বিপাশার বয়স যখন ছয় তখনই তার বাবা এক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল । তার আর কোন ভাইবোন ছিল না , মা সুজাতা দেবী বেশ কষ্ট করেই মেয়েকে মানুষ করেছিলেন । অপরদিকে ব্যক্তিত্বময়ী সুজাতা দেবী মেয়েকে নিজের মনের মত করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং সমস্ত বিষয়েই নিজের চিন্তাধারা মেয়ের উপরে চাপিয়ে দিতেন । সুজাতা দেবীর কড়া শাসনে বিপাশা বড় হয়ে উঠেছিল । মেয়ের গ্র্যাজুয়েশনের পরে তিনি মেয়ের বিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে উপযুক্ত পাত্রের খোঁজ শুরু করলেন ।
ঘটকের মাধ্যমে এবং আত্মীয় পরিজনদের সূত্রে সুজাতা দেবী
বেশ কয়েকটি পাত্রের সন্ধানও পেয়ে গেলেন
। কিছুদিন ধরে পাত্র ও পাত্রীর পরিবারের
মধ্যে যোগাযোগ আলাপ আলোচনা চলার পরে একজায়গায় বিয়ের সম্পর্ক চূড়ান্ত হয়ে গেল
। পাত্র অতনু স্কুলশিক্ষক , শৈশবেই পিতৃহীন হয়েছে , কোন ভাই বোন নেই । অতনুর মা
অনিমা দেবী ছোট একটি ব্যবসা চালিয়ে ছেলেকে মানুষ করেছেন । শিক্ষকতা পাওয়ার পরে অতনু অবশ্য মাকে সেই
ব্যবসা চালাতে দেয়নি । একটাই মাত্র অসুবিধা, অতনুর বাড়ি পাশের জেলায় । দু'টি
গাড়ি বদলে নদী পেরিয়ে যাতায়াত করতে হবে ।
যথাসময়ে বিয়ে হয়ে গেল । নববধূ বিপাশা বরবেশী অতনুর
সাথে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল । অনিমা দেবী
বিপাশাকে সাদরে বরণ করে ঘরে তুললেন । আচার
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে দূরের আত্মীয়স্বজন যে যার বাড়ি ফিরে গেলে অতনুদের
বাড়িটা একটু ফাঁকা হয়ে গেল । তারপরে
ধীরে ধীরে বিপাশা বুঝতে পারল অনিমা দেবী আর পাঁচটা শাশুড়ীর মত নন । তিনি বিপাশাকে
ছেলের বউ হিসাবে নয় , বরং নিজের মেয়ের মত করেই দেখেন । তার খাওয়াদাওয়া ও
অন্যান্য বিষয়ে বিশেষ খেয়াল রাখেন । নিজের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর ঘরে আসার পরে
নতুন পরিবেশে মেয়েরা সাধারণত একটু
আড়ষ্টতা বোধ করে থাকে । অনিমা দেবীর আচার ব্যবহার বিপাশাকে সেই অসুবিধা বোধ করতে
দিল না । বিপাশা অচিরেই শাশুড়ীর গুণমুগ্ধ
হয়ে পড়ল । কয়েকদিনের মধ্যেই স্বামী অতনুর তুলনায় তার মা অনিমা দেবীই বেশি আপন
হয়ে উঠল ।
প্রচলিত রীতি অনুসারে অষ্টমঙ্গলা উপলক্ষ্যে অতনুর সাথে বিপাশা তার মায়ের বাড়িতে গেল ।
কিন্তু সেখানে মায়ের কাছে বা প্রতিবেশী মহিলাদের সঙ্গে কথা বলার সময়
শ্বশুরবাড়ীর বিবরণ দিতে গিয়ে বিপাশা কেবলই তার শাশুড়ীর গুণাবলীর বর্ণনা দিতে
শুরু করল । তার কথায় - আমার শাশুড়ি খুবই ভালো , আমাকে তাঁর মেয়ের মত দেখেন । না
সাজলেও আমার শাশুড়িকে খুব সুন্দর দেখায় , তিনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন । রোজ বিকালে
আমার চুল বেঁধে দেন, আমার জন্য নিজের হাতে ভাত বেড়ে দেন , খাওয়ার সময়ে আমার
সামনে বসে থাকেন । আমার শাশুড়ি নিজেই বাড়ির সব কাজ করেন , আমাকে কোন কাজ করতে
দেন না । আমার শাশুড়ীর রান্না এককথায় চমৎকার আর তাঁর রান্না করা শুক্তোর তো কোন
জবাব নেই । আমার শ্বাশুড়ীর ঘরদোর খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন , জিনিসপত্রও সাজানো
গোছানো । ইত্যাদি ইত্যাদি ।
শাশুড়ীর প্রতি বিপাশার অত ভক্তি দেখে প্রতিবেশীরা কেউ
মুখ টিপে হাসে , কেউ বা টিপ্পনী দেয় - বিয়ের পরে সব শাশুড়ীকেই অমন ভালোমানুষ মনে হয় , আস্তে আস্তে আসল গুণ ফুটে
উঠবে । বিপাশা তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে - না
না , আমার শ্বাশুড়ি অমন নন , তিনি সত্যিই খুব ভাল । বিপাশার মা সুজাতা দেবী
একসময়ে বলে বসলেন - তোর শাশুড়ী কি তোকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসেন ? বিপাশা
গম্ভীরভাবে বলল - হ্যাঁ মা , তুমি তো মাঝেমাঝেই আমাকে বকাবকি করতে , আমাকে দিয়ে
বাড়ির কাজ করাতে । কিন্তু আমার শাশুড়ী আমাকে কখনো বলেননি , বাড়ির কোন কাজও করতে দেননি । তিনি সত্যিই
সত্যিই আমাকে নিজের মেয়ে বলে মনে করেন । এই কথায় সুলতা দেবী একটু রাগ করেই বলে
বসলেন - তোর শাশুড়ী এতই যদি তোকে ভালোবাসে তাহলে আমার এখানে আসার দরকার কি ? তুই
তো এখন নতুন একটা মা পেয়ে গেছিস । তুই বরং কালই তোর শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যা , আর
কোনদিন আমার কাছে আসবার দরকার নেই । বিপাশা একটু মৃদুস্বরে বলল - তুমি যদি চাও ,
সেটাই হবে । আমরা কালই ফিরে যাব , না ডাকলে আর কোনদিন তোমার কাছে আসব না । আমি
আমার নতুন মায়ের কাছে ভালই থাকব ।
ছবি আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন