মায়ের মত শাশুড়ি - অসিত কুমার পাল


 


বিপাশার বয়স যখন ছয় তখনই তার বাবা এক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল । তার আর কোন ভাইবোন ছিল না , মা সুজাতা দেবী বেশ কষ্ট করেই মেয়েকে মানুষ করেছিলেন । অপরদিকে ব্যক্তিত্বময়ী সুজাতা দেবী মেয়েকে নিজের মনের মত করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং সমস্ত বিষয়েই নিজের চিন্তাধারা মেয়ের উপরে চাপিয়ে দিতেন । সুজাতা দেবীর কড়া শাসনে বিপাশা বড় হয়ে উঠেছিল । মেয়ের গ্র্যাজুয়েশনের পরে  তিনি মেয়ের বিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে উপযুক্ত পাত্রের খোঁজ শুরু করলেন ।

ঘটকের মাধ্যমে এবং আত্মীয় পরিজনদের সূত্রে সুজাতা দেবী বেশ কয়েকটি পাত্রের  সন্ধানও পেয়ে গেলেন ।  কিছুদিন ধরে পাত্র ও পাত্রীর পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ আলাপ আলোচনা চলার পরে একজায়গায় বিয়ের সম্পর্ক চূড়ান্ত হয়ে গেল । পাত্র অতনু স্কুলশিক্ষক , শৈশবেই পিতৃহীন হয়েছে , কোন ভাই বোন নেই । অতনুর মা অনিমা দেবী ছোট একটি ব্যবসা চালিয়ে ছেলেকে মানুষ করেছেন ।  শিক্ষকতা পাওয়ার পরে অতনু অবশ্য মাকে সেই ব্যবসা চালাতে দেয়নি । একটাই মাত্র অসুবিধা, অতনুর বাড়ি পাশের জেলায় । দু'টি গাড়ি বদলে নদী পেরিয়ে যাতায়াত করতে হবে ।

যথাসময়ে বিয়ে হয়ে গেল । নববধূ বিপাশা বরবেশী অতনুর সাথে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল ।  অনিমা দেবী বিপাশাকে সাদরে বরণ করে ঘরে তুললেন ।  আচার অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে দূরের আত্মীয়স্বজন যে যার বাড়ি ফিরে গেলে অতনুদের বাড়িটা একটু ফাঁকা হয়ে গেল ।  তারপরে ধীরে ধীরে বিপাশা বুঝতে পারল অনিমা দেবী আর পাঁচটা শাশুড়ীর মত নন । তিনি বিপাশাকে ছেলের বউ হিসাবে নয় , বরং নিজের মেয়ের মত করেই দেখেন । তার খাওয়াদাওয়া ও অন্যান্য বিষয়ে বিশেষ খেয়াল রাখেন । নিজের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর ঘরে আসার পরে নতুন পরিবেশে মেয়েরা সাধারণত  একটু আড়ষ্টতা বোধ করে থাকে । অনিমা দেবীর আচার ব্যবহার বিপাশাকে সেই অসুবিধা বোধ করতে দিল না ।  বিপাশা অচিরেই শাশুড়ীর গুণমুগ্ধ হয়ে পড়ল । কয়েকদিনের মধ্যেই স্বামী অতনুর তুলনায় তার মা অনিমা দেবীই বেশি আপন হয়ে উঠল ।

প্রচলিত রীতি অনুসারে অষ্টমঙ্গলা উপলক্ষ্যে  অতনুর সাথে বিপাশা তার মায়ের বাড়িতে গেল । কিন্তু সেখানে মায়ের কাছে বা প্রতিবেশী মহিলাদের সঙ্গে কথা বলার সময় শ্বশুরবাড়ীর বিবরণ দিতে গিয়ে বিপাশা কেবলই তার শাশুড়ীর গুণাবলীর বর্ণনা দিতে শুরু করল । তার কথায় - আমার শাশুড়ি খুবই ভালো , আমাকে তাঁর মেয়ের মত দেখেন । না সাজলেও আমার শাশুড়িকে খুব সুন্দর দেখায় , তিনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন । রোজ বিকালে আমার চুল বেঁধে দেন, আমার জন্য নিজের হাতে ভাত বেড়ে দেন , খাওয়ার সময়ে আমার সামনে বসে থাকেন । আমার শাশুড়ি নিজেই বাড়ির সব কাজ করেন , আমাকে কোন কাজ করতে দেন না । আমার শাশুড়ীর রান্না এককথায় চমৎকার আর তাঁর রান্না করা শুক্তোর তো কোন জবাব নেই । আমার শ্বাশুড়ীর ঘরদোর খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন , জিনিসপত্রও সাজানো গোছানো । ইত্যাদি ইত্যাদি ।

শাশুড়ীর প্রতি বিপাশার অত ভক্তি দেখে প্রতিবেশীরা কেউ মুখ টিপে হাসে , কেউ বা টিপ্পনী দেয় - বিয়ের পরে সব শাশুড়ীকেই অমন  ভালোমানুষ মনে হয় , আস্তে আস্তে আসল গুণ ফুটে উঠবে । বিপাশা তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে -  না না , আমার শ্বাশুড়ি অমন নন , তিনি সত্যিই খুব ভাল । বিপাশার মা সুজাতা দেবী একসময়ে বলে বসলেন - তোর শাশুড়ী কি তোকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসেন ? বিপাশা গম্ভীরভাবে বলল - হ্যাঁ মা , তুমি তো মাঝেমাঝেই আমাকে বকাবকি করতে , আমাকে দিয়ে বাড়ির কাজ করাতে । কিন্তু আমার শাশুড়ী আমাকে কখনো বলেননি ,  বাড়ির কোন কাজও করতে দেননি । তিনি সত্যিই সত্যিই আমাকে নিজের মেয়ে বলে মনে করেন । এই কথায় সুলতা দেবী একটু রাগ করেই বলে বসলেন - তোর শাশুড়ী এতই যদি তোকে ভালোবাসে তাহলে আমার এখানে আসার দরকার কি ? তুই তো এখন নতুন একটা মা পেয়ে গেছিস । তুই বরং কালই তোর শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যা , আর কোনদিন আমার কাছে আসবার দরকার নেই । বিপাশা একটু মৃদুস্বরে বলল - তুমি যদি চাও , সেটাই হবে । আমরা কালই ফিরে যাব , না ডাকলে আর কোনদিন তোমার কাছে আসব না । আমি আমার নতুন মায়ের কাছে ভালই থাকব ।



ছবি আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন