গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত কোনো ঋতুতেই, কোনো দুর্যোগেই ননী দাদুর মিস নেই। প্রত্যেকদিন আমাদের বাড়ি ঠিক সন্ধ্যেবেলায় চলে আসে।আমাদের বাড়ির আশেপাশে আমার সমবয়সী আরো পাঁচ জন আছে। রাখাল, হিমু, জিতেন, অপু, তারক আর আমি বিশু। আমরা সবাই একই স্কুলে পড়ি। এই গ্রামের জুনিয়র হাই স্কুলে। জিতেন আর অপু ক্লাস সিক্স আর বাকিরা ক্লাস ফাইভ। গ্রামে আমাদের সবার বাড়ি পাশাপাশিই। আমার বাড়িটা সবার বাড়ির মাঝামাঝি বলে সবাই সন্ধ্যে হলেই আমার বাড়ির উঠোনে জড়ো হয়। বছরের শেষে ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে তো কথাই নেই ।সকালে খেলা আর বিকাল থেকেই ননী দাদুর গল্প শোনা।
দাদুরও বেশ অভ্যাস হয়ে গেছে। এসেই হাঁক পাড়ে,
"কিরে, কোথায় গেলি সবাই?" প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাবেলা নতুন নতুন গল্প।
আবার রাত ন'টা বাজলে জিতেন সঙ্গে করে দাদুকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। জিতেনের বাড়ি ননী
দাদুর বাড়ির কাছেই। খালধারের এপার আর ওপার। মাঝখানে একটা বাঁশের সাঁকো।
ননী দাদু মানে ননী ভট্টাচার্য্য। সবাই বলে পুরুতমশাই।
গ্রামে বিভিন্ন বাড়িতে পুজো আচ্চা করে দিন গুজরান করে। এখন একটু চোখেও কম দেখে।
পায়ে হেঁটে বহু পথ পাড়ি দেয়। বয়স প্রায় ৭৫। হাতে লাঠি উঠেছে। চোখে হাই
পাওয়ারে চশমা। একটু দুর্বল হয়ে গেছে।আসলে আজ থেকে প্রায় ১০-১২ বছর আগে ছেলেটার
দেহ এই খালের জলেই ভেসে উঠেছিল। সেই থেকে যেন একটু মনমরা, একটু আত্মভোলা। কিন্তু
ছোটো ছেলেপিলে খুব ভালোবাসে। আমাদের বাড়ি এলেই মা মুড়ি আর চা দেয়। আমরা বন্ধুরা
উঠোনে বা মাটির দাওয়ায় চাটাই পেতে, মেলায় কেনা ছোটো টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে,
মুড়ি খেতে খেতে গল্প শুনি।
সেবারও সময়টা ছিল ফাইনাল পরীক্ষার পর। শীত পড়তে শুরু
করেছে। তাড়াতাড়ি অন্ধকার নামছে। কিন্তু এই অন্ধকারেও দাদুর আসা আটকায়নি। মা
একবার বলেছিল, "এত কষ্ট করে আসার দরকার নেই ঠাকুরমশাই"। এই শুনে আমরা তো
খুব মনমরা হয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু দাদু কর্ণপাত করেনি। ঠিক পরেরদিন আবার চলে
এসেছিল।
হালকা চাঁদের আলোয় তখন চারদিক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
আমরা সবাই চাদর জড়িয়ে বসে আছি বাড়ির দাওয়ায়। বাইরে হিম পড়ছে। মা তাই উঠানে
বসতে বারণ করেছে। দূর থেকেই দেখা গেলো দাদু ডান হাতে হ্যারিকেন আর বাম হাতে লাঠি
নিয়ে হেলতে দুলতে আসছে। পরনে খাটো খদ্দরের ধুতি আর গায়ে জড়ানো চাদর।এসে মায়ের
রান্নাঘরের উনুনের কাছে গিয়ে হাত পা সেঁকে নিয়ে চাটাইতে এসে বসলো।আজ চা খাবে না
বললো। শরীর ভালো নেই। মা বকাবকি করতেই হেসে উঠলো। বললো, "বউমা আর কতদিন বা
বাঁচবো! সবক'টা গল্প শেষ করতে হবে না!" বলেই ফোকলা দাঁতে একগাল হাসি।
হিমু না পেরে বলেই দিল, "ও দাদু, গল্প শুরু করো। আর
কতক্ষন বকবক করবে?"
"দাঁড়া দাদুভাই, দাঁড়া। আজ যে গল্প বলবো, একেবারে
আমার জীবনের গল্প। খুব ভয়ের। শুনবি তো?"
আমরা হৈ হৈ করে বললাম, "শুনবো, আলবৎ শুনবো।"
আমি বললাম, "ইসস জিতেনটা আজ আসলো না। ও ভূতের গল্প
খুব ভালোবাসে। কিন্তু দাদু আজ তুমি একা ফিরবে কিকরে?"
"কিরে বিশু, আজ তোদের বাড়ি যদি থেকে যাই? কিরে,
থাকতে দিবি তো?" বলেই দাদু এবার হো হো করে হেসে উঠলো।
আমার তো বেশ মজা হচ্ছিল। রাতে দাদু থেকে গেলে আরো কত
গল্প শুনবো। বন্ধুরা কেউ শুনতে পারবে না।
দাদু গল্প শুরু করলো, "এই গত মাসে আমি এমন একদিন
তোদের বাড়ি সন্ধ্যেবেলা আসছি। অল্প অল্প হওয়া দিচ্ছে। বেশ আরাম লাগছে। তোদের
দিদা তখন তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালাচ্ছে। আমি দেখলাম তখনও খুব অন্ধকার হয়নি।
পরিষ্কার সব দেখা যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে খালধারে এসে পড়লাম। সেদিন হ্যারিকেন হাতে
ছিল না। বাঁশের সাঁকোটায় পা দিতেই কেমন যেন সাঁকো ভয়ংকর নড়ে উঠলো। ভয়ে আমার
ঘাম ছুটে গেলো। আর এক পা দিতেই হাত থেকে লাঠিটা পড়ে গেলো খালে আর আমি হুমড়ি
খেয়ে সাঁকো থেকে পড়তে যাবো, তখনই কে যেন আমার হাত চেপে ধরলো। আমি সামনে চেয়ে
কাউকেই দেখলাম না। কিন্তু বুঝতে পারছি কে যেন আমায় হাত টেনে ধরে সাঁকো পার করছে।
আমি সাঁকো পার হতেই দেখি আমার লাঠি আবার হাতে চলে আসলো। কিন্তু কেউ কোথাও নেই।
পিছনে ঘুরে খালের দিকে একবার তাকালাম। ওমা! দেখি একটা ছোটো ছেলে, তোদের মত বয়স।
অনেকটা আমার ছেলে বিধুর ছোটবেলার মত, আমার দিকে তাকিয়ে আছে, একগলা জলে দাড়িয়ে
হাতে ভাঙ্গা হ্যারিকেন নিয়ে। আমি বিধু বলে ডাকতেই ঝুপ করে লন্ঠনশুদ্ধু ছেলেটা জলে
ডুব দিয়ে কোথায় যে চলে গেলো আর দেখলাম না।অত ছোট ছেলে কি করে খালের জলে ডুবে ছিল
কেজানে! আমার তো ভয়ে হাত পা আটকে গিয়েছিল। পরে জিতেনের বাড়ি গিয়ে জিতেনকে
নিয়ে তবে তোদের বাড়ি এসেছিলাম।"
"তুমি ঠিক দেখেছিলে?" হিমু জিজ্ঞাসা করলো।
"হ্যাঁ হ্যাঁ, এত কম দেখি না। চারদিক তখনও
পরিষ্কার, আর পূর্ণিমার আলো ছিল।" দাদু বলে উঠলো।
"তুমি আমাদের সেইদিন বলোনি কেন?"
"আরে! সেইদিন বললে জিতেন ভয় পেয়ে যেত।ও বাড়ি
ফিরতে পারতো না।" দাদু এক নিঃশ্বাসে বলে দিলো।
"আর তুমি?" তারক, দাদুকে জিজ্ঞাসা করলো।
"আমার তো বাড়ি ফিরতেই হবে, তোদের দিদা আছে। ঐ ছোটো
বাচ্চা আর কি করবে! তবে কি জানিস, আমি দেখলাম যেন অবিকল আমার বিধুর মত। সেই খালি
গা। সেই চোখ।" বলতে বলতে দাদুর চোখ
জলে ভরে গেলো।
আমরা কিন্তু খুব ভয় পেয়ে গেলাম। কখন যে সব বন্ধুরা
পাশাপাশি গা ঘেঁষে বসে পড়েছি মনে নেই। ভয়ে আর কেউ কথা বলছে না। কিছু সময় সবাই
চুপচাপ। হঠাৎ আঁধার ফুঁড়ে জিতেন আমাদের উঠোনে চলে আসলো। মা জিজ্ঞাস করলো,
"কিরে জিতেন, এত হাঁপাচ্ছিস কেন?"
দাদু হ্যারিকেনটা তুলে ধরলো।
"ও দাদু, তুমি এখানে? আর দিদা যে জ্বরে কাতরাচ্ছে! চলো,
এক্ষুনি চলো।" জিতেন এক নিঃশ্বাসে বললো।
"কি বলিস! আমি তো ওষুধ দিয়েই এসেছি!" দাদু
চিৎকার করে বলে উঠলো।
"ঠাকুরমশাই, আপনি এক্ষুনি জিতেনের সাথে যান। কাল
খুড়িমা ভালো থাকলে আসবেন।" মা বললো।
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। জিতেন আমাদের দিকে তাকিয়ে
কিছু বলতে না বলতেই দেখি দাদু কখন হাওয়া হয়ে গেছে। মা চিৎকার করে আমাদের বকা দিয়ে বলল, "এক্ষুনি তোরা
সবাই লন্ঠন নিয়ে যা। দাদুর সাথে যা। এখনও কেন হাঁ করে দাড়িয়ে আছিস?"
বলা মাত্রই আমরা ছুট লাগলাম খালের রাস্তার দিকে। এদিকে
ওদিক খোঁজার পরও দাদুকে দেখতে পেলাম না। সবার মনে একই প্রশ্ন, অন্ধকারে এতো
তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেলো কিকরে! এত জোরে তো দাদু হাঁটতে পারবে না। পথও খুব কম না।
কিন্তু সারা পথ জুড়ে দাদুর কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। কি জানি কোথাও আবার পড়ে গেলো
কিনা!
খালের সাঁকো পার হতে গিয়ে দাদুর গল্প মনে করে বেশ ভয়
করতে লাগলো আমাদের।জিতেন জানালো, দাদুর বাড়ির পাশেই জেলে বাড়ির বউটা জিতেনকে
প্রথম খবরটা জানায়। শুনেই এক মুহূর্ত দেরী না করেই এক দৌড়ে জিতেন আমার বাড়ি এসে
হাজির হয়েছিল।
আমরা সাঁকো পার হয়ে দাদুর বাড়ির সামনে এসে গেলাম। এসে
দেখি অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। সারা পাড়ার লোক এসে গেছে।আমরা ভীড় ঠেলে সামনে
গিয়ে পুরো অবাক। খুড়িমা অর্থাৎ আমাদের দিদা, একভাবে কেঁদে চলেছে, আর দাদুর দেহটা
বাইরে শোয়ানো। সাদা কাপড়ে ঢাকা। কে যেন পাশ থেকে বলে উঠলো, "পুরুতমশাই
এভাবে চলে যাবে ভাবিনি। এইতো বিকালবেলায় আমায় বলল খালের ওপারে আজও যাবে
মিত্রদের বাড়িতে গল্প করতে।"
আমরা বন্ধুরা সবাই হতবাক, নিরুত্তর। এর ওর মুখ
চাওয়াচাওয়ি করছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা।
মিত্র অর্থাৎ আমার বাবা বিপুল মিত্র। দাদু যে এতক্ষণ ধরে আমাদের বাড়িতে বসে গল্প
শোনালো! তাহলে কি ওটা
দাদুর আত্মা?? তাই কি দাদু তার শেষ গল্পটা বলবে বলে আমাদের বাড়ি ছুটে এসেছিল??
আমরা সবাই ধপ করে মাটিতে বসে পড়লাম। সবার বুক ফেটে কান্নাগুলো বেরোতে চেষ্টা করছে। শুধু মনে
হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি, আর ভাবছি আগামীকাল থেকে কে আমাদের গল্প শোনাবে! জিতেন হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো। ওর কান্নার আওয়াজ শুনে
আমার চোখের জল আর বাঁধ মানলো না। গল্পদাদুর আসর অকালেই ভেঙে গেলো।
ছবি আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন