ছবি - সান্ত্বনা ব্যানার্জী

 


দুপুরের খাওয়ার পাট মিটিয়ে, সব গোছগাছ করে বাড়তি তরিতরকারী ফ্রীজে ভরে হাতমুখ ধুয়ে আরাম করে সোফায় বসে সুনন্দা, মোবাইল হাতে নিয়ে। নতুন প্রজন্মের মতোই এই অবসরের সঙ্গী হয়ে গেছে এই স্মার্ট ফোন। একবার হোয়াটস অ্যাপ, একবার ফেসবুক। হোয়াটসঅ্যাপে কিছু কিছু পোস্ট, লেখালিখি করলেও ফেসবুক শুধু দেখে। কিছু পোস্ট করলেই পুরনো সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব, ছাত্রছাত্রীরা এত কমেন্ট করে যে ভালো লাগলেও সেগুলো পড়তে আর উত্তর দিতে অনেকটা সময় খরচ হয়ে যায়। আজও তেমনই ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে চোখে পড়ে গেলো একটি সাদাকালো যুগের কনের সাজে সজ্জিত ছবি। কোনো এক পুত্র তার মায়ের সেই সাদামাটা ঘরোয়া সাজের অপূর্ব সুন্দর সিগ্ধ কচি মুখের ছবিটি পোস্ট করেছে বড়ো ভালোবাসা মাখিয়ে।

ছবিতে একেবারে আটকে যায় চোখ। তারপরই দু'চোখ ছাপিয়ে জল চোখের কোলে টলটল করে ওঠে। হাতে ভাজা মৌরী দিতে এসে লক্ষ্য করে বৌমা রূপসা, "কি হয়েছে মা! কাদঁছো কেন?"

তাড়াতাড়ি লুকোনোর চেষ্টা করে সুনন্দা, "কই কাঁদিনি তো।"

"বললে হবে! চোখে জল একেবারে টলটল করছে!" বলতে বলতেই মোবাইলের ওপর চোখ পড়ে যায় রূপসার আর দেখতে পায় সাদাকালো ছবিটি। "কার ছবি মা! চেনো নাকি?" কৌতূহলী হয়ে ওঠে ও।

"না না, কোনো এক ছেলে তার মায়ের বিয়ের ছবি পোস্ট করেছে। আমার বিয়ের অন্ততঃ একটা ছবিও যদি থাকতো..!"

জল এবার আর চোখে আটকে থাকে না, একেবারে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। এই ব্যাপারটা মোটামুটি সবার জানা। প্রথম প্রথম অনিন্দ্য সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতো, "ছবি দিয়ে কি হবে, ইউ আর অলওয়েজ ইন মাই মাইন্ড।" এখন আর কিছু বলে না। না শোনার ভান করে যথারীতি মোবাইলে মগ্ন থাকে।

রূপসা অনুযোগ করে, "তুমিই বা বাড়ীতে বাবাকে একটু বলোনি কেন মা ছবি তোলার ব্যবস্থা করতে?"

অভিমানের গলায় বলে সুনন্দা, "এ কি তোদের যুগ! ও সব বলার সাহসই ছিল না। তখন বিয়ে মানে দুই পরিবারেই রাশি রাশি আত্মীয়স্বজনের সমাগম। এক সপ্তাহ ধরে হালুইকরের রান্না, মিষ্টির ভিয়েন, খাওয়াদাওয়া চলতো। বিয়েটা যাদের তাদের যে কোনো শখ ইচ্ছে থাকতে পারে এ সব নিয়ে অভিভাবকদের কোনো খেয়ালই থাকতো না। আমি নাহয় মেয়ে, কিন্তু তোর বাবা তো চাকরী করা স্বাবলম্বী পাত্র, সে নিজেও তো এই ব্যবস্থা টা করতে পারতো!" একটু সামলে নিয়ে বলে, "শুধু নিজের জন্য নয়। আমি তো কালো রোগা অতি সাদামাটা একটি কনে, কিন্ত তোর বাবা! কি যে সুপুরুষ ছিলো! সারা গ্রামে একেবারে হৈ হৈ পড়ে গিয়েছিল। ওই কালো মেয়েটার এমন রাজপুত্রের মত বর! তারও তো বরবেশে কোনো ছবি নেই!"

এবার হেসে ফেলে রূপসা, "ঠিক আছে,ঠিক আছে। এবার তো তোমাদের চল্লিশতম বিবাহবার্ষিকী। আমি তোমাদের বর কনে সাজিয়ে নিজে হাতে ছবি তুলবো, বড়ো করে সেলিব্রেট করবো আমরা"।

একটু রাগতস্বরে বলে সুনন্দা, "বাজে বকিস না, ষাট বছরের বৃদ্ধা আর সাতষট্টি বছরের বুড়োকে সং সাজানোর কোনো দরকার নেই। ওসব একদম করবি না।"

গটগট করে বাথরুমে ঢুকে যায় ও। চোখে মুখে জল দিয়ে শান্ত হয় একটু। নিজের ঘরে গিয়ে চুল বেঁধে শাড়ী ছেড়ে নেয়। ততক্ষনে বৈকালিক চা করে ফেলেছে অনিন্দ্য। নির্বিকারভাবে ওর দিকে চা বিস্কুটের ট্রে-টা এগিয়ে দিয়ে সোফায় বসে চা খায় নিঃশব্দে। নিজের চা-টা খেয়ে পার্কে হাঁটতে যাওয়ার জন্য বেরোনোর সময় আড়চোখে দেখে নেয় অনিন্দ্যর ঠোঁটে চাপা হাসি।

পার্কের দিকে হাঁটতে শুরু করে সুনন্দা। ওখানে দু'পাক হেঁটে নিয়ে গল্প করে সবাই মিলে কিছুক্ষণ। হাঁটতে হাঁটতে নিজের মুখোমুখী হয় এখন। ছিঃ!ছিঃ! একি ছেলেমানুষী করে ফেলল ও! এই বয়সে এসে বিয়ের চল্লিশ বছর পার করে এই সামান্য ব্যাপারটা কেন ভুলতে পারছে না! সত্যিই তো! সেই সময়ের মেয়ে বলে সেও যেমন মনের কোনো ইচ্ছের কথা বলতে পারেনি, তেমনই অনিন্দ্যরও হয়তো লজ্জা বা সংকোচ ছিলো নিজের বিয়েতে নিজে ছবি তোলার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু বিয়ের পর থেকে সুনন্দা বুঝেছে এমন সহমর্মী সমব্যথী মানুষকে পাশে পাওয়া বড়ো ভাগ্যের কথা! এতবছর ওরা পথ চলেছে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসে, ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়, আস্থায়। তবুও এই দৈন্য কেন! এ কথা ঠিক, তথাকথিত প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ওর কম। কর্তব্যবোধ বেশী। স্নেহে যত্নে কর্তব্যে পিতৃসুলভ। খোঁপায় ফুল গুঁজে দিয়ে আদর না দেখালেও অসুখেবিসুখে ওষুধপথ্য দিতে রাত জাগতে কোনো ক্লান্তি ছিলো না। সুখে দুঃখে সারাক্ষণ আগলে এসেছে ওকে। রূপসার সামনে এই ছেলেমানুষীটা করে ফেলে খুব লজ্জা লাগছে এখন। তবুও এই প্রেমের বহিঃপ্রকাশের অভাব একটা সূক্ষ্ম কাঁটার মত বিঁধেই থাকে। একবার ছোটো বোনের কাছে বলতেই ও খুব উপহাস করে বলেছিল, "ভালো পেয়েছো তাই বুঝতে পারো না। কি ঘণ্টা হবে ওই একটু জড়িয়ে ধরে আদর করে! একটা কাজে সাহায্য করে আমায়, তোমাদের আদরের কুন্তল! কিচ্ছু পারে না। আবার জোর করে কোনো কাজ করাতে গেলে এমন করে করবে, আমার কাজ বাড়িয়ে দেবে। দরকার নেই অমন আদিখ্যেতায়!"

পার্কে আগেই এসে বসে আছে রীতি, ওর বড়ো মনের মত বন্ধু। দু'জনেই পরস্পরকে মনের কথা খুলে বলতে পারে স্বচ্ছন্দে। আজকের ব্যাপারটাও চেপে রাখতে পারে না, বলে ফেলে রীতির কাছে। সব শুনে ওকে আশ্বস্থ করে রীতি, "আরে এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে! কনের সাজে নিজেকে দেখতে পাওয়া, স্মৃতিস্বরূপ একটা ছবি থাকবে এই চাওয়ার মধ্যে অন্যায় কোথায়! তবে কি আর করা যাবে। যা হয়নি তাই নিয়ে আর কষ্ট পেও না। তার বদলে যা পেয়েছো, সেইগুলোকেই মনে রেখো। এই যে আমার অ্যালবাম ভর্তি বিয়ের ছবি, দেখিই না। দেখতে ইচ্ছেই করে না। ওই লোকটার সঙ্গে ছবিগুলো দেখলেই আমার রাগ হয়। গোটা জীবনটা যে যন্ত্রণা, অসম্মান, অপ্রেমে বিভীষিকাময় করে দিলো, সেখানে ওই ছবিগুলোর কোনো মূল্য আছে কি? পাগলী কোথাকার!"

এরপর দুই বন্ধুতে চলে নানা সুখ দুঃখের গল্প। তবুও বড়ো অবাক লাগে সুনন্দার। এই সামান্য একটা অপ্রাপ্তি কেন আজও এমন কাঁটার মত বিঁধে আছে! কত দম্পতিরই তো অ্যালবাম ভর্তি বিয়ের ছবি আছে, অথচ কয়েকবছর কাটতে না কাটতেই হয়ে গেছে বিচ্ছেদ। আবার কোথাও স্বামী, কোথাও স্ত্রী একে অপরের কাছে নতিস্বীকার করে, লাঞ্ছনা, প্রতারণা সয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে বছরের পর বছর। নাই বা থাকলো ছবি। ছবির মত সুন্দর এক দাম্পত্যজীবন উপহার দিয়েছেন তাকে স্বয়ং ঈশ্বর। বারবার ক্ষমা চায় সুনন্দা ঈশ্বরের কাছে। প্রতিজ্ঞা করে, কখনও এটা নিয়ে ও আর কষ্ট পাবে না, কখনও না।



ছবি আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন