"হাই দ্যাখো গ’ তুই ইখানে কেনে, লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা
রাঙা মাটির দ্যাশে যা
হেথাকে তুকে মানাইছে নাই গ’, ইক্কেবারেই মানাইছে নাই গ’
অ-তুই লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা… "
সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে বাঁকুড়া জেলার কিছু অংশ নিয়ে আলাদা করে বিষ্ণুপুর জেলা গঠিত হবে। বাঁকুড়াবাসী হিসাবে মনে একটু দুঃখ হচ্ছে বইকি! বাঁকুড়ার কথা বললেই বিষ্ণুপুরের ছবি মনের মধ্যে স্পষ্ট ভেসে ওঠে। উভয়ে একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত ছিল। "যা হয়েছে তা ভালই হয়েছে ,যা হচ্ছে তা ভালই হচ্ছে, যা হবে তাও ভালই হবে।"- এই মতামতে ভরসা রেখে এগিয়ে চলি! যদিও রাঙামাটির দেশ বললেই এই দুই জেলাকে অবিচ্ছেদ্যভাবেই বোঝানো হয়। আমার এই লেখায় বিষ্ণুপুরকে বাঁকুড়া জেলার মধ্যে রেখেই লিখছি। যেহেতু এখন ঘোষণা হয়েছে সরকারি ভাবে বাস্তবে রূপায়ন হয় নি।
ইতিহাস
প্রাচীন কালে বাঁকুড়া জেলা সুহ্মভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল। মহাভারতে আছে, ভীম সুহ্মভূমির রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। মহাভারত-এর টীকা রচয়িতা নীলকণ্ঠ সুহ্মভূমিকের "রাঢ়া" (রাঢ়) নামে চিহ্নিত করেছেন। জৈন ধর্মগ্রন্থ আচারাঙ্গ সূত্রে রাঢ় অঞ্চলকে বলা হয়েছে "লাঢ়"। ঐতিহাসিকদের মতে, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে "সুহ্ম" শব্দটি থেকেই প্রথমে "লাঢ়" ও পরে "রাঢ়" শব্দটির উৎপত্তি হয়। বাঁকুড়া সদর মহকুমার শুশুনিয়া পাহাড়ে একটি সংস্কৃত শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে। এটি খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে রাজা চন্দ্রবর্মণ খোদাই করিয়েছিলেন। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে রঘুনাথ মল্ল, মল্ল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় থেকে বাঁকুড়া জেলা "মল্লভূম" নামে পরিচিত হয়। এরপরই বাঁকুড়া অঞ্চলের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ দ্রুত ঘটতে থাকে। বিষ্ণুপুর মহকুমার সদর শহর বিষ্ণুপুরে (সেই সময় "বন-বিষ্ণুপুর" নামে পরিচিত ছিল) মল্লভূম রাজ্যের রাজধানী স্থাপিত হয়। মল্ল রাজবংশ প্রায় ১০০০ বছর এই অঞ্চল শাসন করেছিল এবং প্রজাহিতৈষী রাজবংশ হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিল। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের পর বিষ্ণুপুর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। পরে মরাঠা আক্রমণ ও ১৭৭০ সালের মন্বন্তরে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক কাঠামো সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়, যা পরে ধীরে ধীরে পুনরায় উদ্ধার করা হয়।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ :
বাঁকুড়া জেলার প্রাচীনতম মানব বসতির নিদর্শনটি হল ডিহর, যা সত্তরের দশকে, মাণিকলাল সিংহ কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই সভ্যতা, প্রায় ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ ক্যালকোলিথিক মানবগোষ্ঠী দ্বারকেশ্বর নদের উত্তর তীরে বসতি স্থাপন করেছিল।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের শেষভাবে বিভিন্ন প্রোটো-অস্ট্রালয়েড ও কয়েকটি প্রোটো-দ্রাবিড় উপজাতি এখানে বসতি স্থাপন করে। এই সব উপজাতি খাদ্যসংগ্রহ, শিকার, পশুপালন ও চাষবাস করত। প্রাচীন কালে বাঁকুড়া জেলা ছিল রাঢ় অঞ্চলের অন্তর্গত। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই অঞ্চলে আদিবাসী জনজাতির সংখ্যা অধিক ছিল। প্রোটো-ইন্দো-আর্য গোষ্ঠীর মানুষেরা এই অঞ্চলের আর্যীকরণ করে। এই জাতির মানুষেরা উত্তর ভারত থেকে বাংলায় এসেছিল। এখানে দুটি প্রধান জাতিগোষ্ঠী ছিল - নিষাদ (প্রোটো-অস্ট্রালয়েড উপজাতি) ও দাস-দস্যু (দ্রাবিড় জাতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত)। উপগোষ্ঠীগুলির অন্তর্গত ছিল বাগদি, বাউড়ি, জেলে, হাড়ি, ডোম ও অন্যান্যরা। সাঁওতাল ও মাল পাহাড়িয়ারা সম্ভবত প্রথম থেকেই এই অঞ্চলের বাসিন্দা। খাদ্য, পোষাকপরিচ্ছদ, ধর্ম, আচরণ ও অন্যান্য বিষয়ে বিভিন্ন উপজাতিগুলির মধ্যে পার্থক্য ছিল এবং এদের পরস্পরের মধ্যে মেলামেশা ছিল না, স্বজাতির বাইরে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন তো দূরের কথা।
আর্যীকরণ
প্রোটো-ইন্দো-আর্যরা এখানে এলে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের আর্যীকরণ শুরু হয়। প্রথম দিকে গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুযায়ী এই আর্যীকরণ শুরু হয়। এর ফলে এই অঞ্চলে বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠার পিছনে এই অঞ্চলের পুরনো সমাজব্যবস্থারও কিছু অবদান ছিল। তবে এই আর্যীকরণ সহজে হয়নি। কয়েক শতাব্দী ধরে সংঘর্ষ ও সহযোগিতা উভয় পরিবেশেই ধীরে ধীরে আর্যীকরণের কাজ সম্পাদিত হয়েছে।
ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী) এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অসুর নামে অভিহিত করা হয়েছে। আজও এই জেলার বহু গ্রামের নাম অসুর-দের নামের সঙ্গে যুক্ত। বৌধায়ন ধর্মসূত্র গ্রন্থে (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দী) বলা হয়েছে, অঙ্গ ও মধ্যদেশে আংশিক আর্যীকরণ সম্পন্ন হলেও, পুণ্ড্র, বঙ্গ ও কলিঙ্গ কেবল উত্তর ভারতের আর্য জাতির সংস্পর্শেই এসেছে।প্রাকৃত ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা শুশুনিয়া লেখ থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে রাজা চন্দ্রবর্মণের পুত্র সিংহবর্মণ পুষ্করণের (অধুনা পোখরনা) রাজা ছিলেন। প্রায় সমগ্র রাঢ় (দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা) তার শাসনাধীনে ছিল। এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে জানা যায়, সমুদ্রগুপ্ত চন্দ্রবর্মণকে পরাজিত করে এই অঞ্চলটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত করেছিলেন। বহু বছর এই অঞ্চল বর্ধমানভুক্তি ও দণ্ডভুক্তির অধীনস্থ ছিল।
আচারাঙ্গ সূত্র নামক প্রাচীন জৈন গ্রন্থে (আনুমানিক খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী) সুহ্ম ও লাঢ়া (রাঢ়?) অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে। উক্ত গ্রন্থে এই অঞ্চলদুটিকে বর্বর জাতি অধ্যুষিত বলা হয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, বাংলায় আর্যীকরণের কাজ প্রথমে উত্তর ও পূর্ব বাংলায় হয়, এবং তার পরে হয় পশ্চিম বাংলায়। এই সময়েই বাংলায় জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ করে। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে বাংলায় আর্য ধর্মের প্রসারের একাধিক নিদর্শন পাওয়া গেছে।
বিষ্ণুপুর রাজ্য
খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্ন পর্যন্ত প্রায় এক সহস্রাব্দ কাল বাঁকুড়া জেলার ইতিহাস বিষ্ণুপুরের হিন্দু মল্ল রাজবংশের উত্থান ও পতনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, "বিষ্ণুপুরের প্রাচীন রাজবংশের সূচনা সেই সময় ঘটে যখন দিল্লিতে হিন্দু রাজবংশ শাসন করত। সেই সময় ভারতের কেউ মুসলমান সম্প্রদায়ের নাম শোনেনি। বখতিয়ার খিলজি হিন্দু রাজাদের হাত থেকে বাংলার শাসন অধিকার করে নেওয়ার আগে পাঁচ শতাব্দীকাল এই রাজবংশ বিষ্ণুপুর শাসন করেছিল। যদিও, বাংলায় মুসলমান বিজয় বিষ্ণুপুর রাজাদের শাসনের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনেনি... বাংলার উর্বর অংশের মুসলমান শাসকেরা এই অরণ্যরাজ্য সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন না। তারা এই অঞ্চলে কখনও আসেওনি। এই কারণে, শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল বিষ্ণুপুরের রাজারা নির্বিঘ্নে শাসনকাজ চালিয়ে যান। পরবর্তীকালে অবশ্য মুঘল রাজশক্তি এই অঞ্চল পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। মাঝে মাঝে মুঘল বাহিনী বিষ্ণুপুরের নিকটে এসে রাজস্ব দাবি করত এবং সম্ভবত বিষ্ণুপুরের রাজারা রাজস্ব দিয়েও দিতেন। মুর্শিদাবাদের সুবাদারেরা পরবর্তীকালের বীরভূম ও বর্ধমানের রাজাদের মতো বিষ্ণুপুরের রাজাদেরও নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্পূর্ণ সক্ষম হননি। বর্ধমান রাজাদের শক্তিবৃদ্ধি হওয়ার পর বিষ্ণুপুর রাজবংশের অবক্ষয় শুরু হয়। মহারাজা কীর্তিচাঁদ বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে এই অঞ্চলের একটি বিস্তৃর্ণ অঞ্চল নিজ জমিদারির অন্তর্ভুক্ত করেন। বর্গী হানার সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুপুর রাজবংশের পতন সম্পূর্ণ হয়। বর্তমানে এইটি দরিদ্র জমিদার পরিবার মাত্র।"
বিষ্ণুপুর রাজাদের উৎস রহস্যাবৃত। বহু শতাব্দীকাল তাদের বাগদি রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও বিষ্ণুপুরের রাজারা এবং তাদের অনুগামীরা দাবি করেন যে তারা উত্তর ভারতের ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভুত। এই অঞ্চলের আর্যীকরণের শেষ পর্যায়ে এই দাবি বিশেষ জোরালো হয়ে ওঠে। বিষ্ণুপুরের রাজারা মল্ল রাজা নামে পরিচিত। সংস্কৃত মল্ল শব্দটির অর্থ মল্লযোদ্ধা। তবে এই শব্দটির সঙ্গে এই অঞ্চলের মাল উপজাতির সম্পর্ক থাকাও সম্ভব। এই উপজাতির সঙ্গে বাগদিদের সম্পর্ক বিদ্যমান।
বিষ্ণুপুর-সংলগ্ন অঞ্চলটিকে অতীতে মল্লভূম বলা হত। মল্লভূম রাজ্যের কেন্দ্রীয় এলাকা ছিল বর্তমান বাঁকুড়া থানা এলাকা (ছাতনা বাদে), ওন্দা, বিষ্ণুপুর, কোতুলপুর ও ইন্দাস। তবে প্রাচীন বিষ্ণুপুর রাজ্যের আয়তন আরও বড়ো ছিল। উত্তরে সাঁওতাল পরগনার দামিন-ই-কোহ থেকে এই রাজ্য দক্ষিণে মেদিনীপুর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। পূর্বে বর্ধমানের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমে ছোটোনাগপুরের একটি অঞ্চলও এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই জেলার কিছু অঞ্চল অতীতে আদিবাসী অধ্যুষিত হলেও পরে তাদের ধীরে ধীরে দমন করা হয়। খাতড়া অঞ্চলটি ধলভূম, রায়পুর অঞ্চলটি তুঙ্গভূম ও ছাতনা অঞ্চলটি সামন্তভূম নামে পরিচিত ছিল। মল্ল রাজারা এই সব অঞ্চলও মল্লভূমের অধিকারে আনেন। প্রাচীন লেখগুলিতে বরাহভূমি বা বরাভূমি নামেও (অধুনা বরাভূম) একটি অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায়। দারিকেশী নদী ও শেখর পর্বত (সম্ভবত অধুনা পরেশনাথ) এই রাজ্যের সীমা ছিল। "
উৎসব
করম উৎসব :
প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্ল একাদশী তিথিতে করম পরব উৎসব হয়ে থাকে। এর সাতদিন আগে মেয়েরা ভোরবেলায় শালের দাঁতন কাঠি ভেঙে নদী বা পুকুরে স্নান করে বাঁশ দিয়ে বোনা ছোট টুপা ও ডালায় বালি দিয়ে ভর্তি করেন। তারপর গ্রামের প্রান্তে একস্থানে ডালাগুলিকে রেখে জাওয়া গান গাইতে গাইতে তিন পাক ঘোরে। এরপর তাতে তেল ও হলুদ দিয়ে মটর, মুগ, বুট, জুনার ও কুত্থির বীজ মাখানো হয়। অবিবাহিত মেয়েরা স্নান করে ভিজে কাপড়ে ছোট শাল পাতার থালায় বীজগুলিকে বুনা দেন ও তাতে সিঁদুর ও কাজলের তিনটি দাগ টানা হয়, যাকে বাগাল জাওয়া বলা হয়। এরপর ডালাতে ও টুপাতে বীজ বোনা হয়। এরপর প্রত্যেকের জাওয়া চিহ্নিত করার জন্য কাশকাঠি পুঁতে দেওয়া হয়। একে জাওয়া পাতা বলা হয়। যে ডালায় একাধিক বীজ পোঁতা হয়, তাকে সাঙ্গী জাওয়া ডালা এবং যে ডালায় একটি বীজ পোঁতা হয়, তাকে একাঙ্গী জাওয়া ডালা বলা হয়। যে সমস্ত কুমারী মেয়েরা এই কাজ করেন, তাদের জাওয়ার মা বলা হয়। রুখা শুখা মাটিতে সবুজ ফসলের আশায় এই উৎসবের আয়োজন হয়। নতুন পোশাক পরে মেয়েরা নাচে-গানে মেতে ওঠেন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিধারায় লালপেড়ে সাদা শাড়ি, মিশকালো চুলের খোঁপায় হলুদ গাঁদা ফুলের আভাস, কিশোরী কোমর দুলে ওঠে, পায়ের চলন সামনে পিছনে হয়, মাদলের একটানা দ্রিমি-দ্রিমি-দ্রাম-দ্রামের প্রতিধ্বনির অনুরণনে গেয়ে ওঠে লুপ্তপ্রায় জাওয়া গান। যে গানে লুকিয়ে আছে নারী সমাজের প্রাত্যহিক জীবনচর্চার বেদনামধুর বর্ণনা।সমস্ত আচার সম্পন্ন হলে নির্দিষ্ট দিনে সকলে মিলে করম গান গাইতে গাইতে করম ডালকে নদীতে বিসর্জন দেন।
ভাদু উৎসব :
পয়লা ভাদ্র কুমারী মেয়েরা গ্রামের কোন বাড়ীর কুলুঙ্গী বা প্রকোষ্ঠ পরিষ্কার করে ভাদু প্রতিষ্ঠা করেন। একটি পাত্রে ফুল রেখে ভাদুর বিমূর্ত রূপ কল্পনা করে তারা সমবেত কন্ঠে ভাদু গীত গেয়ে থাকেন। ভাদ্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে ভাদুর মূর্তি ঘরে নিয়ে আসা হয়। ভাদ্র সংক্রান্তির পূর্ব রাত্রকে ভাদুর জাগরণ পালিত হয়ে থাকে। এই রাত্রে রঙিন কাপড় বা কাগজের ঘর তৈরী করে এই মূর্তি স্থাপন করে তার সামনে মিষ্টান্ন সাজিয়ে রাখা হয়। এরপর রাত নয়টা বা দশটা থেকে ভাদু গীত গাওয়া হয়। কুমারী ও বিবাহিত মহিলারা গ্রামের প্রতিটি মঞ্চে গেলে তাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় ও তারা এই সব মঞ্চে ভাদু গীত পরিবেশন করে থাকেন। ভাদ্র সংক্রান্তির সকালে দলবদ্ধভাবে মহিলারা ভাদু মূর্তির বিসর্জন করা হয়।
রাঢ় বাংলার অন্যতম লৌকিক উৎসব হল ভাদু উৎসব। ভাদু উৎসব নিয়ে বেশ কিছু লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। পঞ্চকোট রাজপরিবারের নীলমণি সিংদেওর তৃতীয়া কন্যা ভদ্রাবতীর বিবাহ স্থির হওয়ার পর তার ভাবী স্বামীর অকালমৃত্যু হলে মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। বিয়ে করতে আসার সময় ভদ্রাবতীর হবু স্বামী ও তার বরযাত্রী ডাকাতদলের হাতে খুন হলে ভদ্রাবতী চিতার আগুনে প্রাণ বিসর্জন করেন। ভদ্রাবতীকে জনমানসে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নীলমণি সিংদেও ভাদু গানের প্রচলন করেন।
টুসু উৎসব :
টুসু গান
১
"পৌষ মাসে পৌষাল্যা, মাঘ মাসে পিঠা,
কেঁন্দুলির চাল করতে গিয়ে মাথা হল চিটা।
ফুল তুলছেন, ডাল ভাঙছেন রাধিকা সুন্দরী,
আরও ফুল তুলো রাধে, আরও ফুল তুলো,
ঐ ফুলেতে আমাদের রাইয়ের সেবা হবে।
এসো রাই, বসো রাই
বসো সিংহাসনে
তোমারই বিয়া দুব অমূলরতনের সঙ্গে।
অমূলরতনের জল টুকু পড়ল সাগরে
সাগর শুখিয়ে গেল
গেল অবহেলে।"
২
"বাঁকুড়াতে দেখে এলাম তিনটি টুসু যায় চলে
হায় রে হাতে নাই রে টাকা নিথাম টুসু দর করে।"
আমি তখন অনেক ছোট্ট। ৫/৬ বছর বয়স হবে। মামাবাড়ি গিয়েছিলাম। শীতকাল ছিল। টুসু ভাসানোর আগের দিন সবাইকে বলা হল,' কাল সবাই তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। টুসু ভাসাতে হবে।' আমার কাছে বিষয়টি নতুন। আমার খুব কৌতুহল হচ্ছিল! সারারাত ভালো করে ঘুম হয় নি। পরদিন খুব ভোরে উঠে গেলাম। আমি সেইবার টুসু ভাসিয়েছিলাম। তারপর পবিত্র মকর জল সবার মাথায় ছিটিয়ে দিয়েছিলাম।
টুসু বিদায়ের গান
"তিরিশ দিন রাখিলাম মাকে
তিরো সলতা দিয়ে গো
আর রাখিতে লাড়লাম মাকে
মকর আইচে লিতেগো।"
মকর উৎসব :
'চক্র দেখে মক্র চান' - মকর সংক্রান্তি প্রত্যেকটি হিন্দু ধর্মের মানুষের কাছে অত্যন্ত শুভ দিন বলে মানা হয়। এই দিন অন্যসব স্থানের মতোই আমাদের রাঢ় অঞ্চলের মানুষ ঘটা করে পালন করে। ‘পৌষ‘ এর শেষ দিনটিকে মকর সংক্রান্তি বলা হয়। আমরা বলি 'মকর পরব'। আদিবাসী সম্প্রায়ের মানুষরা এই দিন মাংস, ভাত খায়। বনমোরগের লড়াই খেলার সাথে তাদের উৎসবের দিনগুলি উপভোগ করে। ‘হাঁড়িয়া’ নামে একটি বাড়িতে তৈরি পানীয় এবং ধামসা মাদলের তালে তালে নাচ তাদের উৎসবকে অতিরিক্ত আকর্ষণীয় করে তোলে।
এখান পূজা :
মকর উৎসবের পর দিন “এখান পূজা” হয়। এইদিন লক্ষ্মী পূজাও হয়। প্রায় সকলের বাড়িতে এইদিন মাংস হয়।
বাঁন্দনা পরব :
বাঁন্দনা (সাহারাই) নভেম্বর মাসে কার্তিক অমাবস্যার পবিত্র দিবসে পালিত আরেকটি জনপ্রিয় উপজাতীয় উৎসব। গ্রামবাসীরা তাদের পোষা প্রাণীদের খুবই গুরুত্ব দেয়। অধিবাসীরা তাদের পোষ্যদের পূজা করেন। লোকেরা তাদের পোষ্যদের স্নান করান, তাদের ভাল খাওয়ান, অলঙ্কার এবং প্রাকৃতিক রঙ দিয়ে সাজান। অধিবাসীরা তাদের জীবনে পোষ্যগুলির অবদানের স্বীকৃতি জানাতে ‘ওহিরা’ গান করে সাহারাই উৎসব উদযাপন করেন। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষেররা সোনার মতো হলুদ বর্ণের ধানক্ষেতের জন্য ‘মা ভগবতীর’ প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
পলাশ উৎসব :
শাল-পলাশের স্থান বলে খ্যাত বাঁকুড়াতে 'পলাশ উৎসব' আনন্দের সাথে উৎযাপিত হয়। পলাশ উৎসব রঙের উৎসব। বসন্তের আগমন যে হয়েছে তা নতুন গজানো কচি পাতা আর ফুল জানান দিয়ে যায়। মুকুটমণিপুর খুবই গর্বের সাথে বসন্তে পলাশ উৎসব বা হোলি উদযাপন করে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বাতাসে ‘আবির’ ছিটিয়ে দেওয়া, পলাশের জ্বলন্ত লাল বর্ণ, নীল জলছবি, উজ্জ্বল পোশাক এবং ফুলের অলঙ্কার পরে থাকে।
সকলে “বনপাহাড়ির রানী”-এর কোলে ‘হোলি’ এবং ‘পলাশ উৎসব’ একবার হলেও উদযাপন করে যাবেন।
মেলা
বিষ্ণুপুর মেলা
বিষ্ণুপুরের ভগবান মদনমোহনের মন্দিরের কাছে প্রতি বছর ২৭-৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিষ্ণুপুর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলা অত্যন্ত বিখ্যাত এবং বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। মেলা-প্রাঙ্গণে থাকে দুর্দান্ত পোড়ামাটির নিদর্শন, হস্তশিল্পের সম্ভার, বিভিন্ন ধরণের শিল্পকর্ম এবং ঐতিহ্যবাহী বিষ্ণুপুরী পোশাকের স্টল। বিষ্ণুপুর মেলা এমন এক স্থান যেখানে আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন বিষ্ণুপুরের সমৃদ্ধ সংগীত- সংস্কৃতির আসল মর্ম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলিতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের উৎস্থাপনা অবশ্যই আপনাকে আনন্দ দেবে। মন্দিরের শহরটির নিজস্ব সঙ্গীত ঘরানা রয়েছে যা ‘বিষ্ণুপুর ঘরানা’ নামে পরিচিত।
এক্তেশ্বর গাজন / এক্তেশ্বরের মেলা
এক্তেশ্বরের গাজন ‘চৈত্র মাস’-এর শেষ দিনে পালিত হয়। এক্তেশ্বর, দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে অবস্থিত। এই স্থানটি ‘এক্তেশ্বর’ নামে পরিচিত মহাদেবের মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। লোকেরা এখানে চড়ক পূজা উদযাপন করে খুব আনন্দের সাথে। মেলায় হস্তশিল্পের সামগ্রী, খাবার, মিষ্টির দোকান বসে। বিভিন্ন স্থানীয় সামগ্রী এবং চড়কেরও বিভিন্ন দোকান বসে।
ধারার মেলা
ধারার মেলা শুশুনিয়ার পাদদেশে পালিত হয়। গ্রামবাসীরা ‘নরসিংহ’ প্রতিমার পূজা করে। এখানে ঈশ্বরের ও ধারার পবিত্র জলের নামে একটি মেলা বসে। গ্রামবাসীরা চড়ক পূজা দিয়ে এই মেলা উদযাপন করে। মেলায় স্থানীয় নিদর্শনগুলির বিভিন্ন দোকান (মূলত বালু-পাথর দিয়ে তৈরি), খাবার, মিষ্টি, হস্তশিল্পের ঝিলিক ইত্যাদি দেখা যায়।
নৃত্য
ঝুমুর নৃত্যঃ
ঝুমুর একটি উপজাতীয় নৃত্য। নৃত্যে অংশ নেওয়া মহিলারা একে অপরের কোমর ধরেন। তাদের হাত, পা এবং মাথা একটি তালে তাল মিলিয়ে যথাক্রমে এগিয়ে এবং পিছনে নৃত্যটি পরিবেশন করেন। পুরুষ অংশগ্রহণকারীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেন। নাচের সাথে বাজনা না বাজলে ঠিক জমে না। পুরুষরা বাঁশি, ড্রাম এবং ‘তাল’ বাজিয়ে নৃত্যে সহযোগিতা করেন।
ছৌ নৃত্য
ছৌ নৃত্য এই অঞ্চলের অন্যতম বিখ্যাত নৃত্য শিল্প। স্থানীয় পুরুষ নৃত্যশিল্পীরা বিভিন্ন মুখোশ পড়েন এবং রাতে আখড়া নামে পরিচিত খোলা জায়গায় নাচেন। লোকসংগীত, ঢোল, মাদল, সানাই, ধামসা এবং খড়কা বাদ্যযন্ত্র সহকারে ছৌ নৃত্য পরিবেশিত হয়। রামায়ণ, মহাভারত এবং অন্যান্য স্থানীয় উপাখ্যানের দৃশ্যগুলি এই নৃত্যের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়।
গণ্যমান্য ব্যক্তি
চিত্রশিল্পী যামিনী রায় :
বিখ্যাত চিত্রকর যামিনী রায়ের বাড়ি এই জেলায়।বাঙালি চিত্রশিল্পী যামিনী রায় ১৮৮৭ সালের ১১ই এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামের এক মধ্যবিত্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রামতরণ রায়। মাতার নাম নগেন্দ্রবালা দেবী।১৯০৬ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক রীতিতে পড়াশোনা করেন। আর্ট স্কুলে ইতালীয় শিল্পী গিলার্দি ও পরে অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউনের সংস্পর্শে এসে তিনি প্রাচ্য-প্রতীচ্যের উভয় শিল্পের কলা-কৌশলের সাথে পরিচিত হন। ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক রীতি শিখলেও শেষ পর্যন্ত দেশজ সরল রীতিতে চিত্র নির্মাণ করেন। এছাড়া কিছুদিন তিনি ফার্সি শিল্পীদের মতো চিত্র চর্চা করেন। এইসময় তিনি তার চিত্র চর্চার বেগ আরও বৃদ্ধি করেন। তিনি ১৬ বছর বয়সে কলকাতা আর্ট কলেজে চিত্র চর্চার জন্য ভর্তি হন।বাংলার লোকজ পুতুল, শিশু, গ্রাম বাংলার সরল মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখর চিত্র ইত্যাদি তিনি তার ছবির ‘ফর্ম’ হিসেবে গ্রহণ করেন। "
রামকিঙ্কর বেইজ :
বিখ্যাত চিত্রকর ও ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের বাড়িও এই জেলায়।রামকিঙ্কর বেইজ ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির বাঁকুড়া শহরের যুগীপাড়ায় (অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে) এক পরমানিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পদবী বেইজ, সংস্কৃত বৈদ্য ও প্রাকৃত বেজ্জ-র পরিবর্তির রূপ। তার পিতা ছিলেন চণ্ডীচরণ বেইজ। মধ্যকৈশোরে রামকিঙ্কর অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি আঁকতেন। মেট্রিক ক্লাস (বর্তমানে যা মাধ্যমিকের সমতুল্য) পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর ষোলো বছর বয়সে তিনি বাঁকুড়ার বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের নজরে পড়ে যান। চার বছর পরে তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র হিসেবে যোগ দেন। আচার্য নন্দলাল বসু ছিলেন তার শিক্ষক। রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় প্রমুখকে সহপাঠী হিসাবে পেয়েছিলেন। চারুকলায় ডিপ্লোমা অর্জন করে তিনি বিশ্বভারতীর ভাস্কর্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদে বৃত হন। ১৯৭১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী জহর দাশগুপ্ত শঙ্খ চৌধুরী ছিলেন তার ছাত্র।
রামানন্দ চট্টপাধ্যায় :
বিখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক রামানন্দ চট্টপাধ্যায়ের বাড়ি এই জেলায়। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় অবিভক্ত বাংলার অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার পাঠকপাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম শ্রীনাথ চট্টোপাধ্যায় ও মাতার নাম হরসুন্দরী দেবী। তিনি বাঁকুড়া জেলা স্কুল থেকে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স,সেন্ট জেভিয়ার'স কলেজ, কলকাতা থেকে এফ.এ.এবং সিটি কলেজ থেকে ইংরাজীতে অনার্স সহ বি.এ পাশ করেন। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ.পাশ করেন। প্রতি পরীক্ষাতেই বিশেষ কৃতিত্ব দেখান ও বৃত্তিলাভ করেন। তিনি ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সভাপতি হয়েছিলেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদ কায়স্থ পাঠশালায় যোগ দেন। শেষে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ও পরে অধ্যক্ষ হন।
পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা :
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় নিজে সাহিত্যস্রষ্টা ছিলেন না,কিন্তু সাহিত্যসৃষ্টির পরম সহায়ক ছিলেন। এম.এ পরীক্ষার পরই তিনি ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে 'ধর্মবন্ধু' পত্রিকার সম্পাদনা করেন।১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে মাসিক পত্রিকা 'দাসী' প্রকাশিত হলে তিনি সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই সময়েই নিজস্ব বাংলা ব্রেইল প্রথার উদ্ভাবন করেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর সাহায্যে শিশুদের উপযোগী পত্রিকা মুকুল প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হন। শিবনাথ শাস্ত্রী ওই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে মাসিক 'প্রদীপ' পত্রিকার সম্পাদক হন। এলাহাবাদে বর্তমানে প্রয়াগরাজে কর্মরত থাকার সময় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে (১৩০৮ বৈশাখ,বঙ্গাব্দে) বিখ্যাত ও আধুনিক কালের সর্বাঙ্গসুন্দর মাসিক 'প্রবাসী' পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের রচনাসম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হত। চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের সুন্দর প্রতিলিপিতে বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।
মা সারদা :
মা সারদার পূণ্য জন্মভূমি ' জয়রামবাটি ' এই জেলায় অবস্থিত।
“ওকি গো, মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কি কথা বলতে আছে? কথা সত্য হলেও অপ্রিয় করে বলতে নেই। শেষে ঐরূপ স্বভাব হয়ে যায়। মানুষের চক্ষুলজ্জা ভেঙে গেলে আর মুখে কিছু আটকায় না। ঠাকুর বলতেন, 'একজন খোঁড়াকে যদি জিজ্ঞাসা করতে হয়, তুমি খোঁড়া হ'লে কি করে?--তাহলে বলতে হয়, তোমার পা-টি অমন মোড়া হ'ল কি করে?'” - মা সারদা
১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর (বাংলা ১২৬০ সনের ৮ পৌষ, হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, অগ্রহায়ণ কৃষ্ণা সপ্তমী তিথি।) পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার অন্তর্গত প্রত্যন্ত গ্রাম জয়রামবাটীর এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে সারদা দেবীর জন্ম হয়। তার পিতা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮১০ - ১৮৭৪) ও মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন। সারদা দেবীর পিতৃকূল মুখোপাধ্যায়-বংশ পুরুষানুক্রমে রামের উপাসক ছিলেন।১৮৫৯ সালের মে মাসে, সেকালে প্রচলিত গ্রাম্য প্রথা অনুসারে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়।"
এছাড়াও
চন্দ্রবর্মনের শিলালিপি :
এই জেলার একটি পাহাড়ে রাজা চন্দ্রবর্মার শিলালিপি আছে। এভাবেই অযত্নে পড়ে আছে রাজা চন্দ্রবর্মনের শিলালিপি। খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে এই জনপদের গড়ে ওঠার পিছনে রাজপুতানার পুষ্করণা রাজ্যের দিগ্বিজয়ী চন্দ্রবর্মার ভূমিকা ছিল। তিনি তাঁর বঙ্গবিজয়ের স্মারকরূপে এখানে আর একটি পুষ্করণা নগরী তৈরি করেছিলেন। চন্দ্রবর্মার খোঁজ মেলে শুশুনিয়া পাহাড়ের উত্তর ঢালে পাথরের গায়ে খোদিত এক লিপিমালাতেও। লিপিটি খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে খোদিত। সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিসেন রচিত ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’-তে চন্দ্রবর্মার উল্লেখ দেখে ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন, সমুদ্রগুপ্ত যে ন’জন রাজাকে পরাস্ত করে তাঁদের রাজ্য অধিকার করেছিলেন, চন্দ্রবর্মা তাঁদের এক জন। চন্দ্রবর্মার রাজত্বকালের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌর থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত একটি শিলালিপিতে। প্রাচীন মালবদেশের দশপুর-মন্দসৌর লিপিসূত্র অনুসারে, জয়বর্মার পুত্র সিংহবর্মা। সিংহবর্মার দুই পুত্র—বড়, চন্দ্রবর্মা ও ছোট, নরবর্মা। শুশুনিয়ায় উদ্ধার করা চন্দ্রবর্মা খোদিত লিপিতে বিষ্ণুচক্র-র একটু নীচে বাঁ দিকে শঙ্খ আকৃতির মতো আরও একটি লিপি রয়েছে। তন্ত্রশাস্ত্রে দেবদেবীর পুজোয় শঙ্খমুদ্রার ব্যবহার দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করেন, ওই লিপি তান্ত্রিক-শঙ্খলিপি। এখনও পাঠোদ্ধার হয়নি। অনুমান, চন্দ্রবর্মার আগে শুশুনিয়া পাহাড়ে বৌদ্ধ শ্রমণেরা থাকতেন। মহাযান বৌদ্ধমতের সঙ্গে তান্ত্রিক যোগ ছিল। তাই শঙ্খমুদ্রার আকারে লিখিত এই লিপিটি বৌদ্ধ শ্রমণদের সাধন-সঙ্কেতও হতে পারে।
মল্লরাজাদের নিদর্শন :
এই জেলায় মল্লরাজাদের অনেক নিদর্শন পাওয়া যায়। বিশেষ করে মল্লরাজাদের তৈরি সব থেকে বড় পাথরের মন্দির গোকুলনগরের গোকুলচাঁদ মন্দির এখনও অতীত গৌরবের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।যদিও বলা হয় রাজা কংসনারায়ণ বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজার প্রচলন করেন, কিন্তু কিছু ঐতিহাসিকের মতে বাংলায় সবার আগে মাটির মুর্তিতে দুর্গাপূজা হয়েছে বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরে । তখন প্রদ্যুম্ননগরে ছিল মল্পভূমের রাজধানী । রাজবংশের কুলদেবী ছিলেন দেবী রাজরাজেশ্বরী। রাজা জগৎমল্ল ছিলেন এই বংশের ১৯তম রাজা, রাজত্বকাল ৯৯৪ থেকে ১০০৭ অব্দ। লোকশ্রুতি, একদিন রাজা একান্তে থাকার সময়ে গাছের উপরে একটি সারসের দিকে চোখ যায়। সারসটি বারবার তার একটি পোষ্য কুকুরকে আক্রমণ করছিল। তিনি এর পিছনে অলৌকিক কিছু আছে ভেবে তাকাতেই দেখেন মৃন্মরী রূপে দেবী এসে তাঁকে রাজধানী বিষ্ণুপুরে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। সেই নির্দেশ মেনে তিনি জঙ্গল সাফ করে প্রদ্যুম্ননগর থেকে রাজধানী বিষ্ণুপুরে সরিয়ে আনেন এবং মৃন্ময়ী দেবীর মূর্তি পূজা শুরু করেন। এই বাড়িতেই একচালা মূর্তিতে লক্ষ্মী-গণেশ ও কার্তিক- সরস্বতীর স্থানবদল হয়। লক্ষ্মীর স্থলে গণেশ ও গণেশের স্থলে লক্ষ্মী এবং কার্তিকের স্থলে সরস্বতী ও সরস্বতীর স্থলে কার্তিক আসে ।এই বদল ঘটে মল্প রানির নির্দেশে । পরিবারে নারীদের সর্বোচ্চ স্থান দেওয়ার উদ্দেশ্যে রানি এই নির্দেশ দেন। তাঁর কথাতেই একচালায় লক্ষ্মী ও সরস্বতী উপরে, আর তাঁদের পায়ের কাছে কার্তিক ও গণেশ। মূর্তি নির্মাণের এই রীতিকে বলা হয় বিষ্ণুপুরী ঘরানা বা জগৎমল্ল প্রথা। সারা বাঙলার হাজার হাজার দুর্গামূর্তি এই প্রথা মেনে তৈরি হলেও অনেকেই এর মূল কারণ সম্পর্কে অন্ধকারে । যদিও, সেই মন্দিরের পুজাপদ্ধতি ও মূর্তিভাবনাই আজও বহন করছে বাঙলার সংস্কৃতি।
মদনমোহন মন্দির :
মল্লরাজা দুর্জন সিংহ দেব এই একরত্ন ইষ্টক নির্মিত মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন ১৬৯৪ সালে। এই মন্দিরটির ছাদ চৌকো ও বাঁকানো, কিনারা বাঁকযুক্ত ও মধ্যে গম্বুজাকৃতি শীর্ষ বর্তমান। মন্দিরের দেওয়ালে কৃষ্ণলীলা, দশাবতার ও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনীর বিভিন্ন দৃশ্য ভাস্কর্যের মাধ্যমে রূপায়িত। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১২.২ মিটার এবং উচ্চতা ১০.৭ মিটার।বিষ্ণুপুরের ৫৬ তম রাজা চৈতন্যদেবের আমলে ব্রিটিশের চক্রান্তে বিশাল রাজস্ব দেনায় রাজা অষ্টধাতুর মদনমোহন বিগ্রহ বন্ধক রাখেন। এইভাবেই মদনমোহন বিগ্রহ হাতছাড়া হয়। বর্তমানে বাগবাজার মদনমোহন মন্দিরে এই মূর্তি অধিষ্ঠান রত।
জোড় বাংলা মন্দির (বিষ্ণুপুর) :
জোড়-বাংলা রীতির মন্দির স্থাপত্য এপার বাংলা ও ওপার বাংলায় বেশ কিছু থাকলেও বিষ্ণুপুরের জোড়বাংলা আপন স্থাপত্য রীতির বৈশিষ্ঠে সমুজ্জ্বল। জোড়বাংলা ম্পন্দিরে যে ‘বাংলার ঘরের চাল’এর আদল তা সমগ্র বঙ্গে প্রচলিত । জোড়বাংলা মন্দিরে প্রাপ্ত লিপি অনুসারীই মন্দিরটি ৯৬১ মল্লাব্দে(১৬৫৫ খ্রীস্টাব্দ) মল্ল রাজ রঘুনাথ সিংহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।দু’খানি দুচালা ‘বাংলার কুটির ঘর পাশাপাশি জুড়ে দিলে যা হয় তাই জোড়বাংলা।’বাংলার মন্দির নির্মানের অপূর্ব নিদর্শন এই ‘জোড়বাংলা’। মাটি ইট দিয়ে এর দেওয়াল তৈরী হয়েছে। ভিতরে ও বাইরে মাটির দেওয়ালের উপ ভার্স্কয্য খচিত চিত্র দিয়ে সুসজ্জিত।জোড়বাংলা মন্দিরের গঠন শৈলী বর্ণনা করে “Archaeological survey of India” রায় দিয়েছে যে এই মন্দির টি “কেষ্টরায়”মন্দির নামেও পরিচিত। দক্ষিণ মুখী মন্দির টি বর্গাকার ভিতের উপর গড়ে উঠেছে।দুটি ‘দো-চালা’ যুক্ত হয়ে চারচালা শিখরের রূপ নিয়েছে। জোড়-বাংলা মন্দির টি বহিঃ ও অভ্যন্তর দেওয়ালের সূক্ষ্য এবং অলংকৃত টেরাকোটার কাজ লক্ষ করা যায়।এই মকন্দির টির ভেতরের দৈর্ঘ ১১.৮ মিটার,প্রস্থ ১১.৭ মিটার এবং গঠনগত উচ্চতা ১০.৭ মিটার।
দলমর্দ্দন কামান :
বীর হাম্বিরের শাসনামলে দলমর্দ্দন অপভ্রংশ ( দলমাদল) কামান ( যা সবচেয়ে বড় কামানগুলির মধ্যে একটি) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই কামানটি সেই সময়কার কারিগরদের দক্ষতা প্রদর্শন করে। দল মাদল জগন্নাথ কর্ম্মকার দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। "দলমর্দ্দন" মানে "শত্রুদলের ধ্বংসকারী "। বিষ্ণুপুরের সুবিখ্যাত দলমর্দ্দন কামানটির দৈর্ঘ ১২ ফুট ৫ ইঞ্চি ও পরিধি ১১ ইঞ্চি। গঠনে বিজাপুরের স্বপ্রসিদ্ধ কামান “ মালিক-ই-ময়দান ” -এর অনুরূপ। এই কামানটি এমন লোহা দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে যে আজ পর্যন্ত এর কোথাও একটুও মরচে ধরে নি। বর্তমানে এই কামানটির রক্ষণাবেক্ষণ সরকার করে। কমানটির গায়ে ফার্সিতে একটি লিপি খোদিত আছে, তা থেকে জানা যায় যে এই কামানটি প্রস্তুত করতে একলক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা লেগেছিল। প্রবাদ যে মারাঠা সর্দ্দার ভাস্কর পণ্ডিত ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে বিষ্ণুপুর আক্রমণ করলে রাজধানী রক্ষা করবার জন্য স্বয়ং ঠাকুর মদনমোহনদেব জীউ দলমাদল কামান দেগে শত্রু সৈন্যকে দূর করেছিলেন।
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত :
বিষ্ণুপুর ঘরানার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সেরা। বিষ্ণুপুর ঘরানা হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের হিন্দুস্তানি ধারার ধ্রুপদ সংগীতের একটি ঘরানা। ১৮শ শতাব্দীতে এই ঘরানা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে মল্ল রাজদরবারে বিষ্ণুপুর ঘরানার সূত্রপাত ঘটেছিল। বিষ্ণুপুর ঘরানা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একমাত্র ঘরানা যেটির কেন্দ্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য।বিষ্ণুপুর ঘরানার সংগীতে গায়ক আলাপের মাধ্যমে রাগের সৌন্দর্য মেলে ধরেন।
বিষ্ণুপুর ঘরানার বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞরা হলেন: উস্তাদ বাহাদুর খান, পণ্ডিত গদাধর চক্রবর্তী (কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত), পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য, পণ্ডিত যদুভট্ট, পণ্ডিত অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, মান্না দে, পণ্ডিত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, সংগীতাচার্য রাজেন্দ্রনাথ কর্মকার, পণ্ডিত গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী প্রমুখ।
মেচা সন্দেশ :
এই শহরের মেচা সন্দেশ বিখ্যাত।মেচার স্রষ্টার নাম জানা যায় না। বেলিয়াতোড়ের মেচা প্রস্তুতকারকদের মতে ম্যাচার ইতিহাস অন্তত দু'শো বছরের প্রাচীন। জনশ্রুতি, বিষ্ণুপুরের মল্লরাজের দেওয়ান রাজার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন বেলিয়াতোড়ের জমিদারি। সেই সময়ে বেলিয়াতোড়ে প্রথম মেচা তৈরী হয়। অপর একটি মত অনুসারে ম্যাচার স্রষ্টা জনৈক মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক গিরিশচন্দ্র মোদক। বর্ষায় বাবা ধর্মদাসের মেলা বসত। সেই মেলায় গুড়ের লাড্ডু বিক্রি করতেন গিরিশচন্দ্র মোদক। কিন্তু আর্দ্র আবহাওয়ায় গুড়ের পাক নষ্ট হয়ে যেত। সেই সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে গিরিশচন্দ্র নতুন একটি মিষ্টি উদ্ভাবান করেন, যা হল মেচা।
ইংরেজ আমলেও বেলিয়াতোড়ের মেচা প্রসিদ্ধ ছিল বলে মনে করা হয়। মেচার আদি কারিগরেরা ছিলেন বর্তমান বেলিয়াতোড় ব্লকের বাসিন্দা। পরবর্তীকালে তারা ছড়িয়ে পড়েন ওন্দা, কোতলপুর এবং অন্যান্য স্থানে।
ডোকরা শিল্প :
আনুমানিক প্রায় চারহাজার বছর আগে ডোকরা শিল্পকলার উৎপত্তি।গবেষকদের মতে "ডোকরা" শব্দের উৎপত্তি ডোকরা-ডামার উপজাতি থেকে, যারা বিভিন্ন রকম হাতের কাজে পটু ছিলেন। মনে করা হয় প্রধানত বহু প্রাচীন এই শিল্পের বিকাশ ভারতে প্রথম ঘটেছিল মধ্যপ্রদেশের বস্তারের জলাকীর্ণ অঞ্চলে।।কথিত আছে ৩০০০ বছর আগে বস্তারের রাজা তাঁর রাণীর জন্য ডোকরার গয়না তৈরি করিয়েছিলেন।আসানসোল থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দুরে রাণীগন্ঞ্জ হয়ে বাঁকুড়া যাওয়ার পথে পড়ে বিকনা গ্রাম, যা বর্তমানে ডোকরা গ্রাম নামে পরিচিত। বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের সিল্ক, টেরাকোটা ও মন্দিরের সাথে সাথে বিকনার ডোকরা শিল্পের খ্যাতিও আজ জগৎজোড়া।ডোকরা শিল্পধারা হল একরকমের মোমছাঁচলোপী ধাতু-ঢালাই ( Lost-Wax Casting) পদ্ধতি যা এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয়ে আসছে। তবে সাবেকি ধাতু ঢালাই পদ্ধতির থেকে ডোকরা পদ্ধতি অনেকটাই আলাদা। সাধারণত পাঁচ থেকে সাতটি ধাপে একেকটা ডোকরার শিল্পকর্ম শিল্পীর হাতে পরিপূর্ণ রূপ পায়।
পোড়ামাটি শিল্প বা টেরাকোটাঃ
টেরাকোটা একটি লাতিন শব্দ। “ টেরা” অর্থ “মাটি’ আর “কোটা” অর্থ “পোড়ানো”। অর্থাৎ “টেরাকোটা” শব্দটির অর্থ হল “পোড়ামাটি”। তাই টেরাকোটা শিল্প বলতে বোঝায় “পোড়ামাটির শিল্পকর্ম”।আগুন এবং চাকা আবিষ্কার না হলে মানব সভ্যতার বিবর্তন এত দ্রুত হওয়া সম্ভব ছিল না। চাকা আবিষ্কারই কিন্তু অন্য শিল্পের পথকে প্রসারিত করেছিল। চাকা শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপ্লব ঘটায়নি খাদ্যাভাসের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এনেছিল। পোড়া মাংস, ভাত বা অন্য খাদ্য সামগ্রীর জন্য প্রয়োজন পাত্র। চাকার মাধ্যমেই মাটির পাত্র প্রথম তৈরি করা হয়। তারপর তা পোড়ানো হত। এখান থেকেই জন্ম নিল পোড়ামাটির শিল্প বা টেরাকোটার শিল্পের।টেরাকোটার অলঙ্করণ-শোভিত মন্দিরগুলির মধ্যে বিষ্ণুপুরের “শ্যাম রায়”, ‘রাধাবিনোদ”, “ জোড় বাংলা” ও “মদন মোহনের মন্দির” উৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের জন্য উল্লেখযোগ্য।বাঁকুড়ার সুপ্রাচীন টেরাকোটা শিল্পের ঐতিহ্য বাংলা তথা ভারতের প্রখ্যাত প্রাচীন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। পোড়ামাটির মূর্তি ও মৃৎপাত্রের ভগ্ন অংশ থেকে আমরা প্রাচীন রাঢ় বাঁকুড়ার লোকধর্ম সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারি। বাঁকুড়া শহর থেকে ৩৪ মাইল দূরে তালডাংরা থানার অন্তর্গত পাঁচমুড়া গ্রাম। এখানকার তৈরি ৩০০ শিল্পীদের তৈরী পোড়ামাটির বোঙা হাতি ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম আইকন। এক নজরকাড়া আলঙ্কারিক পোড়ামাটির হাতির পিছনে একটি আকর্ষণীয় ইতিহাস লুকিয়ে আছে।
মল্লভূমের রাজকীয় আস্তাবলগুলি ঘোড়া এবং হাতি দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল, যা কেবল পরিবহণের পদ্ধতি হিসাবেই ব্যবহৃত হত না. বরং শক্তি, প্রভাব এবং মর্ষাদার প্রতীক হিসাবেও ব্যবহৃত হতো। যার হাতি-ঘোড়ার সংখ্যা যত বেশি, তিনি তত বেশি ক্ষমতাশালী শাসক।'বোঙা হাতি’র নেপথ্য কাহিনীটি হলো মল্লভূমের সাঁওতাল সম্প্রদায় যারা পোড়ামাটির শিল্পকে লালন করেছিল এবং তাদের নৈপুণ্যটি সান্থাল দেবতা সিংবোঙাকে উৎসর্গ করেছিল। জনশ্রুতি রয়েছে যে এই সময়কালে, সেখানে চাঁদ রায় নামে একজন জমিদার থাকতেন, যিনি গ্রামবাসীদের কাছে একজন অলৌকিক ডাক্তার হিসাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন।তাঁর উদার সেবার বিনিময়ে, গ্রামবাসীরা তাদের ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসাবে তাকে পোড়ামাটির এই প্রাণীর মূর্তি উপহার দিয়েছিল। বোঙা হাতির অভিনব রূপটি হলো হাতির স্থির মূর্তি, শুঁড় নামানো। পেটে মাথায় এক চ্যাপ্টা গড়ন।আউপৌরে ঘরনায় ফুটিয়ে তোলা হয় অভিনব হাতির অবয়ব। 'বোঙা হাতি' মূর্তির সঙ্গে টোটেম স্মৃতি জড়িয়ে আছে। গ্রামের নির্জন গাছের তলায় অনাদিকাল থেকে পড়ে থাকা পাথরের নুড়ির সাথে অথবা লৌকিক দেবদেবীর মানত পূরণ করার জন্য গড়াম থানে এই 'বোঙা হাতি'কে উৎসর্গ করা হয়।
বালুচরি শাড়ি :
১৭০২ সাল। বাংলার নাজিমের সাথে দ্বন্দ বাঁধিয়ে ভাগীরথীর তীরে মকসুদাবাদে ঢাকা হতে পাত্তারি গুটিয়ে চলে এলেন সম্রাট আরঙ্গজেবের দেওয়ান মুর্শিদকুলি খান। তার নামে জায়গার নাম হয়ে গেল মুর্শিদাবাদ। রাজা মহারাজাদের ব্যাপার। সব কিছুতেই স্বকীয়তা থাকে। তাই রাজপরিবারের পোশাক তৈরির জন্যে ছিল নিজস্ব কারিগর। তাদেরও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন দেওয়ান। তিনি সেই তাঁতী সম্প্রদায়কে থাকবার জন্য গঙ্গার তীরে একটি বালুকাময় গ্রাম দিয়ে দিলেন । বালু থেকে এলাকার নাম হল বালুচর।কারো কারো মতে, এই জায়গাটির নামই জিয়াগঞ্জ। মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলি খান তার বেগমদের পরার জন্য নতুন শাড়ি তৈরির আদেশ দিলেন সেই তাঁতিদের। তাঁতিরা রেশমের সুতোয় যে নতুন শাড়ি বুনল, তারই নাম হল বালুচরী।শাড়ির নকশায় ফুতে উঠতে লাগল নবাবের শৌর্য্য,ঢাল-তরোয়াল-হাতি-ঘোড়া-যোদ্ধা, হুঁকো পান, নানা অঙ্গভঙ্গিতে অন্দরমহলের নারীর দৃশ্য।এই হল বালুচরী শাড়ির সূচনা। বালুচরের এই তাঁতীরাই বংশানুক্রমে বুনতে লাগলেন বালুচরী।
পরবর্তীকালে এক ভয়াবহ বন্যায় গঙ্গার স্রোতে তলিয়ে গেল তাঁদের গ্রাম । মল্লভূমের রাজারা তাঁদের আশ্রয় দিলেন। বিষ্ণুপুরে স্থাপিত হল তাদের নতুন নিবাস। বিষ্ণুপুরের মন্দিরে আছে পোড়া মাটির অপূর্ব সব কারুকাজ। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ সব মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে উৎকীর্ণ । এই সকল কারুকাজ তাঁতিদের আকৃষ্ট করল খুব। ফলে শাড়ির নকশায় আমূল পরিবর্তন শুরু হল। শাড়িতে শোভা পেতে লাগল কৃষ্ণলীলা, রাম লক্ষ্মণ সীতা, অর্জুন-দ্রৌপদী। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে লাগল বালুচরী। বণিকদের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল বালুচরী সিল্ক। তবে একসময় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কালের গহ্বরে হারাতে থাকল এর জৌলুস। বালুচরী ফেরাতে অগ্রণী হলে ঠাকুর পরিবারের উত্তরসূরি সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুর (সুভো ঠাকুর)। কলকাতার হস্তশিল্প দফতরের রিজিওনাল ডিজাইন সেন্টারের অধিকর্তা ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী শুভো ঠাকুর। তিনি বালুচর গ্রামে অনুসন্ধান চালিয়ে বালুচরী শাড়ির একটি আঁচলা উদ্ধার করেন। ওই সেন্টারে তখন নকশা-শিল্পী হিসেবে কাজ করতেন বিষ্ণুপুরের তাঁত শিল্পী অক্ষয় দাস। শুভো ঠাকুরের নির্দেশে ওই আঁচলের নকশা করেন অক্ষয়বাবু। নতুন ভাবে তৈরি হয় বালুচরী শাড়ি। কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুরে ফিরে এলাকার বস্ত্র ব্যবসায়ী ভগবানদাস সারদার আর্থিক সহযোগিতায় ১৯৬৩ সালে অক্ষয়বাবু ফের শুরু করেন বালুচরী শাড়ির পুনর্বয়ন। বিষ্ণুপুরে শুরু হয় বালুচরী শাড়ির পথচলা। একে একে বিষ্ণুপুরের ঘরে ঘরে তাঁতশালে শুরু হয় বালুচরীর বুনন। পরের তিন দশকে এই শহরে ১০০০-র বেশি তাঁতে বালুচরী তৈরির কাজ ছড়িয়ে পড়ে।হাল আমলে প্রবীণ শিল্পী গুরুদাস লক্ষণ শাড়িতে সোনালি সুতোর জরির কাজ যোগ করে তৈরি করেন ‘স্বর্ণচরী শাড়ি' । এই শাড়ী দৈর্ঘ্যে ১৫ ফুট লম্বা ও ৪২ ইঞ্চি চওড়া। আঁচলের দৈর্ঘ্য ২৪ থেকে ৩২ ইঞ্চি। গবেষিকা চিত্রা দেব বালুচরীর অলংকরণকে চার ভাগে ভাগ করেছেন, যথা চিত্র, কল্কা, পাড় ও বুটি। তার মতে চিত্র অংশের নকশা অন্যান্য শাড়ীতে দেখা যায় না।
ভাষা
আমাদের এই প্রিয় জেলা অনেকের কাছে অদ্ভুত মনে হয়।এই অঞ্চলের ভাষা বিশেষ করে উচ্চারণ অনেকের কাছেই হাস্যকর। এইখানে প্রচলিত ভাষার মধ্যে হেরফের আছে।
◆ দক্ষিণ বাঁকুড়ার লোকেদের কথ্য ভাষা সদরের মানুষের থেকে একটু আলাদা।
কিছু উদাহরণ :
ইদিকে ভেলে আছিস যে? ( এইদিকে তাকিয়ে আছিস যে? )
শুন দাঁতগুলা ক্যালাস না। ( শোন দাঁতগুলো বের করিস না। )
বলছি ন উটাই বটেক। ( বলছি না ঐটাই বটে। )
ভাত খাইয়েলে। ( ভাত খেয়ে নে। )
ইটা করবি লাই। ( এটা করবি নাই )
◆ সদরের দিকে আবার বিভিন্ন জায়গার মানুষ থাকেন। সাধারণত প্রমিত কথ্য ভাষাই ব্যবহার করা হয়। তবে, তারমধ্যেও কিছু সাধারণ ভাষা আছে, যেগুলি শুনলেই অঞ্চলের সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
যেমন -
বটে, আমি বলেছিলাম।
শুদা রে। ( জিজ্ঞাস কর রে। )
কি বলচু? ( কি বলছিস )
হ, যাব লে ভাই, ফালতু চিন্তা করচু কী করতে কে জানে! ( হ্যাঁ, যাব রে ভাই, ফালতু চিন্তা করছিস কী করতে কে জানে !)
কেনে যাবি? ( কেন যাবি ?)
কেউ কেউ 'উয়ার' ( ওর ), 'ইয়ার' ( এর ) ব্যবহার করেন।
◆ আবার বিষ্ণুপুরে দিকের মানুষের ভাষা সাধারণত প্রমিত কথ্য ভাষা।
◆ দুর্গাপুর ঘেঁষা অঞ্চলের মানুষের ভাষাও প্রমিত। তবে ঐদিকের অনেকেই ' তোর ' কে ' তুর ' বলেন।
◆ আবার বাঁকুড়ার যেসব অঞ্চল পুরুলিয়া ঘেঁষা, তাদের ভাষার মধ্যে পুরুলিয়ার প্রচলিত উপভাষার টান থাকে।
◆ এইসব অঞ্চলে আদিবাসী মানুষ আছেন। যেমন - সাঁওতাল, মুন্ডা। এদের মধ্যে সাঁওতাল বেশি দেখা যায়। মুন্ডা তার তুলনায় কম। ওদের নিজেদের কথ্য ভাষা আছে। ওদের মধ্যে যারা পড়াশোনা করেন তারা ভালো বাংলা বলতে পারেন। যাঁরা রাজমিস্ত্রী প্রভৃতির কাজ করেন, তারা ভেঙে ভেঙে কাজ চলে যাওয়ার মতো বাংলা বলেন।
আমি নিজেই ভালো বাঁকুড়ার প্রকৃত কথ্য ভাষায় কথা বলতে পারি না। কারণ, ছোটতে আসানসোলে থাকতাম। এখন থাকলেও বন্ধুদের সাথে প্রমিত চলিত ভাষাতেই কথা হয়। তবে ' হ ', ' চু', ' লিবেক ' ( নেবে ), ' দিবেক ' ( দেবে ), ' করব নাই ' ( করব না ) ব্যবহার করি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
ইন্টারনেট
প্রচলিত লোককথা
শ্রীমতী চায়না লাই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন