক পরে সুবাস মাথা তুলে তাকায় অহল্যার মুখের দিকে। জল চিক্ চিক্ করছে, তার আদরের কৃষ্ণকলি অলির চোখের কোণে। যে মেয়েটা সকালবেলায় এত হাসিখুশি, নানান দুষ্টুমিতে ও খুনসুটিতে উচ্ছল, ভরপুর---কী এমন হলো তার ! আষাঢ়ের জলভরা মেঘের মতো এখন তার মুখ ভার ! গুমোট পরিবেশকে হাল্কা করার জন্য সুবাস বলে....
----অলি ! কথা বলছো না কেন ? কী হলো তোমার ? কেন এত চুপচাপ ?
সুবাসের কথায় অহল্যার রুদ্ধ আবেগ আর কোন বাধা মানে না। অঝোরে জলের ধারা চোখের কোণ দিয়ে কপোল গড়িয়ে টপ্ টপ্ করে মাটিতে পড়তে থাকে। সুবাস বুঝতে পারে---তার অলি কিছুটা ভয় পেয়েছে আজ। তাই সরাসরি সান্ত্বনার স্তোকবাক্য দিয়ে সুবাস বলে....
----অলি ! তুমি মিছেমিছি ভয় পাচ্ছ কেন ? এরকম দুর্যোগে এর আগে সেবারও তো আমরা ওপার থেকে জাল তুলে এনেছি নিরাপদে। তাহলে ?
অহল্যা সবই বোঝে। তবুও কেন যেন আজ তার প্রাণ---তার প্রাণেশ্বরকে কিছুতেই কাছ-ছাড়া করতে চায় না। মন বলে---"যেতে নাহি দিব।" কিন্তু মুখ ফুটে সে-কথা সে বলতে পারেনা। কারণ তাদের সামনে আজ দুর্যোগের ঘনঘটার চেয়েও ভয়ানক বড় বিপদ জীবন জীবিকার ! তাই অসহায়ের মত তার এই নীরব বোবা কান্না। যেতে দিতে মন না চাইলেও, তবুও আজ সে সুবাসের বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
গুরুগম্ভীর এই বিষন্ন পরিস্থিতিকে কিছুটা হালকা ও সহজ করার জন্য সুবাস প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে। অহল্যার প্রশংসা করে বলে....
----অলি, আজকের খিচুড়িটা বানিয়েছ কিন্তু খাসা। রাতের জন্য একটু বেশি করে রেখো। এখন তাড়া থাকায় বাকিটা আর খাচ্ছি না।বরং তুমি খেয়ে নিও। ভালো কথা, রাতে একটু চাটনি বানিও তো। ফিরে এসে বেশ জমিয়ে দু'জনে একসাথে, একপাতে বসে খাবো।
পাতে খানিকটা খিচুড়ি ফেলে রেখে, ধড়পড় করে উঠে গেল সুবাস। খাওয়ায় বেশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরিত্যক্ত খিচুড়ি চোখের জল ফেলতে ফেলতে অহল্যা অন্যমনস্কভাবে মুখে তোলে। কিন্তু কিছুতেই যেন গলা দিয়ে নামতে চায় না। তাই এঁঠো খিচুড়িসহ থালাটা নিয়ে পুকুরঘাটে চলে যায় অহল্যা। সুবাস হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য গড়িয়ে পড়ে বিছানায়।
ওদিকে অজয় ও বিজয়দের বাড়ির লোকজনদের মনেও দুশ্চিন্তার কালো মেঘের ঘনঘটা। দুপুর ১২-টার আকাশবাণীর বিশেষ নিউজ বুলেটিন তাদের মনেও ভয় এবং শঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে। তাই ছোট থেকে বড় সবাই এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় তাদের বাইরে যেতে নিষেধ করছে। মোহনা পেরিয়ে ওপার থেকে জাল-সেট তুলে আনার ক্ষেত্রে যে জীবনের বিরাট ঝুঁকি রয়েছে তা বোঝানোর চেষ্টা চলছে অবিরত। বাড়ির বড়দের সমবেত যেন আবেদন---"ওগো, আজ তোরা যাসনে গো তোরা , যাসনে ঘরের বাহিরে !"
না---! আপনজনদের এই আকুল আবেদন ও অনুরোধ তাদের 'অগস্ত্য যাত্রা'-য় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তারা মরিয়া! তারা যাবেই ! যেতে তাদের হবেই !
এদিকে ঘড়িতে প্রায় বিকেল আড়াইটা। তাই আর দেরি নয়। অজয়, বিজয় পরস্পর ডাকাডাকি করে সুবাসের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সুবাসের বাড়ির কাছাকাছি এসে অজয় ও বিজয় বারবার ডাক দিয়ে বলে....
----সুবাসদা---সুবাসদা! সময় হয়ে গেছে। জলদি বেরিয়ে এসো। আর বেশি দেরি করা ঠিক হবে না।
তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে সুবাস তার সোহাগী কৃষ্ণকলি অলিকে কাছে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরে, তার কপালে বারবার সোহাগ চুম্বন এঁকে দেয়। আদর করে সান্ত্বনা দিয়ে বলে....
---- তুমি কোন রকম দুশ্চিন্তা করো না। দেখবে তোমার অপার ভালবাসা আর আন্তরিক পতিভক্তি তোমার সিঁথির সিঁদুরের ঠিক মনে রাখবে। নিরাপদে আমি আবার ফিরে আসব তোমার কাছে।
এতক্ষণ পরে নিজেকে খানিকটা আশ্বস্ত করে মুখ তোলে অহল্যা। আর তার সেই চিরাচরিত ভুবনভুলানো হাসির ঝিলিক চোখে মুখে ছড়িয়ে দিয়ে সুবাসের মুখের পানে তাকায়। সুবাস অহল্যার চিবুক তুলে ধরে একটু নাড়া দিয়ে বলে....
----অলি, এবার আমাকে অনুমতি দাও। আমি তবে যাই।
চকিতে সুবাসের মুখে ডান হাতখানা চাপা দিয়ে অহল্যা বলে....
----যাই বলতে নাই গো ! বল আসি। দুগ্গা---দুগ্গা---দুগ্গা---
দু'হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে মনে মনে দুর্গাকে প্রণাম জানায় অহল্যা। আর সুবাসের বাড়ি থেকে রওনা হয়ে যাওয়ার পথের পানে তাকিয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে।
অজয়, বিজয় ও সুবাস দ্রুতপদে হেঁটে নদীর ধারে পৌঁছে যায়। শুকনো চরে তাড়াতাড়ি করে চলে যায় পানসি ভানুমতীর কাছে। ভানুমতীর চতুর্দিকে শক্ত করে বাঁধা কাছির বাঁধন খুলে দেয়। তুলে রাখে নোঙ্গরটা পানসির উপরে। নোঙ্গর তুলে তিনজন এক সুরে বলে---' হেঁই জোয়ানি হেঁইও, মারো ঠেলা হেঁইও।' এই বোল ধরে ভানুমতীকে ঠেলা মারে। এক রকম জোর জবরদস্তি করে শুকনো চড়ায় ঠেলে ঠেলে ভানুমতীকে তারা নামিয়ে দিল মোহনার জলে। খানিকটা যেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
ইত্যবসরে বাতাসের গতিবেগ ও ঝড়ের দাপট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করল। শুরু হল মুষলধারে আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি। দিনের আলোয় যেন অমাবস্যার ঘনান্ধকার নেমে এলো চতুর্দিকে। বিকাল, সন্ধ্যা ও রাত্রি মিলেমিশে একাকার। বারংবার আকাশে বিদ্যুতের চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি। মুহুর্মুহু বজ্রপাতের তীব্র আওয়াজ পরিবেশকে আরো ভয়ংকর ও বিপজ্জনক করে তুলল। কিন্তু সবকিছুকে উপেক্ষা করে সুবাসরা ভানুমতীর সাহায্যে ওপারে যাবার প্রস্তুতি নিল। মাভৈঃ বলে তিনজনে এক সুরে ভানুমতীকে নিয়ে বাঁধা সেই গানটা ধরল....
চল্ ভানুমতী চল্....
মোহনা পেরিয়ে নিয়ে যাবি
তুই যে মোদের ভরসা ও বল
চল ভানুমতী চল্....
তারপর---তারপর কী হলো ! কী ঘটলো ! কীভাবে ঘটলো ! কেউ দেখেনি, কেউ জানে না ! হয়তো একমাত্র অন্তর্যামীই জানেন।
আস্তে আস্তে রাত বাড়ে। সময়ের ঘড়িও টিক্ টিক্ করে ঠিক এগিয়ে চলে। রাত ন'টা। আকাশবাণী কলকাতা বেতারকেন্দ্র ঘোষণা করল...." ঘূর্ণিঝড় সাগরদ্বীপ ও তৎসংলগ্ন সুন্দরবন অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রচন্ড ধ্বংসলীলা চালিয়ে চলে গেছে বাংলাদেশের দিকে।"
ততক্ষণে বাতাস দিক পরিবর্তন করেছে। গতিবেগও কিছুটা কমেছে। কিন্তু বৃষ্টির দাপট একটুও কমেনি। বরং ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। রাত কত গভীর হলো! কিন্তু তখনও অজয়, বিজয় ও সুবাস ঘরে ফেরেনি। বাইরে গাঢ় ঘন অন্ধকার। চারিদিকে অথৈ জল। সমানে ভারী বৃষ্টির দাপট। যে কারণে বাইরে বেরিয়ে ভয়ংকর দুর্যোগের রাতে সুবাসদের খোঁজখবর নেওয়া কোন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হলো না। তাই সকালের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কী !
অজয় বিজয়দের পরিবারের লোকজনদের উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কায় আর অরন্ধনে ও নিরশনে বিনিদ্র রজনী কাটে। জনম দুখিনী অভাগিনী অহল্যা নির্জন ঘরে একাকিনী। লণ্ঠনের মিনমিনে আবছা আলোয় নির্বাক। চুপচাপ।ঠায় বসে এক জায়গায়। কেবল প্রহর গুনতে থাকে সুবাসের ঘরে ফেরার প্রতীক্ষায়। সুবাস যে বলে গেছে জাল-সেট তুলে নিয়ে নিরাপদে ফিরে আসবে তার কাছে। তার ভালোবাসার পাতিব্রত্যের জোরে তার সিঁথির সিঁদুরের মান রাখতে ঠিক তার কাছে ফিরে আসবে আবার। বারবার সেই কথাগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একাকিনী ভাবতে থাকে মনমরা শোকাতুরা সাথীহারা অহল্যা।
সুখের রাত বেশ তাড়াতাড়ি ছোটে। তাই বড় ছোট। দুঃখের রাত বোধ হয় দীর্ঘই হয় ! তবুও এক সময় ঝড় বৃষ্টি থেমে গিয়ে ভোরের আলো ফোটে। প্রভাত আসে। সকাল হয়। আকাশের বিদ্যুতের ঝলকানির মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তিন বন্ধুর নিরুদ্দেশের খবর। ছোট্ট গ্রামে পরস্পর কানাকানি করে জানাজানি হতে বেশি সময় লাগে না। তাই মুহূর্তে নদী চত্ত্বর পরিণত হলো জনসমুদ্রে।
খোঁজ....খোঁজ....খোঁজ....!
নদীর ধারের আশপাশ চারদিকে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। বেলা বাড়ল। তল্লাশি চালানো হল মোহনা থেকে মাঝ দরিয়া পর্যন্ত। না-না, কোন হদিশ নেই। হদিশ নেই অজয় বিজয় ও সুবাসের। হদিশ নেই পানসি ভানুমতীরও। না, ভানুমতীও তার নামের প্রতি সুবিচার করে কোনো অলৌকিক জাদুবলে ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারেনি তিন বন্ধুকে। কোন হদিশও পাওয়া গেল না অভিশপ্ত বারান্দা জালেরও।
পরের দিন বড় বড় ট্রলারের সাহায্যে অনেক লোকজন নিয়ে আরো এক প্রস্থ খোঁজখবর শুরু হল। প্রায় সারাটা দিন চলে গেল। দিনের শেষে গোধূলিবেলায় 'বুলচেরি'- দ্বীপের নির্জন সজল বালুকাবেলায় সন্ধ্যারাগে অলক্ত অজয় ও বিজয়ের মৃতদেহ অর্ধনগ্ন অবস্থায় পাওয়া গেল পাশাপাশি। দু'জনের পরণে শর্ট প্যান্ট ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তবে অজয়ের মুষ্টিবদ্ধ দু'হাতে ছোট্ট দাঁড়খানা তখনো শক্ত করে ধরা। বিজয় ডানহাতে ধরে আছে বাঁশের অর্ধভগ্ন লগিটা। জীবনযুদ্ধে শেষ লড়াইয়ের ঝান্ডাবিহীন ডান্ডারই যেন প্রতীক।
প্রকৃতির ভয়াল রুদ্ররোষের সঙ্গে অসম যুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যে তারা 'মরার আগে মরবো না ভাই, মরবো না'-- এই সংকল্প নিয়ে লড়াই করেছে, তাদের নীরব নিথর নিশ্চল পড়ে থাকা ক্ষতবিক্ষত মরদেহ যেন সে কথারই প্রমাণ দিচ্ছে। দুর্ভাগ্য তাদের জীবনের শেষ লড়াইয়ে প্রাণপণ লড়াই করেও অজয় যেমন অজেয় থাকতে পারেনি, তেমনি বিজয়ও হতে পারেনি বিজয়ী। আর সুবাস, সে তো একেবারেই নিরুদ্দেশ !
সেদিনের অনুসন্ধানকারী দলে দু'চারজন বাড়ির লোক বা আত্মীয়-স্বজন থাকলেও বেশিরভাগ লোকজন ছিল অনাত্মীয় গ্রামবাসী ও প্রতিবেশী। তবুও গভীরভাবে সকলে শোকবিহ্বল। চোখের জল ফেলতে ফেলতে অতি যত্ন সহকারে অজয় ও বিজয়ের মরদেহ গ্রামে নিয়ে ফিরল অনুসন্ধানকারী দল। আত্মীয় অনাত্মীয় নির্বিশেষে সবাই চোখের জলে ভেসে, শ্মশানে এসে তাদের শেষ বিদায় জানাল। অমন করে দৃপ্ত যৌবনের দূত ও প্রতীক অকালে হারিয়ে গেল তরতাজা তিনটি প্রাণ। স্বজন হারানো শোকসন্তপ্ত তিনটি পরিবারের সাথে সারাটা গ্রাম আজও শোকে মূহ্যমান।
নিরুদ্দেশের খাতায় নাম লেখানো সুবাসের পতিব্রতা স্ত্রী অহল্যা প্রতি হারানোর শোক ও নির্বাক অবক্ত যন্ত্রণায় ধীরে ধীরে যেন পাষাণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজও প্রতি বিকালে অহল্যা তৃষিত চাতকের মত শবরীর প্রতীক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করে নদীর ধারে। সজলনয়নে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাগর বেলার দিকে। তার পানসি বেয়ে সুবাস আবারও ঘরে ফিরে আসবে, এই আশায়।
গ্রামের লোকজন ও পাড়াপড়শি প্রায় বলাবলি করে নিশ্চয়ই সুবাস আর বেঁচে
নেই। বেঁচে থাকলে এতদিনে ফিরে আসত। চিরদুখিনী, নিঃসঙ্গিনী পাষাণী অহল্যা তাদের কথায় কান দিলেও কিন্তু বিশ্বাস করে না। তার স্থির বিশ্বাস তার সোহাগী অলিকে ছেড়ে সুবাস বেশি দিন দূরে থাকতে পারে না। একদিন না একদিন ঠিক ফিরে আসবে তার কাছে। এই আশা নিয়ে এখনো বেঁচে আছে অহল্যা।
দুরন্ত ঘূর্ণিঝড়ের এই নির্মম মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরেও বাঁচার লড়াইয়ের কঠিন সংগ্রামে লড়তে গিয়ে এবং গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে নিরুদ্দেশের খাতায় নাম লিখিয়েছে এই গ্রামেরই জয়, সঞ্জয়, হৃদয়, সতীশ, খগেন, বিকাশ, পূর্ণ এবং আরো অনেকে। অতলান্ত অকূল পাথারের নীল লবণ নীরে, এমনি করে স্বপন, পঞ্চানন ও নিরঞ্জনদেরও অকাল বিসর্জন ঘটে গেছে সেই কতকাল আগে ! জানিনা তাদের আপনজনদের মনে আজও কী বিরহ চলছে। অহল্যার মত তাদের বুকেও কি শোকের পাষাণ জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে আছে ?
ক্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্রের পাদস্পর্শে গৌতমমুনি-পত্নী অভিশপ্ত অহল্যার পাষাণ উদ্ধার হয়েছিল। পতিবিরহিনী, শোকবিহ্বলা এ অহল্যাদের বুকের পাষাণ কোন কালে, কোন রামচন্দ্র এসে সরাবে ? কে নেভাবে সন্তান শোকাতুরা জননীর বুকে রাবণের অনির্বাণ চিতার অনল ? পুত্রহারা বধির শোকবিহ্বল বৃদ্ধ পিতার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে সান্ত্বনার সুরে কে শোনাবে শান্তির ললিত বাণী !!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন